এস এম সুলতান ও আদম সুরত - তারেক মাসুদের টেলিফোন ইন্টারভিউ ১৯৯২

  • বাঁইচা থাকতে মিডিয়া এই দেশে কেউরে পাত্তা দেয় না। এটা পুরানা কথা। আমার একটা বাতিক আছে কীর্তিমান মানুষদের মিডিয়া চিননের অনেক আগেই চিনা ফেলানোর। তাদের পোর্টেট করি ক্যামেরায় আর মন চাইলেইসাক্ষাৎকার নিয়া রাখি। এইসব মহা মূল্যবান মনে কইরা আমার ব্যক্তিগত আর্কাইভ PHOTOSEUM-এ ব্যাংকের মতো জমা করি। প্রিন্ট মিডিয়ার কৌশলীরা আমার এই দোষের কথা জানে। অনেক কীর্তিমান মানুষরে মিডিয়া জিগায় না। তাদের কোনো দাম নাই। কিন্তু তারা মরলে আমারে খোঁজে–কিছু আছে নাকি? এইভাবে চলতেছে আমাদের সোনার ডিজিটাল বাংলাদেশ।
      • tmamerica1.jpg
      • সলিমুল্লাহ খান, তারেক মাসুদ, নাসির আলী মামুন, আলম খোরশেদ। আমেরিকায়, রোড আইল্যান্ডে, ১৯৯২ সালে। ছবি. ক্যাথরিন মাসুদ
      • আমেরিকান ক্যাথরিন শেপির ঢাকায় তারেক মাসুদরে বিয়া করছেন খবর পাই। ১৯৮৯-এর শেষে এই বাংলা-আমেরিকান বউ-জামাই নিউ ইয়র্কে থাকতে আসে। প্রায় সোয়া এক বছর হইল আমিও নিউ ইয়র্ক প্রবাসী। কামকাইজ করি, ডলার পাই। কিন্তু সব মরুভূমি! কিছুই ভালো লাগে না। আমার নিশানা যে আরেক দিকে এইটা কেউ বোঝে না। দেশী ভাইরা কয়, আপনে বোধহয় জমিদারের পুত, কামকাজে মন নাই। মিয়া এই রাষ্ট্রটা বেহেশত। আমরা রাস্তায় বের হইলে কত কী দেখি, সব সুন্দর সুন্দর জিনিস! যা খাই-দাই গুলশান-বনানীর কোটিপতিরাও তা খাইতে পারে না। আমি ভাবি তাদের কথা, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমার ফোকাস অন্য দিগন্তে। ইতিমধ্যে অ্যালেন গিন্সবার্গের সাথে আমার যোগাযোগ হয়, তার ছবি তুলি।
      • এমন সময় এক রাইতে ফোন আসে–মামুন, আমি তারেক মাসুদ। বিয়া করছি, আমার বউ ক্যাথরিন–কথা বলেন! কথার মধ্যে বললেন আদম সুরতের প্রিমিয়ার শো হইতেছে ফিফথ অ্যাভেনিউ ‍নিউ ইয়র্ক স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর অডিটোরিয়ামে। সলিমুল্লাহ খান, আলম খোরশেদ এরা থাকবে, আপনে আসবেন। আমি সুলতানের শরীরের ঘ্রাণ পাইলাম মনে হইল। নির্ধারিত রজনীতে আদম সুরত দেখা হইল, একজন আরেকজনরে জড়াইয়া ধরলাম। অনেক কথা। তারপরে বন্ধুদের সাথে গল্প হয় ফোনে। ওই সময় এস এম সুলতান নিয়া তারেক মাসুদের সঙ্গে এটি অ্যান্ড টি ফোনে আমার বাসা থেইকা সংলাপ করি প্রায় এক ঘণ্টা এবং তা স্পিকার খুইলা ক্যাসেট রেকর্ডারে টেপ করি।
          • ১৯৯২-এর ১৪ ও ১৭ জুন এই দুই দিনের সংলাপটা ঊনিশ বছর পরে কী মনে হয়?

