মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান

মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতান 

আইয়ুব ভুঁইয়া

প্রখ্যাত ইংরেজ কবি কুপার বলেছেন, 'মানুষ তৈরি করেছে নগর , আর ঈশ্বর তৈরি করেছেন গ্রাম । ' উপমহাদেশের নন্দিত শিল্পী সুলতানের ক্ষেত্রে একথাটিকে একটু পরিবর্তন করে বলা যায়, সমসাময়িক অন্যান্য শিল্পীরা যখন তাঁদের ক্যানভাসে নগর সভ্যতাকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত তখন সুলতান তাঁর ক্যানভাসে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও নিসর্গ এবং খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্পকে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। সুলতান তাঁর ক্যানভাসে রং তুলির আঁচড়ে এ জনপদের মাটি ও মানুষের বঞ্চনাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এতদঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনী । তাই সুলতানকে বলা যায় মাটি ও মানুষের শিল্পী, প্রকৃতি ও নিসর্গের শিল্পী, জীবনের শিল্পী । যৌবনের উন্মাদনায় এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সুলতান এশিয়া ও ইউরোপের দেশে দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং অসংখ্য প্রদর্শনী করেছেন। কিন্তু মাটি ও মানুষের টানে, চিত্র নদীর টানে, সুলতান মৃত্যুর প্রায় তিন দশক আগে আবার নড়াইলের মাটিতে ফিরে আসেন। যেমনিভাবে আরেক কৃতী মনীষী মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাটি ও মানুষের টানে, কপোতাক্ষ নদের টানে সুদুর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরী থেকে ছুটে চলে আসেন । কি অপূর্ব মিল দু'জনের মধ্যে। দু'জনই আবার বৃহত্তর যশোরের অধিবাসী । আজ একজন চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন কপোতাক্ষ নদের তীরে, আরেকজন চিত্রা নদীর তীরে।পৃথিবীতে খুব কম শিল্পীই সুলতানের মত এত ঘনিষ্ঠভাবে মাটি ও মানুষের সংগে, খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের সংগে জড়িত ছিলেন । এক্ষেত্রে সুলতানকে ডাচ শিল্পী ব্রুগেলের সংগে তুলনা করা যায় । গ্রামীণ ও কৃষক জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য তাঁর বিপুল খ্যাতি ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীর এ শিল্পী তখনকার সময়ের নেদারল্যাণ্ডের গ্রামীণ ও কৃষি জীবনকে তার ক্যানভাসে চমৎকারভাবে তুলে ধরেন। কৃষক জীবনের নানা বৈচিত্র– বিভিন্ন মৌসুমে মাঠে কাজ করা, বীজ বোনা, ফসল কাটা ইত্যাদি জীবন্তভাবে তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে । এর কারণও ছিল । ব্রুগেলের সময় নেদারল্যাণ্ডের কৃষকদের কঠিন সময় যাচ্ছিল। উৎপাদন ভাল হলেও মালিক শ্রেণীর হাতে তারা শোষিত হচ্ছিল । তারপরও হাসিগানে , উৎসবে , ভোজে তারা জীবন রাঙ্গিয়ে রেখেছিল। ব্রুগেলের বিষয়বস্তুর সংগে সুলতানের ছবির বিষয়বস্তুর চমৎকার মিল রয়েছে । ব্রুগেল যেমন কৃষক ও গণমানুষকে নিয়ে ছবি এঁকেছেন তেমনি সুলতানও গ্রামবাংলার মানুষকে নিয়ে প্রচুর ছবি এঁকেছেন । ব্রুগেলের ‘ হার্ভেস্ট টাইম ’ চিত্রে গ্রীষ্মকালে কৃষকের ফসল কাটার দৃশ্য চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে । এ ছবিতে একটি বিশাল ফসলের মাঠে একজন কৃষক শস্য কাটছে। আর মাঠের এক পাশে গাছের তলায় নানা ভঙ্গিতে বিশ্রামরত কৃষকদের দেখা যাচ্ছে । এ ধরনের বিষয় নিয়ে সুলতানের অসংখ্য ছবি রয়েছে । ব্রুগেলের সংগে সুলতানের পার্থক্য শুধু এটুকু যে সুলতানের ছবির কৃষকরা পেশীবহুল, আর ব্রুগেলের কৃষকরা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের। সুলতানের কৃষকরা বাংলার কৃষ্ণাঙ্গ আর ব্রুগেলের কৃষকরা নেদারল্যাণ্ডের শ্বেতাঙ্গ।তবে কৃষক জীবন নিয়ে আরো অনেকে ছবি এঁকেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মিল , ভ্যান গগ ও কনস্টবল । মিলের একটি ছবির নাম হচ্ছে ‘ প্রার্থনা ' , এটি এক কৃষক দম্পতির ছবি । সন্ধ্যা নেমে আসছে , প্রার্থনায় যাবার সময় হয়েছে। কিন্তু তাদের গির্জায় যাবার সময় নেই । কাজের চাপ প্রচণ্ড । তাই স্বামী - স্ত্রী ক্ষেতের মাঝে দাড়িয়েই প্রার্থনা সেরে নিচ্ছে । কনস্টবল এবং ভ্যান গগের ছবিতেও আমরা কর্মরত মানুষের সাক্ষাৎ পাই । ভ্যান গগের' পটেটো ইটার্স' এ ধরনেরই ছবি । এতে একটি দরিদ্র কৃষক পরিবার আলো আঁধারীতে বসে একনিষ্ঠ মনে আলু খাচ্ছে।

আগেই বলেছি সুলতানের তুলিতে এতদঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রাম, ক্ষুধা ও দারিদ্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে । এক্ষেত্রে তার ' মানুষের মানচিত্র ' চিত্রটির কথা উল্লেখ করা যায় । ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বাহিনী যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল গুয়ের্নিকা গ্রামে বিশ্ব নন্দিত শিল্পী পাবলো পিকাসো তার বিদ্রোহী তুলির আঁচড়ে ‘ গুয়ের্নিকা ' চিত্রে সে ধ্বংসলীলাকে জীবন্ত করে তোলেন । পাবলো পিকাসো তাঁর প্রতিবাদী ক্যানভাসে যে গুয়ের্নিকা সৃষ্টি করেন স্পেনের গৃহযুদ্ধের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গোটা ইউরোপকে বার বার সে চিত্রের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। পিকাসো যেমন তাঁর 'গুয়ের্নিকা' চিত্রে স্পেনের গৃহযুদ্ধের ধ্বংসলীলাকে তুলে ধরেছেন তেমনি সুলতান তার ' মানুষের মানচিত্র ' শিল্পকর্মে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও সংগ্রামের কাহিনীকে তুলে ধরেছেন। গুয়ের্নিকা যেন হিরোশিমা ও নাগাসাকির ভবিষ্যৎ চিত্রকেই ধারণ করেছিল। 'মানুষের মানচিত্র' শিল্পকর্মে সুলতান নিয়ত সংগ্রামশীল বাংলার গণমানুষকে জীবন্ত করে তুলেছেন।

সুলতান মূলতঃ ছবি এঁকেছেন রেনেসাঁসের আদর্শে। এ সম্পর্কে শিল্প সমালোচক শরীফ এ জামান লিখেছেন, রেনেসাঁস চিত্রকলায় পুরুষরা স্বাস্থ্যবান ও পেশীবহুল হিসেবে চিত্রিত। তবে রেনেসাঁস চিত্রকলায় পুরুষরা পেশীবহুল ও স্বাস্থ্যবান হিসেবে চিত্রিত হলেও নারীরা তা নয় । তারা স্বাভাবিক সৌন্দর্যে চিত্রিত । কিন্তু সুলতানের নারীরা পেশীবহুল, তারা কালো, মেদবহুল ও স্থূলকায় হলেও শ্রীহীনা নয়। গৌরবর্ণ হলেই বে সুশ্রী হয়না , শ্যামলা বা কালোর মাঝেও যে এক ধরনের আকর্ষণীয় সৌন্দর্য রয়েছে সুলতানের চিত্রকলা দেখলে তা বোঝা যায়। তাঁর নিপুণ হাতের তুলির স্পর্শে মাংসপেশীর উত্থান পতন সুকৌশলে চিত্রিত হওয়ায় নারীচিত্র আঁকতে গিয়ে নির্দিষ্ট কোনো শাস্ত্রমত বা আদর্শ অনুসরণ না করেও তার দেহগুলো অতি সুকোমল ও জীবস্ত ।

রেনেসাঁসের দ্বিতীয় পর্বের শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মাইকেলএঞ্জেলো এবং রাফায়েলের চিত্রকর্মের সংগে সুলতানের ছবির আঙ্গিকগত মিল রয়েছে। সুলতানের ওপর এঁদের প্রভাব লক্ষণীয় । বিশেষ করে সুলতানের প্রথম রোপণ ' ( First  Plantation ) - কে সিসটিন চ্যাপেলের গম্বুজের মাঝখানে চিত্রিত মাইকেলএঞ্জেলোর ' মহাপ্লাবন ' ও ' জগৎ সৃষ্টি'র দৃশ্যের ধারাবাহিকতা বলা চলে । সিসটিন চ্যাপেলে মাইকেলএঞ্জেলো মূলত : Old Testament থেকে বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন , যদিও সেখানে বাইবেল বহির্ভূত দৃশ্যও ছিল । সেখানে শিল্পী এঁকেছেন অবতারদের চিত্র যারা পৃথিবীতে যীশুর আগমন বার্তা প্রচার করছে। গম্বুজের ঠিক মাঝখানে আছে মহা প্লাবনের দৃশ্য, নৌকায় আশ্রয় গ্রহণ এবং মানুষ ও জগৎ সৃষ্টির দৃশ্য। প্লাবন শেষে পৃথিবী শান্ত হলেও কোথাও প্রাণের চিহ্ন মাত্র নেই । মাটিতে তখনো রুক্ষ্মতা বিদ্যমান, সবুজ নিশ্চিহ্ন, দু'একটি লতাগুল্ম সবেমাত্র এখানে সেখানে জন্মেছে। আদমের নিকট পৃথিবী এক নতুন জায়গা। সুলতানের First Plantation- এ আমরা দেখতে পাই একজন সুঠাম্ পেশীর মানুষ একটি চারা রোপণ করছে আর দু'জন দেবকন্য তাতে জল সিঞ্চন করছে। এ ছবিটিকে মাইকেলএঞ্জেলোর সিসটিন চ্যাপেলের ধারাবাহিকতা হিসেবে ধরা যায়। এর যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণও আছে। মাইকেলএঞ্জেলো যেখানে শেষ করেছেন সুলতান সেখান থেকে শুরু করেছেন। সুলতানের ছবির পেশীবহুল, সুঠাম, শক্তিমান পুরুষটিই আদম যিনি ঈশ্বরের দানে পুষ্ট হয়ে প্রাণহীণ রুক্ষ্ম পৃথিবীর বুকে বৃক্ষচারা রোপণের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারের চেষ্টা করছেন।

সুলতান কেন তার কৃষকদের স্বাস্থ্যবান করে চিত্রিত করলেন তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। শিল্পী এখানে আমাদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের সাথে রাজনৈতিক জটিলতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । আমরা দ্রাবিড় , অস্ট্রিক ও অনার্যদের বংশধর যারা খুব শক্তিশালী ও কর্মঠ মানুষ ছিলেন । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ প্রভু, জমিদার, সামস্ত প্রভু ও বিদেশী প্রভুদের শোষণের ফলে তাদের সে স্বাস্থ্য হারিয়ে যায় । যুগ যুগ ধরে তাদের শ্রমের ফসল অন্যের পেটে চলে যায় । কিন্তু এত কিছুর পরও তারা টিকে আছে জীবন সংগ্রামে হেরে যায়নি । এদের মধ্যে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন কর্মশক্তি আছে, এক ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে এরা ধারণ করে আছে । সুলতান তাদের এ ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও শক্তিকে রং তুলির খেলায় অনুপমভাবে তুলে ধরেছেন। সুলতানের কৃষকরা শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক। ' 'শক্তিই সৌন্দর্য'' সুলতান ছিলেন এ দর্শনে বিশ্বাসী । তাঁর ছবির ক্যানভাসেও তাই ফুটে উঠেছে।

শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে সুলতান মূলতঃ গুস্তাব কোরবে প্রবর্তিত প্রত্যক্ষবাদের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর কৃষকদের চলমান প্রাত্যহিকতায় প্রত্যক্ষ করতেন না। তাঁর দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূর। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তাঁর কৃষকরা তাদের হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাবে। আবার মাঠে মাঠে সবুজ ধান ফলাবে ও গান গাইবে।

১৯৪৬ সালে সিমলায় সুলতানের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় । প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন কাপুরতালার মহারাজা । একজন বিদেশী মহিলা এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেন । এ সম্পর্কে সুলতান শাহাদুজ্জামানের সংগে এক আলাপনে বলেছেন, ‘ঐ প্রদর্শনীটা হয়েছিল একজন বিদেশিনীর উদ্যোগে । ওখানে ( সিমলায় ) আমি ছোটখাট ছবি আঁকতাম । সেগুলো বিক্রির জন্য একটা স্টুডিওতে দিয়ে আসতাম।একদিন সেখানে গিয়ে দেখলাম আমার নামে একজন মহিলা একটি চিরকুট রেখে গেছেন । চিরকুটে লিখেছে আমি যেন তার সংগে দেখা করি । গিয়ে দেখি একজন বয়স্ক অভিজাত মহিলা। সম্ভবত: কানাডীয় ছিলেন । নাম মিসেস হাডসন । পেইন্টিং - এর ভক্ত । মহিলা আমার ছবির খুব প্রশংসা করলেন । বললেন, আমিতো ভেবেছি এসব ছবির শিল্পী আরো বয়ষ্ক কেউ হবেন । তো সে মহিলাই প্রস্তাব দিলেন যে তিনি আমার ছবির একটা একক প্রদর্শনীর আয়োজন করতে চান। ওখানকার মহারাজা প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। প্রদর্শনীতে অনেক গণ্যমান্য লোকের সমাগম হয়েছিল । সকলে ছবির বেশ প্রশংসা করলেন । বেশকিছু ছবি বিক্রিও হল । এভাবেই আমার প্রথম প্রদর্শনী হল । ' সুলতানের জীবনের প্রথম প্রদর্শনীর ছবিগুলো কেমন ছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় । কারণ এ ব্যাপারে লিখিত কোনো তথ্য নেই । তবে সুলতান বলেছেন, তখন তিনি কাশ্মীরের ল্যাগুস্কেপ, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের, কৃষকের, আগেকার দিনের গয়না পরা মহিলাদের ছবি এঁকেছেন । এছাড়া তিনি তখন কিছু বিমূর্ত ও আধা বিমূর্ত ছবিও এঁকেছেন বলে জানান । প্রথম প্রদর্শনীর পর করাচী, লাহোর, নিউইয়র্ক এবং লণ্ডনে সুলতানের মোট বিশটি প্রদর্শনী হয় । এসব একক ও সম্মিলিত প্রদর্শনীর মাধ্যমে সুলতান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিত্রকলার জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন । ১৯৫১ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর সুলতান কোন প্রদর্শনী করেননি । তাহলে প্রশ্ন উঠে সুলতান কি এ সময়ে কোনো ছবি আঁকেননি ? ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে স্বাধীন বাংলাদেশে সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে সুলতান বলেছেন ছবি আঁকা এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলাম । কারণ আমি শিশুদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। সাধারণ মানুষ ছবি আঁকুক ।গ্রামের তরুণ প্রজন্ম ও বাচ্চাদের মধ্যে নান্দনিকতা বিস্তার লাভ করুক এ নিয়েই মত্ত ছিলাম । আমাকে শেষে ছবি আঁকতে ভীষণভাবে আগ্রহী করলো সে সময়কার ইরানী দূতাবাসের কালচারাল এটাসে ভদ্রলোক । তিনি আমার ছবি খুব পছন্দ করতেন । আমাকে বলতে বলতে এক সময় বাধ্যই করলেন ছবি আঁকতে । আমি বহুদিন পর নতুন উদ্যমে অনেক ছবি আকলাম । তার এ দীর্ঘ নীরবতা সম্পর্কে শিল্পী আবুল মনসুর লিখেছেন' বলা যেতে পারে এসময় তার গভর্যন্ত্রণাকাল, যথার্থ শিল্পভাষা অনুসন্ধান ও আত্মআবিষ্কারের রক্তাক্ত সাধনার কাল । কিন্তু তা মনে হয় না । দীর্ঘ ২০ বছর তার অনুশীলন বা অনুসন্ধানের কোনো রেখা চিত্রেরও সন্ধান পাওয়া যায় না । শিল্পের মাধ্যমেই যিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন তার জীবনসত্য ও শিল্পসৃষ্টির মধ্যেই যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন জীবন যাপনের স্বার্থকতা, তার দীর্ঘ তেইশ বছরের নীরবতার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা জানতে পারিনা।' সুলতান সারা জীবনে ২৩ টি প্রদর্শনী করেন । কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ২৪ বছরে তার মাত্র ৩ টি প্রদর্শনী হয়। ১৯৭৬ সালে শিল্পকলা একাডেমী, ১৯৮৭ সালে জার্মান কালচারাল সেন্টার এবং ১৯৯৪ সালে গ্যালারী টোন তার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। গ্যালারী টোনেরটা ছিল সুলতানের ডুইং প্রদর্শনী । তবে এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ প্রদর্শনী । প্রদর্শনী চলাকালে একদিন গ্যালারী টোনে তার সাক্ষাৎকার নিতে যাই । এসময় শিল্পী সুলতান ছিলেন প্রচণ্ড রকম অসুস্থ । আমি তাকে বললাম এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমি আপনার গোটা জীবনকে তুলে আনতে চাই। আমাকে আপনি সেভাবে সহযোগিতা করবেন আশা করি । তিনি বললেন , আমাকে পুরোপুরি জানতে হলে আপনাকে আমার নড়াইলের বাসভবনে আসতে হবে। সেখানে রয়েছে আমার আলাদা এক পৃথিবী, যা দেখে আপনি আমাকে এবং আমার জীবনদর্শন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারবেন । তাঁকে কথা দিলাম আসব। সুযোগ খুঁজছি নড়াইল যাবার। ১৯৯৪ সালে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে একদিন শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগের পরিচালক সুবীর চৌধুরী টেলিফোন করে বললেন ১০ ই আগস্ট সরকারীভাবে সুলতানের ৭০ তম জন্মদিন পালন করা হচ্ছে । সেখানে ঢাকা থেকে কয়েকজন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী যাচ্ছেন। আপনাকেও যেতে হবে । সুবীরদার আমন্ত্রণ পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠল । নড়াইলের বাসভবনে শিল্পী একটি 'শিশু স্বর্গ' তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি শিশু কিশোর , পশু - পাখি , প্রকৃতি ও নিসর্গের সঙ্গে মিতালী করে সময় কাটাতেন । সেখানে তার একটি নৈসর্গিক বাগানবাড়ী ছিল । চিত্রা নদীতে ছিল তার একটা নৌকা । এতে তিনি শিশুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ১০ ই আগস্ট বৃষ্টিস্নাত সকালে চিত্রা পাড়ের এ গ্রামটিতে বসে শিল্পীর জন্মদিনের জলসা। জন্মদিনকে ঘিরে শিল্পীর ভুবনে বসে শিশু - কিশোরদের আনন্দ মেলা। সকাল থেকেই অগণিত শিশু - কিশোরের কলকাকলিতে এবং পশু - পাখির বিচিত্র শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে সুলতানের শিল্পাঙ্গন । বরণ্যে শিল্পী সুলতানের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করে । ঢাকা থেকে যাওয়া আমরা সাংবাদিকরা যশোর হতে সকাল ৮ টায় নড়াইল পৌছে যাই । শিল্পীর ভুবনে প্রবেশ করে দেখি অসুস্থ শিল্পী একটি বিশাল খাটের ওপর বসে আছেন । অসংখ্য শিশু তাঁকে চারদিকে ঘিরে আছে । কেউ শিল্পীকে হাত দিয়ে আদর করছে । কেউ চুমো খাচ্ছে । মনে হচ্ছে শিল্পী যেন ফুলের মেলায় বসে আছেন । প্রতিটি ফুটফুটে শিশুকে একেকটি ফুলের মতই দেখাচ্ছিল । সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য । যা শুধু চোখ দিয়ে দেখা যায় , ভাষায় প্রকাশ করা খুবই কঠিন । পরিবেশ আমাকে আবেগতাড়িত করে তোলে । পেশাগত পরিচয় ভুলে গিয়ে আমিও খাটে উঠে পড়লাম । শিশুদের প্রিয় 'দাদু' সুলতানকে জড়িয়ে ধরলাম । এরমধ্যে অসংখ্য শিশুর চাপে খাটটি মড়মড় করে ভেঙে গেল । আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে পড়লাম । নিজেকে খুব অপরাধী মনে হল । আমার অসহায় অবস্থা দেখে সহকর্মী বন্ধুরা মৃদু হাসলেন । এরপর শিশুদের কলহাস্যের মধ্যেই শুরু হল সাংবাদিকদের সঙ্গে শিল্পীর একান্ত আলাপচারিতা । এতে শিল্পীর বিশাল কর্মময় জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হয় । শিল্পী ধীরস্থির ভাবে সাংবাদিকদের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেন । জীবনের ৭০ তম জন্মদিনে পা দিয়ে আজ তার মনের অনুভূতি কি জিজ্ঞাসা করা হলে শিল্পী বলেন : ' জীবনের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে । আসলেও আমি আমার স্বপ্ন অনুযায়ী কিছুই করতে পারিনি। আমি শুধু নড়াইলের কিছু শিশুকে নিয়েই পড়ে আছি । তিনি বলেন , যারা জীবনে বৃহৎ কাজ করেন জন্মদিনে তারা তাদের মনের অনুভূতির কথা বলেন। ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণ করেন । আমারতো এখনও কোনো মহৎ কর্ম করা হয়নি, যা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। আপনাদের ভালবাসা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া । জন্মদিনে আপনারা আমার এখানে ছুটে এসেছেন সেজন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ । ' তার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া কি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ইউরোপ এবং আমেরিকা আমাকে চেনে এবং জানে এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া । এক সময়ে আমি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি , প্রদর্শনী করেছি । বরেণ্য শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলেছি । এসব স্মৃতি আমাকে আনন্দ দেয় । আপনার কোন স্বপ্ন অপূর্ণ রয়েছে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি দুঃখ করে বলেন , ' শিশু স্বর্গ ' তৈরির জন্য তাকে একাই লড়ে যেতে হচ্ছে । এক্ষেত্রে কেউ সহযোগিতা করছে না । জীবনের সঙ্গে শিক্ষাকে , শিল্পকে মেলানোর বিষয়টা কেউ বুঝাতে চাইছে না । ক্ষোভের সঙ্গে সুলতান আরো বলেন, আমরা দেশে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চাই । কিন্তু শুধু শহরকে নিয়েই দেশ নয়। আমাদের জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ গ্রামে পড়ে আছে । তাদের উন্নয়ন ছাড়া দেশের সার্বিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় । কিন্তু এই বিষয়টি কেউ বুঝতে চাইছে না । তার মৃত্যুর পর তাঁর এই ভুবন এবং এই সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা কিভাবে চলবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন , আমার এসব সম্পদ একটি ট্রাস্ট গঠন করে সরকার পরিচালনা করুক তাই চাই । শিল্পকলা একাডেমী থেকে মাসিক যে ভাতা পান তাতে চলে কিনা জানতে চাওয়া হলে সদা বিনয়ী শিল্পী সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যান । তিনি শুধু বললেন, 'আপনারাতো দেখছেন এখানে আমার কত খরচ '। কথার ফাকে ফাকে শিল্পী খাটের নিচে শুয়ে থাকা তার প্রিয় কুকুরটির খোজ নেন, বৃষ্টির মধ্যে সেটা বাইরে চলে গেছে কিনা । এ জন্য তাকে বারবার আশ্বস্ত করতে হচ্ছে । এদিকে অসুস্থ শিল্পীকে আর বেশী কথা না বলানোর জন্য ভেতর থেকে শিল্পীর সেবা শুশ্রুষাকারী নীহারবালা আমাদের বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন । চিরকুমার এই মহান মনীষীর কাছে আমাদের সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল কেন বিয়ে করেননি । তিনি বললেন , জীবনের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এসে আজ প্রশ্নটি আমার নিজেরও। কেন বিয়ে করিনি ? জীবনের প্রথম দিকে ভাবতাম বিয়ে করলে আমার শিল্পী জীবন ব্যাহত হতে পারে । আমি আত্মকেন্দ্রিক ও বৈষয়িক হয়ে যাব । আমি আমার শিল্পের সাধনা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবো । কিন্তু আবার যখন দেখি পৃথিবীর আনেক বড় বড় শিল্পী বিয়ে করেছেন, সংসার করেছেন এবং তাদের ছেলেমেয়ে আছে তখন আমি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাই না । নন্দিত শিল্পী সুলতান মৃদু হেসে বলেন, আসলে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার নিজের কাছেও নেই ।১৯৯৪ সালের ১০ আগস্ট বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে সুলতানের নড়াইলের বাসভবনে শিল্পীর ৭০ তম জন্মদিন পালিত হয় । ছবিতে অসুস্থ শিল্পীকে ঢাকা থেকে আগত জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে দেখা যাচ্ছে । এটাই ছিল সুলতানের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles