সুলতান কেন ?
আমরা যখন তরুণ, তখন এসএম সুলতান জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর সম্পর্কে বিচিত্র মিথ প্রচলিত ছিল আমাদের মধ্যে। এই মিথের সবই যে মিথ্যা ছিল, তাও নয়। তবে শিল্পীর বাহ্যিক বর্ণাঢ্য জীবন, কিছুটা হলেও তাঁর দার্শনিক অন্তরসত্তাকে আড়াল করে রেখেছিল । একপ্রকার সৌভাগ্য বলতে হয়, শিল্পী সুলতানের ওপর আমার প্রামাণ্যচিত্র আদম সুরত শেষ করতে সাত মাসের জায়গায় সাত বছর লেগেছিল। তাতে প্রামাণ্যচিত্রের ক্ষতি - বৃদ্ধি কী হয়েছিল তা অন্য কথা, কিন্তু সুলতানের দীর্ঘদিনের সান্নিধ্যে থেকে নিজেকে বহুভাবে সমৃদ্ধ করার সুযােগ পেয়েছিলাম। সুলতান বলতেন, 'কৃষকের জীবনকে আগে দেখতাম বার্ডস আই ভিউ থেকে, এখন দেখছি ফ্রগস আই ভিউ থেকে, তাই ওদেরকে এত বড় মনে হয়।' আমিও তেমনি পরের দিকে শিল্পী সুলতানকে কাছ থেকে দেখার সুযােগ পেয়েছিলাম। কত বড় মাপের শিল্পী তা বিচার করার অধিকার আমার নেই, কিন্তু কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তা জানার সুযােগ হয়েছিল । অবশ্য এই দেখার চোখ সৃষ্টিতে আহমদ ছফার অবদান রয়েছে। ওই সময় আমাদের অনেকেই সুলতানের কোনাে অরিজিনাল সৃষ্টিকর্ম দেখার সুযােগের আগেই আহমদ ছফার বাংলার চিত্র ঐতিহ্য ও সুলতানের সাধনা পুস্তিকাটি পড়ার সুযােগ হয়েছিল।
সত্তর দশকের দ্বিতীয় ভাগে শিল্প-সংস্কৃতির সব শাখায় নতুন করে শিকড় সন্ধানের ব্যষ্টিক ও ব্যক্তিক উদ্যোগ দেখা যায়।শুধু শিকড় নয়, প্রতিটি মাধ্যমে নতুন শিল্পভাষা সৃষ্টির তাগিদও লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে সেলিম আল দীনের নাটক ও 'গ্রাম থিয়েটার ’ নিরীক্ষা । আশির দশকের গােড়াতে অন্যান্য মাধ্যমেও ভাবনাটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবিতার ক্ষেত্রে 'রাখাল’ গােষ্ঠীর আবির্ভাব সুলতানের 'প্রথম বৃক্ষ রােপণ’কে প্রচ্ছদ করে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মানুষের মানচিত্র কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ—এসবের অন্যতম দৃষ্টান্ত। চিত্রকলার বিমূর্তপ্রধান আধুনিকতাবাদী গণ্ডিকে অতিক্রম করে একদল প্রতিভাবান তরুণ চিত্রশিল্পী মূর্ততার দিকে ফিরে গিয়ে আখ্যান নির্মাণে কেবল স্পেস নয়, সময়কেও ধারণ করার উদ্যোগ নেন । এই তরুণদের সমস্বর শুনতে পাই, 'সময়’র সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে। 'সময়' গােষ্ঠীর শিল্পীদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ও গােষ্ঠীগত সম্পর্ক আদম সুরত নির্মাণের সিদ্ধান্তে পরােক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য।
আমাদের চলচ্চিত্র মাধ্যমটি কেবল তখনাে নয়, এখনাে শিকড়-বাকড়হীন। শুধু ভিত ও ভাষা নয়, মাধ্যমটির খােলনলচে বদলানাে জরুরি হয়ে পড়েছিল। সুলতানকে নিয়ে ছবি বানানাের আমাদের এই উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন বা একক ভাবনার ফল নয়। বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী সুলতানকে নিয়ে ছবি নির্মাণের স্বপ্ন দেখছিলেন।তাঁদের অন্যতম নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও সাজেদুল আউয়াল শামীম। আদম সুরত নির্মাণে মিশুক মুনীরের সম্পৃক্তি কাকতালীয় নয়। ইতিমধ্যে মুভি ক্যামেরায় না হলেও স্টিল ক্যামেরায় বিভিন্ন বাউল মেলার ছবি তুলে বেড়াচ্ছিল মিশুক। আমার জন্ম গ্রামে, বেড়ে ওঠা আড়ং মেলা, বিশ্বকর্মার নৌকাবাইচ, যাত্রা, বাউল গানের আবহের মধ্য দিয়ে। নিজে গাঁয়ের ছেলে বলে এসব তেমন গা করিনি। বরং বছরে এক- দুবার ঢাকা শহরে এলে রাতের বেলা আলাের বন্যা দেখে মনে হতাে, এ যেন স্থায়ী মেলা-পার্বণ !
গাঁয়ের ধুলাকে গায়ে না নেওয়ার আরেকটা বড় কারণ ছিল আধুনিকতার জোয়ার। পশ্চিমা ভাবধারা ধনতান্ত্রিক হােক আর সমাজতান্ত্রিক হােক — দুটোই আমাদের শিখিয়েছিল গ্রামীণ সব কিছুকে গ্রাম্য বলে পরিত্যাগ করা। আমাদের জন্য নাগরিক হওয়াটা সাহেব হওয়ার পূর্বশর্ত ছিল। পােশাক-পরিচ্ছদ শীত ও তাপ থেকে রক্ষার জন্য নয়, বরং নিজেদের কালাে শরীরকে যত বেশি ঢাকতে পারি, তারই চেষ্টা। অন্যদিকে বাউল ও আধ্যাত্মিক গান প্রগতিশীল আদর্শের চোখে ছিল নেহাত ভাববাদী সামন্ত সংস্কৃতি মাত্র। এভাবে যখন আমরা আধুনিকতার নামে হাজার হাজার বুনাে ফুল পায়ে দলে ফেলছি, তখন সুলতান আমাদের গ্রামবাংলাকে নতুন করে আবিষ্কারের পথ দেখালেন।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আদম সুরত নির্মাণে যতটা সময় সুলতানকে কেন্দ্র করে শুটিং করেছিলাম, এর চেয়ে ঢের বেশি শুটিং করেছিলাম বিচিত্র মেলা-পার্বণ। শুটিং করেছিলাম চৈত্রসংক্রান্তির মেলা, রথযাত্রা, বিশ্বকর্মার নৌকাবাইচসহ বহু বাউল মেলা। মনে মনে স্বপ্ন ছিল, লােকজ উৎসব নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করব।কিন্তু আদম সুরত নির্মাণে প্রাণান্ত অবস্থা হয়ে যাওয়ায় ‘লােকজ উৎসব’ লােকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেল। আমার মনে পড়ে, ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি পড়ে আছে ... দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে ... সুলতানের ভাঙা - পােড়াে বাড়িতে আমরা দলবল নিয়ে পড়ে আছি। সুলতান ভাই একদিন নিয়ে যাচ্ছেন সাঁওতালপাড়ায় তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখাতে, আরেক দিন নিয়ে যাচ্ছেন জেলেপাড়ায় সারা রাত কীর্তন শােনাতে। একদিন বিকালে বললেন, চলুন আপনাদের এক জায়গায় নিয়ে যাই। আমরা শুটিংয়ের লটবহর গােছগাছ শুরু করতেই বললেন, এগুলাে থাক! গন্তব্যে পৌঁছার কিছু আগেই শুনতে পেলাম বিচ্ছেদ গানের সুর ভেসে আসছে। পৌঁছানাের পর বুঝতে বাকি রইল না আমরা বিজয় সরকারের বাড়িতে ! গানের বিশাল আসর বসেছে।
লোকজ সংস্কৃতি ও কৃষিপ্রধান লােকজজীবনের সঙ্গে সুলতানের যােগসূত্রকে যতটা সহজ ও সরল মনে হয়, ততটা নয়। সুলতানের নাইভিটি বা সারল্য কোনাে বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত নয়, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত।সুলতানের বাংলাদেশ পল গগ্যার তাহিতি নয়। তাঁর কৃষক আদর্শায়িত অথচ সংগ্রামী। সুলতানের নারী শিল্পীর নয়, কৃষকের স্বপ্নের নারী। গগ্যা যেখানে তাহিতির নারীদের আদর্শায়িত করেছেন, তেমনই সুলতান সমগ্র কৃষিসমাজকে মহিমান্বিত করেছেন।
আমি যখন শিল্পী সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করি তখন অনেক জ্ঞানী - গুণীর প্রশ্ন ছিল, জীবিত-মৃত এত শিল্পী থাকতে সুলতান কেন ? অনেকটা আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলার মতাে করে কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করেছি, ছবিটি করতে চাই এ কারণে নয় যে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী । বরং এ কারণে যে তথাকথিত উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে পড়া একটি কৃষিপ্রধান দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সুলতানের জীবন ও কর্ম প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। বাংলার কৃষকসমাজ একজন বড় শিল্পীকে মহৎ শিল্পীতে রূপান্তরিত করেছে। একজন শিল্পী তার সমাজকে বদলানাের যে ক্ষমতা রাখে, তার চেয়ে বরং সমাজ ও সময় একজন শিল্পীকে বদলে দেওয়ার ঢের শক্তি রাখে। সুলতান তার দৃষ্টান্ত । উনসত্তরের গণজাগরণ ও মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর সম্পৃক্ততা সুলতানের শিল্পীসত্তাকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যে কত বড় ভূমিকা রেখেছিল, দীর্ঘ বিরতির পরে '৭২ সালে সুলতানের আঁকা ‘গণহত্যা ’ চিত্রকর্মটি এর প্রমাণ ।
তথ্যসূত্রঃ চলচ্চিত্রযাত্রা
তারেক মাসুদ
কথাপ্রকাশ
কথাপ্রকাশ সংস্করণ
আগষ্ট ২০২১
Recent Comments