          • নাসির আলী মামুন

              • 5.jpg

                    • ………
                    • বিটল্ ও সোনা’র সাথে এস এম সুলতান, মাছিমদিয়া, নড়াইল ১৯৭৯ ছবি: নাসির আলী মামুন/Photoseum
                    • ………
              • মামুন: …টারে আপনি, মানে কীভাবে মূল্যায়ন করেন—একজন মানুষ।…আর্টটারে বাদ দিয়ে বলবেন।
              • তারেক: টোটাল কিছু, মানে সব দিক দিয়ে বলছি। মানে, তাকে আর্টিস্ট হিসেবে শুধু নয়।
              • মামুন: আর্টিস্ট বাদ দিবেন। শিল্পীসত্তা বাদ দিয়া এস এম সুলতান—অ্যাজ এ পারসন আর কি। [তারেক: আচ্ছা] মানে এ সম্পর্কে আপনি কয়েক মিনিট বলেন, আমি শুনি।
              • তারেক: না, এখন ধরেন, সুলতান ভাই সম্পর্কে তো এতো মিথ, তার মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আমার, যতটুকুন তাকে বুঝেছি—আমার কাছে খুব, এক ধরনের ডুয়েল পারসোনালিটি মনে হয়েছে। অর্থাৎ একদিক দিয়ে তিনি অত্যন্ত বিনম্র, ভদ্র, বিনয়ী এবং পোলাইট–যাকে বলে আর কি [মামুন: হ্যাঁ–], ভদ্রোচিত এবং সেটা শুধু আপনার, ধরুন, তার সিনিয়রদের প্রতি বা তার সমবয়সী, তাদের নয়, এমনকি জুনিয়র যারা, যেমন আমাদের সঙ্গে, আমার সঙ্গে, মানে আমাকে তিনি শুধু ‘তারেক’ বলেন তা নয়, ‘তারেক ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। এখন…
              • মামুন: আমারেও বলতো, হ্যাঁ–এটা খারাপ লাগে মাঝে মাঝে, লজ্জা লাগে।
                    • তারেক: খারাপ লাগে, আমি বলেছি। বলে কি, ‘না, আপনি বড় কাজ করছেন; আপনি বয়সে ছোটো হলেই তো ছোট নয়’—এ রকম তার হচ্ছে বিনয়। তো এখন ধরুন, তার…আমার বয়স ডাবল বয়স তাঁর, অথচ তিনি আমাকে ‘তারেক ভাই’ ডাকেন এবং আপনি বলে সম্বোধন করেন। এগুলো তার ওই এক ধরনের যে অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্রোচিত একটা ব্যাপার আছে তার মধ্যে, ভদ্রোচিত–সেই থেকে।

                    • মামুন: মানে মানবিক গুণাবলি সবগুলোই তার মধ্যে আছে।–
              • তারেক: অ্যাট দ্য সেইম টাইম আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমি দেখেছি যে, তার আরেকটি দিকও আছে। একটা রুদ্রমূর্তি আছে, যেটা মাঝে মাঝে খুব, একসময় হয়তো আপনি জানেন যে, হয়তো ’৭০ দশকের দিকে আরো বেশি ছিল ব্যাপারটা, খুব ফ্রিকোয়েন্ট থাকত জিনিসটা, মাঝে মাঝে হলেও, তাঁর মাঝে মাঝে দেখা যেত সেই রূপটা। কিন্তু এখন অনেকটা বেরিয়ে যে রূপ–সেটা হচ্ছে, মানে, যখন কোনো কিছু পছন্দ করে না, কাউকে বা কোনো কিছু, যেভাবে তিনি মাঝে মাঝে রিয়্যাক্ট করেন, তার নিজস্ব গাম্ভীর্য এবং মানে, শালীনতা বজায় রেখেও তিনি তার যে ক্ষোভ বা প্রতিবাদটা করেন, সেটা খুব লক্ষণীয় এবং খুব ইন্টারেস্টিং এবং সেই সব মুহূর্ত আমার কিছু মনে আছে যখন আমি দেখেছি তাকে এ রকম ভাবে। বিশেষ করে যখন কোনো সরকারি আমলা বা এই জাতীয় বা এ রকম টাকাঅলা লোক যারা তাঁকে, ছবি কিনে–তাকে কিনে নেয়ার বা মনোপোলাইজ করার চেষ্টা করছে, সেসব লোকের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখেছি তিনি অত্যন্ত, কী বলা যায়, খুব অ্যাসারটিভ একটা রোল নেন মাঝে মাঝে এবং সেটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। …লোকদের সাথে খুব তার সাথে সম্পর্ক নেই। মূলত তিনি খুব–অত্যন্ত বিনয়ী, কিন্তু মাঝে মাঝে যেটা বললাম, তার এই রূপটা দেখা যায়।
              • tmmm.jpg

                    • ………
                    • তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর; আদম সুরত-এর নির্মাণকাল ১৯৮৯ সালে।
                    • ………
                    • মামুন: প্রায় বেশিরভাগই শিল্পী এবং রুচিশীল মানুষ–শুধু শিল্পী না, যারা রুচিশীল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ—তাদের মধ্যে কিন্তু এই ডুয়েল পারসোনালিটিস আছে কিন্তু। কিন্তু আমি ভাবছিলাম যে আপনি বলবেন, তাঁর লাইফে–জীবনযাপনে মানে ব্যক্তিগত জীবনে কন্ট্রাডিকশন, আমি কিন্তু কন্ট্রাডিকশন দেখছি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে। সে আলাপ করবো নে পরে। ডুয়েল পারসোনালিটি কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই আছে। যারা রুচিশীল, ভদ্র, মার্জিত, শিক্ষিত—আছে কিন্তু, শুধু সুলতান ভাইয়ের বেলায় না, প্রায়ই আছে।
              • তারেক: সেই–না, আছে এবং সুলতান ভাইয়েরও সেটা আছে।
              • মামুন: তাঁর কন্ট্রাডিকশন আমি দেখছি এবং এটা তাঁর মানে ফিলোসফির মধ্যে কন্ট্রাডিকশন আছে।
              • তারেক: এটা তো সব মানুষেরই থাকে এবং সুলতান ভাইয়েরও আছে। দেখেছি আমি সুলতান ভাইয়ের মধ্যে যে একই সঙ্গে, ধরুন, ব্যক্তিগতভাবে ফিলোসফিকালি আমি জানি যে, চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত, সাধারণ মানুষের প্রতিও অত্যন্ত দরদি, কিন্তু একইসঙ্গে আমি দেখেছি মাঝে মাঝে—হি অলসো ফাউন্ড হিম, হি অলসো বিহ্যাভিং স্লাইটলি ডিফারেন্টলি। [মামুন: এক্সাক্টলি] সেটা থাকেই, অনেকের মধ্যেই স্ববিরোধিতা থাকে।
              • মামুন: সেটা মাত্রা ছাড়ায় না তার মধ্যে, এইটা ঠিক।
              • তারেক: হ্যাঁ, সেটাও ঠিক।
              • মামুন: লিমিট, লিমিটেড—এইটা ঠিক। আচ্ছা একজন–এস এম সুলতান একজন শিল্পী—আপনি কীভাবে দেখেন? এটা আপনি, মানে বলবেন–ভারত উপমহাদেশের কনটেক্সটে। [তারেক: না, এখন ধরুন…] একজন শিল্পী এস এম সুলতান; ধরেন আমাদের দেশে অনেক শিল্পী আছে। বাংলাদেশে, উভয় বাংলায় অনেক শিল্পী–যামিনী রায়, তারপরে আপনার, আমাদের দেশের জয়নুল আবেদিন, তার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইয়ের ছেলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এই ধরনের বড় বড় শিল্পী আছে। এস এম সুলতানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
                    • 2.jpg
                    • গ্রামবাসীর সাথে এস এম সুলতান ও নাসির আলী মামুন, মাছিমদিয়া, নড়াইল ১৯৮২ ছবি: বিমানেশ
              • তারেক: এখন প্রথম কথা হচ্ছে যে, আমি ওই একটা জিনিসে বিশ্বাসী নই। যেটা হচ্ছে যে তুলনামূলক বিচার, [মামুন: হ্যাঁ, তুলনামূলক–] সেটা আমি আমার ছবির মধ্যেও চেষ্টা করেছি টু অ্যাভয়েড–কম্পারেটিভ না করা। সুতরাং সেই দিকে আমি যাব না যে, কার সঙ্গে তুলনীয় বা কার থেকে বড় বা কার থেকে ছোট। তবে অ্যাজ এ পেইন্টার আমার কাছে যেটা মনে হয়, আমি নিশ্চিত নই, অ্যাজ এ পেইন্টার সমস্ত আধুনিক চিত্রকলার বিভিন্ন নিরিখে তাঁর ছবি, ইটস্ ডিউ টাইম টু প্রুভ হোয়েদার হি উড প্রুভ অ্যাজ এ মডার্ন পেইন্টার, বাট আই মিন, আমি খুব অবাক হবো না যদি তাঁর–নতুন করে, সেটি এক বছরের মধ্যে নয়, হয়তো ১০ বছর, ২০ বছর, কি ৫০ বছর পরেও, তাঁর ছবির প্রকৃত মূল্যায়ন এবং খুব পজিটিভলি মূল্যায়ন হয়। আমি মনে করি, তাঁর এখনো–অ্যাজ এ পেইন্টার তাঁর মূল্যায়ন হয়নি। অনেক পেইন্টারের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এই ধরনের আনইউজুয়াল পেইন্টারের ক্ষেত্রে তার জীবদ্দশায় হয়তো কিংবদন্তিতুল্য হয়ে উঠে, অনেক লিজেন্ডারি হয়ে যায়, ওই অর্থে পপুলারিটিও পায়, কিন্তু [মামুন: প্রকৃত মূল্যায়ন যেইটা আর কি।] প্রকৃত মূল্যায়ন, যে ক্রিটিকাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যান্ড অ্যাপ্রিসিয়েশন অব হিজ ওয়ার্ক এবং সেটার মানদণ্ড বিচার, সেটা করার সময় এখনো হয় নি। কারণ, তার প্রধান কারণ হচ্ছে যে, তাঁর ছবি–আপাতদৃষ্টে হচ্ছে খুব নাইভ পেইন্টার। অনেকটা স্বভাব কবির মতো। স্বভাব কবি যেরকম স্বভাব চারণ কবি, এইরকম চারণ চিত্রকরের মতো। কিন্তু এইটা, মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, তিনি তো আসলে প্রকৃত অর্থে তিনি তো আসলে স্বভাব চিত্রকর নয় বা নন। তিনি সমস্ত ওয়ার্কিং পেইন্টিং-এর ইতিহাসের মধ্য দিয়ে এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি ওই সরলতার মধ্যে ফিরে গেছেন। সো, ইট ইজ নট দি সেইম সরলতা। সেই স্বাভাবিক একজন গ্রামের পটুয়ার যে সরলতা, তাঁর সরলতা–ছবির আঁকিয়ে হিসেবে, এক নয়। তিনি সমস্ত অভিজ্ঞতা, বিমূর্ত কলা এবং আধুনিক শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতায়, মানে, ট্রানসেন্ড করে তিনি সরলতায় গেছেন। সো ইট হ্যাজ এ ডিফারেন্ট ডাইমেনশন এবং এই ডাইমেনশনের কারণেই তাঁর ছবি নেহায়েত নাইভ পেইন্টিং বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই এবং তার ছবির মধ্যে যে বিষয় এবং অ্যাপ্রোচ আছে তার মধ্যে অনেক আধুনিক অ্যাপ্রোচের কিছু সম্পর্ক ইতিমধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন সারা বিশ্বে এখন পরিবেশবাদী যে চেতনা কাজ করছে এবং নগরসভ্যতার যে পলিউশন এবং নগরসভ্যতার যে আত্মঘাতী দিক—যুদ্ধ এবং জটিলতা, ইত্যাকার জটিলতার দিক, সেইটার বিপরীতে এবং বিপ্রতীপে গ্রামীণ জীবনের এবং সরল, অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে প্রিমিটিভ জীবনের প্রতি, ফিরে যাওয়ার যে এক ধরনের নতুন [মামুন: প্রয়াস, ইচ্ছা, আগ্রহ] তার সাথে এইটা খুবই সম্পৃক্ত এবং সেই কারণেই দেখা যায় যে, সুলতানের ছবি বিদেশে মানুষ একটি বিশেষ, স্পেসালি গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। কারণ এইটা আধুনিক, পশ্চিমের দিকে যে একটা নতুন চিন্তা-চেতনা হচ্ছে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে, ভিজ্যুয়াল আর্টের ক্ষেত্রে এবং পরিবেশবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন রকম আন্দোলনের ক্ষেত্রে—এই ক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক টাইপ তার ছবিগুলো, এক। আর দুই হচ্ছে যে, ছবি বাংলাদেশের যে ধারা আমরা দেখেছি; ধরুন, এই যাদের কথা বললেন অবনী ঠাকুর, নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী, জয়নুল আবেদিন—এই ধারার পরে আমরা যেটি দেখতে পাচ্ছি যে বিশেষ করে বাংলাদেশের যে চিত্রকলা…
              • মামুন: না, আমি আপনাকে এস এম সুলতানের সাথে আসলে তুলনা করা ঠিক না, ছোট-বড় তুলনা করা ঠিক না, আমি বলতে চাইছিলাম, এই কারণে তুলনা করা যায়, অবশ্যই এস এম সুলতান অ্যাজ এ পেইন্টার হিসাবে অন্যান্য আর্টিস্টের সাথে, কারণ অন্যান্য আর্টিস্টের পেইন্টিংসের সাথে এস এম সুলতানের পেইন্টিংসের কোনো মিল নাই, একেবারে আলাদা তাঁর স্ট্রোক। সেই জন্যই তুলনা করা কিন্তু যায়, অবশ্যই যায়।
              • তারেক: সেই অর্থে বলছি যে..
              • মামুন: আমি বুঝছি আপনার কথাটা।
              • তারেক: আমি যেটা শেষ বলছিলাম সেটা হচ্ছে যে, ধরুন, একটা দিকে খুবই স্ট্রাইকিং আসপেক্ট রয়েছে। সেটা হচ্ছে যে, আমাদের দেশের যে, ওই চারজন যে পূর্বসূরি, বিখ্যাত চিত্রকর আছেন–জয়নুল আবেদিন, অবনী এবং নন্দলাল বসু, যামিনী রায়সহ, এর পরে কিন্তু বিশেষ করে বাংলাদেশের চিত্রকলা জয়নুল আবেদিনের ছাত্রদের জেনারেশন থেকে–প্রথম জেনারেশনের ছাত্র যারা—মুর্তজা বশীর, তারপরে আপনার রশীদ চৌধুরী, কিবরিয়া–এদের সবার সবকিছু মিলিয়ে নতুন যে বিমূর্ত কলার, পাশ্চাত্য বিমূর্ত কলার প্রতি যে একটা বিরাট ঝোঁক …হলো সেটা, সেই বিপরীতে একটা ভিন্ন মতামত, ভিন্ন একটা ধারা এবং ফিগারেটিভ কাজের প্রতি আবার ফিরে আসা, এইটা একটা নতুন জিনিস এবং আমি লক্ষ করেছি হয়তো সুলতান উড হ্যাভ–অ্যাজ এ পেইন্টার হিসাবে জানি না, যে পেইন্টিং তার হিসাবে জানি না কিন্তু তার পেইন্টিং যে পরবর্তী ছাত্রদের, মানে স্টুডেন্ট অব আর্টের যারা তাদের উপরে প্রভাব ফেলছে সেটা লক্ষ করা যায়। কারণ ইদানীং ফিগারেটিভ কাজ দেখবেন, ঢাকায়, প্রচুর ফিরে এসছে। তরুণ অনেক শিল্পী যারা ছবি আঁকছেন তারা আবার ফিগারেটিভ ওয়ার্কে ফিরে এসছেন, নট নেসেসারি রিয়্যালিস্টিক ওয়ার্কে। কিন্তু সুলতানের ছবি যদিও ফিগারেটিভ ওয়ার্ক আমি মনে করি না, ওই অর্থে সরল, অর্থাৎ ফিগারেটিভ কাজ নয়। সুলতানের ছবি–ফিগারেটিভ বটে, কিন্তু রিয়্যালিস্টিক নয়, মোর দ্যান রিয়্যাল। সুতরাং এক ধরনের যেটা বলেন আপনি, ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা স্যুররিয়ালিজম বলুন, তাঁর ছবির মধ্যে আছে। ফলে ইট’স নট ক্রিটিক্যালি, লিটারালি আপনার রিয়্যালিস্টিক ওয়ার্ক, বাট ডেফিনিটলি ফিগারেটিভ।
              • মামুন: আচ্ছা এস এম সুলতানের এই প্রসঙ্গে বলি, জিজ্ঞাসা করি। এই যে, এস এম সুলতান এই ধরনের পেশিবহুল দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ এই যে মানুষের ছবি আঁকে, মানে ফিগারেটিভ স্টাডি করে—এগুলি কি সে সচেতনভাবেই করে, আপনার মনে হয়? খুব সচেতনভাবে, নাকি এটা একটা জাস্ট তাঁর একটা স্টাইল, নাকি তার এটার মধ্যে একটা মোটিভ আছে, একটা হাইলি ফিলোসফিকাল কিছু আছে, যেটা এস এম সুলতান ব্যক্ত করছেন…।
              • তারেক: হ্যাঁ, আছে কিন্তু অত উচ্চকিত নয়। আমি মনে করি তার চিন্তা-চেতনা আছে এবং সেই চিন্তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এবং প্রত্যক্ষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসছে, নট নেসেসারিলি ধরুন, বা ইন্টেলেকচুয়ালি সে পারসিভ করেছে। যেমন ধরুন, ব্যাপারটা, এই সমন্বয়টা কীভাবে হয়েছে—বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তাঁর মানে, ফিলোসফিকাল আউটলুক, দুটো কীভাবে কমবাইন্ড হয়েছে, তাঁর একটা নিজের কথা দিয়েই আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। তিনি আমাকে একসময় বলেছিলেন যে, দেখুন, আমি তো আসলে বাংলার কৃষককে নিয়ে এই যে গত ৩০ বছর ধরে আছি, তা ঠিক নয়। আমি অনেক আগে থেকেই, যখন আমি ইউরোপে ছিলাম, তখনো আমি কিন্তু বাংলার কৃষককে নিয়ে অনেক ছবি, আপনি দেখেছেন, আমাকে বলতো যে, করাচিতে দেখে এসেছেন, সিক্সটিজ এবং ওখানে বসে…
              • মামুন: আপনি আমাকে দেখাইছেন। এইরকম কিছু স্লাইড আমি দেখছি আপনার কাছে।
