আমার স্মৃতিতে সুলতান

সে ১৯৫৪–এর কথা। আমি দৌলতপুর বি. এল. কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক, নাজিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সুফিয়ানের পর তখন প্রিন্সিপাল হয়ে এসেছেন ইংরেজীতে ফার্স্ট ও গোল্ড মেডেল পাওয়া ফজলুর রহমান সাহেব, যাঁর অনেক কিছুতে উৎসাহ—খেলাধুলায়, শিল্পে, সাহিত্যেও সঙ্গীতে। আমি শরীর চর্চায় ও খেলাধুলায় উৎসাহী ছিলাম বলে আমার প্রতি তাঁর ছিল পরম স্নেহদৃষ্টি। এই সময় এস. এম. সুলতানের সঙ্গে আমার দেখা।দৌলতপুর ফুটবল মাঠের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের একটি কদম গাছে একজন ত্রিশ বা ত্রিশোর্ধ বয়সের একহারা গড়নের এক ধুতি-গেঞ্জি পরা লোককে দেখলাম। মেয়েদের মত তাঁর চুলের মাঝখানে সিথি—সে চুল আধা কোঁকড়া এবং কাঁধ-ছোঁওয়া এবং অজস্র, ঘন এবং কালো। তেমনি সমস্ত মুখ গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা। ঈষৎ লম্বা শ্যামবর্ণের মানুষ। এবং হাতে তাঁর বাঁশের বাঁশি। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হলো পাবনার হেমায়েতপুর থেকে ছাড়া পাওয়া এক পাগল।পাগল সাধারণ মানুষের মনে যেমন ভয় ধরায় তেমনি কৌতূহলও সৃষ্টি করে। তরুণ মনে সে কৌতূহল আরও বেশী করে জাগে। আমরা কয়েকজন ছাত্র সেই কৌতূহলবশে একে একে সেই গাছের দিকে ভিড়তে লাগলাম।তখন ক্লাস শুরু হয়নি। হয়ত সকাল ৯টা-১০টা হবে এমনি সময়। পাগল বাঁশি বাজাতে শুরু করল। খুব মাদকতাপূর্ণ অপূর্ব বাজনা নয়; কিন্তু এটা বোঝা গেলো এ বিদ্যায় পাগল পারদর্শী।কাশের ঘণ্টা বাজল। আমরা সব ক্লাসে ঢুকলাম। একটা নোটিশ এলো প্রিন্সিপালের কাছ থেকে। বিলেত ফেরতা এক বাঙালী শিল্পী আজ দুপুর ১২টায় কলেজ হলে বক্তৃতা দেবেন তোমরা উপস্থিত থাকবে। সময়মত উপস্থিত হলাম। এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, সেই ধুতি গেঞ্জি পরা বংশীবাদক সেদিনের সেই বিলেত ফেরত শিল্পী এবং বক্তা। পিছনে তাঁর বিরাট এক ব্ল্যাক বোর্ড আর হাতে সাদা চকখড়ি।পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল ফজলুর রহমান। বললেন, উনি একজন বিখ্যাত শিল্পী। সম্প্রতি আমেরিকা, লণ্ডন ও প্যারিস ঘুরে এসেছেন। তিনি আধুনিক শিল্পের ওপর বক্তৃতা দিয়ে শিল্প কি, চিত্রশিল্প কি—এ সব তোমাদের বুঝিয়ে দেবেন। এর নাম এস.এম. সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান।সুলতান বক্তৃতা শুরু করলেন ইংরেজীতে। ফ্লুয়েন্ট। মনে হল ইংরেজী তাঁর মাতৃভাষা। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে ব্ল্যাক বোর্ডে ছবি আঁকছিলেন। কখনো মানুষের,কখনো প্রাণীর, কখনও প্রকৃতির। তাঁর সেই স্কেচ আঁকা দেখে অভিভূত হলাম। ছবি বোঝার জন্যে নয়, অতি দ্রুত, অতি স্বচ্ছন্দ গতিতে, অতি সাবলীল ভঙ্গিতে তাঁর সেই ছবি আঁকা আমাকে মুগ্ধ করল।আর সুলতানের সে বক্তৃতা শুধু ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না, তা সম্প্রসারিত হল।দর্শনে। জগৎ ও জীবনের দর্শন নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। কৌতূহলী ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন—শূন্যে ফিরত যেতে হবে-শূন্যে ফিরে যেতে হবে। শূন্য থেকে সব কিছুর উদ্ভব। সেই শূন্যতে আমাদেরফিরে যেতে হবে।লোকটি যে সাধারণ পাগল নয় — অসাধারণ পাগল, বুঝলাম। দৌলতপুর কলেজ হোস্টেলের এক কামরায় উঠেছিলেন তিনি। ছুটির পরে আমরা সেই কামরায় গিয়ে উপস্থিত হলাম এক অদ্ভুত মানুষ সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে।একটা স্যুটকেস থেকে এক কপি মেঘনাদবধ কাব্য বের করে সেখান থেকে আবৃত্তি শুরু করলেন। আমার বন্ধুরা হঠাৎ আমাকে দেখিয়ে বলল, এর নাম শাহাবুদ্দীন। ও চমৎকার আবৃত্তি করে।তাই না-কি! আপনি চমৎকার আবৃত্তি করেন। তাহলে আপনিই পড়ুন। আমি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মধুসূদনকে বেশী পছন্দ করি। অসাধারণ কবি।এই আবৃত্তির মাধ্যমে সুলতানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল। কিন্তু তখনও সুলতানের সঙ্গে পূর্ণ পরিচয় হয়নি। সুলতানের স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে এলো কয়েকটি ইংরেজী পত্রিকা। নিউইয়র্ক টাইমস, হেরাল্ড ট্রিবিউন, ডেলী টেলিগ্রাফ প্রভৃতি। সেখানে শেরোয়ানী পরা চুল-দাড়ি ও বাবরি চুলের সুলতানের ছাপানো ছবির সঙ্গে সুলতানের আঁকা পেন্টিং-এর ওপর রিপোর্ট দেখলাম। বুঝলাম সুলতান পাগল নয়—প্রতিভা।জানতে পারলাম, সুলতান মাইকেল মধুসূধনের মত যশোহরের লোক। প্রকৃতিগত দিক থেকে উভয়ের মধ্যে এই মিল ছিল, উভয়েই শৃঙ্খলার প্রতি উদাসীন,বেপরোয়া। তবে মধুসূদন খেতেন মদ আর সুলতান খান গাঁজা।সুলতান আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, গাঁজা টানছিলেন, আর ছোট্ট একটা এক্সারসাইজ খাতায় পেন্সিল দিয়ে খেয়াল-খুশী মত ছবি আঁকছিলেন অবলীলাক্রমে,অতি দ্রুতগতিতে; নানা ধরনের স্কেচ। মানুষ ও প্রাণীর। আমি তখন ব্যায়াম করতাম। শরীরের প্রতিটি পেশী সম্বন্ধে আমার কিছু জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিল।দেখলাম বড়ির এ্যানাটমি সম্বন্ধে সুলতানের জ্ঞান যেন চিকিৎসকের চেয়ে কম নয়।শরীরের এমন কোনো পেশী নেই যা সুলতানের জানা নেই। শুধু উপরবাহু বা ফোরআর্ম নয় ; হাতের কব্জির আশপাশের ক্ষুদ্র পেশী এবং হাতের তালুর পেশী পর্যন্ত তার নখদর্পণে। শুধু এই নয়, পেশীবহুল শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো তার পেন্সিল ও তুলির টানে জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগলো।হঠাৎ ছবি আঁকা ফেলে বললেন, আপনাদের এখানে হারমোনিয়াম-তবলা আছে নাকি? হারমোনিয়াম-তবলা আসতে দেরী হল না। এবার শুরু হল গান এবং ছাত্র-তবলচীর কাছ থেকে তবলা কেড়ে নিয়ে শুরু করলেন তবলা বাজানো।তারপর আরো অবাক কাণ্ড। তিনি নৃত্যের উপর বক্তৃতা শুরু করলেন এবং আরো অবাক কাণ্ড ছাত্র তবলচীকে তবলা বাজাতে ইঙ্গিত করে তিনি লীলায়িত ভঙ্গিতে ধ্রুপদ-নৃত্য শুরু করলেন। আমরা বুঝলাম সুলতান বহু গুণে গুণান্বিত শিল্পী। তিনি দেখালেন, একজন শিল্পী যে শিল্পের চর্চা করেন শুধু সেই নির্দিষ্ট শিল্প সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান সীমাবদ্ধ থাকলে তিনি আংশিক শিল্পী হবেন—পূর্ণ শিল্পী হবেন না। সুতরাং পূর্ণশিল্পী হওয়ার জন্য বিষয়-বৈচিত্রের জ্ঞান অপরিহার্য। এ যুগে আমার সঙ্গে আর একজন চিত্রশিল্পীর সাক্ষাৎ ঘটেনি যার এক সঙ্গে এত ভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞান দেখতে পেয়েছি।হঠাৎ সুলতান হারিয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন, এই পাগল প্রতিভা? শুনলাম,মহেশ্বরপাশা পানবাড়ির এক গাঁজাখোর সন্ন্যাসীর সাথে তাঁকে দেখা গেছে। সে সন্ন্যাসীর সঙ্গে সুলতানকেও দেখা গেছে প্রভাতের লাল উদীয়মান সূর্যের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। তারপর শুনলাম সে মন্দিরেও সুলতান নেই। ফিরে গেছেন তিনি যশোরে। তাঁর বাড়ীতে। সুলতান আমাদের মনে নিদারুণ চমক আর কৌতূহল সৃষ্টি করে হারিয়ে গেলেন। আমাদের মনে সুলতানের ক্ষণিক সাক্ষাতের এক স্থির বিদ্যুৎ আঁকা রইলো।সেদিন আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঢাকার আর্ট কলেজে আপনি তো অনায়াসে।শিক্ষক হতে পারতেন, কেন হলেন না। গোঁফ-দাড়ির মাঝ থেকে তাঁর ছোট ছোট পরিপাটি দাঁতের হাসি বেরিয়ে এলো। বললেন, ওদের সঙ্গে আমার বনে না।সুলতানকে অকস্মাৎ নিদারুণ অহংকারী মনে হয়েছিল। তাঁর নিচু শান্তকণ্ঠের মধ্যে এক জেদী, বিদ্রোহী, ব্যতিক্রমধর্মী নিঃসঙ্গ মানুষকে দেখলাম। যাঁর সঙ্গে অন্য শিল্পীদের বনে না। তাঁর কথা শুনেই মনে হয়েছিলো, অন্যের নীচে থেকে, নীচাসন থেকে কাজ করার লোক তিনি নন। তিনি কোথাও কাজ করলে সর্বোচ্চ আসনে বসে কাজ করবেন—অথবা থাকবেন একা-নিঃসঙ্গ। নিজের চিন্তার একাডেমীকে নিজে গড়ে তুলবেন। সুলতানের জন্য বিশেষ দুঃখবোধ নিয়ে সরে আসলাম। সুলতান কয়েক বছরের জন্যে স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলেন।১৯৫৮–৫৯–এর দিকে কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ীতে সুলতানের সঙ্গে আবার দেখা হলো। এবার যে সুলতানকে দেখলাম, তিনি অন্য সুলতান। প্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়ল, সেটা হলো সুলতানের পোশাক। মাথায় সেই আগের চুল আছে কিন্তু দাড়ি গোঁফ সম্পূর্ণ চাঁছা। পোশাক বদল। গেরুয়া রঙের ঢিলা লুঙ্গি পরা। হাতে একতারা বা দো-তারার বদলে একটা বিশাল তানপুরা। কোথায় ছিলেন এতদিন ? পশ্চিম পাকিস্তানে।তিনি শান্ত—ধীর নীচুকণ্ঠে কথা বলতেন, বুঝা গেল তিনি পাকিস্তানে তাঁর বেশকিছু বন্ধুর বাসায় কাটিয়ে এসেছেন। সেখানে ইচ্ছামত ছবি এঁকেছেন।জসীম উদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তাঁর কোথায় পরিচয় হয়েছিল জানি না।হয়তবা পশ্চিম পাকিস্তানে হয়তবা যশোরে; অথবা ঢাকায় তাঁর কোনো বন্ধুর বাসায।এক আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যশোরে আমার সঙ্গে জসীম উদ্দীনের দেখা হয় জমিদার মনুজকান্ত মজুমদারের বাসায়। ঐ মনুজকান্ত মজুমদারের ঘরের দেয়ালে আটকানো মধুসূদন দত্তের একটা ওয়াটার কালারের প্রোট্রেট ছিল। শুনেছিলাম সেটা সুলতানের আঁকা। সৌজন্য ও ব্যবহারে নম্র ও অমায়িক সুলতান স্নেহ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ডাককে ঠেলে ফেলতে পারতেন না। অনেকে তাঁর মত গুণীর সংস্পর্শে থাকা পছন্দ করতেন। বাড়ীতে দাওয়াত দিতেন এবং প্রয়োজন বোধে ভালো ভালো ছবিও আঁকিয়ে নিতেন। দাতা ও অমিতব্যয়ী সুলতান মাঝে মাঝে কপর্দকহীন হয়ে পড়তেন। চতুর বন্ধুরা সেই সুযোগে সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাঁকে গৃহে রেখে তাঁকে দিয়ে দামী ছবি আঁকিয়ে নিতেন দেয়ালের বা গৃহের সৌন্দর্য বাড়াতে বা আভিজাত্যকে তুলে ধরতে। সম্ভবত এই ধরনের কোনো বন্ধুর বাসা থেকে জসীমউদ্দীন, পল্লী প্রকৃতির ছবির কবি জসীম উদ্দীন, প্রকৃতি ও প্রকৃতির ছবির প্রেমিক জসীম উদ্দীন সুলতানকে খুঁজে পান।এর পরে সুলতানের সঙ্গে আমার বহু দিন দেখা হয়নি। তারপরে দেখা হলো ঢাকায় ১৯৭৬-এ। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়েছিলেন ভাস্কর মতিউর রহমান। উনি কোহিনূর কেমিলক্যালসে চাকরি করতেন এবং মূর্তি গড়তেন। এস. এম. সুলতানের অসামান্য ভক্ত। আমি তখন নজরুল একাডেমী পত্রিকা সম্পাদনা করি আর থাকি ৬২১নং উত্তর শাজাহানপুরের একটি ছোট্ট উঠোনওয়ালা ছোট্ট সুন্দর বারান্দার একতলা ভাড়াটে বাসায়।মতিউর রহমান এ বাসাতে একদিন সুলতানকে নিয়ে হাজির হলেন।এস. এম.সুলতান তখন প্রৌঢ় পঞ্চাশোর্ধ বয়সের ভগ্ন-স্বাস্থ্যের সুলতান। পরনে সেই ধুতি পাঞ্জাবী নেই। সেই বাউলের পোশাক, গেরুয়া বসন নেই। প্যান্ট আর ফুলহাতা শার্ট পরা সুলতান। বলা বাহুল্য, স্কন্ধ নয় মধ্য পিঠেও নয় মাঝামাঝি ছড়ানো সেই চুল আছে—সেই নিবিড় ঘন আধা কোঁকড়ানো চুল। আর জসীমউদ্দীনের বাড়ীতে দেখা গোঁফ-দাড়ি—চাঁছা সুলতান। আমৃত্যু তিনি আর দাড়ি-গোঁফ কখনো রাখেননি।দৌলতপুর কলেজে তাঁকে যে রকম মুখর দেখেছিলাম জসীম উদ্দীনের বাড়ীতে তাঁকে আর তেমন দেখিনি। তখন তাঁকে অনেকখানি নীরব দেখেছিলাম। আজ দেখলাম আরও নীরব—প্রায় নিশ্চুপ। প্রয়োজনের কথা ছাড়া তিনি কথা বলেন না। হয়ে গেছেন আরও স্থির, বিনয়ী। বলা বাহুল্য, প্রকৃতিগতভাবে সুলতান ছিলেন মহাবিনয়ী যাকে বলে বিনয়ের অবতার।এইবার সুলতানের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন মিশবার সুযোগ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ঢাকার লেখক, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার যেমন পরিচয় ছিল।