শিল্পী সুলতানের কিছু স্মৃতি কিছু কথা

বিশ্বনন্দিত চিত্রশিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতান চলে গেলেন । সুলতান চলে গেলেন জড় কালিমার বাকা সংসারের এপার থেকে আলোয় ঝলমল্ আরেক পৃথিবীতে । যে পৃথিবীতে খ্যাতি আর অখ্যাতি পাওয়া আর না পাওয়ার কোনো হিসেব মেলাতে হয় । না যেখানে নেই সময় আর অসময়ের কোনো দ্বন্দ্ব । যেখানে আছে শান্তি ; শ্রান্তি ও ক্লান্তি অপনোদনের অখন্ড অবিরাম প্রতিবেশ । তাই আজ আর সুলতানের মহাযাত্রায় বিগলিত অণুধারে নমিত হবো না । বরঞ্চ তাঁর স্মৃতি আলোচনা করবো । মোহাম্মদ সুলতান বিশাল বটবৃক্ষের মতো । বিরাট মহীরুহ । সারা পৃথিবীর জড়তা ও দৈন্যের বিরুদ্ধেই যেন তিনি নীরব ভাষাচারী । তার উচ্চারণ ছিলো ধীর ও সুরের ব্যঞ্জনায় মথিত , তেমনি নিরাপোষ ও বিপ্লবী । বিপ্লবী বলবো এ জন্য যে , স্বপ্ন ছিল তার জড়তা ও মিথ্যাকে গুড়িয়ে সুন্দরের সৃজন করা । সুলতানকে নিয়ে অনেক কথা বলার আছে । অসংখ্য পংক্তি সাজানোর প্রেরণা জাগে মনে । ইতোমধ্যে কিছু পংক্তি রচনার কাজ শেষও করেছি । বাংলাবাজারের একটি বড় প্রকাশনা মালিকের উদ্যোগে লিখেছিলাম ছোটদের সুলতান । প্রায় ৩ বছর আগের লেখা । সুলতান ভাই তা জানতেন । আশা করেছিলেন তিনি পুস্তকটি প্রকাশ হোক । কিন্তু একটি বিশেষ কারণে প্রকাশক বিনীত পত্রে তার প্রকাশনার অক্ষমতা জানিয়েছেন । সুলতান ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ দিনের চলাফেরায় ও আলাপচারিতায় তার বহু সংঘাতের সফল জীবনের কাহিনী শুনেছি — মনে রেখেছি শেষ দিকে লিখে ও টেপ করে পুস্তক সাজিয়েছিলাম , শিল্পী সুলতানের আত্মকথা । এ ছাড়া তার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুতেও লিখেছি কয়েকটি প্রবন্ধ ও কবিতা । আজ আর ঐভাবে নয় । আজ লিখবো শিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতানের কিছু স্মৃতিকথা । সব কথা লেখার ও বলার সুযোগ নেই এখানে । তবু খন্ড মেঘের কণা বৃষ্টির মতো যদি সুর তোলে । আমি যখন নড়াইল জেলার কলাবাড়িয়া পূর্বপার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬ ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র তখন লাল মিয়া নামের এক অদ্ভুত লোকের কথা কলেজ পড়ুয়াদের মুখ থেকে শুনেছি । শুনেছি , লাল মিয়া বাশি বাজাতে পারেন — কালো সাপের সাথে তার বন্ধুতা আছে । একবার নাকি নড়াইল কলেজের কোনো অনুষ্ঠানে বাশি বাজিয়ে শ্রোতাদের এমন মুগ্ধ করেছিলেন যে , কলেজ কর্তৃপক্ষ ও ছাত্ররা লাল মিয়ার বাশি শুনে বাহ্যিক চেতনা হারিয়ে ফেলেন । তাই লাল মিয়া যখন বাশি বাজিয়ে অনুষ্ঠান থেকে তাঁর আস্তানার দিকে ফিরে যেতে থাকেন তখন শিক্ষক ও ছাত্ররা তাকে পুকুর পাড়ে গিয়ে মালা পরিয়ে দেন । এই কাহিনী শোনার পর , সেই কিশোর বয়সেই যাদুর বাশিওলা লাল মিয়াকে দেখার জন্য মনটা ব্যাকুল ছিল । যারা এই কাহিনীর মতো আরো অনেক কাহিনী সে সময়ে বলতো তারা আমাদের কলাবাড়িয়া গ্রামেরই কলেজ পড়ুয়া । তারা সবাই পড়াশুনা করতো নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে । কলাবাড়িয়া বর্তমান নড়াইল জেলার একটি প্রাচীন জনপদ । ঐ সময় আরো শুনেছি , লাল মিয়া যখন গভীর রাতে নড়াইলের জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটে বাশি বাজাতেন তাঁর বাশির সুরে কালো কালো কেউটে সাপ দুপাশে নাচতো । সাপের উপস্থিতি আমার মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করলেও লাল মিয়াকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হতো । কিন্তু কি ভাবে কার সাথে নড়াইল যাবো ? কে আমার এই সাধ সেদিন পূরণ করবে ? আমার বাবা আব্দুর রাজ্জাক মিয়া ) প্রায়ই জমিজমার ব্যাপারে নড়াইল যেতেন । কিন্তু তাকে আমি লাল মিয়াকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারিনি । তিনি ছিলেন ভিন্ন চিন্তা ও মেজাজের লোক। একবার শুনতে পেলাম , বিশাল ঝাকড়াচুলে কালো গাউন গায়ে নড়াইলের সেই লাল মিয়া এসেছিলেন বড়দিয়া মহাজনের লক্ষ্মীপূজোর আড়ং - এ । শুনেছিলাম , লাল মিয়া বড়দিয়ায় ছোট বড়ো নানা আকারের বাশের বাশি তৈরি করে বড়দিয়ার তেয়ারে ( মেলা ) বিক্রি করতে এসেছিলেন । অনেক লোকই তাকে দেখার জন্য ভিড় করেছিল । জানিনি , লাল মিয়ার বাশি কেমন বিক্রি হয়েছিল । বড়দিয়া একটি মোকাম । খুলনা - ঢাকা ও খুলনা - বরিশাল যাওয়া আসার লঞ্চ ও ইস্টিমারের বিখ্যাত ঘাট । মামাবাড়িতে ( ফরিদপুরের পুকুরিয়া গ্রাম ) যাওয়ার পথে নবগঙ্গা নদীতীরে অবস্থিত বড়দিয়ার বিশাল মোকাম ও লঞ্চঘাট দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার । কিন্তু মায়ের কঠিন প্রহরায় তখনো কোনোদিন বড়দিয়ার মাটিতে পা রাখার সুযোগ হয়নি । আমাদের বাড়ি থেকে বড়দিয়ার দূরত্ব ৯ মাইলের বেশি নয় । অনেকের মুখে যখন সেই কালো গাউন পরা লাল মিয়ার বাশি বিক্রির কথা শুনেছি তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম , আগামী বছরের শারদীয়া লক্ষ্মীপূজোর মেলায় আমি অবশ্যই লাল মিয়াকে বড়দিয়ায় । গিয়ে দেখে আসবো । ১৯৬৬ সনের মেলায় বিশালদেহী ঝাকড়া চুলের যাদুর বাশিওলা লাল মিয়াকে দেখতে গিয়েছিলাম । তখন আমি কলাবাড়িয়া গ্রামের পার্শ্ববর্তী মুলখানায় ফুপুবাড়িতে থাকতাম । কিন্তু না , সেবার লাল মিয়াকে আমি দেখতে পাইনি । বালক বয়সে যতোটা পেরেছি লাল মিয়ার সন্ধান করেছিলাম । কোথাও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি । আমাদের দলের একজন জানালো , লাল মিয়াতো পাগল । তার তো ঠিক - ঠিকানা নাই । তিনি অন্য জগতের মানুষ । জীবনের প্রথমবার বড়দিয়ার মেলায় গিয়েছিলাম লাল মিয়াকে দেখতে যাকে না দেখেই ভালবেসেছিলাম , শুধু তার গল্প শুনে । সেদিন তার দেখা না পেয়ে মেলার সব আনন্দই নিরানন্দে মিশে গেলো । ঐ বয়সে যা কিছু আনন্দ দেয় যেমন ধাশি , পুতুল , মিষ্টি , নানা রকমের খেলনা , সবই কিনে সাথীদের সাথে শারদীয়া পূর্ণিমায় পথ চলতে চলতে যেমন প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে ছিলাম তেমনি লাল মিয়াকে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট অনুভব করেছিলাম । তারপর দীর্ঘ সময় কেটে গিয়েছে । লাল মিয়ার দেখা পেলাম ১৯৭৩ সনের শেষ দিকে । নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারের মুচিরপুল থেকে সোজা খেয়াঘাটে যাওয়ার পথে ; হাতের ডাইনে গোডাউন মতো একটি দোকানে । মনে নেই কার সাথে ভয়ে ভয়ে গিয়ে লাল মিয়ার খাস আড্ডায় দাড়িয়েছিলাম । তার গায়ে ছিলো মিশকালো গাউন । তার চেয়ে কালো একটি কলকে ছিলো হাতে । সামনে সেই কিংবদন্তির বিশাল বাশি । নির্বিকার দৃষ্টি পৃথিবীর কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি । তার পাশের লোকেরা খুব মনোযোগী , তার কথা শুনছেন। কথাগুলো এমন আকর্ষণীয় যা সবাইকেই নিবিষ্ট করে । বুঝতে পেরেছিলাম , প্রতিক্রিয়ায় তিনি তখন বিভোর- তবে কোনো ভাবেই বাহ্যিক জ্ঞান ও বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলেননি । আমার সাথী আমার নামধাম এমন কি কবিতা ও গান রচনার দুর্বার নেশার কথা জানিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন লাল মিয়ার সাথে লাল মিয়া আমাকে কবিতার কথা শোনালেন । কবিদের নিয়ে কিছু বললেন । প্রথম আলাপেই আমাকে কবি সম্বোধন করলেন । আমি অতি সতর্কতার সাথে তার প্রতিটি কথা , চোখ মুখ হাত ও দৈহিক আন্দোলন লক্ষ্য করতে লাগলাম । হঠাৎ হেসে ফেললেন তিনি হো হো করে । মুখে বললেন , ‘ কবিরা শব্দ নিয়ে ছবি আঁকেন । শব্দের রস সঞ্চারণে তার ছবি হয় যুগোষ্ঠীর্ণ । এই গাঙ্গেয় ভূমির কবিরা তাই করেছেন যুগে যুগে । আপনাকেও তা করতে হবে । আমি ঠার কথার এক ফাকে বললাম , ' আপনার কথাই তো কবিতা । আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি ' । তিনি বললেন , ' আমি রঙ ও তুলি দিয়ে ক্যানভাসের ওপর পৃথিবীর কবিতা আঁকি । ' একটু থেমে আমার বহু দিনের স্বপ্নলোকের মানুষ যাদুর বাশিওলা লাল মিয়া ... বা হাতের তালুতে গাজার তামাক ঘষতে ঘষতে বললেন , ' কবিরা শব্দের ঘটকালি করেন । মাইকেলকে দেখুন না , তিনি বললেন: ' কে কবি – কবে কে মোরে ? ঘটকালি করি শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জুন .. সেই কি সে যম - দমী ? তার শিরোপরি শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন ? সেই কবি মোর মতে , কল্পনা সুন্দরী যার মন কমলেতে পাতেন আমন , অস্তাগামী - ভানু - প্রভা - সদৃশ বিতরি ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ - কিরণ । কবিতাংশ পাঠ করে লাল মিয়া থামলেন । আমার মনে হলো , তিনি মাইকেল মধুসূদনের ‘ কবি ’ সনেটটির সবটাই পাঠ করতে পারতেন । পরে জেনেছিলাম , শিল্পী মাইকেল মধুসূদনের প্রতি অসম্ভব দুর্বল ছিলেন । অনেকবার তার মুখ থেকে শুনেছি , “ মধুসূদন বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি । মধুকে কেউ মাড়িয়ে যেতে পারেন নি । পরবর্তীকালে তিনি আমাকে অনেক উর্দু ফার্সি কবিতাও মোশায়ারার ভঙ্গিতে শুনিয়েছিলেন ।এরপর কিছু সময়ের জন্য লাল মিয়া আমাকে তার বিশালাকার বাশি বাজিয়ে শুনিয়ে ছিলেন । বাশি শেষ হলে আমি জানতে চেয়েছিলাম , ' কোন সুর ? ' তিনি বলেছিলেন , * সুদূর লোকের ভেসে আসা সুর । আস্তে আস্তে বুঝতে হয় । আমি একেবারেই কথা তুলিনি । কারণ গঞ্জিকার অতিমাত্রা তাঁকে বিষণ্ণ করে রেখেছিলো । যতদূর মনে পড়ে , তখন ছিলো শীতকাল । রূপগঞ্জ বাজারের পশ্চিম পার্শ্বে বঁট - অশ্বত্থ ও অন্যান্য গাছের ছায়ায় সূর্যের ক্ষীণ প্রভা দেখা যাচ্ছে । সন্ধ্যা আসার আগাম আগমনী শীতের বাতাসে বাতাসে । কিন্তু লাল মিয়ার ঘরে ফেরার কিংবা স্থান ত্যাগের কোনো ব্যস্ততা দেখলাম না । আমি সেদিনও তার ঘর - গৃহ সংসার সম্বন্ধে কোনো ধারণা পাইনি । তাই চিব পথিক লাল মিয়ার নিরাসক্ত ভাব আমাকে ব্যথাতুর করেছিলো । লাল মিয়ার সাথে প্রথম দিনের আলাপ বেশ দীর্ঘ হয়েছিলো । তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত , বিদ্যাপতি , চন্ডিদাস, শেখ সাদি আল্লামা ইকবাল , জামি , রুমি , হালি , গালিব , জোস মালিহাবাদি , লালন প্রমুখকে নিয়ে নানা কথা, এমনকি তাদের কবিতার কিছু কিছু অংশ উচ্চারণও করেছিলেন । লাল মিয়ার সঙ্গে প্রথম আলাপে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই । ভেবেছি , একজন চিত্রশিল্পী হয়ে বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষার কবিদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি কিভাবে জন্মালো । তাই লাল মিয়ার সাথে আমাকে মিশতে হবে । শিল্পীর সঙ্গে প্রথম দিনের আলাপচারিতা , দীর্ঘ স্মৃতি , দীর্ঘ কথার সরিৎসাগর । সালাম জানিয়ে লাল মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি নড়াইলের পার্শ্বে একটি গ্রামে আশ্রয় নেই । আমার সঙ্গীটি যাবার পথে আমাকে জানালেন , লাল মিয়া সাহেবের আসল নাম শেখ মুহম্মদ সুলতান -- ' লাল মিয়া ' সুলতানের মা বাবার দেওয়া বাল্য নাম । এরপর অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী নড়াইলের বিশ্ববরেণ্য সন্তান সুলতান সাহেবের সঙ্গে বয়সের সব পার্থক্য ভুলে গিয়ে কেমন করে আমি বন্ধুত্বের অকাট্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম তা আঁচ করতে পারি নি । ধীরে ধীরে সম্পর্কের গভীরতায় পিতৃত্বয়সী এই বিশাল মানুষটাকে ' ভাই ' সম্বোধন করে ফেলি । তিনি নিজেও কোনো কোনো সময়ে আমাকে আমার নামের সাথে ভাই শব্দটি জড়িয়ে ‘ মহসিন ভাই ' বলে সম্বোধন করেছেন । একবার এই ' ভাই ' সম্বোধন নিয়ে সুলতান ভাই একটি দুষ্টচক্রকে দারুণ অপমান করেছিলেন । ঘটনাটি ছিলো এমন যতদূর মনে পড়ে , ১৯৮৫ সনে আমাদের কালিয়া উপজেলার তৎকালীন ইউ.এন.ও জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন আমার মতো কয়েকজন উৎসাহী ব্যক্তিকে একুশে ফেব্রুয়ারি উৎযাপন ও একটি একুশে সংকলন প্রকাশে উৎসাহী করেছিলেন । তিনি নানা জনের কাছ থেকে কিছু টাকাও জোগাড় করেছিলেন । জনাব শামসুদ্দীন সাহেবের আন্তরিকতায় ও তত্ত্বাবধানে আমরা ' শব্দের চাবুক ' নামের একটি একুশে সংকলন করি । ওটির সম্পাদনা করেছিলাম আমি । ২০ ফেব্রুয়ারি খুব সকালে জনাব শামসুদ্দীন সাহেবের গাড়িতে চড়ে আমি , মানিক বিশ্বাস ও স্বয়ং ইউ.এন.ও সাহেব সুলতান ভাইয়ের নড়াইল চিত্রশালা ভবনে উপস্থিত হই । এর কয়েকদিন আগে আমরা তাঁকে কালিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে একুশে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলাম । যাহোক , সকাল বেলায় কালিয়া থেকে নড়াইলে গিয়ে আমরা সুলতান ভাইকে কালিয়া নিয়ে যাই । পথে সুলতান ভাই চাঁচুড়ি পুরুলিয়া স্কুলের ( বহু কথিত নন্দন কানন স্কুল ) সামনে দাড়িয়ে ইউ.এন.ও সাহেবকে অনুরোধ করেন , স্কুলটিকে আর্থিক সাহায্য দানের জন্য । আমার জানা মতে ইউ.এন.ও সাহেব বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর সম্মানে স্কুলটির উন্নয়নে আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন । যা হোক , নবগঙ্গা নদী ফেরির সাহায্যে পার হয়ে আমরা কালিয়ায় পৌছাই । আমরা শিল্পীকে যথাসাধ্য সম্মান দেখিয়ে বিকেল বেলায় কালিয়া পাবলিক লাইব্রেরি সংলগ্ন পশ্চিম পার্শ্বে চারদিকে দেওয়ালঘেরা জায়গায় ২০ ফেব্রুয়ারিই একুশের অনুষ্ঠান ও ‘ শব্দের চাবুক সংকলনটি প্রকাশ করি । প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতার প্রারম্ভে ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারায় কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ' শ্রদ্ধেয় মহসিন ভাই ' বলার সাথে সাথে প্রথম সারিতে বসা কয়েকজন উকিল হেসে উঠেছিলেন । প্রথমতঃ অর্থকরী ব্যবসায় নিয়োজিত উকিলরা আমার মতো ' পদ্য লেখকাকে শ্রদ্ধার আসনে দেখতে রাজি ছিলেন না । তারা ভেবেছিলেন , সুলতান সাহেব আমার মতো বখে যাওয়া তরুণের নাম উচ্চারণ করতে শ্রদ্ধেয় শব্দটি বলবেন কোন দুঃখে । তাদের হাসিতে সুলতান ভাই দারুণভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন । তিনি ' শ্রদ্ধেয় মহসিন ভাই আবারো উচ্চারণ করে ঐ নিচাশয়দের মুখ সেদিন ম্লান করে দিয়েছিলেন । তাদের মাথা নিচু হয়ে যায় । আমার পরম শুভাকাল্কী ইউ.এন.ও শামসুদ্দীন সাহেব ও মানিক বাবু পরে এ নিয়ে বেশ মজা করেছিলেন । যে প্রসঙ্গে এই ঘটনা বলা তাহলো , সুলতান ভাই কবি - শিল্পী - সাহিত্যক এমনকি যে কোনো সৃজনশীল মানুষকে বয়সের সব তারতম্য ভুলে শ্রদ্ধা করতেন , ভালোবাসতেন । তাই কিশোর প্রায় কোনো তরুণকে তিনি ' ভাই ' বলতে , ‘ শ্রদ্ধেয় ’ বলতে কার্পণ্য করতেন না । আর ঐ সম্বোধনে তিনি পরাজিত হয়েছেন এমন ভাবনা চিত্তা তার মনের কোণে স্থান পেয়েছিল এমন ভাবতে পারি নি । কিংবদন্তির শিল্পী এস.এম. সুলতানের সাথে আমার অগণিত দিনও রাত্রির আনন্দ , ক্লান্তি ও বঞ্চনার ইতিবৃত্ত জড়িয়ে আছে । ১৯৮১ সনে নড়াইলের মহকুমা হাকিম জনাব মমতাজুর রহমান নড়াইলের গুণীজন অর্থাৎ কবি, সাহিত্যিক , শিল্পী , কবিয়াল , জারিয়াল ও সাংবাদিকদের তার বাসায় আহ্বান করেছিলেন । বলা যায় , সেটা ছিলো নড়াইল মহকুমার গুণীজন সমাবেশ । এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিলো চিত্রানদীর পশ্চিম তীরে ‘ নীলকুঠি ' , পরবর্তী কালে এস . ডি.ও সাহেবের বাসভবনে । ঐ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিল্পী এস.এম. কবিয়াল বিজয় সরকার , জারিয়াল মসলেম বয়াতি প্রমুখ । সেখানে আমিও আমন্ত্রিত হয়ে ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ’ সংগ্রহ করে দ্রুত প্রকাশের জন্য বক্তৃতায় এস.ডি.ও সাহেবকে অনুরোধ করি । আমি ইতোমধ্যে অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের ' হারামণি - এর কয়েকটি সংকলনে লোকসাহিত্য সংগ্রহ করে দিয়ে এবং খুলনার কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিবিধ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে কিঞ্চিৎ পরিচিতি পেয়েছিলাম । সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিলো , একজন লোকসাহিত্য গবেষকের সাহায্যে ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ' গ্রন্থটি সম্পাদনা করা হবে । আমার গ্রামের বাড়ি শহর থেকে দূরে থাকায় সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতায় বিশ্বাসী কয়েকজন শহরবাসী আমি যাতে গ্রন্থ সম্পাদনার দায়িত্ব না পাই সেই মতলবে ছিলেন । কিন্তু ঐ গ্রন্থ সম্পাদনা ও গান সংগ্রহের দায়িত্ব প্রাপ্তিতে সুলতান ভাই আমার সমর্থক ছিলেন । আমি ঐ গ্রন্থটির সম্পাদনা কাজটি করি । কিন্তু প্রচ্ছদ তৈরির সময় এস.ডি.ও সাহেব সম্পাদক হিসেবে তার নামটি প্রচ্ছদে রেখেছিলেন । আমি ঐ আচরণে বিস্মিত হই । তবু তিনি আমার নামটিও সহসম্পাদক হিসেবে রেখে ছিলেন । সে অনেক ঘটনা অনেক ক্লেশদায়ক অভিজ্ঞতা : কি করে একজন আমলা বিনা সাধনা ও পরিশ্রমে সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকের তকমা গায়ের জোরে গ্রহণ করেন । প্রথম সাহিত্য সম্মেলনের দিন অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে নিয়ে একটি ছবি তোলা হয়েছিলো । কিন্তু ছবি তোলার সময় আমরা সুলতান ভাইকে দেখতে পেলাম না । তাতে এস.ডি.ও সাহেবের মন ক্ষুণ্ন হলো । ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ' গ্রন্থের সম্পাদনা কাজ পেয়ে আমি নড়াইল সাহিত্য পরিষদের খরচায় দীর্ঘ দিন নড়াইল শহরে ও রূপগঞ্জে অবস্থান করেছিলাম । তখন সুলতান ভাইয়ের সাথে প্রতিদিনই আমার দেখা হতো । তিনি আমাদের অনুরোধে ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ' গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন । যদিও প্রচ্ছদের জন্য আমরা তাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা ভাবতে পারিনি । তবে তার জীবজানোয়ার , পশুপাখি ও পোষ্যদের জন্য এস.ডি.ও সাহেব টাকা দিতেন । তিনি কোনো কোনো সকাল ও বিকেলে রিকসায় দুবেলাই নড়াইল শহরে যেতেন । আমি প্রথম কিছুদিন লোকগানের সংগ্রহ নিয়ে নড়াইলের রাইফেল ক্লাব বা আনসার ক্লাবে থাকতাম । এস.ডি.ও সাহেব ও সুলতান ভাই কখনো পায়ে হেঁটে ক্লাবে যেতেন কখনো বা গাড়িতে । কারণ এস.ডি.ও ভবন থেকে ক্লাবের দূরত্ব বেশি নয় । অবশ্য পরে আমার থাকা ও দাপ্তরিক কাজের জন্য নড়াইলের ডাকবাংলার মাঝখানের কক্ষটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো । ক্লাবে অবস্থানকালে এক সকালে এস.ডি.ও সাহেব ও সুলতান ভাই বিনা নোটিশে রাইফেল ক্লাবে আমার রুমে হাজির হলেন সম্পাদনা কাজের অগ্রগতি দেখতে । প্রচুর বই পুস্তক ও কাগজপত্রের মধ্যে একখানি সুন্দর সুবিন্যস্ত পাটের দড়ি ( রশি ) দেখে উভয়েই ঘাবড়ে গেলেন । তারা দু'জনই একসাথে প্রশ্ন করলেন , আরে দড়ি কেন ? ( দড়ি রাখা আমাদের অঞ্চলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার ইঙ্গিতবহ ) । আমি তাদের সবিনয়ে জানালাম , ' ঝিনঝিনে ' । ' ঝিনঝিনেয় ঐ সময় দক্ষিণ বাংলায় পা থেকে হঠাৎ শুরু হওয়া ব্যথায় অগণিত লোক আক্রান্ত হতো । পায়ে যদি প্রতিবন্ধকতা থাকতো মানুষ রক্ষা পেতো । তাই রশির ব্যবস্থা তাদের হাসিতে আমি বেশ লজ্জা পেয়েছিলাম । হাসি ফেলে সুলতান এস . ডি.ও সাহেবকে বললেন , ' দেখুন স্যার , এই রকম নিষ্ঠাবান লোকদ্বারাই আমাদের নড়াইলের কাজ হবে । এমন লোক আপনি জীবনেও পাবেন না । ' ঝিনঝিনের ' ভয়েতো মানুষ একা পথ চলে না । একঘরে একা ঘুমায় না । অথচ কবি সাহেব আমাদের কাজের স্বার্থে ( নড়াইলের লোকসঙ্গীত গ্রন্থ সম্পাদনা ) ফাঁকা ঘরে একাই থাকছেন । একথা শুনে এস.ডি.ও সাহেব খুশি হলেন । আর মুখে বললেন , ' যতো ছালা ( শালা ) পাগল এক জায়গায় এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো , নড়াইলের বুদ্ধিমান ও বিবেচক লোকেরা লোকসঙ্গীত সংগ্রহের সাথে জড়িত সবাইকে অনুৎপাদিত খাতে অর্থ ব্যয়ের জন্য পাগল আখ্যায়িত করেছিলো । দীর্ঘদিন নড়াইল রূপগঞ্জের দোকান - রেস্তরায় আমাদের নামের আগে কিংবা পরে পাগল কথাটি জুড়ে দেওয়া হতো । সেদিনের ঐ পাগল গোষ্ঠীর মধ্যমণি ছিলেন সুলতান ভাই । তিনি তার স্বীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি গেটআপ ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ' গ্রন্থের জন্য এঁকে দিয়েছিলেন । আমি মনে করি এটি শিল্পী সুলতানের একটি বড়ো কাজ । তবে সুলতান ভাই প্রচ্ছদ করতে স্বতস্ফূর্ত রাজি হয়েও বেশ দেরি করেছিলেন । আর এ জন্য নড়াইল থেকে আমাকে প্রায়ই তার পুরানো দালানের বাসায় যেতে হতো । আড্ডা জমাতে হতো রূপগঞ্জের বিভিন্ন আড্ডাখানায়। প্রায়ই তার বাজারের টাকা দিতে হয়েছে আমাকে । বাজারের টাকা দেওয়ার সাথে কাজের কোনো সম্পর্ক ছিলো। না । তার দৈন্য ও দুদর্শা আমাকে পীড়িত করতো তাই আমি মাঝে মাঝে অর্থ সাহায্য করেছি । সেই ছবির প্রসঙ্গটি ভুলে গিয়েছি । এস.ডি.ও সাহেবের বাংলোর সামনে সবাই মিলে আমরা ছবি তুলেছিলাম ১৯৮১ সনের ১৯ জুন । সিদ্ধান্ত হলো , ঐ ছবিটা ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ' গ্রন্থে ছাপা হবে । কিন্তু গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী প্রিয় সুলতানের ছবি থাকছে না । আমি এস.ডি.ও সাহেবকে বুঝিয়েছিলাম , সুলতান ভাই ও এস.ডি.ও সাহেবের আরেকটি ছবিও গ্রন্থে প্রকাশ পাবে । সুলতান ভাই ছবি তুলতে রাজি হলেন । তবে ছবি দুজনের নয় তিন জনের যাবে । এরপর এস.ডি.ও সাহেব ডানে মাঝে সুলতান ভাই ও শেষে আমার পাড়ানো একটি ছবি এস.ডি.ও - এর বাংলোর সামনে থেকে তোলা হলো । ১৯৮১ সনেই ক্যাপশনসহ ' নড়াইলের লোকসঙ্গীত ' গ্রন্থে আলোচিত ছবি দু'টো প্রকাশ পায় । তখনকার দিনে বরেণ্য শিল্পী সুলতানের কাছে আমার বয়স , পরিচিতি, যোগ্যতা ও খ্যাতি যে কতো নগণ্য ছিলো তা আমার জানা । তবু আমাকে ছাড়া তিনি যে প্রকাশিতব্য পুস্তকের জন্য ছবি তুলতে রাজি হননি , এটা ছিলো আমার প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসারই প্রমাণ । সুলতান ভাই সংসারের সমস্ত দোষকালিমার উর্ধ্বে ছিলেন , এমন মত আমি কখনো পোষণ করি না । শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অনেক জাতীয় পুরুষের সাথে আমার দীর্ঘ পারঙ্গমতা সৃষ্টি হয়েছিলো , যারা এখন আমাদের জাতীয়তার স্তস্তস্বরূপ । সুলতান ছিলেন তাদের ব্যতিক্রম । অনেক মহাপুরুষকে জানি যারা তাদের স্বার্থে সুদূর গ্রাম থেকে চিঠি লিখে ঢাকায় এনে আমাকে একবেলা খাবার টেবিলে ডেকে বসাতেও সাহসী হননি । তাদের মৃত্যুর পরে তাঁদের পুত্রকন্যারা দেখেছি পিতার উচ্ছৃবৃত্তির সহযোগিতায় ইন্টেলেকচুয়াল আচরণ করেছেন । অথচ তাঁদের জন্য বছরের পর বছর আমার শ্রম , অর্থ ও মেধা ব্যয় হয়েছে । সুলতান ভাইয়ের দুর্বিসহ দুর্দিনে আমি তাকে নানাভাবে সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করেছি । যখন তার সুদিন এসেছে তখন তিনি তা কোনোভাবে বিস্তৃত হননি । নতুন বাড়িতে যাওয়ার পরে অকারণেই রূপগঞ্জ থেকে ফেরার পথে আমায় রিকসায় তুলে নিয়েছেন। মৃদুস্বরে বলেছেন , ' আসেন কবি সাহেব , বড়ো মাছ আছে , ভাজি রান্না দুই - ই হবে । আমি আমার কাজের ব্যস্ততায় তাকে যতোটা এড়াতে চেয়েছি তিনি ততটা শক্ত হয়েছেন , ' যেতে হবে ' । গিয়েছিও । বাসায় গিয়েই ‘ বাসনা ' , ' পদ্ম ' ওদের মা ' নীহারবালা'কে ডেকে সন্ধান নিয়েছেন জীবজন্তুগুলোর আহার হয়েছে কি না ? জীবজন্তুর বিচিত্র সব নাম । সীমাহীন আদর আর যত্নে তিনি তাদের লালন করেছিলেন — যেন জন্ম জন্মান্তরের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক । মনে হয় , তারা সুলতানের ভাষা যতোটা বুঝতো তার প্রতিবেশী বৈরী মানুষেরা তা বুঝতে পারতো না । জীবজন্তুর প্রতি সুলতানের দুর্বলতা কখনো কখনো সাধারণ শালীনতাকে ব্যাহত করেছে । তাঁর ভক্ত ও বন্ধুরা সেসব জানতেন কিন্তু অন্যরা কোনো ভাবেই তা গ্রহণ করতে পারতেন না । সম্ভবতঃ ১৯৮৩ সনের শরৎকালের কোনো এক সুন্দর সকালে আমি ও মাউলি গ্রামের মানিক বিশ্বাস নড়াইলের তারিক ভাইয়ের হোটেল থেকে সরাসরি রিকসায় সুলতান ভাইয়ের পুরানো বাড়িতে হাজির হলাম । আমরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম এক প্যাকেট দামি বিস্কুট ও টেপরেকর্ডার । চা বিস্কুট খাবো আর শিল্প দর্শন বিষয়ে আলোচনা করবো । আর সেই আলোচনা রেকর্ড করবো । সুলতান ভাই তখন ভগ্নপ্রায় বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় থাকতেন । দ্বিতীয়তলার মাঝের কক্ষে আমরা বসতাম , কথা বলতাম , তিনি ঐ কক্ষে ছবিও আঁকতেন । রাতের বেলা শিকলবন্দি তার প্রিয় কুকুর ‘ চম্পাকেও রাখতেন । ছোট খাটো ব্রাউন কালারের রাশিয়ান কুকুরটির নাম ছিলো ' চম্পা ' । যা হোক , সকালবেলায় আমার হাতে বিস্কুটের প্যাকেট দেখে সুলতান ভাই বেশ খুশি হলেন । চিৎকার করে পশ্চিম দিকের কক্ষে পদ্মকে লক্ষ্য করে বললেন , ' পদ্ম , দুই সাহেব এসেছেন , একটু চা হবে ? ” আমি সুলতান ভাইয়ের সাথে সুফী দর্শন , সুফী সাহিত্য , বৈষ্ণবদর্শন , পদাবলী সাহিত্য , বাংলা সাহিত্যে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের অবদান প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করেছি । আর স্বল্পভাষী মানিক বিশ্বাস সব কথা টেপ করেছেন । বেশ কিছু সময় পরে আমাদের জন্য চা আসলো । আমি বিস্কুটের প্যাকেট খোলা মাত্র শিকল বাধা চম্পা লাফাতে থাকে । সুলতান ভাই বললেন , বিস্কুট খেতে চায় । এরপর সব বিস্কুটই তিনি চম্পাকে দিয়ে দিলেন । কুকুরের পাশে রাখা একটি মাটির পাত্রে সুলতান ভাই তার কাপের পুরোটা চা চম্পার জন্য ঢেলে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতে থাকেন । ঐ ঘটনায় আমি বেশ উৎসাহ বোধ করলেও মানিক বিশ্বাস একটু ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন ।সুলতান ভাই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সঙ্গে যেমন মিশতে পারতেন তেমনি অতিদীন কাংগাল অস্ত্যজ মানুষদের সাথে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতেন । মূলতঃ গরীব ও পিছেপড়া মানুষদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিলো অধিকতর গভীর । উপমহাদেশের বড়ো বড়ো কবি - সাহিত্যিক , চিত্রশিল্পী , গায়ক , যন্ত্রশিল্পী , নৃত্যশিল্পী , রাজনীতিকেরা যেমন তার বন্ধু ছিলেন , তেমনি গ্রামের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত অসংস্কৃত কবিয়াল - জারিয়াল ভিক্ষুগায়ক – বোষ্টম বোষ্টমিরাও সুলতানকে আকর্ষণ করেছিলো । নড়াইল জেলার ডুমদি গ্রামের কবিয়াল বিজয় সরকার , চালনা গ্রামের প্রফুল্ল গোসাই , তারাপুরের জারিয়াল মসলেম বয়াতি , গাজিরহাটের গোবিন্দ গোসাই প্রমুখের সঙ্গে সুলতান ভাই সহজভাবে মিলে মিশে সঙ্গ দিতেন । আমি কৈশোর থেকে সংসার উদাসীন ও বিষয় বিরাগী হওয়ায় উল্লেখিত ব্যক্তিগণসহ অসংখ্য কবি , জারি , ভাবগান , অষ্টগান , কীর্ত্তন ও যাত্রা গানের দলে থেকেছি , গান রচনা করেছি , পালা রচনা করেছি ও অভিনয় করেছি । সুলতান ভাইও আমাদের লোব - জীবনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রাণের টানে জড়িয়ে পড়েছিলেন । তাই তার ও আমার আন্তরিক সম্পর্ক আমৃত্যুই ছিলো , কোনো ঝড়ো হাওয়ায় তা উৎপাটিত হতে পারেনি । একবার আমি নড়াইলের প্রায় ৪ মাইল পশ্চিমে তুলারামপুরার আসরের কবিগান সেরে পরদিন দুপুরে রূপগঞ্জ বাজারে সুলতান ভাইয়ের সাথে দেখা করি । বেশ কিছুদিন পরে দেখা হওয়ায় সুলতান ভাই বড়ো খুশি হলেন । দর্শন ও শিল্পের জটিল জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ হলো তার সাথে । আমি ঐদিন রাতে নড়াইল থেকে গেলাম । কথা রইলো কয়েকদিন পর ( প্রায় ১৪ দিন ) যখন নড়াইলের দক্ষিণ প্রান্তে বনবলিশাখালি গ্রামে কবিয়াল বিজয় সরকারের কবিগান হবে সুলতান ভাইকে নিয়ে যেতে হবে । কবিয়াল বিজয় সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলাম , সুলতান ভাই কবিয়াল বিজয় সরকারের দলে পেশাদার বাশিবাদক ছিলেন । পরবর্তীকালে আমিও ঐ কবির দলের বাধনদার বা সরকার ছিলাম । যা হোক , বনখলিশাখালির কবিগান শুরু হওয়ার দুদিন আগে আমি পায়ে হেঁটে সরকার মশাইয়ের ডুমদির বাড়িতে রাত যাপন করি । এবং শেষ রাতে পায়ে হেঁটে কুড়িগ্রামে সুলতান ভাইয়ের বাসার দিকে রওনা হই । কুড়িগ্রাম পৌছাতে সকাল ৭ টা বেজে যায় । এরপর সুলতান ভাইয়ের ভাষায় ' বাল্যসেবা ' সেরে রূপগঞ্জ থেকে লঞ্চে চড়ে গোবরা ঘাটে নেমে পড়ি । সুলতান ভাইয়ের গায়ে কালো লম্বা গাউন , হাতে বিশালকায় বাশি , মাথায় ঝাকড়াচুল। সে সময় আমারও মাথায় ছিলো দীর্ঘ মধ্য কুঞ্চিত কেশবাস , সাদা পাজামা পানজাবি ও খদ্দরের চাদর গায়ে । শীতের প্রায় দুপুরে গোবরা বাজারে পথ চলার সময় শত শত লোক আমাদের পিছু নেয় । গোবরার পাশের একজন পরিচিত গ্রাম্য ডাক্তার আমাদের উদ্ধার করে তার বাড়িতে নিয়ে নাস্তা করালেন । আজ আর মনে নেই , এরপর আমরা দুজনে গরুর গাড়িতে না রিকসাভ্যানে বনখলিশাখালীর ভাগ্যিদার ডাক্তারের বাড়িতে কবিয়াল বিজয় সরকারের কবিগানের দলের সঙ্গে মিলিত হলাম । ৩ দিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে সুলতান সেখানে মাত্র ২ দিন থেকেছিলেন । তৃতীয় দিন সকালে তিনি নড়াইলে ফিরে যান । কথা ছিলো , তিনি আমাদের সাথে ৩ দিনই থাকবেন । কিন্তু একটি ঘটনায় তিনি ব্যথা পেয়েছিলেন বলে মনে হয় । আমার প্রতি আমার চেয়ে বেশি বয়সী লোকদের সম্মান ও স্নেহ ছিলো বরাবরই । আমিও তাদের সব সময় শ্রদ্ধা করে আসছি । ভাগ্যিদার ডাক্তারের পশ্চিম পোতার টিনের ঘরের পূর্ব পার্শ্বের বারান্দার দক্ষিণাংশে সুলতান ভাই ও আমি এক বিছানায় রাত কাটাতাম। আর সারা দিন তাকে সঙ্গ দিতাম । তিনি যখন গঞ্জিকার তামাক কাটতেন আমি তখন গুলি বানাতাম । এর ফাকে সুলতান ভাই তার হারানো দিনের স্মৃতিচারণ করতেন । দ্বিতীয়দিন বিকেল বেলায় কবিয়াল বিজয় সরকার সুলতানের গাজা সেবনের খুব সমালোচনা করেন । বিশেষত আমাকে রূঢ় কথা বলেন । সম্ভবতঃ সুলতান ভাইয়ের কানে কেউ ঐ কথা লাগিয়েছিলো । তাই তিনি তৃতীয়দিন সকালেই আমাদের ত্যাগ করে নড়াইল ফিরে গেলেন । এখানে উল্লেখ থাকা ভালো বিজয় সরকার শিল্পী সুলতানের শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন । তবে তিনি সুলতানের সুসংগঠিত জীবন কামনা করেছিলেন । যা হোক , এই ঘটনা সুলতান এক সময় ভুলে গিয়েছিলেন । তাই পরবর্তীকালে আমাদের সম্পর্কের কোনো ছেদ ঘটেনি । এরপরও আমি , সুলতান ও কবিয়াল বিজয় সরকার বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করেছি , ছবি তুলেছি এবং বৈঠক আলোচনায় যোগ দিয়েছি ।শিল্পী সুলতান যে শুধু বড়ো মাপের শিল্পী ছিলেন তা নয় — তেজদীপ্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারীও ছিলেন । যৌবনে তিনি অনেক অশালীন ও ঠগবাজ লোককে নিজ হাতে পিটিয়েছেন । তার মারমুখি হওয়া আর অন্যায়কারীকে মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার একাধিক ঘটনা তিনি আমার কাছে বলেছিলেন । নড়াইল জেলার কালিয়া থানার চাচুড়ি - পুরুলিয়া নন্দনকানন উচ্চ বিদ্যালয় ও নন্দন কানন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান ভাই । ওটা তার মামা রাহাতুল্লাহর গ্রাম । ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের পরে সুলতান ভাই ঢাকা আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের থেকে মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত হয়ে নড়াইল ও যশোরের বিভিন্ন জায়গায় হতাশ জীবন যাপন করেন । এক পর্যায়ে তিনি পুরুলিয়ার কৈলাস সিকদারের পরিত্যক্ত প্রাচীন জংলা ভিটা স্থানীয় উৎসাহী যুবকদের নিয়ে পরিষ্কার করেছিলেন । এরপর তো স্কুল প্রতিষ্ঠার বিচিত্র ঘটনা । যা হোক , ঐ স্বপ্নময় চাচুড়ি পুরুলিয়া এলাকা কেন এবং কিভাবে ত্যাগ করলেন তা তিনি আমাকে এভাবে বলেছিলেন , ' দেখুন কবি সাহেব , আমার জীবনের দীর্ঘ নটি বছরের শ্রম আর মেধা খাটিয়েছিলাম নন্দন কানন স্কুলের জন্য । ওখানকার সবাই আমাকে জানে । সবাই আমাকে মানে । চাচুড়িয়া হাটের দিনে আমি হাটের কাছের এক হিন্দু বাড়িতে তামাক খেতে যাচ্ছি এমন সময় একজন লোক আমাকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটা অশালীন কথা বলে । আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো । আমি ঐ লোকটাকে বিনয়ের সাথে ডেকে কাছে আনলাম । লোকটা কিছু বোঝেনি । আস্তে করে মাথার উপর থেকে হাট সওদার ধামাও নামালাম , এরপর তার ঘাড় চেপে নিচু করে কিল মারতে শুরু করি । লোকটা প্রাণ ভয়ে চিৎকার করতে থাকে । আমি তাকে ছাড়িনি । এর মধ্যে পার্শ্বের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে দুজন সিপাই এসে আমাকে থামিয়ে দেয় । আমি ঐ বদ লোকটাকে গুনে গুনে মোট ৫০ টি কিল দিতে চেয়েছিলাম , পারিনি । বদটা বেহুঁশ হয়ে থাকলো । আর সারা গা ফুলে গেলো । পুলিশের সিপাইরা আমাকে তাদের ফাঁড়িতে নিয়ে উঠালো । আমি পরের দিন ঐ এলাকা ত্যাগ করেছি । সুলতান যখন ঐ ঘটনাটী বলছিলেন তখনও তার চোখে মুখে যুগপৎ ক্ষোভ ও অভিমানের আগুন নেভেনি । ঘটনাটি শোনার পরে একটু থেমে আমি বললাম , ' তাকে কি না মেরেও আমরা ক্ষমা করতে পারি না ' ? সুলতান বললেন , ' ঐ লোকটা আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে চিনতো , জানতো । আমি তো তার কোনো ক্ষতি করিনি । সে কেন ‘ ছোট কাপের ' মাত্রা ছাড়িয়ে বড়ো কাপে ' কথা বলবে । তাই শাস্তি তাকে পেতেই হবে । " আমি তার সাথে একমত হলাম । তিনি তখন হো হো করে হেসে উঠলেন । এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন তা হলো , সুলতান ভাই ছাত্র জীবনে কিছু আরবি , ফার্সি বিদ্যাও অর্জন করেছিলেন । তিনি নড়াইল কলেজিয়েট স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে পিতার ইচ্ছেয় ভর্তি হয়েছিলেন নাকসি এ . বি . এস জুনিয়ার মাদ্রাসার ৬ ষ্ঠ শ্রেণীতে । ঐ জুনিয়ার মাদ্রাসায় সুলতান ভাই ৭ ম শ্রেণীতে অধ্যয়ন কালেই কোলকাতায় পাড়ি জমিয়েছিলেন । এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে । যা হোক সুলতান ভাইকে আমি ১৯৮০ সন থেকে ১৯৮৬ সনের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে ‘ বড়ো কাপ ’ ‘ ছোট কাপ ' - এর প্রসঙ্গ , মানুষ “ বিসমিল্লাহ শরিফ ' থেকে সরে যাওয়ায় নারীর ব্যাভিচার ও রাজনীতিকদের চৌর্যবৃত্তি বেড়ে গিয়েছে বলতে শুনেছি , ফসল হচ্ছে না মাঠে বলতে শুনেছি ঐ সময় । প্রায়ই তিনি বলতেন , যা বসুন্ধরার পবিত্র মাটিকে আমরা অপবিত্র হতে দেবনা । এভাবে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সুলতান ভাই ‘ বড়ো কাপ ’ ‘ ছোট কাপ ’ ‘ বিসমিল্লাহ শরিফ ' ও ' মা বসুন্ধরা ' তত্ত্বে নিজেকে সমর্পণ করে রেখেছিলেন । সুলতানের ঐ সব আলোচনার মধ্যে যেমন সমাজের করুণ চিত্র ফুটে উঠতো তেমনি তার জীবনের তীব্র বঞ্চনা আর দুঃখ কষ্টের আগুনকে অনুভব করা যেতো । সুলতান ভাই কখনও তার অপছন্দ লোকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন না । তাই সাধারণ মানুষ মনে করতো , তিনি একেবারেই স্বল্পভাষী । কিন্তু না , তীব্র আপনত্বে যাদের তিনি আপন করে নিয়েছিলেন তাদের কাছে তিনি ছিলেন শিশুসুলভ সহজ ভাষী সুন্দর নমনীয় মানুষ । কথায় কথায় সহজ হাসিতে তিনি ঘরকে আলো ঝলমল করে তুলতেন । সামান্য আনন্দ ও সুন্দরের স্পর্শে সুলতানকে বড়োই সুন্দর দেখাতো । গভীর মমত্ব নিয়ে তিনি তার পরিবেশকে বিবেচনা করতেন । কারো ক্ষতি কিংবা দুঃখ কষ্টের কিংবা যন্ত্রণার কারণ হতে তাকে দেখা যায়নি । সুলতান ভাইয়ের আলাপসভার মূলকথক থাকতেন তিনি । রূপগঞ্জ বাজারের মুচির পুলের কাছে অন্ততঃ চারটি দোকানে তাকে আমি দীর্ঘদিন আড্ডা দিতে দেখেছি । আমিও নিজে দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার আলাপ - সভার আলাপে যোগ দিয়েছি । শুনেছি , তার জীবনের বিশ্রুত আরো ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্মৃতি কথা । পুরানো বলতে বলতে কখনও তিনি হারিয়ে যেতেন কোনো বিষাদের দিনের কথা চোরাবালিতে । আবার কখনও আনন্দের ঝর্ণাধারা ঝরে পড়তো তার চোখ আর মুখের নীলাকাশ থেকে । এভাবে আমি সুখ দুঃখ , আনন্দ ও বিষাদের জোড়া নৌকায় সুলতান ভাইকে অসংখ্য বার পারাপার হতে দেখেছি । সুলতান নিতান্ত গরীব পরিবারের সন্তান । তবু পিতা মেছের ধাউড়িয়া অতি যত্নের সাথে তাকে লালন পালন করতে চেয়েছিলেন । মেছের ধাউড়িয়া মাছিমদিয়ার লোক । ধাউড়িয়া বাড়ির কেবলি দক্ষিণ পাশের বাড়িটি হাজের ধাইদের । ধাই বা ধাত্রী পেশার লোকেরা নড়াইল জমিদার বাড়ির রওশন চৌকিতে শানদারের কাজ করতো । অর্থাৎ শানাই বাজিয়ে প্রহর শেষের শুনানি দিতো । ধাউড়িয়াদের সন্তান মেছের নড়াইল জমিদার বাড়ির রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন । তিনি প্রথম বিয়ে করেছিলেন চাচুড়ি পুরুলিয়ায় । সুলতান ও তার সহোদরা ফুলমনিকে তার মা রেখে ইস্তেকাল করলে মেছের ধাউড়িয়া নড়াইলের দুর্গাপুর গ্রামের আয়তুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন । কিন্তু গরীব পরিবারে টানাপোড়েন ছিল নিত্য সাথী । সৎ মায়ের সাথে রাগারাগী করে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র সুলতান পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিনকার মহানগরী কোলকাতায় । এটা ছিল ১৯৩৮ সনের ঘটনা । সুলতান ভাইয়ের মুখ থেকে শোনা , মাছিমদিয়া থেকে অর্থাৎ বাড়ি থেকে ৩ আনা বা ১২ পয়সা নিয়ে সামান্য কাপড় ও একটি ছাতা নিয়ে সুলতান হাট বাড়িয়া লঞ্চ ঘাটের দিকে এগুতে থাকেন । পেছনে পেছনে বোন ফুলমনি মা হারা ভাইকে ‘ ফিরে আয় , ফিরে আয় ' বলে কাঁদতে কাঁদতে পিছু নেয় । সুলতান বলেছিলেন , ‘ তুই ফিরে যা , আমি আবার আসবো । ' এরপর নড়াইলের লাল মিয়া নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের বাড়িতে আশ্রয় পান । কোলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্ত্তি হয়ে সোহরাওয়ার্দী পরিবারে থাকবার সুযোগ পান লাল মিয়া । শাহেদ সোহরাওয়ার্দী লাল মিয়ার নাম রাখেন মোহাম্মদ সুলতান । তবে শেখ পদবীটি কার দেওয়া তা আমি সুলতাই ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারিনি । তিনি তার পৈত্রিক গোষ্ঠির নাম যে ধাউড়িয়া তাও কোনদিন উচ্চারণ করেননি । ধাউড়িয়া কি দাড়িয়া বংশনামের অন্য উচ্চারণ তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন ।যা হোক , এরপর লাল মিয়া ধাউড়িয়া শেখ মুহম্মদ সুলতান নামে সভ্য পৃথিবীতে চিত্র শিল্পের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে ১৯৫১ সনে নড়াইলের মাটিতেই ফিরে আসেন । তখন সুলতান এক ভিন্ন মানুষ ও বিশেষ মেজাজের অধিকারী । বিশ্ব নন্দিত এই স্পিী পৈত্রিক ভিটায় গিয়ে দেখেন জনৈক আবুল হোসেন মিয়ার পরিবারের এক অংশ তার পৈত্রিক ভিটায় বসবাস করছে । সুলতানের পিতা মেছের ঐ ভিটার ২৯ শতক জমি একরারনামার মাধ্যমে ১০০ টাকায় বন্ধক রাখেন । বন্ধক রাখার তারিখ ছিল ১৯৪৪ সনের ৩ জানুয়ারি । এর কয়েক মাস পরেই সুলতানের পিতা তার দ্বিতীয় শ্বশুর বাড়ি দুর্গাপুরে বসবাস কালে মারা যান । একরার নামায় আবুল হোসেন মিয়ার পক্ষকে ১০ টাকা ফেরৎ দিলে জমিও ফেরৎ দেওয়ার কথা ছিল । সুলতান পিতার ঐ ভিটেয় আর কখনও বসবাস করতে পারেননি । এই পৈত্রিক ভূমি খণ্ড পাওয়ার আকাংখায় তিনি তার সৎ ভাই আব্দুল ওয়াদুদ , বোন মোমেনা খানম প্রমুখের বিরুদ্ধে ১২/৫/৮৫ তারিখে উপজেলা মুন্সেফ আদালতে একটি মামলা রুজু করেন । এসব পরের কথা । পিতামাতা ও আত্মীয় স্বজনবিহীন পৈত্রিক ভিটায় দখল বা অবস্থান না পেয়ে সুলতান ঢাকায় থাকতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ঢাকায় তখনকার খ্যাতিমান শিল্পীরা ঈর্ষাতুর হয়ে তাকে কোনো অবস্থান নিতে দেননি । অভিমানী কঠোর আত্মসম্মান— বোধসম্পন্ন সুলতান একবার যশোর , নড়াইল , কুড়িগ্রাম , রূপগঞ্জ , চাচুড়ি - পুরুলিয়া করে জীবন অতিবাহিত করলেন । মাটি আর মানুষের দুনির্বার আকর্ষণ কাটিয়ে তিনি বিদেশেও পাড়ি জমাননি । আর কৈশোরের একটি প্রেমে ব্যার্থ হয়েও তিনি চিরকালের জন্য বিয়ে বিমুখ হয়ে রইলেন । আমেরিকা ও বিলাতফেরৎ ও সভ্য পৃথিবীর কাছে আদৃত মহান শিল্পী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবজ্ঞা আর অনাদরে ক্লেশকর জীবন বেছে নিয়েছিলেন । আমি জানি তাকে বহুদিন ধরে অনিদ্রায় অনাহারে কাটাতে হয়েছে । সংসার বিমুখ এই মহৎ শিল্পীকে জীবনের সমস্ত না পাওয়ার তপস্যায় কাটাতে হয়েছে । সমাজের অবিচার অনীহা বেশির ভাগ সময়ই তিনি বৃদ্ধ অশ্বত্থ বৃক্ষের মতো সয়ে নিয়েছেন । এবার শিল্পী সুলতানের এক দার্শনিকসুলভ রসিকতার কথা বলবো । যতদূর মনে পড়ে ১৯৮৫ সনের শেষ দিকে তখনকার ঢাকার জার্মান কালচারাল সেন্টারের পরিচালক পিটার সেভিজ তার ধর্মপুত্র তালিব , ছফা ভাই ( আহম্মদ ছফা ) , সুলতান ভাই ও আমি রূপগঞ্জ বাজার হতে সুলতান ভাইয়ের বাসায় দুপুরে খাবার খেতে যাচ্ছিলাম । আমরা হেঁটে হেঁটে চলছি । নিশিনাথ তলার উত্তর দিকে উপস্থিত হলে সুলতান ভাই তার জুতার সামনে ছোট একটি মরা শুষ্ক সাপ পেলেন । সাপটা আকারে ছোট । রাস্তার তাপে ও মানুষের পায়ের ও রিকসা ভ্যানের চাপে ইংরেজি এস অক্ষরের আকার ধারণ করেছে । সুলতান ভাই ঐ শুকনো সাপের দেহটি বা হাতে উঠিয়ে আমাদের বললেন , ' বলুন তো সাপটি মরার আগে কি বলতে চেয়েছে ? ” আমি বললাম , ' আপনি বলুন, ' সুলতান বললেন , ' সাপ দেহকে এস তৈরী করে বলছে ‘ সেভ ’ , ‘ আমাকে বাঁচাও ’ । আমি বললাম , ' সাপটি মরার আগে বলছে ' স্নেক ' অর্থাৎ ‘ আমি সাপ ' — সাপ তার অস্তিত্বকে ঘোষণা করছে । আমার কথায় সুলতান ভাই ও ছফা ভাই রাস্তার মাঝখানে হেসে উঠলেন । সেভিজ ও তালিব আমাদের ভাষা বোকেনা । পুরো ঘটনা ও কথাগুলো যখন ছফা ভাই তাদের ইংরেজিতে বুঝিয়ে বললেন , তারাও হেসে উঠলেন । সুলতান আমাকে বললেন , ' আপনার কথাটি সুন্দর ও দর্শনপূর্ণ । প্রতিটি জীবনই তার অস্তিত্বের প্রতি দৃষ্টিবান । আল্লাহ এভাবেই সবাইকে সৃষ্টি করেছে । সেদিন দুপুর বেলায় আমরা সুলতান ভাইয়ের বাসায় খুব সুখকর বিচিত্র খাবার খেয়েছিলাম। সুলতান ভাইয়ের সাথে আমার অজস্র সুখ - দুখের দিনরাত্রি যাপনের স্মৃতি আর ইতিবৃত্ত রয়েছে । তা আমার প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ' শিল্পী সুলতানের আত্মোচ্চারণ ও অন্যান্য ' - এ প্রকাশ করেছি । তার সাথে আমার জীবনের শেষ স্মৃতি এমন :১৯৯৪ সনের ৭ জানুয়ারি থেকে ১৬ জানুয়ারি ঢাকার গ্যালারি টোনে ছিল সুলতান ভাইয়ের একক তৃতীয় ও শেষ চিত্র প্রদর্শনী । তিনদিন ধরে তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি । সুলতান ভাইকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে জানতে পারিনি । ১১ জানুয়ারি গ্যালারি টোন থেকে শিল্পী মিঠু আমায় নিয়ে গেলেন ' হোটেল ডি আমাজানে ' । সেখানে শীর্ণদেহী শ্বাস কষ্টের রোগী সুলতান ভাইকে পেলাম । তিনি আমায় দেখে শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। আমাকে বললেন , ' কবি সাহেব , আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান । আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। তাকে সান্ত্বনা যোগালাম । বললাম , ' এই শীতে আপনার তো নড়াইলের বাইরে আসা ঠিক হয়নি । তিনি জানালেন , ' এরা ছাড়েননি ' । আমি জানি সুলতান ভাইয়ের ভালবাসার দায় ভোগে কতো না দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে । জীবনের শেষ দিকে তার আর ব্যতিক্রম হবে কেন ? সেটি ছিল হোটেলের ৭ নং কক্ষ । কঁাথা কাপড় একেবারে ময়লা । সুলতান ভাইয়ের শীর্ণ দেহে একটি অতি সাধারণ গেঞ্জি জড়ানো । কিছু সময় পরে তিনি আমার কাছে দুটো ভেল্টোলিন টেবলেট চাইলেন । আমি ঔষধ আনতে উদ্যত হলে শিল্পী মিঠু কাউকে দিয়ে ভেন্টোলিন আনিয়ে দিলেন । সেদিন প্রায় পৌনে দু'ঘন্টা কথা হলো । ঢাকায় থাকার সুবাদে আমাদের আগের যোগাযোগ নেই বলে আমি দুঃখ করলাম । তিনি বললেন , ' কয়েকমাস আগেও যখন নড়াইলে দেখা হয়েছে , যোগাযোগতো আছে । আমি আপনার লেখা পড়ি । ভাল লাগে । দিন শেষে আবার নড়াইলে ফিরে যাবেন । ' আমি কোনো জবাব দেইনি । সুলতান ভাইয়ের সাথে বন্ধুবর মিঠু আমারও একটি ছবি তুলে রাখলেন। আমি হেসে বললাম , ' এমনও হতে পারে এই আমাদের জীবনের শেষ ছবি । ' সুলতান কিছু বললেন না । কেমন যেন মিইয়ে গেলেন । তার তামাটে ছোট মুখ খানি কোন অজানা স্লানিমায় ভরে গেল । মাথা নিচু করে রইলেন । চোখ দুটো তঁার আলতো ভিজে গিয়েছে । ঐ দৃশ্যে আমি কষ্ট পেয়েছি । আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছে । কেন আমি এমন কথাটা বললাম । জীবনবাদী সুলতান শেষ হয়ে যাওয়ার শেষ কথা একেবারেই শুনতে চাইতেন না । এরপর এক সুঠাম দেহী মহিলা সুলতান আর নীহারবালার জন্য একটি শিশুকে সাথে করে ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে এলেন । দুপুরের খাবার খাবেন তারা । সম্ভবত ৩ টার ফ্লাইটেই তিনি সেদিনই যশোর গিয়েছিলেন । আমার বাসাবোর ছোট্ট বাসায় আর তাকে আনা হলো না । বিদায় নেওয়ার সময় বললাম , ' সুলতান ভাই পত্রিকায় আছি জানেন । নড়াইল যাওয়ার সুযোগ কম । কি জানি কবে দেখা হয় । ' তিনি আস্তে করে বললেন , ' তাইতো । আপনি সুখী হবেন । আবার দেশে ফিরে যাবেন । কিন্তু আমি যখন দেশে ফিরে গিয়েছি তখন আমার চির অভিমানী সুলতান ভাই কিংবদন্তির পুরুষ শেখ মোহাম্মদ সুলতান এই মরদেহে আর নেই । তিনি তার চির সুন্দরের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন । নড়াইলের দীর্ঘ ঘোরাফেরা বিষাদের কালিতে কালো হয়ে থাকলো — আমার সঙ্গীরা কেউ তা বুঝতে পারেনি । তবে ক্যামেরায় বন্দী করলাম সুলত'ন ভাইয়ের প্রিয় পশু - পাখী , বাসগৃহ , শিশুস্বর্গ , ও তাঁর মাটির শেষ শয্যা কবরগাহ ।সুলতান ভাইয়ের প্রসঙ্গে আমার অনেক বলার ছিল , অনেক বলার আছে । সব কথা বলার অবকাশ এখানে নেই। তবে তার পিতৃ ভিটের শেষ কথাটি বলা দরকার । বন্ধক দেওয় ৷ পিতৃভিটের ওপর দিয়ে ঢাকা - খুলনা হাইওয়ের ব্লুপ্রিন্ট ছিল বেশ আগেই । সুলতান ভাই কোর্টে ইনজাঙ্কশন জারি করিয়ে তার জীবন কালে পিতৃ ভিটেটি রক্ষা করেছিলেন । কিন্তু তার মৃত্যুর পরে তার পিতৃভিটে রক্ষার আর কেউ রইল না । আর তাই চিত্রা নদীর ব্রীজ নির্মাণে সুলতান ভাইয়ের জন্মভূমি বাঙালির স্মৃতিতীর্থ কোদালের আঘাতে চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে । আর আমরা সব অসম্ভবকে সম্ভব বলে গ্রহণ করলাম কোনো কষ্টই অনুভব করিনি ।


Share

Recent Comments

Recent Articles