              • তারেক: তো বলে যে, ‘তার মানে হচ্ছে যে আমি কিন্তু তখনও আঁকতাম। কিন্তু মজার ব্যাপারটা হলো–তখন আঁকতাম টপোগ্রাফিকাল পয়েন্ট অব ভিউ দিয়ে। বার্ডস আই, বলছে যে বার্ডস আই থেকে দেখতাম আমি বাংলাদেশের গরিব কৃষককে। ফলে ওদেরকে খুব ছোট করে দেখতাম। দেখবেন যে ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে অলঙ্কারের মতো লুকিয়ে আছে অল মোস্ট, এ রকম করে, ছোট্ট করে ল্যান্ডস্কেপে ভাস্ট টপোগ্রাফিকালি এরিয়াল শট অব ল্যান্ডস্কেপ-এ…’
              • মামুন: একটা-দুটা ফিগার আছে।
              • তারেক: ‘দুটা ফিগার অলঙ্কারের মতো বসে আছে। এ রকম করে দেখতাম আমি।’
              • মামুন: কারণ সে প্রকৃতির মধ্যে নিজে ছিল না সশরীরে।
              • তারেক: হ্যাঁ। বলে যে, ‘এক ধরনের করুণা কাজ করত ওদের জন্যে। ফলে ওদেরকে আমি খুব দূর দৃষ্টি থেকে, বার্ডস আই ভিউ থেকে দেখতাম। ওদেরকে ছোট করে দেখতাম খামাখা, [মামুন: খুব দামী কথা কিন্ত] কিন্তু যখন ওদের সঙ্গে গত ৩০ বছর ধরে আমি খুব কাছাকাছি—এত বেশি কাছাকাছি থাকতে লাগলাম যে, যা হয়, যাকে আপনাদের সিনেমার ভাষায় বলে, ফ্রগ আই ভিউ। ফ্রগ যে তার মানুষ বা তার কাছাকাছি জিনিসকে খুব বড় করে দেখে।’ [মামুন: তাই নাকি?] হ্যাঁ, এটা একটা ক্যামেরার ল্যাংগুয়েজ কিন্তু। ক্যামেরার টার্মও বলে।
              • মামুন: আমার জানা ছিল না, আচ্ছা আচ্ছা।
              • তারেক: ফ্রগ’স আই ভিউ বলে।
              • মামুন: আই ভিউ…
              • তারেক: এটা খুব, মাটিতে ফ্লোরে রেখে আপনি কোনো শট নিবেন, একদম মাটিতে, তাহলে দেখবেন যে, লো এঙ্গেল, সব সময় দেখবেন কিন্তু, লো এঙ্গেল থেকে কোনো শট নিলে যেই লোকের, যার শট নেবেন বা যে জিনিসের শট নেবেন, তা বড় লাগে। বড় লাগে না?
              • মামুন: হ্যাঁ, ওয়াইড একটা…
              • তারেক: ওয়াইডনেস আছে। বলছে যে, ওইটাই আরকি? ওটা হচ্ছে যে, ‘আপনাদের সিনেমার ভাষায় আছে—ফ্রগ’স আই ভিউ। বা আমি তো ওদের এত কাছে থেকে দেখতে শুরু করলাম এবং ওদের সাথে থাকতাম, এত কাছে থেকে দেখতাম যে, ফ্রগ’স আই ভিউ থেকে দেখতে শুরু করলাম। অর্থাৎ আগে যেমন বেশি ছোট দেখতাম, এখন রিয়েল থেকে আরও বেশি রিয়েল, বেশি বড় দেখি ওদেরকে।’ অর্থাৎ ইন মেটাফরিক্যাল সেন্স, সে বলছে আমাকে যে, ‘আসলে আমি তো আগে দেখতাম ওদেরকে দরিদ্র; দূর থেকে মনে হতো, বাংলাদেশের, আমার দেশের গরীব কৃষক কত দরিদ্র। ফলে ওদেরকে আমি ছোট করেই দেখতাম হয়তো। কিন্তু যখন ওদের মধ্যে থাকলাম তখন আমি ওদের দারিদ্র্যটা আর খুব একটা বেশি দেখি না। আমি অবাক হয়ে যাই এটা দেখে যে, ওরা এই দারিদ্র, দারিদ্র্য—তার পরেও কী অসীম আত্মবল এবং মনোবল ওদের এবং ওদের মধ্যে যে মানসিক শক্তি বা আভ্যন্তরীণ শক্তি, ইনার ইন্সটিংক্ট—সেটা দিয়ে ওরা জীবনকে, জীবনের সাথে স্ট্রাগল করে যুদ্ধ করে চলছে। ওরা কখনোই পরাজিত হয় না। আমার কাছে মনে হয়েছে, ওইটাই হচ্ছে ওদের আসল পরিচয়। দারিদ্র্য ওদের মূল পরিচয় নয়। ওদের পরিচয় হচ্ছে দারিদ্র্যতার (দরিদ্রতার—বি.স.) পরেও ওরা যে কী করে টিকে থাকে, এত কনফিডেন্টলি, ভেতরের শক্তি যদি না থাকে তাহলে তো ওরা পারত না। তো আমি এই ভিতরের শক্তিটাই দেখাতে চেয়েছি, মানে আউটার ম্যানিফেস্টেসন।
              • মামুন: আচ্ছা, এস এম সুলতানের এই যে ব্যক্তিগত জীবনযাপন, আপনি বলছেন একটু আগে, ব্যক্তিগত জীবনে সে যেভাবে থাকে, যেভাবে ঘুমায়, যা খায়, যেমন ঘরে থাকে, আমি এখনকার কথা বলতেছি না, আগে–এই ধরেন, এখন থেকে দশ বছর আগে—এখন তো সে ভদ্র হয়ে গেছে, আধুনিক জীবনযাপন করে; এখন না, আগে এই যে পোশাক—কালো রংয়ের একটা বড় ফতুয়া, গাউন, তারপরে বড় বড় লম্বা চুল, যা এখনও আছে; চশমা পড়ত না, তার পর এই যে গাঁজা খাইত, মানে এই ধরনের জীবনযাপন—এইটা কি এক ধরনের শোম্যানশিপ না, আধুনিক জীবনে?
              • তারেক : দুটো জিনিস, একটা হচ্ছে যে এক ধরনের…
              • মামুন: এটা কি সে সচেতনভাবে করত? আমি এইটাই জানতে চাই, সচেতনভাবে করত কি না? নাকি এটা অবচেতন মনে…
              • তারেক: আমার মনে হয় না যে ওই অর্থে সচেতন। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ওই অর্থে সচেতন নয়। কিন্তু অ্যাট দ্য সেইম টাইম আমি মনে করি, আত্মসচেতন ব্যক্তি সে। অর্থাৎ সে জানে এইটা অন্যরা কী রকমভাবে নিচ্ছে, জানে। অনেকে যেমন আউল বাউল আছে, তারা কেয়ার করে না।
              • মামুন: কেয়ার করে না।
              • তারেক: তারা কী পোশাক পড়েছে, কী রকম ভূষণ পড়েছে, কী রকম আচার-আচরণ করছে এবং লোকজন কীভাবে নিচ্ছে—দে ডোন্ট কেয়ার। আর সুলতান ভাই, আমার ধারণা, সে জানে। কিন্তু সে এটা, নিজে এতে মজাই পায়। এই ভেবে যে—‘ওরা আমাকে কী ভাবছে।’ কিন্তু আমার মনে হয় এক হচ্ছে যে…
              • মামুন: এই যে কষ্টের জীবন সে লালন করল এত বছর, ৩০-৩৫ বছর বাংলাদেশে, মানে যশোরের নড়াইলে, সেটাও কি সে ইচ্ছা করে বরণ করে নিয়েছিলেন?
              • তারেক: হ্যা, আমার কথা…
              • মামুন: ছবি আঁকলেই বিক্রি করতে পারত।
              • তারেক: আমি তাকে যেভাবে বুঝি। আমার মনে হয়, তিনি একজন আউটসাইডার হবেন এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এই সমাজের থেকে…
              • মামুন: অ্যালুফ থাকবেন আর কি।
              • তারেক: বিযুক্ত থাকবেন। এই বিযুক্ততা নানানভাবে হয় এবং সে নানানভাবেই চেষ্টা করেছেন—কখনো মহিলা হয়ে, কখনো পাগল হয়ে, কখনো সাধু হয়ে; কিন্তু কোনোটাই তার আরাধ্য বিষয় নয়। মহিলা হওয়া তার জীবনের লক্ষ্য নয়, সাধু হওয়াও তার জীবনের লক্ষ্য নয়।


              • সূত্র: https://arts.bdnews24.com/archives/3918?fbclid=IwAR1U2Fu6SprU09MVpepjfcdvGsXxEk9c4FZDKkVDJVonvV82aTgYkLL6AlQ
          Share

          Recent Comments

          Recent Articles