তেমনি শিল্পীদের মধ্যে কামরুল হাসান, কাইয়ূম চৌধুরী, রশীদ চৌধুরী, আব্দুররউফ, হাশেম খান, মোস্তফা আজিজ, মোস্তফা মনোয়ার প্রমুখের সঙ্গেও আমারনিবিড় সম্পর্ক না থাকলেও পরিচয় ছিল। কিন্তু সুলতানের প্রতি আমার একটা ভিন্ন আকর্ষণ ছিল। সে আকর্ষণের কারণ শুধু যে তাঁর ছবি আঁকা তা নয়—সম্ভবত তাঁর ভিতরকার রহস্যময়তা। মানুষের নগ্ন বিকশিত বিষয়ের বা বস্তুর প্রতি যত কৌতূহলথাকে তার চেয়ে বেশী আকর্ষণ থাকে অর্ধআবৃত বস্তু ও বিষয়ের প্রতি। বিশেষ সময় বা মুহূর্তে নিস্তব্ধতা বা অন্ধকারের প্রতিও মানুষের আকর্ষণ কম নয়। সে জন্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—ও আমার আঁধার ভালো আলোর কাছে থেকে থেকে।আমার প্রতিও সুলতানের হয়ত কোনো আকর্ষণ ছিল। সুলতানের চোখ মধুসূদন,রবীন্দ্রনাথ, বায়রণ, নজরুল বা ফররুখের মত বিশাল ছিল না; কিন্তু সুলতানের ছোট্ট চোখের কুপির মত কালো তারায় ছিল অন্তর্ভেদী দৃষ্টির ধার। সুলতান জানতেন আমি সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত ভালোবাসী। ঐ ভালোবাসার একাত্মতা তাঁকে আমার কাছে ডেকে এনেছিল।সুলতান মতিউর রহমানের সম্ভবতঃ খিলগাঁ চৌধুরীপাড়ার একটি ভাড়াটে বাসায় উঠেছিলেন। এরপরে ৪০০ টাকায় তাঁর জন্য পশ্চিম রামপুরায় ওয়াপদা রোডের পাশে একটি তিন কামরার একতলা বাসা ভাড়া নেয়া হয় ১৯৭৬-এ। শিল্পকলা একাডেমীতে সলুতানের একক চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়। তার সবগুলো ছবি সুলতান। এই বাসাতে বসেই এঁকেছিলেন। বোধ হয় মাস চারেকের জন্য এই বাসা ভাড়া এবং ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে ছোট বড় প্রায় ২০০ তেল ও জলরং ছবি এঁকেছিলেন সুলতান।মতিউর রহমান সাহেব তাঁর এই ছবি আঁকার সব সাজ-সরঞ্জাম যোগাতেন। শুনেছি ঐসব ক্যানভাস, তুলি, রং এবং বাড়ী ভাড়ার টাকা সে সময়ের ইরান এমব্যাসির একজন শিল্পরসিক কূটনীতিক যোগাতেন। ১৯৪৭ সনে দেশ-বিভাগের পর সুলতান পশ্চিম পাকিস্তানে যান এবং এক পারসী স্কুলে শিল্পের শিক্ষকতা করতে যান।সেসময় থেকে হয়ত পারসী বা ইরানীদের সঙ্গে তাঁর নিগূঢ় যোগাযোগ হয়ে থাকবে।আমি বলেছি ঢাকার আর্টিস্ট সমাজ থেকে নিজেকে তিনি দূরে রাখতেন। তাঁর ভবঘুরে, বোহেমিয়ান, নেশা-আসক্ত চরিত্র এজন্য দায়ী ছিল কি-না জানি না। তবে তাঁদের শিল্প-চিন্তার মধ্যে আদর্শগত ব্যবধান ছিল। তবু একদিন মতিউর রহমানের বাসায় আমি কয়েকজন শিল্পীকে এক কাবাব ভোজের অনুষ্ঠানে সমবেত হতে দেখেছিলাম। কাঠের কয়লা জ্বেলে ঐ বাসার উঠোনে মতিউর রহমান নিজের হাতে কাবাব সিদ্ধ করেছিলেন। দাওয়াতপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে রশীদ চৌধুরী ও সম্ভবত মোস্তফা মনোয়ার ছিলেন। আর কে ছিলেন মনে করতে পারছি না। মতিউর রহমান তাঁর নিজের গড়া কাষ্ঠ নির্মিত অথবা সিমেন্ট-বালু-ইটের টুকরো মিশ্রিত উপাদান দিয়ে তৈরী করা ভাস্কর মূর্তির প্রদর্শনী দেখার জন্যই হয়ত সেই অনুষ্ঠানে রআয়োজন করেন। সেদিন তরুণ শিল্পীদের অবশ্য ‘সুলতান ভাই’ ‘সুলতান ভাই'সম্বোধন করতে দেখেছি। কিন্তু জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের শিষ্যদের কখনও সুলতানভক্ত হতে দেখিনি।আমার কেন যেন মনে হয়, সুলতানকে এইভাবে দলগতভাবে অস্পৃশ্য রাখার আর একটি কারণ ঢাকার শিল্পীদের বাম রাজনীতির প্রতি আনুগত্য। (সুলতান ভাবতেন যে কোনো আদর্শ, যে কোনো আধুনিক রাজনৈতিক আদর্শ হলেও শেষ পর্যন্ত তা শিকল—শেষ পর্যন্ত তা খাঁচা। শিল্পী কেন ঐ খাঁচায় বন্দী হবে ? আমি সুলতানের ছবি আঁকা পছন্দ করতাম....আর সুলতান পছন্দ করতেন আমার আবৃত্তি। আমি বলতাম, আমি আবৃত্তি করলে আপনার ছবি আঁকা খারাপ হয়ে যাবে। সুলতান বলতেন, আরো ভালো হবে।বলেছি সুলতানের গাঁজা খাওয়ার নেশা ছিল। টুকিটাকি কাজ আর ঐ গাঁজা-মাজার জন্য মতিউর রহমান সাহেব সুলতানকে একটি বালক-ভৃত্য জোগাড় করে দিয়েছিলেন।গাঁজার ছিল দুটো কল্কে। একটি ছোট এবং একটি বড়। ছোট কঙ্কেতে গাঁজা খেয়ে যখন তৃপ্তি পেতেন না তখন বড় কল্কেতে গাঁজা খেয়ে সুলতান কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকতেন তারপর বসতেন ছবি আঁকতে। তারপর সে কি ক্ষিপ্রশক্তিতে ছবি আঁকা।আমি দেখেছি পেন্সিল কাটার দিয়ে সুলতান একটি বড় পেন্সিলকে প্রথমে চোখালো করে নিতেন। ফুল স্কেপ সাইজের একটি কাগজে যে ছবিটি আঁকতেন তার একটি ছোট মাপের খসড়া করতেন। তারপর সাদা রঙ লাগানো বিশাল ক্যানভাসের ওপর কয়লা (চারকোল) দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছবি আঁকা শুরু করতেন। অসাধারণ অপূর্ব সেই সব স্কেচ। আমার কখনো কখনো মনে হতো রঙ চাপানোরা আগের সেই স্কেচগুলোকে যদি ক্যামেরায় ধরে রাখা যেতো তাহলে সুলতানের অসামান্য বলিষ্ঠ রেখার টানগুলো আর এক ভিন্ন চিত্রকলা হয়ে অমর হয়ে থাকত।আমি পূর্বে বলেছি, মানুষের শরীরের প্রতিটি পেশীর সঙ্গে সুলতানের নিবিড় ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। হিউম্যান বডির এ্যানাটমি তাঁর মুখস্থ তো ছিলই। প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনে, অঙ্গভঙ্গির বিবর্তনে পেশীতে যে বহু বিচিত্র বিপরীতধর্মী ভাঁজ পড়ে, বসা ও শোয়ার, দাঁড়ানো, দৌড়ানো ও হাঁটার, হাত ও হাঁটুর ভাঁজ করার সময়, ঘাড় সোজা করা বা বাঁকানোর সময়, পাশ ফেরা, উপুড় ও চিৎ হওয়া কিংবা কাৎ হওয়া ইত্যাদির সময় পেশীর বিচিত্র বঙ্কিম ভাঁজগুলো নিখুঁতভাবে সুলতানের পেন্সিল,কয়লা বা তুলির টানে জেগে উঠতো। এই শিক্ষায় সুলতান এতটাই পরিপক্ক ও শিক্ষিত ছিলেন যে, রঙ লাগানোর আগে তাঁর অঙ্কিত ছবির নানা ভঙ্গির পেশীর বাকের অপূর্বতা দেখে আমার গ্রীক শিল্পীদের আঁকা ছবির কথা মনে হতো অথবা তাদের ভাস্কর মূর্তির কথা। ছাত্রজীবনে যে সামান্য কিছুদিন তিনি কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়েন সেই সময়টুকু যে তিনি দারুণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় ব্যয় করেছেন তাতে সন্দেহ নেই। আমি আমার জানা বহু শিল্পীকে এই পেশী আঁকতে এবং তাদের বিচিত্র রঙিন রূপ আঁকতে ও তাদের নিখুঁত বিভাজন সৃষ্টি করতে স্থূলতার ওব্যর্থতার পরিচয় দিতে দেখেছি। সুলতানের সে অক্ষমতা ছিল না। সুলতান বলেছিলেন, 'সৎ মায়ের জ্বালায় অস্থির হয়ে আমি বাড়ী থেকে পালাই। কলকাতায় নড়াইলের জমিদার বাড়ীতে গিয়ে উঠি। বাবা এই জমিদারদের রাজমিস্ত্রী ছিলেন।জমিদারের ছোট ভাই আমার ছবি আঁকার নেশা দেখে—কেননা কয়লা পেলেই আমি তাদের বাড়ীর দেয়ালে ছবি এঁকে বসতাম— আমাকে বিলেত থেকে ইংরেজীতে লেখা দুটো বিশাল আকৃতির ছবির বই এনে দেন। সেখানে অনেক অনেক ছবি। নানা ধরনের স্কেচ। জমিদার বাবু বললেন, ছবি আঁকতে চাইলে এই প্রাথমিক বিদ্যাগুলো তোকে শিখতে হবে। আমি তখন বালক মাত্র। ওখানে দু’বছর কাটালাম। শিল্পরসিক জমিদারের ছোট ভাই এবার বললেন, লাল মিয়া যদি বড় শিল্পী হতে চাও তোমাকে আরও ভালো শিক্ষকের কাছে ছবি আঁকা শিখতে হবে। তার মানে তোমাকে আর্ট স্কুলে বা কলেজে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু তার আগে তোমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে এবং সে ইন্টারভিউতে তোমাকে পাস করতে হবে।আমি কলকাতা আর্ট স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে ফার্স্ট হলাম। কিন্তু আমি তো ম্যাট্রিক পাস করিনি। ভর্তি হবো কি করে। জমিদার বাবু বললেন, উপায় একটি। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীকে ধরতে হবে। তিনি ভর্তি কমিটির সদস্য। তিনি বলে দিলে আর সমস্যা থাকবে না।আমি ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সোহরাওয়ার্দীর বাড়ী পৌছার মুহূর্তে দেখলাম,তিনি তাঁর প্রাইভেট কারে বেরিয়ে আসছেন। আমি তাঁর বাড়ীর সামনে দাঁড়ালাম।তিনি ইশারায় ডাকলেন এবং কারণ জিজ্ঞাসা করতে আমি সব কথা বললাম। আমি মিথ্যা কথা বললাম যে, আমার কেউ নেই। সোহরাওয়ার্দী গাড়ী থেকে নেমে আমাকে বাড়ীর ভিতরে নিয়ে গেলেন এবং একটি ঘর দেখিয়ে বললেন ঐ ঘরের খাটে যে মহিলা বসে আছেন ওকে যেয়ে তুই মা বলে ডাকবি। ঐ মহিলা ছিলেন নিঃসন্তান।শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর কোনো চাচার স্ত্রী। বিশাল খাটের ধবধবে শয্যার ওপরে সোনার গহনা পরা এক সুন্দরী প্রায় পৌঢ়া মহিলাকে দেখলাম আমি। তাকে ‘মা’ সম্বোধন করলাম। তিনি আমার মুখে চোখে কি মায়া দেখলেন। খাট থেকে নেমে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি হয়ে গেলাম সোহরাওয়ার্দী পরিবারের সদস্য।আমার আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ায় বাধা থাকলো না। আর আর্টের অসাধারণ সমঝদার এবং সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বিরাট লাইব্রেরীর আমি তত্ত্বাবধায়ক হলাম।আমার আনন্দের সীমা রইল না।”এই পরিবারে থাকাতে সুলতানের কতকগুলা লাভ হয় বলে আমার বিশ্বাস।সোহরাওয়ার্দী পরিবারে যে ভাষা চালু ছিল তা বাংলার চেয়ে বেশী উর্দু আর ইংরেজী। মেধাবী সুলতান ঐ দুটো ভাষায় যে অনর্গল কথা বলতে পারতেন তার কারণ সেটি। আর্টের ওপর তাঁর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তৃতা দেয়ার কারণ ঐ পাঠাগার থেকে হৃদয় ভরে তিনি তাঁর জ্ঞান লাভের অমিত পিপাসা মেটাতে পেরেছিলেন।এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক, প্রকৃত প্রতিভার জন্য শিক্ষকের প্রাথমিক প্রয়োজন থাকলেও কোনো মহাশিক্ষার দরকার হয় না। প্রতিভা মাত্রই স্ব-শিক্ষিত। সুলতানের জন্য শিক্ষকের শিক্ষার প্রয়োজন ছিল না বলে আর্ট স্কুলের ডিগ্রী না নিয়েই সুলতান স্কুল ছেড়েছিলেন। কারণ, শিক্ষককে যিনি শেখাতে পারেন তাঁর জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না। প্রকৃতি ও প্রতিভা নিজেই তাঁর শিক্ষক। এটি শেক্সপীয়র,রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বেলায় যেমন সত্য সুলতানের বেলাতেও তাই।ছবি আঁকতে আঁকতে মাঝে মাঝে সুলতান ক্লান্ত হতেন। সে সময় তিনি গাঁজা খেতেন বা তাঁর চিরসঙ্গী বাঁশের বাঁশি বাজাতেন। মাঝে মাঝে বলতেন, শাহাবুদ্দীন ভাই, এবার কবিতা আবৃত্তি শুনবো। আজ বিদ্রোহী কবিতা। আমি পুরো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাকে আবৃত্তি করে শোনাতাম। বলতেন, ক্লাসিক ক্লাসিক।এমনি একদিন উপস্থিত কে একজন বললেন, আমি আর একজনের মুখে ‘বিদ্রোহী’র সুন্দর আবৃত্তি শুনেছি। বিনয়ী সুলতান হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন, ঐসব পেশাদার আবৃত্তিকারদের সঙ্গে শাহাবুদ্দীন ভাই-এর আবৃত্তির তুলনা করছেন? তাদের কণ্ঠে ঐ আবেগ, ঐ উচ্চারণ, আছে না-কি! ঐ ছন্দবোধ আছে ! শাহাবুদ্দীন ভাই কবিতা আবৃত্তি করেন না, ছবি আঁকেন। আপনাদের তা দেখার চোখ নেই।সত্যিই একদিন আমার রবীন্দ্রনাথের 'পৃথিবী' কবিতার আবৃত্তি শুনে তিনি চট্‌পট্ এক ছবি এঁকে বসলেন। পংক্তিগুলো ছিল এই—

বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎ চক্ষুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে এল কালো শ্যেন পাখীর মতো তোমার ঝড়-সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন কেশর ফোলা সিংহ :তাঁর লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে হতাশ বনস্পতি ধূলায় পড়ল উপুড় হয়ে; হাওয়ার মুখে ছুটল ভাঙা কুঁড়ের চাল শিকল ছেঁড়া কয়েদী ডাকাতের মতো।

দৈনিক পত্রিকার পুরো পৃষ্ঠার মাপের একটা সাদা গজে মোটা পেন্সিল দিয়ে ঝটপট তিনি একটা 'কেশর ফোলা সিংহের' ছবি আঁকলেন। পিছনে ঝড়ের আকাশের পটভূমি। অগ্নিচক্ষু শিকারোদ্যত সে সিংহ; উঁচু বল্লমের মত তার লেজ। দ্যেলক্রয়ের ঝড়-আতঙ্কিত ঘোড়া'র ছবির সঙ্গে তার মিল ছিল। এর পেন্টিং শেষ করেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। তবে তিনি তখন যে ছবি আঁকছিলেন তার সবগুলোই স্বাস্থ্যবান, শক্তিমান মানুষ ও মানুষীর। সে সময় তিনি আমার মুখ থেকে বহুবার‘ বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি শুনেছিলেন। তাঁর মনে সে সময় শক্তিমত্তার যে অনুপ্রেরণা এসেছিল 'বিদ্রোহী' কবিতার মধ্যে হয়তো তার আত্মিক মিল ছিল। উল্লেখযোগ্য,তিনি যেমন মধুসূদনের ভক্ত ছিলেন তেমনি ছিলেন নজরুল ও ইকবালের ভক্ত।