সুলতান : জীবন ও শিল্পবোধ

প্রতিটি মানুষেরই একটি ঠিকানা থাকে। সুলতানেরও ঠিকানা ছিল। ঠিকানাটি বাংলাদেশ । বাঙালি হিসাবে বাংলাদেশকে তিনি মনে প্রাণে ভালোবাসতেন। তাই পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে এসে ঠাঁই নিলেন এই দেশে । তাও আবার শহরে নয়, রাজধানীতে নয়, নড়াইলের গ্রামে। বন বাদাড়ের পশুপাখি আর মানব সন্তান নিয়ে বসবাস।

সুলতানের জন্ম কৃষিজীবী পরিবারে । বাবা কৃষক তাই শিশু কাল থেকেই অবলোকন করেছেন কি ভাবে খরায়, বন্যায়, রৌদ্র বৃষ্টিতে মানুষ মাটির বুক থেকে ফসল তুলে আনে । আর সে ফসলেও ভাগ থাকে অন্যজনের। সর্বসাকুল্যে যা পায় তাতে সারা বছরের আহার জোটানোর কষ্টকর জীবন যাপন।

গ্রামের পুকুরে নদীর তীরে বাংলার নারীদের দেখেছেন কলসী কাঁখে পানি আনতে, ধান ভানতে, শাপলা তুলতে খাদ্যের সংস্থানের জন্য।

শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম নেয়া এই ক্ষণজন্মা মানুষটি জীবনের প্রতিপদে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন।কারও প্রতি কোনো অনুযোগ অভিযোগ ছিলোনা তাঁর। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ জীবনে করেছেন কিনা সন্দেহ আছে । যদি তাই করতেন তবে হয়তো একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পী হতেন ; প্রকৃত শিল্পী বা স্বভাব শিল্পী হতেন কিনা সন্দেহ আছে।

বিভাগ পূর্ব বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বহুদেশে, বিচিত্র পরিবেশে বৈচিত্র্যময় জীবন যাপন করেও সুলতান স্থিতি নেননি কোথাও। যাবাবর জীবন যাপন ছিলো তাঁর সবচেয়ে পছন্দের। জীবনের বা মনের কোনো বন্ধনই তাঁর স্বভাবজাত ছিল না। একমাত্র দেশ ও দেশের মানুষের বন্ধনই তাকে ফিরিয়ে এনেছে, ধরে রেখেছে আপন করে।

ছেলেবেলায় বৃটিশ ভারতের খ্যাতনামা পন্ডিত, বিজ্ঞ চিত্র সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাহচর্য ও পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা সুলতানের মধ্যে সুলতানী মেজাজ তৈরী হয়েছিল। সে মেজাজে যৌবন কাটিয়েছেন তিনি। মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনই যাননি তিনি তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর শিল্প শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ঘুরে বেড়ালেন সারা ভারত। পছন্দ হলো সিমলা। জীবনের বেশ কিছু সময় কাটালেন সেখানে, আঁকলেন প্রচুর ছবি। প্রদর্শনীও করলেন। ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। তখন ভারতবর্ষের ছবি আঁকার ধারার বিপরীত সে সব ছবি। উজ্জ্বল রঙ আর তুলির আঁচর দিয়ে জলরঙে আঁকা সে সব ছবি আজ বিরল, মাতৃভূমির সংগ্রহে আর থাকলো না। দেশভাগের পর চলে এলেন পাকিস্তানে ( পূর্ব ও পশ্চিম ), দেশে ( পূর্ব ) কদর না পেয়ে চলে গেলেন পাকিস্তানে। সমাদর পেলেন। সেখানে শিল্পীদের সাথে গড়ে উঠলো সখ্য। কাশ্মীরের ভূচিত্র এঁকে প্রশংসা কুড়ালেন । সে সব ছবি ছিল পশ্চিমা এক্সপ্রেশনিস্ট ধাঁচের রঙের ব্যবহার ছিল কিছুটা ঐ ধরনের। পরবর্তী জীবনে এসব রঙ তাঁর ছবিতে স্থায়ী ভাবে আসন লাভ করেছিলো।

ইউরোপ ভ্রমণের সুযোগ আসে পাকিস্তান শিল্পী প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে। প্রখর দৃষ্টিতে অবলোকন করলেন তিনি সে সব দেশের শিল্প জগৎকে। অতীত বর্তমান সব কিছুই। হতাশামিশ্রিত আশা নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। কিন্তু আশার চেয়ে হতাশাই তাঁকে পেয়ে বসে বেশী। জীবন সম্পর্কে তাঁর মূল্যবোধ দাড়ায় অন্য রকম। জীবনকে বিলিয়ে দিলেন প্রেমপূজারী হিসাবে। পঞ্চাশের দশকে সুলতান হলেন প্রকৃত যাযাবর। ঘর নেই ঠিকানা নেই আহার বিহারে চিন্তা নেই । হাতে বাঁশী । কাঁধে বাঁশির ব্যাগ, পরনে গেরুয়া পোশাক; এক সন্ন্যাস রূপ নিলেন তিনি। তার বাঁশির সুর মানুষের মনে দোলা লাগাতো। কত মারধর খেয়েছেন সুলতান, কত গালমন্দ শুনেছেন, কোনো প্রতিবাদ করেন নি কখনও। নড়াইল বাসী তাকে অপমানিত অপদস্ত করেছে । ব্যতিক্রম যে ছিলোনা তা নয়, নড়াইল সরকারী কলেজের ছাত্ররা তাঁকে পছন্দ করতো । তাদের আশ্রয়ে থাকতেন, আবার একদিন কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ উধাও হয়ে যেতন। আবার হয়তো কিছুদিন পর বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসতেন। নেশা আর বাঁশি এই ছিল তাঁর তখনকার জীবন। পুরো দশকটাই এমনি করে কেটে গেল। এই দশকের প্রথম কয়েক বছর তিনি সুস্থভাবে কাজ করেছিলেন। লাহোরে দু'টি প্রদর্শনীও করেছেন । ছবিও এঁকেছেন প্রচুর । ষাটের দশকে তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায় নি সুলতানের। দু'একজন পরিচিত জন ছাড়া তাঁর খোজ খবর কেউ রাখতো কিনা বলা মুসকিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৬ সালের দিকে তিনি আবার উদয় হলেন নবউদ্যোমে । হয়তো এই স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। এ সময়ে ডাক পেলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে একটি প্রদর্শনী করার। দীর্ঘ কয়েক মাস শিল্পকলা একাডেমীর বিশাল গ্যালারী কক্ষে একের পর এক সৃষ্টি করে গেলেন দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার। মনের ভেতরের পুঞ্জিভূত জীবন বোধকে, নিজের শিল্প বোধকে উজাড় করে দিলেন ।

এই প্রদর্শনী থেকেই প্রকৃত নবপ্রজন্মের শিল্পানুরাগী শিল্পরসিক এবং শিল্পীরা সুলতানকে চিনতে শিখলেন। চারিদিকে সুলতানের ভক্ত- অনুরক্তের অভাব হলো না। শিল্প সংগ্রাহকগণ সুলতানের ছবি সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। দেশে বিদেশে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হলো। হারিয়ে যাওয়া সুলতানকে আবার এদেশের মানুষ তাদের কাছে পেল।

শিল্পী সুলতানের জীবনবোধ ছিল ভিন্ন। তিনি যেখানে গিয়েছেন, দেখেছেন যে মানুষ কারিগর। মানুষ সৃষ্টি করে যাচ্ছে তার নিজের শ্রম, সৃজনশীলতা আর মেধা দিয়ে, গোড়া থেকে প্রতিটি ধাপ যাচ্ছে সাফল্যের দিকে। প্রতিটি ধাপের প্রক্রিয়া করণকৌশল সম্পর্কে সদা সচেতন, সতর্ক ভাবে সৃষ্টি করে যাচ্ছে। একজন কৃষক সচেতন সর্তক ভাবে মাঠে ফসল বুনছে, একজন মাঝি সচেতন সতর্ক ভাবে নৌকা বেয়ে যাচ্ছে। একজন গায়ের বধূ তার কর্ম সচেতন ভাবে করে যাচ্ছে। একজন স্ত্রী তার স্বামীর পাশাপাশি সতর্ক সচেতন ভাবে কাজ করছে। এই যে সচেতনতা, সতর্কতার কারণ শিল্প নির্মাণ কৌশলের দ্বারা হয় না এজন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। সুলতানের মধ্যে এর সমন্বয় ছিল । এজন্যই তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন ‘প্রথম রোপপ ' - এর মত ছবি। এ ছবির বিষয়টি অতি সাধারণ।আমাদের লোকচক্ষুর অগোচরে হাজারো গাছ জন্মাচ্ছে কারও না কারো হাতে কিন্তু প্রথম যিনি গাছের চারা লাগালেন তার একটি রূপদান কি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলো শুধু সুলতানের জন্য। আমার মনে হয় সত্যিই তাই । সুলতান না এলে হয়তো এমন করে জানতে পারতাম না প্রথম চারা লাগানো মানুষটিকে অর্থাৎ আদমকে।

সুলতান যদি ইউরোপে তাঁর ছবি আঁকতেন তবে হয়তো আলোড়ন হতো কিন্তু বাংলাদেশ বলেই তা হয়নি । শিল্পী আকোন্দি জেলখানায় আটক থেকে দেয়ালে ছবি এঁকেছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তা আজ সংরক্ষিত। সুলতানকে বন্দী করে রেখেছিলো সমাজ, প্রকাশ করতে দেয়নি তাঁর অন্তরের জ্বালাকে। জীবন সায়াহ্নে এসে উজাড় করে দিলেন সবকিছু।

সুলতানের ছবির নিজস্ব গঠন শৈলী ছিল, যে শৈলী তাকে স্বকীয়তা দান করেছে, করেছে অমর। তাঁর এক ভক্তের মুখে শুনেছিলাম। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে কয়েকজন বিদেশী শিল্পী নড়াইলে এসেছিলেন সুলতানের ছবি আঁকার করণ - কৌশল সম্পর্কে জানার জন্য । সুলতান সেদিন তাদের সারারাত ছবি আঁকার তালিম দিয়েছিলেন । তারা নিয়ে গেল সুলতানের কৌশল। কারণ আমাদের চোখ খুলেছে সত্তরের দশকে । আমরা তার আগে সুলতানকে চিনিনি । চিনিনি বলেই তিনি সব সময় রাজধানী থেকে দূরে থাকতেন, পছন্দও করতেন। নিজেকে গুটিয়ে রাখার একটি অভিনব অভিমান তাঁর ছিলো। তিনি বৈষয়িক ছিলেন না । বিষয় নিয়ে ভাবনা করেন নি। নিরাভরণ সন্ন্যাস জীবনযাপন করতেন । তাঁর কাছে জাতপাত হিন্দু মুসলমান কোনো ব্যাপার ছিল না । তাই তিনি নড়াইলের নব প্রজন্মের কাছে ছিলেন কাকু হিসেবে পরিচিত । আর সবার কাছে ছিলেন সুলতান ভাই ।

সহজ সরল এই মানুষটির ছবির বিষয় ছিল সহজ সরল । কোনো বুদ্ধির মারপ্যাচ নেই তাঁর ছবিতে । যা আমরা দেখেও দেখি না। আমাদের অতীত যা আমরা ভুলে যাই নগর জীবনে তিনি আঁকতেন সেসব ছবি । ছবির বিষয় সবই এদেশের কিন্তু তার কাঠামোগত দিক, গড়নগত বলিষ্ঠতা ভারতীয় ভাস্কর্যের সংগে তুলনীয়। ভারতশিল্পের এক বিরাট অংশ জুড়ে ভাস্কর্য ( ডিপ রিলিফ ) অজন্তা, ইলোরা, মহাবলীপুরম - এর শীলাকাব্য যেমন বলিষ্ঠ, যেমন সৌন্দর্যমন্ডিত, বীর্যবান, তেমনি সুলতানের ছবির মানব মানবী। তিনি তাঁর ছবির মানবমানবীকে কখনই অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখতেন না। যে মানুষ এই বিশাল পৃথিবীর সমস্ত জড় ও জীবের অধিকর্তা সে মানুষের নিয়ন্ত্রণের অধীন এ বিশ্ব প্রকৃতি, সকল সৃষ্টি, কোন অর্থে সে মানুষ ক্ষীণকায় দূর্বল হবে ? সেই আদিকালে, আদিম মানুষ ভয়ংকর পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে টিকিয়ে রেখে গেড়েছে সভ্যতার বীজ, গতিময় করেছে সংস্কৃতির ধারাকে । পাহাড়ের গায়ে এঁকেছে ছবি । কঠিন শীলাকে দিয়েছে মৃন্ময়রূপ । মানুষ জল, মাটি প্রাকৃতিক দূর্যোগকে উপেক্ষা করে টিকে আছে। তারা যদি ক্ষীণকায়, শীর্ণকায় হয় তবে উন্নতি কিভাবে হবে। মানুষকে হতে হবে সবচেয়ে শক্তিশালী, একমাত্র মানুষই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে । তাই আমরা তাঁর ছবিতে দেখতে পাই মানুষের অন্য রূপ। মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে ক্যানভাসের দেয়ালে রং তুলির হাতুড়ী নিয়ে খোদাই করেছেন এদেশের জীবন গাথা। প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর যেমন গড়েছেন পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন দেব - দেবীর কাল্পনিক অবয়ব। সে ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখে শিল্পী সুলতান তাঁর ছবির পাত্রমিত্রকে দেবতা ও দেবীর রূপ দিয়েছেন। যারা শিল্পীর অভিজ্ঞতা প্রসূত ও কাল্পনিক সৃষ্টি। এর পেছনে শিল্পীর নিজস্ব দর্শন কাজ করেছে সে কথা অনস্বীকার্য। একটি আগ্নেয়গিরির জন্ম হয় পাহাড়ের অভ্যন্তরে । আমরা দেখতে পাই যখন তা বিস্ফোরিত হয় । তার আগে আমরা বুঝতে পারি না। সুলতান ছিলেন এমনি একজন শিল্পী যার ভিতর আগ্নেয়গিরির আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিলো। কিন্তু বিস্ফোরিত হবার সুযোগ আসেনি। যখন এসেছে তখন বিশাল ক্যানভাস জুড়ে তাঁর শিল্প দর্শন, শিল্প বোধকে প্রকাশ করেছেন।

একজন মহৎ শিল্পী সারা জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকেন, কিন্তু প্রকাশ পায় সে অভিজ্ঞতার কিছু মাত্র । তাতেই আলোড়িত হয় দেশ, সমাজ, জাতি। একজন শিল্পীর জীবনবোধ ও শিল্পবোধ তখনই কল্যাণকর হয় যখন তার সৃজনশীলতা সমাজ ও জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। জাগিয়ে তুলতে পারে নিজস্ব সংস্কৃতি আর কৃষ্টিকে। শিল্পী সুলতান তেমনি এক শিল্পী যিনি এ দেশের সংস্কৃতিকে যোগান দিয়েছেন এমন এক ফল্গুধারা যার শেষ নেই ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles