শেখ মুহম্মদ সুলতান

শিল্পী শেখ মুহম্মদ সুলতান চলে গেলেন। জানতাম যে তিনি অসুস্থ। এও জানতাম যে, বিগত কিছুকাল ধরে তিনি মাঝে মাঝেই শারীরিক দিক থেকে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পতিত হচ্ছিলেন। তবু তিনি যে সত্যি সত্যি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে যাবেন তা কখনো ভাবিনি।সুলতান ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ। শিল্পী হিসেবেও নানা দিক দিয়ে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। কী উদ্দাম জীবন কাটিয়েছেন এক সময় ! পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে, কাশ্মীরে, বাংলাদেশের ঢাকায় চালচুলোহীন ঠিকানাহীন প্রায় যাযাবর জীবনযাপন করেছেন তিনি। আর ছবি এঁকেছেন। অজস্র ছবি। ছোট বড়, প্রকৃতির,মানুষের। সিমলায় প্রদর্শনী করলেন ১৯৪৫ সালে, লাহোরে ১৯৪৮ সালে আর করাচীতে ১৯৪৯ সালে। বেশির ভাগই বাংলা ও কাশ্মীরের নয়নাভিরাম ল্যাগুস্কেপ,কিছুটা আদর্শায়িত। জল রং-এর কাজ ও তৈলচিত্র। মানুষের কিছু ফিগারস্টাডিও ছিল, ড্রাইপয়েন্ট রেখাচিত্র আর ক্রেয়নের কাজ। বিশাল প্যানেলও ছিল। শিল্পসমালোচক সৈয়দ আমজাদ আলী ১৯৫২ সালে শিল্পী এস. এম. সুলতান সম্পর্কে লিখেছিলেন, “অতীতে তিনি কি ধরনের ছবি আঁকতেন জানি না, শুধু জানি জীবন থেকে নেয়া অনেক ছবি তিনি এঁকেছেন। এখন তিনি প্রধানত বাংলা ও কাশ্মীরের নৈসর্গিক ছবি আঁকছেন কিন্তু গত চার বছরের মধ্যে তিনি কাশ্মীর যান নি। বাংলায় যাননি ত বারো বছর। তাই তাঁর সব ছবিই স্মৃতিনির্ভর। ...বাংলার নিসর্গ দৃশ্য প্রধানত জল রং-এ করা। সেখানে অথৈ জলের বিস্তার আর আকাশ, বিলীয়মান দিগন্ত, তাল গাছ, নৌকা, জেলে, কুঁড়েঘর—শান্ত পল্লীর মায়াবী পরিবেশ। কাশ্মীরের নিসর্গ দৃশ্য সাধারণত তেল রং-এ করা। সেখানে গাঢ় বেগুনি পাহাড়, বিচিত্র লতাগুল্ম ও বৃক্ষরাজি, হ্রদ ও স্রোতস্বিনীর বর্ণাঢ্য উচ্ছলতা।তবে সুলতান শুধু ল্যাগুস্কেপচি ত্রকরই নন। সম্প্রতি তিনি দুটি বিরাট প্যানেলে একরাশ উদ্বাস্ত ও দারিদ্র্য লাঞ্ছিত জনগোষ্ঠীর ছবি এঁকেছেন। মানবমূর্তির রেখায়নে কঠিন নির্বাচন, বিরাটত্ব ও দপ্তভাবারোপ এবং সর্বোপরি মানবিক মমত্ববোধ ও ট্র্যাজেডির আভাস তাঁর বিকাশমান দক্ষ হাতের স্বাগতিক স্বাক্ষর বহন করছে।” আমজাদ আলী তাঁর লেখাটি শেষ করেছিলেন এইভাবে : “আমার মনে হয় সুলতান কারিগরি কৌশলের দিক থেকে তাঁর সাফল্য অর্জন করেছেন। এখন দরকার মহৎ আইডিয়া আর জীবনের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাবলী, যার মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন চিত্রকলার