ইকবালের ‘খুদী দর্শন' তাঁর মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাবণের শক্তিমত্তা,বিদ্রোহ, নজরুলের ‘বিদ্রোহী' আর ইকবালের 'খুদী দর্শন' তাঁর চিত্তে অপরিমেয় মানবশক্তির প্রেরণা জাগাতে সাহায্য করেছিল বলে আমার ধারণা। মানুষের মানসের অন্তর্মুলে এই ইচ্ছাশক্তির অবদান আছে বলে মানুষ পৃথিবীর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে আজও বেঁচে আছে; এবং ভবিষ্যতের সুখী সমাজও সে গড়ে তুলবে এই শক্তির বলে। তাই মানুষের দুর্বল জরাজীর্ণ কঙ্কালসার ছবি আঁকলেই হবে না; তার উত্তাল তরঙ্গায়িত পেশীর ফুঁসে ওঠার মধ্যদিয়ে মানুষের অভ্যন্তরীণ ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে দেখাতে হবে মানুষ অজেয়। সুলতানের ১৯৭৬-এ আঁকা ছবির পিছনে এই দর্শন কাজ করেছিল।আমি কিছুদিন আগে বলেছি নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতা বাংলা চতুর্দশ শতাব্দীর (ইংরেজী বিংশ শতাব্দীর) শ্রেষ্ঠ কবিতা। যেমন অনেকের মতো পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম বা পেন্টিং। ঐ ছবিতে ধ্বংসের ছবি এঁকে ফ্যাসিজমের পাশবিকতার বিরুদ্ধে পিকাসো মানবতার যে অসীম আর্তনাদকে ফুটিয়ে তুলেছেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে অলৌকিক ভাষা ও ছন্দে বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল ইসলাম তাই করেছেন, এই দিক দিয়ে বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব কাব্যে যার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। 'গুয়ের্নিকা'তে আমরা যন্ত্রণার যে নগ্ন মূর্তি দেখি,'বিদ্রোহী'তে সেই প্রত্যক্ষ যন্ত্রণার বদলে আছে শক্তির দুর্দান্ত অভিব্যক্তি; কিন্তু বিদ্রোহীর শেষ স্তবক দু'টিই বলে দেয় ‘বিদ্রোহী’ শক্তিই ঐ বিশ্ব মানবতার অসহনীয় যন্ত্রণারই অভিব্যক্তি। উল্লেখযোগ্য, জার্মান ভাববাদী দার্শনিক নীৎসে ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়ে মানুষ যত মানুষে পরিণত হতে পারে এই দর্শনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই দর্শন দিয়ে ধনবাদী বা সাম্রাজ্যবাদীদের উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন। অনেকের বিশ্বাস, অনেকের ধারণা, এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল হিটলার ও মুসলিনির চরিত্রে। শোষক চিরদিন শোষক থাকবে, দাস চিরদিন দাস।নীৎসের দর্শনে এই মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। পিকাসো নীৎসেকে পড়েছিলেন কিন্তু সে দর্শন একটি বিপরীত ভাব নিয়ে ‘গুয়ের্নিকা’য় রূপ লাভ করে। শোষিতের বিরুদ্ধে মানুষের আক্রোশের যে শক্তি তা ‘গুয়ের্নিকায়’ রূপায়িত হয়। ‘বিদ্রোহী’তেও আমরা সেই নিপীড়িতের শক্তির আত্মপ্রকাশ দেখি। ইকবালের ‘খুদী দর্শনে’ নীৎসের অতিমানুষ হওয়ার দার্শনিক চিন্তা প্রেরণার প্রভাব রাখতে পারে কিন্তু তিনিও দানব শক্তির বিরুদ্ধে শক্তিকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। সুলতানের ১৯৭৬–এর পেশী বহুল মানব-মানবীর চিত্রপটে সেই দর্শনের প্রতিফলন ঘটেছিল। সুলতান প্রত্যক্ষভাবে বা স্পষ্টভাবে বলতেন না কিন্তু জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো মানুষের মনে যে করুণার উদ্রেক করে সেই ছবি একটি তাৎক্ষণিক ছবি বলে তাঁর ধারণা ছিল।ক্ষুধিতের শীর্ণ শরীর চিত্রের মধ্যে জয়নুল আবেদিন একটি প্রশান্ত বিদ্রোহের সুরছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জয়নুলের কোন ছবিতে ‘গুয়ের্নিকার’ মতো protest against the brutality of fascism in paricular and modern war in general লক্ষ্য করা যায়নি।

সুলতান কি মানুষের এই যন্ত্রণার বাস্তবতার প্রত্যক্ষ দিকটাকে এড়িয়ে কোনো ভবিষ্যতের স্বপ্নে ঐ কল্পনামূর্তির বিরুদ্ধ চিত্র মানুষকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন?

পিকাসোর সঙ্গে সুলতানের একটি মিল ছিল। বয়সের সাথে সাথে অনেক শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্যে ভাটা পড়ে। কিন্তু পিকাসোর জীবনে তা ঘটেনি। ১৯৭৬–এ সুলতান পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার গঞ্জিকা শোষিত শীর্ণ শরীরের মধ্যে তাঁর যে মনটি ছিল তা বলিষ্ঠতায় তরুণ ষাঁড়ের চেয়ে কম ছিল না। তিনি ম্যাটাডররূপী পিকাসোর মতো ছিলেন না কিন্তু তার ঐ বয়সের আঁকা ছবির মধ্যে স্পেনের লড়াকু ষাঁড়ের শক্তি ফুটে উঠেছিল। বাইরের বিনয়ী ক্ষীণদেহী সুলতানের মধ্যে যে কি প্রবল স্বাধীনতা প্রিয় একজন বিদ্রোহী সুলতান বাস করতেন ফুঁসে ওঠা সাগর তরঙ্গের মত পেশীর উচ্ছ্বাসের রূপ এঁকে সুলতান আমাদের তা দেখিয়েছেন।যা হোক, ১৯৭৬-এর পর সুলতান আবার হারিয়ে গেলেন। কিন্তু ১৯৭৬-এর চিত্র প্রদর্শনীর পরে মনে হল সুলতান নব জন্মলাভ করেছেন। স্বদেশী মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের মানুষ যে পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী শিল্প-রসিক ও সংস্কৃতি-রসিক হয়ে উঠেছেন তা বোঝা গেলো। আমি তৃপ্তি পেলাম। তরুণ বয়সে যাকে আমি একজন শ্রেষ্ঠ শিল্পী ভেবেছিলাম— সুলতান শেষ পর্যন্ত তাঁর কর্মের মাধ্যমে আমার সেই ধারণাকে সত্যে পরিণত করেছেন।আমার সঙ্গে সুলতানের শেষ দেখা হয় শান্তিবাগে। আমি শান্তিবাগের প্রফেসর আবুল কাশেম সাহেবের (ভাষা আন্দোলনের কাশেম সাহেব নন) ১৯৫/৪-এ শাস্তিবাগের তিনতলা বাড়ীর দোতলা ফ্লাটের ভাড়াটে ছিলাম। সময়টা ১৯৮৪। আমাদের বাসার সামনে গলি-রাস্তার অপর পারে থাকতেন হরদত্ত গ্লাস ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার কিবরিয়া সাহেব। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না, একদিন বিকেলে আমার হাতে একটি চিরকুট এলো: আর্টিস্ট সুলতান আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমার বাসায় এসেছেন। অনুগ্রহ করে আসবেন কি? সুলতান নাম শুনে গায়ে হাওয়াই শার্ট চাপিয়ে লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এলাম। সুলতানের সঙ্গে দেখা হলো। অধিকাংশ গঞ্জিকাসেবীদের মতো বিশুষ্ক তোবড়ানো গাল, ক্লীন শেভে সুলতান। লম্বা কালো গাউন পরা। অতি শীর্ণ কিন্তু সেই পূর্বের মতো ঋজু মেরুদন্ড এবং ঋজু গ্রীবা। পূর্বের সেই অম্লান হাসি আছে কিন্তু সেই শুভ্র সুন্দর দাঁত নেই। কিন্তু ঠোটে মুখে ও চোখে দাঁত না ওঠা শিশুর হাসির মাধুর্য।ভাই কেমন আছেন? বলে দু'হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। দু'জনে কোলাকুলি করলাম। পরস্পর কুশল বিনিময় হল। দেখলাম সুলতানের চেহারার বদল হয়েছে কিন্তু স্বভাবের বদল হয়নি।সুলতান এ বাসায় কেন এলেন? সুলতান ঐ বাসায় প্রায় আসতেন। সম্ভবতঃ শিল্প রসিক এবং সঙ্গীত রসিক কিবরিয়া সাহেবের বন্ধুত্বের টানে এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে। কিবরিয়া সাহেবের সংগ্রহে ওস্তাদ ফৈয়াজ খা, করিম খাঁ, বড়ে গোলাম আলী, আমীর খা প্রমুখের লং প্লেয়িং রেকর্ড ছিল। ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা। আমীর আলী খা, রবিশঙ্করের সরঙ্গী সেতারের বাজনারও লং প্লেয়িং রেকর্ড। সুলতান ঢাকায় এলে তাই কিবরিয়া সাহেবের বাসায় আসতেন ঐ সব শুনতে। কিবরিয়া সাহেবের শিল্প ও সংগীত-এর তানের প্রশংসা করতেন।সুলতান কারও সমালোচনা করতে জানতেন না—কাউকে ছোট করতে চাইতেন না।সবাই বন্ধু সবাই আত্মীয়।

সুলতান ১৯৭৬–এ আমার শাহজাহানপুরের বাসায় কয়েকবার এসেছেন। আমার স্ত্রী নূরজাহানকে বোনের মতো স্নেহ করতেন। নূরজাহান সুলতানকে জিজ্ঞেস করেছিল,ভাই আপনি বিয়ে করেননি কেন? সুলতান হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, যে বয়সে মানুষ নারী প্রেমে পড়ে সে বয়সে শিল্পের প্রেমে পড়েছিলাম তাই। আজও তো সে প্রেমে ভাটা পড়েনি।

সুলতান লোকান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু যারা অমর হওয়ার জন্য জন্মান তাঁদের যথার্থ মৃত্যু কোনোদিন হয় না।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫



Share

Recent Comments

Recent Articles