মানুষের মুক্তি না হলে কাব্যেরও মুক্তি হবে না

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ স্যার, কালাপানির কবিতায় তো আপনি লিখেছেন, ‘শীত শীত/ দু’ হাঁটুতে সিঁধিয়েছে মৃত্যুভীতি/ মনে লয়/ আসন্ন বিলয় / সর্বমানুষের/ দ্যাখ, ন্যাড়া কঞ্চিতে ধরেছে ফুল/ পূর্ণিমার। আপনি সবসময়ই সর্বমানুষের হতে চেয়েছেন। সর্বমানুষের আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতিফলনের কথাই যেন মনে করিয়ে দেয় আপনার এ কবিতা। সর্বমানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকেই কি আপনার কবিতা মুদ্রিত হয় আপনার শাদা খাতার পাতায়? এবং আপনার কবিতার চরিত্ররা যেনো সুলতানের আঁকা ছবির সেই দৃঢ়, ঋজু, পেশীবহুল মানুষগুলো, এইখানে স্যার আমি জানতে চাই, সুলতানের যে চিত্রকলার জগৎ, সেটার সাথে আপনার কবিতার জগতের একটা অস্পষ্ট মিল যেন আছে-

মোহাম্মদ রফিক : তুমি খুব ভালো একটা প্রসঙ্গ তুলেছো। আমি আশির দশকের শুরুতে, তখন বোধহয় আমার কীর্তিনাশা বেরিয়েছে, কপিলা বোধহয় লেখা হয়েছে, খোলা কবিতা লেখার আগে আগে, আমি একবার যশোর গেলাম। যাওয়ার পর আমার খুব ইচ্ছে হলো যে আমি, নড়াইল যাবো, সুলতান ভাইকে দেখে আসবো। তখন কিন্তু আমি উনাকে চিনি না। নাম শুনেছি, কিংবদন্তি শুনেছি, প্রচুর কল্পকাহিনী শুনেছি। তো আমার ইচ্ছে হলো যে আমি যাবোই যাবো। উনাকে চাক্ষুস দেখবো। তো আমি যশোর থেকে দুটা ছেলেকে বললাম যে আমি নড়াইল যাবো। তখন কিন্তু যাওয়ার পথ অত সুগম ছিলো না। এবং তখন ঐ ঝরঝরে বাসে যেতে হতো। বহুপথ হেঁটে আর নৌকায় যেতে হতো।

একদিন সকালবেলা যশোর থেকে রওনা দিলাম আমরা তিনজন। দশটা এগারোটা নাগাদ সুলতান ভাইয়ের ভাঙা বাড়িতে গিয়ে আমরা হাজির হলাম। সুলতান ভাই তখন একা থাকেন এবং সঙ্গে তার একজন মহিলা থাকেন, যিনি রান্না বান্না করে দেন। বাঁশের একটা মাচার উপর খাঁচার ভিতরে একটা বেজি, সাপ, শকুন এসব পালেন তিনি। এবং মাচার নিচে ঐ ডাম্প জায়গায় গাদা মারা তার ছবি।

আমাদের মনে হলো সেই সকালবেলাতেই, তিনি গঞ্জিকা ছাড়া আর কিছু সেবন করেন না। তো এর মধ্যেই কথাবার্তা চলছে। হঠাৎ করে তিনি বললেন, এই আপনারা কিন্তু দুপুর বেলা আমার এখানে খেয়ে যাবেন। আমরা কিছুতেই রাজি হচ্ছি না। তিনি জোর করছেন। বলছেন, না, খেয়ে যেতেই হবে। তখন যে মহিলা সুলতান ভাইয়ের সাথে থাকতেন, তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে বললেন, যে উনি যে আপনাদের খেয়ে যেতে বলছেন, বাড়িতে তো কিছুই নেই। চালও নেই। কী খাবেন?

আমি আস্তে আস্তে তাঁকে বললাম, ভাববেন না, উনি বলে ফেলেছেন, আমরা ব্যবস্থা করছি। আমি গিয়ে তখন অশোক সেন নামে আমার সাথে যে দুজন গেছেন তাদের একজন, তাকে টাকা দিয়ে বললাম যে বাজারে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসো। তো সে, দ্রুত গিয়ে মাছ, শাকসব্জি এসব নিয়ে আসলো। আসার পরে ঐ মহিলা রান্নাবান্না করলো। সুলতান ভাইসহ আমরা খেলাম। সুস্বাদু রান্না অবশ্যই। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সুলতান ভাই একবার জিজ্ঞেসও করলেন না, এই খাবার কোত্থেকে আসলো, অথচ প্রসন্নচিত্তে খেয়ে নিলেন!

সুলতান ভাই এমনই সরল ও জগৎ সংসারের ভাবনাহীন মানুষ ছিলেন।

তো সন্ধ্যায় সেই অজপাড়াগায়ে অন্ধকার নামলে আমরা চলে এলাম। দেখলাম যে সুলতান ভাইয়ের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নাই। আমি মনে করলাম যে এটা আমার দায়িত্ব। আমি জেলাপ্রশাসকের সাথে দেখা করে তাকে বললাম, আপনি আর্থিকভাবে না পারেন, অন্তত তাঁর বাড়িটাতে একটু বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেন। তাতে অন্তত এই তীব্র শীতে একটু উষ্ণতা এই বাড়িতে তৈরি হবে। পরে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, উনি সেটা করেছিলেন।

স্যার, শিল্পী সুলতান কি জাহাঙ্গীরনগরে গিয়েছিলেন?

মোহাম্মদ রফিক : কিছুদিন পরেই এ ঘটনার, আমি তখন জাহাঙ্গীরনগরে, তুমি তো জানোই প্রান্তিকের কাছে যে বাসাটায় থাকতাম, হঠাৎ করে একদিন দেখি যে সুলতান ভাই হাজির। কি ব্যাপার! বলে ভাই, আমি তো আপনার এখানে থাকতে এসেছি। এবং সুলতান ভাই প্রায় ছ’মাস আমার সাথে কাটিয়ে গেলো। এবং উনি প্রতি সকালবেলা উঠে আমার একটা ছবি আঁকতেন। বাসা বদলে আসার পর সেই ছবিগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেছে তার কোন খোঁজ নেই এখন। এঁকে এঁকে তিনি আমার খাটের ওপর বিছানার নিচে রেখে দিতেন। তখন আমিও খুব মদ্যপানে আসক্ত ছিলাম। আর আমি দেখতাম উনি সকালবেলা উঠেই গাঁজা নিয়ে বসেছেন। ফরীদি (হুমায়ুন) ছিলো আমাদের ছাত্র, আরেকজন ছিলো মেহেদী বলে নাম, দুজনেই মারা গেছে। উনি ঐ দুজনকে দিয়ে গাঁজার ব্যবস্থা করাতেন।

আমি বললাম, সুলতান ভাই, গাঁজা খেলে তো শরীর নষ্ট হয়। তো, উনি খুব ছেলে মানুষ ছিলেন, অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প করতেন! আমাকে বললেন, আচ্ছা রফিক, তো কী করি! আমি বললাম, আপনিও আমার সাথে মদ্য পান করেন। উনি রাজি হলেন। তখন আমি ফরীদিকে বললাম, ফরীদি, একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়। তো, ও ঢাকা থেকে একটা ভালো মদ জোগাড় করলো। আমরা তো বাংলা খেতাম, বুঝতেই পারো। ফরীদি, সুলতান ভাই খাবে বলে একটা ভালো, বিদেশী মদ নিয়ে এলো ক্যাম্পাসে। খুব আয়েশ করে আমি ফরীদি আর সুলতান ভাই বসলাম। একটু খেয়ে সুলতান ভাই বললনে, এটা তো জল, হা হা হা, এটা তো কিছু হয় না। এটা আমি খাবো না। হা হা হা। (দু’জনের সম্মিলিত হাসি)

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আর খেলেনই না?

মোহাম্মদ রফিক : তুমি অবাক হয়ে যাবে, উনি যে গাঁজায় একেকটা টান দিতেন, তুমি বা আমি যদি দেই ওরকম আমি নিশ্চিত আমাদের বুক ফেটে যাবে। সুলতান ভাই সকালবেলায় উঠে ঠিকমত কথা বলতে পারতো না, কিছু করতে পারতো না, কিন্তু গাঁজায় টান দেবার পরই বলতো যে, এইবার ভাল্ললাগছে। এই হচ্ছে সুলতান ভাই। তারপরে, আমার ছাত্ররা, তাদের বিদায় উপলক্ষে উৎসব করবে, তারা শিল্পী সুলতানকে উৎসব আমন্ত্রণ জানাবে, ওরা উনাকে আমন্ত্রণ করতে গেলো, বললো, যে আপনি কোথায় থাকবেন! আমাদের টিএসসিতে গেস্ট হাউস আছে, ওখানে আমরা ব্যবস্থা করতে পারি আপনি চাইলে। বললো, রফিক ভাই আছে না? ওরা বললো, হ্যাঁ আছে।

উনি বললেন, তাহলে গেস্ট হাউসে থাকবো কেন? রফিক ভাইয়ের ওখানে থাকবো। তো আমার ছাত্রদের একজন কবির এসে বললো যে স্যার, সুলতান ভাই তো বলছে আপনার এখানে থাকবে, তো আমি বললাম, ঠিক আছে, থাকবে। তখন তিনি গাঁজা টাজা ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু প্রচন্ড কাশি। এবং কিছুদিন আমার এখানে থাকলেন, জাহাঙ্গীরনগরে মুক্তমঞ্চ থেকে সম্বর্ধনা নিলেন, এরপর তো ফিরে গিয়ে মারা গেলেন। আমার ধারণা, সুলতান ভাই খুব সরল ধরনের, সাহসী লোক ছিলেন, নিজের কল্পনার জগতে বিচরণ করতেন।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনারা দুজনেই এই অঞ্চলের মানুষের যাপনের মূল সুরটা ধরেছেন, নিজেদের সৃষ্টিকর্মে প্রোথিত করেছেন।

মোহাম্মদ রফিক : করতে পেরেছি কি না জানি না, তবে আমি এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই হচ্ছে আমার সাথে সুলতান ভাইয়ের সংশ্রব। তবে আমার মনে হয় যে, সুলতান ভাইয়ের এই নেশায় থাকার সুযোগ নিয়ে এইদেশে অনেকে অনেক ব্যবসা সুবিধা বাগিয়ে নিয়েছে। অনেকেই ব্যবসা করছে এই দেশে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এখনো করছে।


সাক্ষাৎকারঃশিমুল সালাহ্উদ্দিন।

{আলাপ শুরুর সময় ৩১ মে, ২০১৫, রবিবার, সকাল ১১.১০, উত্তরা}

Share

Recent Comments

Recent Articles