মাস্টারপীসসমূহ।” ভবিষ্যদ্বাণীই করেছিলেন আমজাদ আলী। পঞ্চাশের দশকেই সুলতান যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচটি এবং বিলেতে চারটি প্রদর্শনী করেন। এর মধ্যে একটি ছিল যৌথ প্রদর্শনী, যেখানে পাবলো পিকাসো, সালভাদর দালি, মাতিস, ব্রাক ও ক্লীর মত বিশ্বনন্দিত আধুনিক সেরা শিল্পীদের চিত্রকর্মের সঙ্গে প্রদর্শিত হয় শেখ মুহম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম।কিন্তু আমরা বাংলাদেশের মানুষ তখনো তাঁর কথা বিশেষ কিছু জানতাম না। সে সুযোগ ঘটলো দেশ স্বাধীন হবার পর। ১৯৭৬-এ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে তাঁর একটি চিত্র প্রদর্শনী হল। বড় প্রদর্শনী। তখনো ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়নি। আমি তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই ১৯৮৭ সালে, যখন ঢাকাস্থ গ্যোয়েটে ইন্সটিটিউটে তাঁর কাজের একটি সাড়া জাগানো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এর আগেই অবশ্য আমি সুলতানের শিল্প প্রতিভার কথা জানতে পাই, তাঁর বেশ কিছু কাজ দেখি, তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করি। ১৯৮৭ সালের প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় আমি একটা ছোট লেখাও লিখেছিলাম। আজ তিনি চিরবিদায় নেবার পর নানা ব্যক্তিগত স্মৃতি মনে জেগে উঠছে।গত তিন বছরের মধ্যে আমি একাধিকবার নড়াইলে তাঁর বাসায় গিয়েছি। সে এক আশ্রমের মতো পরিবেশ। গাছ-গাছালিতে পূর্ণ। পোষা কুকুর, বিড়াল, বেজী,খরগোস, বানর আর কয়েক রকম পাখি নিয়ে চিত্রা নদীর তীরে চিরকুমার সুলতান যে জীবন যাপন করছিলেন, গভীর প্রশান্তির মধ্যে, তা আমার মত সদাব্যস্তম হানগরীর মানুষের কাছে খুবই ব্যতিক্রমী মনে হয়েছিল। তাঁর দেখাশোনা করতেন নীহারবালা আর নীহারবালার কন্যা। সুলতানই তাদের চরম দুর্দিনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তারাও শেষ দিন পর্যন্ত সুলতানকে গভীর মমতার সঙ্গে সেবাযত্নক রেছেন। আমি বার তিনেক নড়াইলে সুলতানের বাসভবনে গিয়েছিলাম, প্রতিবারই কয়েক ঘণ্টা ছিলাম সেখানে, গল্প করেছি, একসঙ্গে বসে খেয়েছি। নীহারবালা কী তীক্ষ্ণ সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখতেন সুলতানের সুখ-সুবিধার ব্যাপারে তা দেখেছি।হাঁপানির অবস্থা কেমন আছে জেনে নেয়া, ওষুধ ঠিক সময়ে তাঁর সামনে সাজিয়েরাখা, খাবার সময় জিনিসপত্র এগিয়ে দেয়া, স্নানের সময় গায়ে পানি ঢালা, পরে তাঁর দীর্ঘ চুল মুছে আঁচড়ে দেয়া—সব করতে দেখেছি ওই মহিলাকে।সুলতানের জীবনের শেষ কয়েক বছরের স্বপ্ন ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করা। গ্রামের অবহেলিত বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য। ছবি আঁকা শেখানো,তাদের চিত্তে সৌন্দর্যের বোধ জাগানো, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি “শিশু স্বর্গ” নামে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার কাজে নিজেকে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। সুলতান নিজে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁর“শিশু স্বর্গ” দেখিয়েছিলেন। তাঁর বাসভবন সংলগ্ন একটি ঘরে ও বারান্দায় যেখানে ছোটরা তাঁর তত্ত্বাবধানে ছবি আঁকে তাও দেখিয়েছিলেন। তাঁর আরেকটি চমৎকার পরিকল্পনা ছিল। বিশাল একটি নৌকা তৈরি করিয়েছিলেন। চল্লিশ-পঞ্চাশ জন বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী ওই নৌকায় চড়ে নদীপথে ঘুরবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি, আকাশ, তীরের গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষজন, খেতখামার,গরুছাগল, পাখ-পাখালি দেখবে, তাদের ছবি আঁকবে। আমি যখন নৌকাটা দেখিতখন নৌকা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। ওইসব স্বপ্ন নিয়েই সুলতান বিভোর।