মানুষের শিল্পী সুলতান

যে ক'জন ক্ষণজন মানুষ মা , মাটি ও মানুষকে একান্তভাবে কাছ থেকে দেখেছেন , উপলব্ধি করেছেন এবং বিশেষ চিন্তার মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যে দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং দেশে ও বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে চিত্রা নদীর পাড়ের মাছিমদিয়া গ্রামের লাল মিয়া , শিল্পী এসএম সুলতান অন্যতম ব্যক্তিত্ব । সুলতানের শিল্পকর্মে প্রাধান্য বিস্তার করেছে কৃষক , কামার , কুমার , জেলে ও মাঝি তথা - সাধারণ মানুষ , যারা উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত । শিল্পীর আঁকা ছবিতে কি পুরুষ কি নারী সকলেই স্বাস্থ্যবান বা স্বাস্থ্যবতী শক্তিশালী এবং যৌবনদীপ্ত । শিল্পীর আঁকা কৃষাণ - কৃষাণীর দৈহিক গঠন যেমন মােটা - তাজা ও শক্তিতে ভরপুর ঠিক কৃষকের গরুর দৈহিক গঠনও বলিষ্ঠ , শক্তিতে ভরপুর এবং জমি কর্ষণের খুবই উপযােগী । সুলতানের অঙ্কনে বাংলার মানুষ শােষণমুক্ত , বঞ্চনামুক্ত , অত্যাচার ও নিপীড়নমুক্ত সুখী সমৃদ্ধিশালী । শিল্পী প্রচুর সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেছেন তাঁর সব মাষ্টারপিছ চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে , স্বপ্ন দেখেছেন সুখী সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশের । এই দিক দিয়ে শিল্পীর সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সােনার বাংলা গড়ে তােলার একটি অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যায় । আমি শিল্পী নই , তবে একজন পেশাজীবী । আমি শিল্পীর শিল্প কলার আঙ্গিক , অবয়ব ও বিষয়বস্তু নিয়ে তেমন কোন বক্তব্য বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করার মতাে বিদ্যা না রাখলেও এতটুকু বলা অতিশয়ােক্তি হবে না যে , শিল্পীর তুলিতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ছবি যে ভাবে ফুটে উঠেছে তা বিরল এবং দুর্লভ । শিল্পীর অঙ্কন সমূহ মনে হয় জীবন্ত হয়ে কথা বলছে এবং পরিবেশ , পারিপার্শ্বিকতা সবই চেনা ও পরিচিত । সুলতানের আঁকা “ পাট কাটা ” , ধান ভানা ” , “ ধান ঝাড়া ” , “ জলকে চলা ” , “ চর দখল ” , “ গ্রামের খাল ” , “ মৎস্য শিকার ” , “ গ্রামের দুপুর ” , “ নদী পারাপার ” , “ ধান মাড়াই " , “ জমি কর্ষণে যাত্রা ” , “ মাছ ধরা ” , “ নদীর ঘাটে ” , “ ধান কাটা ” , “ জমি কর্ষণ " , “ গুণ টানা ” , তােলা ” , “ ফসল কাটার ক্ষণে " , “ শরতে গ্রামীণ জীবন ” “ শাপলা তােলা " , “ পাট ধােয়া ” , “ পানি ভরা " , “ মাছ কাটা ” , “ প্রথম রােপণ ” এবং “ অতীত দিনের স্মৃতি ” প্রভৃতির ক্যানভাসগুলাে এবং শিল্পী যেন অনেকগুলাে চলন্ত ঘটনার স্থিরচিত্র । শিল্পীর শিল্প ভাবনা এবং জীবনবােধ ফেনায়িত হয়ে উপচিয়ে পরছে প্রতিটি নিখুঁত তুলির আঁচড়ে । বাংলার প্রকৃতি , মানুষ এবং শিল্পী সুলতান এক সত্তায় মিশে গেছে । শিল্পীর আঁকা ছবিগুলােই শুধু নয় , বেশ কিছু আলােকচিত্রও আছে যেগুলাে দেখলে বােঝা যায় তিনি অত্যন্ত সরল সহজ এবং শিশুর মতাে । “ শিশুদের মাঝে ” এবং “ আডডায় শিল্পী " - এ দু’টি আলােকচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মানুষকে বিশেষ করে শিশুদের তিনি অত্যধিক ভালবাসতেন । শিল্পীর শিশুদের মত কোমল মন । শিল্পীর ৮১ তম জন্ম জয়ন্তীতে নড়াইলে গড়ে তােলা হয় শিশু স্বর্গ । শিল্পীর ভাবনার সামান্যতম বাস্তবরূপ । জীব বৈচিত্রে ভরপুর বাংলার প্রকৃতি শিল্পীকে তীব্র ভাবে টানত । এই টানের কাছে পৃথিবীর তাবৎ ঐশৰ্য্য শিল্পীর সংকীর্ণ মনে হয় । পাশ্চাত্যে তিনি নমস্য হয়ে থাকতে পারতেন কিন্তু বাংলার টান তাঁকে হেঁচকা টানে টেনে নিয়ে আসে নড়াইলে । মােহ মুক্ত হলেন তিনি । একটি কথা চালু আছে যে , বাড়ির জঙ্গল পরিস্কার করতে গিয়ে অন্যান্য জিনিসের সাথে একটি বিষধর সাপও বেরিয়ে আসে । সবাই সাপটি মারতে উদ্যত হলে তিনি এগিয়ে এসে সবাইকে নিবৃত্ত করেন । শােনা যায় তিনি এই সাপটিকে পােষ মানিয়ে ছিলেন । প্রাণের প্রতি , সৃষ্টির প্রতি নিবিড় প্রেম না থাকলে তা হওয়া সম্ভব ছিল না । ১৯৯৬ সালের ১০ আগষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী নড়াইলের রূপগঞ্জ “ সুলতান মেলার উদ্বোধন করেন । মেলার গােড়াপত্তন ঐ সময়ে । তখন থেকে প্রতিবছর সুলতান মেলা হয় , সর্ব শ্রেণীর , পেশার ও ধর্মের লােকের সমাগম ঘটে সেখানে । মা - মাটি - মানুষ অর্থেই শিল্পীর শিল্প জীবন , শিল্পী সুলতান ও বাংলার মানুষের । " সুলতান মেলার গােড়া পত্তন সেই লক্ষ্যেই । শিল্পীর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ যেমন কৃষক , কামার , কুমাের , জেলেদের মেলা , সুলতান মেলা , এদের কল্যাণে পরিচালিত হােক এই আমাদের প্রত্যাশা । হাল আমলে “ সুলতান মেলার মাধ্যমে প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না বলে অনেকেরই ক্ষোভ আছে , দুঃখ আছে , সেই সঙ্গে আছে বেদনা । “ সুলতান মেলা ” যারা পরিচালনা করছেন বিষয়টি তারা ভেবে দেখবেন গভীরভাবে । মেলা পরিচালনা করতে গিয়ে সঙ্কীর্ণতার আবর্তে আমরা যেন শিল্পীকে অমর্যাদা না করি ।

23/06/2016

Syed Rezaur Rahman 

Advocate 

Member,Advisory Council 

Bangladesh Awami League 

Share

Recent Comments

Recent Articles