সুলতান তাঁর সালতানাত ত্যাগ করেননি
এক মুহূর্তে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটে যায়। সবই ঠিক ছিল, জীবন চলছে তার নিজস্ব গতিতে। হঠাৎ কেমন ওলট পালট হয়ে যায়। গত ১০ অক্টোবর ভোরবেলা খবরের কাগজে একটি খবর পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো। আমাদের দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর এস. এম. সুলতানের অবস্থার অবনতি, এই শিরোনামায় একটি খবর ছাপা হয়েছে— কালো হরফগুলো একটি আশঙ্কাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় সব রকমের চিকিৎসার পরও তাঁর অবস্থার কোনোরকম উন্নতি হচ্ছে না, বরং অবনতির দিকে যাচ্ছে। এই মন খারাপ করা খবর পড়ার পরও আশা ছিল সুলতান আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন। এর আগেও তিনি গুরুতর অসুখে ভুগেছেন, কিন্তু সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছেন একাধিকবার। ফলে, তাঁর নিরাময়ের আশা নিভে যায়নি। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা 'ওস্তাদ মমতাজ আলী খান স্মৃতি ও সঙ্গীত পরিষদ' - এর বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাই। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত মুস্তফা জামান আব্বাসী এবং তার স্ত্রী আসমা আব্বাসী । কথা বলার এক ফাঁকে আসমা আমাকে জানালেন, শিল্পী এস. এম. সুলতান হয়তো বাঁচবেন না। তার কন্ঠে উদ্বেগ ছিল, শোকের ছায়া ছিল। একটু পরে তার কাছ থেকেই জানলাম, আমাদের দেশের গৌরব, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রকর সুলতান আর নেই। মন বিষাদে ভরে গেলো।এস. এম. সুলতানের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাঁকে প্রথম দেখি পঞ্চাশের দশকের আদি পর্বে । তখন আমি পুরনো ঢাকার সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনে অর্থাৎ আশেক লেনে থাকি । প্রায় রোজই যাই হামিদুর রহমানের বাসায়। আশেক লেনে আসার কিছুদিনের মধ্যেই হামিদের সঙ্গে আমার দেখা হয় এবং আমরা পরস্পর বন্ধু হয়ে যাই। হামিদুর রহমান তখনো শিল্পী হয়ে ওঠেন নি, সবেমাত্র গল্প এবং কবিতা লেখা মশকো করতে চেষ্টাশীল। একদিন সকাল ন'টার দিকে রওয়ানা হয়েছি হামিদের বাসার দিকে। আমাদের দু'জনের বাসা এতো কাছাকাছি ছিল যে, তিন চার মিনিটে আসা - যাওয়া করা যেতো। হামিদুর রহমান থাকতেন বাড়ির শেষপ্রান্তে ছোট একটি ঘরে। সেই ঘরে পৌঁছতে হলে একটি নাতিদীর্ঘ গলি পেরুতে হতো। গলিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই কানে ভেসে এলো বাঁশির সুর। হামিদের ঘরে ঢুকে দেখি একজন তন্ময় হয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছেন আর সারা ঘরে পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরছে সুর। সুর থেমে গেলে হামিদ সেই বংশীবাদকের সঙ্গে আমার পরচয় করিয়ে দেন। সেই অপূর্ব বংশীবাদকই শিল্পী এস এম সুলতান। তখন সুলতানের চুল এতো দীর্ঘ ছিল না, বেশ ছোটই ছিল। কিন্তু তাঁর মুখে পরিব্যাপ্ত ছিল উদাস প্রসন্নতা এবং সারা শরীরে ছিল এক ধরনের আচ্ছন্নতা, যা গঞ্জিকাসেবনেরই প্রসূন হয়তো। কথা তেমন কিছুই হয়নি, কিন্তু বুঝতে পারলাম আমি একজন অসাধারণ ব্যক্তির মুখোমুখি বসে আছি। তখন তিনি সদ্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসেছেন ঢাকায়। তিনি বেশ কিছুকাল ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে।কিন্তু কোথাও বেশিদিন স্থির হয়ে বসার মানুষ নন জাতশিল্পী সুলতান। শুধু শেষের দিকে কয়েক বছর থিতু হয়েছিলেন তাঁর আপন নড়াইলে।
সুলতান বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করে গেছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বিশদ জানতে হলে সকলের অবশ্য পাঠ্য আমাদের অন্যতম কৃতী কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই - এর লেখা উপন্যাস 'সুলতান' । যদিও উপন্যাস, তবু এই বইয়ে চিত্রকর এস.এম.সুলতানের জীবনের বহু সত্য ঘটনাই বিবৃত। এতে প্রকাশিত হয়েছে একজন অসামান্য শিল্পীর প্রকৃত জীবন । হাসনাত আবদুল হাই- এর ‘ সুলতান ’ এবং বাস্তব জীবনের সুলতানের মধ্যে কিছু ভেদ অবশ্যই আছে, কিন্তু এই ভেদরেখা এমনই ক্ষীণ যে, তা' নিয়ে কথা বলা অবান্তর। একজন শিল্পীর জীবনকে হাসনাত আবদুল হাই লিপিবদ্ধ করেছেন বিশিষ্ট রূপদক্ষতায়। গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের এক বালক লাল মিয়া কী করে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একজন অসাধারণ মানুষ এবং শিল্পীতে বিকশিত হয়ে উঠলো তারই ইতিহাস 'সুলতান'।
বহুদিন পর বাংলাদেশে সুলতান যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত চিত্রকর হয়ে ওঠেন তার পেছনে যে দু'তিনজনের অবদান রয়েছে তাঁরা হলেন শক্তিমান লেখক আহমদ ছফা, তরুণ শর্টফিল্ম নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং আমার প্রয়াত বন্ধু আশরাফ আলী। কয়েক বছর আগে আহমদ ছফা সুলতান বিষয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। আশরাফ আলী লেখেন ইংরেজিতে, সম্ভবত হলিডে পত্রিকায়। তারেক মাসুদ ‘আদম সুরত' নামে সুলতান সম্পর্কে একটি চমৎকার শর্টফিল্ম নির্মাণ করেন। জার্মানিতে যে সাম্প্রতিককালে আমাদের প্রিয় শিল্পী এস.এম. সুলতান বরণীয় হয়ে ওঠেন, নিঃসন্দেহে তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার জন্যই, তবে সেখানে তাঁর চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠান এবং প্রচারের পক্ষে কাজ করেছিলেন আহমদ ছফা। মনে পড়ে, 'আদম সুরত' শটফিল্মে আশরাফ আলী সুলতান - এর সঙ্গে আলাপচারী হয়েছিলেন নড়াইলে শিল্পীর ধ্বংসস্তূপপ্রতিম বাসভবনে।
সুলতানের সেই লতাগুল্ম এবং গাছপালা ভরা, কালের ক্ষতচিহ্ন বহনকারী বাড়ি অনেকের স্মৃতিতেই ভাস্বর হয়ে আছে। আমরা যারা যাইনি নানা পশুপাখিময় সেই ভবনে তাদেরও কল্পনায় জাগ্রত তার পরিবেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকোষ্ঠ। বিভিন্ন ব্যক্তির বর্ণনা শুনে, বিশেষত হাসনাত আবদুল হাই- এর সৌজন্যে প্রবাদপ্রতিম সুলতানের ক্ষয়িষ্ণু প্রাসাদ একটি বিশিষ্ট চরিত্রের মর্যাদা পেয়েছে আমার কাছে। পশুপাখি ও গাছপালার প্রতি সুলতানের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম এবং গভীর। তিনি যে কী রকম বৃক্ষপ্রেমিক তার ঈষৎ পরিচয় পাই বিখ্যাত ত্রৈমাসিক মীজানুর রহমানের পত্রিকার সম্পাদকের ধানমন্ডির বাসায়। এক শীত রাতে সুলতান এবং আমি আমন্ত্রিত ছিলাম বন্ধু মীজানের বাসায়। মীজানও পুষ্পবিলাসী এবং বৃক্ষপ্রিয়। এ জন্যই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল তাঁর ত্রৈমাসিকের অসাধারণ একটি বৃক্ষসংখ্যা প্রকাশ করা। শীতের কুয়াশায় বুকে হাঁপানির টান নিয়ে সুলতান মীজানের বাগানের গাছ দেখতে গেলেন । সে - রাতে কথা বলতে গিয়ে লক্ষ্য করেছিলাম, সুলতানের মধ্যে এক ধরনের আধ্যাত্মিক তরঙ্গ বয়ে যায়।
সাধারণ মানুষের প্রতি প্রাণের টান ছিল সুলতানের। তিনি চাইতেন এ দেশের মানুষ বলিষ্ঠ, প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক। এই আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয়েছে তাঁর বহু ক্যানভাসে। তাঁর ক্যানভাসে আমরা সেসব পেশীবহুল, প্রাণবস্ত নারী পুরুষদের দেখতে পাই, যাদের শ্রমে গড়ে ওঠে কৃষিসভ্যতা। শিশুদের নিয়ে বড় রকমের স্বপ্ন ছিল এই অকৃতদার শিল্পী মানুষটির। এ জন্যই তিনি হাতে নিয়েছিলেন একটি প্রকল্প– যেখানে ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে শিল্পশিক্ষা পাবে, সুযোগ পাবে সুন্দর জীবন চর্চার। শিশুদের বিষয়ে, মনে পড়ে, তিনি একটি স্মরণীয় বক্তৃতা করেছিলেন নারায়ণগঞ্জে এক বছর আগে । সুলতান প্রাণত্যাগ করেছেন সত্য, কিন্তু তাঁর সালতানাত অর্থাৎ শিল্পসৃষ্টি ত্যাগ করেননি । কোনো প্রকৃত শিল্পীই তা' করেন না --- তাঁর শিল্পের রাজ্য থেকে যায় কালের আক্রমণ সত্ত্বেও বর্তমান এবং ভবিষ্যতের অনাগত ভোক্তাদের জন্য। আমি এই মুহূর্তে দেখছি, কারুকাজময় একটি বিশাল নৌকায় অনেক শিশু যাত্রা করেছে সুন্দরের সন্ধানে, বৃহত্তর জীবনের দিকে।
বড় মাপের ব্যক্তি ও শিল্পী সুলতানকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ
সম্পাদনাঃ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সুবীর চৌধুরী
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি
প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫
Recent Comments