এই মানুষকে ব্যতিক্রমী মানুষ না বললে কাকে বলবো? ততদিনে তো স্বদেশে তিনি বিরাট সম্মানের আসনে আসীন। ১৯৮২ সালে লাভ করেন একুশে পদক। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত রেসিডেন্ট আর্টিস্টের সম্মান প্রদান করেন। তিনি রাজধানী শহর ঢাকায় আমৃত্যু বিশেষ ব্যবস্থায় থাকতে পারতেন, কিন্তু চিত্রা নদী তীরবর্তী তাঁর শান্ত শ্রীমণ্ডিত গ্রামীণ আবাসটি তিনি ছেড়ে থাকতে পারলেন না। তিনি দূরে থাকতে পারলেন না তাঁর “শিশু স্বর্গ” থেকে, তাঁর স্বপ্নের নৌকা থেকে।জীবনের শেষ দশ বছরে তিনি থেমে থেমে ও সময় নিয়ে আঁকলেও খুব কম সংখ্যক ছবি আঁকেননি। বেশ কয়েকটি বিশালাকার ক্যানভাস এঁকেছেন এই সময়ে এবং সেসব কাজেও, তাঁর আগের কাজের মতোই, আমরা লক্ষ্য করি ব্যতিক্রমী শিল্পী সুলতানকে। আর কারো মতোই নন এই শিল্পী। তিনি তাঁর ছবিতে স্বপ্নকল্পনা ও বাস্তবতা, পুরনো দিনের স্মৃতি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর চাষীরা, চাষী রমণীরা, জেলেরা, আঁশবটিতে মাছকাটা জেলেনীরা বিপুলদেহী, তাদের মাংসপেশী স্ফীত, শরীর গিটপড়া। এক পলকের দৃষ্টিতেই মনে হয় কী সাহসী, প্রত্যয়ী, পরিশ্রমী, সকল প্রতিকূলতার মোকাবিলায় কী দৃঢ়সংকল্প। হয়ত বাস্তব এ্যানাটমির নিরিখে ভুল আছে এসব মানবদেহের চিত্রায়নে, কিন্তু সুলতান সচেতনভাবেই সে সবের প্রতি নজর দেননি।তাঁর অন্বিষ্ট ছিল ভিন্ন জিনিস। ১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যোয়েটে ইন্সটিটিউটে সুলতানের চিত্রপ্রদর্শনী উপলক্ষে ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা পিটার জেভিটস যা বলেছিলেন এ প্রসঙ্গে তা উল্লেখ করা যায়। জেভিস বলেছিলেন, “এই উপমহাদেশের গুটিকয়েক অসামান্য শিল্পীর মধ্যে সবচাইতে জমকালো সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর।সুলতানের শক্তির উৎস তাঁর টিকে থাকার ক্ষমতায়। যেসব মানবমূর্তি তিনি রচনা-করেছেন, সেসব জীবনযুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার বার্তাবহ। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশীদের টিকে থাকার ক্ষমতা ছাড়া তেমন কিছু নেই। তাই সে সব ছবিতে এ জাতির স্বকীয়তার প্রতীক সনাক্ত করা যায়।”ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্পী সুলতান কিন্তু একান্তভাবে বাংলাদেশেরই শিল্পী। তাঁর আঁকা চাষী জেলেরা বাস্তবের চাইতে বিস্তৃততর, বেশি পেশীবহুল, বেশি কর্মতৎপর, যৌথ উদ্যোগে বেশি সমর্পিত, যেমন শান্তির সময়ে ফসল ফলানোর কাজে তেমনি বিপ্লব,উপ-বিপ্লব, বিদ্রোহের সময় প্রবল প্রতিরোধে। বাঙালি তাই তো ছিল, তা না হলে কেমন করে টিকে আছে আজও, এতো বিপর্যয়ের পরে? আবারো বাঙালি,বাংলাদেশের মানুষ, ওই রকম হবে। সুলতান ওই স্বপ্নই দেখতেন। ১৯৮৭ সালের প্রদর্শনী উপলক্ষে রচিত জাতীয় প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের একটি মন্তব্যে সেই ইঙ্গিতই বিধৃত। প্রফেসর রাজ্জাক লিখেছিলেন, সুলতানের ছবির জগতে যাদের দেখি তারা বাংলার সাধারণ মানুষ। এইসব সাধারণ মানুষকে অসাধারণ করে দেখার ক্ষমতাই ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।”সুলতান আর আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর ছবি আছে। আর আছে মানুষ সুলতানের স্মৃতি। দুই-ই আমাদের অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫


Share

Recent Comments

Recent Articles