মুকুটহীন সুলতান

মুকুটহীন সুলতান
বুলবন ওসমান 

গত বছরের আগস্ট মাসের কথা। চারুকলা বিভাগের পরিচালক সুবীর চৌধুরী শিল্পকলা একাডেমী থেকে ফোন করে : স্যার , আমরা শিল্পী এস.এম. সুলতানের সত্তরতম জন্মবার্ষিকী পালন করব নড়াইলে, আপনাকে অন্যতম আলোচক হিসেবে রেখেছি, আপনাকে যেতে হবে।

আমি জানতে চাই আর কে কে যাবেন । সাদেক খান সাহেব আছেন, আসাদ চৌধুরী আর কেরামত মওলা, সুবীরের উত্তর।

দলটি ভালো লেগে গেল। অনুষ্ঠানটিও মঙ্গলসূচক ।আর ঢাকার বাইরে যাবার ডাক এলে আমার এমনিতে কেন জানি খুব ভালো লাগে ।

রাজি হয়ে গেলাম ।

যাবার দিন ঘনিয়ে এলো। ৯ই আগস্ট বেলা আড়াইটায় শিল্পকলা একাডেমী থেকে হবে যাত্রা।

দুপুরের আহার সেরে শিল্পকলা একাডেমী।

দু'টি গাড়িতে রওনা।

সাংবাদিকদের নিয়ে একটি মাইক্রোবাস। আর একটি কার । পর্যটনের। এসি লাগান। কারে আমি, সাদেক খান, কেরামত মওলা, আসাদ চৌধুরী আর সুবীর।

ঢাকা শহর ছাড়িয়ে গাড়ি সাভারের পথে এগিয়ে চলে । সাভারের ভূ - দৃশ্য গজারি গাছের জন্যে ইউরোপের মত লাগে । উঁচু-নীচু ভূমি, গড়ের চরিত্র ধরে কেমন একটা অচেনা ভাব তৈরি করে।মনে হয় এ-অঞ্চল যেন বাংলাদেশের নয়। কোনো শিল্পী এখানের ভূ-দৃশ্য আঁকলে লোকে হয়ত বলবে বিদেশী ছবির নকল। এমনি একটা সাজান -গোছান ভাব।

আমরা সাভার ছাড়িয়ে নয়ারহাটের কাছে পৌঁছেছি আর আকাশ কালো করে নামল ঘন বৃষ্টি । বাংলার সে এক অপরূপ রূপ । পিচঢালা রাস্তা ঝকঝক করছে জলে ভিজে। রাস্তার দু'পাশের নীচু জায়গায় কলমি আর নানা রকম জলজলতা সবুজে ছেয়ে রয়েছে । মাঠে পাট ক্ষেতও হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে ।

আরিচা ঘাটে আসতে আসতে বৃষ্টি থেমে গেল। পড়ন্ত বিকেল। নদীর ঘাটে হু হু হাওয়া । আমরা অল্পক্ষণের মধ্যে ফেরিতে। প্রথম ফেরিটিই পাওয়া গেল । ভরা নদীর ঘোলা জল কেটে ফেরি চলল দৌলতদিয়া অভিমুখে ।

নদীতে বেশ বড় বড় ঢেউ । বিশাল জলরাশি দেখে সবাই ভাবের রাজ্যে আনাগোনা শুরু করে। এরি মধ্যে শশা , ডাব ইত্যাদি ফলের সদব্যবহারও করে কেউ কেউ ।

ভাটিতে থাকায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা দৌলতদিয়া পৌঁছে গেলাম।

আমার ধারণা ছিল না যে এদিকের রাস্তা ঘাট এতটা উন্নত হয়েছে। আগে এখানে অনেকটা জায়গা হেঁটে তারপর বড় রাস্তায় উঠতে হতো।

চমৎকার প্রশস্ত রাস্তা, মসৃণ, দু'পাশ ঢালু ... আধুনিক প্রযুক্তির ছাপযুক্ত।

দেখতে দেখতে আমরা রাজবাড়ীর কাছে পৌঁছে গেলাম। রাজবাড়ী জেলা-শহরের কিছু কিছু সরকারি ভবন চোখে পড়তে লাগল। আগে এ- সব অজ পাড়াগাঁ হিসেবে প্রায় পরিত্যক্ত ছিল।

সন্ধ্যার দিকে আমরা ঝিনাইদহ পৌঁছাই।

একটি মিষ্টির দোকানে সুবীর আমাদের বৈকালিক আপ্যায়নে নেয়।

এখানকার কাঁচা গোল্লা বেশ তাজা। পাউডার দুধে মিষ্টি তৈরি হয় না । বেশ ভালো স্বাদের । দামও ঢাকার তুলনায় অনেক কম।

প্রায় ন'টার দিকে আমরা যশোর পৌঁছাই।

সাংবাদিকরা এখানকার সার্কিট হাউসে থাকবে। আমরা এক কাপ চা পান করে নড়াইলের উদ্দেশে রওনা দিই।

নড়াইলগামী রাস্তাটা আগের মত প্রশস্ত নয় এবং কার্পেটিং -ও অমসৃণ । মহকুমা থেকে জেলা হবার ফল।

এই সব অঞ্চল আবার সর্বহারা পার্টির সদস্যদের দখলে, তাই কেউ কেউ আমাদের এই নৈশযাত্রাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। যখনি দু'চার জন লোক দেখা যায় রাস্তার পাশে কেউ বলে ওঠে, এই ধরল..... সমস্ত রাস্তাটি প্রায় ফাঁকা মাঠের মাঝ দিয়ে । বসতির চিহ্ন কম । দূরে দুএকটা ঘর থেকে বাতির আভাস পাওয়া যায় ।

নড়াইল অঞ্চলটিকে আমার দরিদ্রই মনে হলো।ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে রাস্তার পাশে যেমন চমৎকার চমৎকার দু' একটা বাড়ি দেখা যায় তেমন কোনো বাড়ির চিহ্ন নেই।

কথাটা আমি সাদেক ভাইকে বলেই ফেলি।

তিনি বললেন, যশোর কলকাতার খুব কাছে ছিল তো তাই এখানকার পয়সাওলা লোকেরা সব সম্পদ কলকাতায় ঢেলেছে। এদিকে কিছু করেনি । আর এখানে কোনো ইন্ডাস্ট্রিও গ্রো করেনি। এটাও একটা কারণ।

প্রায় দশটা সাড়ে দশটার দিকে আমরা নড়াইল সার্কিট হাউসে পৌঁছলাম । লম্বাটে দোতলা নতুন বাড়ি। দোতলায় উঠতে উঠতে প্রস্তর ফলকে দেখলাম নির্মাণের সময়। মাত্র বছর দুয়েক হয়েছে, এখনো ভবনের মধ্যে একটা নতুন গন্ধ ।

আমি আর সাদেক ভাই এক কক্ষে । পাশের কক্ষে কেরামত আর আসাদ চৌধুরী।

সার্কিট হাউসের সামনে দেয়ালের পাশে ইউক্যালিপটাসের সার। একটি বাঁধান পতাকা উত্তোলনের মঞ্চ। পাশে একটা জলাভূমি । তারপর ধানক্ষেত, বসতি।

খানিক পর আমাদের খাবার ডাক পড়ল। নীচে প্রশস্ত খাবার ঘর। বড় টেবিল । গরম ভাত, ঘনডাল, রুইমাছ .. তৃপ্তিকর খাবার ।

রাত্রে সাদেক ভাই পত্রিকার ফিচার তৈরির জন্যে অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় বসে কাজ করলেন।একে নতুন জায়গা, তায় স্পঞ্জের বিছানা.... অনেক রাত পর্যন্ত আমারও ঘুম আসে না।

সকালটা বড় চমৎকার।

সাদেক ভাই প্রভাতফেরিতে বেরিয়ে গেলেন। আমি উঠি ছাদে। দিগন্ত ছুঁয়ে সকালের ফর্সাভাব। পূবাকাশে মেঘ থাকায় সূর্যালোক বন্ধ। একটা শীতল হাওয়ার স্রোত ইউক্যালিপটাসের মাথা দুলিয়ে চলেছে। পাতায় পাতায় ঝির ঝিরে আওয়াজ। পাশের জলাভূমিতে ক্ষীণ-তরঙ্গ।

সকালটা ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করায় ব্যস্ত।

নড়াইলের ভূ - দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সাযুজ্যময়। আমাকে গৃহাভিমুখিনতায় পেয়ে বসে।

বেলা আটটার দিকে কৃষি মন্ত্রী আসলেন।

সার্কিট হাউস সরগরম।

বেলা দশটায় শিল্পী সুলতানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন।

প্রায় দশটা বাজে । আমরা সুলতান সাহেবের বাসা অভিমুখে রওনা দিই।

সার্কিট হাউস থেকে খুব কাছেই ওঁর আবাস।

রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত বিদ্যালয়ের বালকরা দুই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

অনেক লোক। শহরের লোক দল বেঁধে বাড়ির দিকে যাচ্ছে।

পুরো ব্যাপারটাই একটা বড় উৎসবের রূপ নিয়েছে।

আমরা সুলতান সাহেবের বাড়ি অভিমুখে এগোই।

দোতলা বাড়ির নীচতলায় তিনি একটি তক্তপোষে বসে। আমরা ঘরে প্রবেশ করি লোকজনের ভীড় কাটিয়ে।

আসাদ চৌধুরী আমার নাম বললেন, বুলবন ওসমান ।

সুলতান সাহেব স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

বললেন, ভালো আছো তো বাবা ! সে কন্ঠে অদ্ভুত এক আন্তরিকতা।

তাঁর শরীরের অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। কেন জানি মনে হচ্ছিল তিনি আর বেশী দিন আমাদের মধ্যে থাকবেন না।

রাত্রেই শুনেছিলাম ওঁর খুব শরীর খারাপ এবং হাঁপানির টানটা বেড়ে গেছে। আমরা বেরিয়ে পড়ি। পেছনে আরো দর্শনার্থীর চাপ।

অনুষ্ঠান যেখানে হবে আমরা গিয়ে সেখানে বসি। শুনলাম এটা ওঁর শিশু - স্বর্গের বিদ্যালয় । শুধু দুপাশের দেয়াল উঠেছে । তার ওপর টিন চাপিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন।

চালার পাশে ভাঙ্গা ইটের স্তূপ। শুনলাম এখানকার জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে এই বিদ্যালয় নির্মাণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একটা পুরোনো ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগছে।

সব কিছু ছাপিয়ে দীনতা প্রকটভাবে জানান দিচ্ছে। শিশু - স্বর্গে স্বর্গের কণামাত্র উপস্থিত নেই।

প্রায় এগারটার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আমরা আলোচক, মন্ত্রী ও জেলা প্রশাসক মঞ্চে গিয়ে বসি।

শিল্পী সুলতানকে চেয়ারে বসিয়ে আনা হোলো। তাঁকে দেখাশোনা করেন যে মহিলা তিনি পেছন থেকে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।

বক্তাদের মধ্যে আসাদ চৌধুরী খুব আবেগধর্মী বক্তৃতা দেন। আমার যখন ডাক আসে প্রথমে পুরোনো কথা বলি। মনে পড়ে প্রথম এশীয় দ্বি - বার্ষিক প্রদর্শনীর সময় একটি ক্যাসেট নিয়ে সুলতানের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম । কিন্তু দুঃখের বিষয় টেপ চালিয়ে দেখি যান্ত্রিক গোলযোগের জন্যে কিছুই ধরা পড়েনি।

নড়াইলবাসীদের সেই দুঃখের কথা জানাই। আরো বলিঃ দেখুন, আমরা রাজধানীতে বসবাসকারীরা মফস্বলের ডাকে খুব একটা নড়ি না, কিন্তু শিল্পী সুলতানের জন্মদিন আমাকে নড়াইল নিয়ে আসলো। আরো বলি, দেখুন শিল্পী সুলতান বাংলার চাষীদের শুধু বড় করে দেখান নি, এর সব কাজকর্মই ছিল তাঁর কাছে বড়।বাংলার লাঠিয়ালদেরও তিনি বড় করে দেখেছেন। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে ম্যামথ শিকার থেকে শুরু করে চর দখল পর্যন্ত জীবনযুদ্ধের এপিঠ - ওপিঠ।

প্রচুর গরম থাকায় আমি বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করি।

জেলা প্রশাসক এবং মন্ত্রী সরকার কি কি করেছেন এবং করবেন তার একটা ফিরিস্তি দেন।

সব শেষে শিল্পীকে সবাই কিছু বলার জন্যে অনুরোধ করে।

শিল্পী সুলতান সবার অনুরোধে বলতে শুরু করেন। তিনি বলেন : প্রতিটি শিশু জন্মায় বিকাশ লাভ করার জন্যে। কিন্তু আমরা তাদের বিকাশের পরিবেশ দিতে পারি না।

শ্যাওলা ও পাথরের মধ্যে যে গাছ বেড়ে ওঠে তাদের গায়ের রঙ যেমন ঐ জায়গার মত হয়ে ওঠে, শিশুরাও তেমনি যে জায়গায় থাকে সে ভাবে বেড়ে ওঠে।

তিনি কথাগুলো এমন করে বলছিলেন তা যে কোনো দার্শনিকের উপলব্ধির চেয়ে কম ছিল না । আমি অবাক হচ্ছিলাম । এমনিতে তিনি কথা খুব সুন্দর করে বলতে পারেন, কিন্তু জীবনের শেষ পাদে এসে তা অন্য এক মাত্রা লাভ করেছে।

তার ভাষণ ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত।

শরীর তাঁকে বেশি কিছু করার অনুমতি দিচ্ছিল না।

আমরা বিদায় নিয়ে তখনি সার্কিট হাউস। কালক্ষেপ না করে আহার।গাড়িতে উঠে বসতেই ঢাকার উদ্দেশে গাড়ি ছেড়ে দেয় । রাত্রের মধ্যেই সব খবর জায়গা মত পৌঁছে দিতে হবে । টিভি ও খবরের কাগজ যাতে সব কভার করতে পারে ।

দু'মাস যেতে না যেতেই ১০ ই অক্টোবর খবর পেলাম বিকেলে সুলতান সাহেব ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

তখন মনে হলো বারেক শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। না হয় আর কোনোদিন দেখা হতো না।

কানে আজো বাজে সেই কন্ঠস্বরঃ ভালো আছোত বাবা!

বাংলার রূপকারদের মধ্যে জয়নুল, কামরুলের সঙ্গে আর একটি নাম সব সময় উচ্চারিত হবে — যিনি মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মাননি; তিনি বাংলার মুকুটহীন সুলতান।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles