সুলতানের স্মৃতি


কিংবদন্তীর নায়ক ছিলেন সুলতান । তাঁর সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশী শুনেছিলাম ১৯৬৫ এর দিকে, যখন চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। নিজের চোখে তাঁকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল । স্বপ্নের চোখে অনেক কিছুই কল্পনা করে নিতাম । সুলতানকে সেই রেনেসাঁস আমলের কোনো মহান শিল্পীর মত ভেবে নিতাম। অধ্যয়ন কালেও বিভিন্ন সময়ে আর্ট কলেজে তাঁর সম্বন্ধে বহু গল্প কাহিনী শুনেছি । এর মধ্যে কিছু কিছু হয়তো অতিরঞ্জন ছিল। আমাদের বছর তিনেকের সিনিয়র শিল্পী যশোরের রফিউদ্দিন আহমেদ এর কাছ থেকেও শুনেছি অনেক কাহিনী। রফিউদ্দিন ভাই ছিলেন একজন স্মার্ট ও ফিটফাট ছাত্র । পড়তেন গ্রাফিক ডিজাইনে। বাবা ডাক্তার, আর্থিক টানাপোড়েন ছিল না । অধিকন্তু সেই আমলে যখন ছাত্ররা পার্টটাইম কমার্শিয়াল কাজ প্রায় পেতই না, তখন তিনি কলেজ ছুটির পর চলে যেতেন একটা ফার্মে । ফিরতেন রাত নটা দশটা নাগাদ। হোস্টেলে আমি থাকতাম দশ নম্বর কক্ষে । তাঁরটা ছিল ন'নম্বর । এসেই সোজা ঢুকে পড়তেন আমাদের ঘরে । সিগারেট ধরিয়ে করতেন নানা গম্প । আমাদের কক্ষে তাঁর আসার অন্যতম আকর্ষণ ছিল তাঁর সহপাঠী বন্ধু মুন্সী মহিউদ্দিন। দুজনের বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। 

রফি ভাই - এর কাছে শুনেছি যে সুলতান সাহেব তাঁদের বাসায় ছিলেন এক সময়ে। একটা ছবি আঁকার স্কুলও করেছিলেন তাঁদের বাড়ীতে। ছোট ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা শেখাতেন। রফি ভাই - এর ছবি আঁকার হাতে খড়িও তাঁর কাছে। শুনেছি ছবি আঁকা শেখাতে গিয়ে রেখা, রঙ আর ছন্দের ব্যাখ্যা দিতে দিতে নিজেই - নাচতে শুরু করতেন । অর্থাৎ শিল্পের প্রতিটি শাখার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সাদৃশ্য আছে তাকে ব্যাখ্যা করতেন। আর সে অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল । এ প্রসঙ্গে ( বিষ্ণুধর্মোত্তর গ্রন্থে বলা হয়েছে শিল্পকলা জীবনের উদ্দেশ্যকে পূর্ণতা দানে সহায়তা করে আর সে জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মোক্ষলাভ। এক রাজা ও সন্ন্যাসীর মধ্যকার কথোপকথনের মাধ্যমে এখানে শিল্পকলার উদ্দেশ্যে ও সংজ্ঞা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া যাবে। এক রাজা শিল্পের অর্থ জানতে গেলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে । সন্ন্যাসী তাকে ( রাজাকে ) প্রথমে নাচের সূত্রসমূহ জানতে নির্দেশ করলেন । রাজা এতে রাজী হয়ে নৃত্যকলা শিখতে শুরু করলেন । রাজা বুঝলেন নৃত্যের সাথে শিল্পকলার অন্যান্য শাখাসমূহের সাদৃশ্য বিদ্যমান। নাচ শেখার পর তিনি আবার সন্ন্যাসীর কাছে গেলেন । তিনি তখন সংগীত ও চিত্রকলা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের উপদেশ দিলেন । কারণ ,শিল্পকলার সমস্ত শাখা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ না করলে স্থান - কালের সম্পর্ক (Time Space Relation) অনুধাবন করা যাবে না এবং জীবনের পরম উদ্দেশ্য মোক্ষলাভও সম্ভবপর হবে না । সুলতান সেই মোক্ষলাভে ব্রতী ছিলেন ।

রফি ভাই সুলতানের আঁকা একটা রাফ্ স্কেচ দেখিয়েছিলেন।মাউন্ট বোর্ডের খসখসে পিঠে 6-B পেন্সিলে আঁকা । প্রথম বর্ষে পড়ার সময় তিনি সুলতান সাহেবকে পার্সপেকটিভ সম্বন্ধে বুঝিয়ে দিতে বলায় তিনি স্কেচটি এঁকে দেখিয়েছিলেন। পার্সপেকটিভ হচ্ছে শিল্পকলা শিক্ষার একটি অপরিহার্য বিষয় এবং বিষয়টি নিরসও বটে। কাছের ও দূরের জিনিষকে কিভাবে আঁকতে হয় তারই নিয়ম কানুন। ওপর থেকে দেখা একটি গ্রামের দৃশ্যকে এঁকেছেন সুলতান। গাঢ় কালো পেন্সিলে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আঁকা ছবিটি । এত বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী যে পেন্সিলের চাপে মোটা বোর্ডটি গর্ত হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। কাছ থেকে দেখলে বেশ শক্ত ( hard ) লাগে । অথচ কিছুটা দূর থেকে দেখলে অদ্ভুত সুন্দর । প্রায় তিরিশ বছর আগে দেখা সুলতানের সেই স্কেচটি আজও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভাসে । রফি ভাই অতি যত্ন করে সেটি তাঁর স্টিলের ট্রাকে একেবারে তলায় রাখতেন ।

আমার ধারণা সুলতানের যৌবন বয়সে আঁকা ছবিগুলোর অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। সেই সময়কার ছবিগুলো সত্যিই ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।তাঁর গ্রামে বসবাসের কারণে সাধারণ মুদির দোকানদার, চায়ের বা ময়রার দোকানে বসে আঁকা স্কেচগুলোর হদিস আজকে পাওয়া সত্যিই মুশকিল । আজীবন দারিদ্র্যের মধ্যে কেটে যাওয়া তাঁর যৌবন  ও প্রৌঢ় জীবনে এক আধ পেটা খাবারের বিনিময়েও ছবি এঁকে দিয়েছেন সাধারণ হোটেলওয়ালা বা দোকানীকে । 


সুলতান সাহেবকে প্রথম দেখবার সুযোগ হয় আমার ১৯৭৬ সালে । আমি তখন খুলনা শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের চারুকলার প্রভাষক । নতুন চাকরি । শিল্পকলা একাডেমী সেবার ঢাকার বাইরে অবস্থানরত শিল্পীদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রদর্শনী উপলক্ষে । আমিও এসেছিলাম । সেমিনার একটি ছিল । তাতে শিল্পীদের পরিচয় পর্বও ছিল । সেই অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে বাবরি চুলওয়ালা কালো আলখাল্লাধারী এক ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখলাম চুপচাপ । এক মনে পাইপ টেনে চলেছেন । শিল্পী কামরুল হাসান পরিচয় করিয়ে দিলেন শিল্পী সুলতানকে । সেই আমার প্রথম দেখা সুলতান। তখন শীত শেষ হয়ে এসেছে মনে পড়ে। বসন্তকাল, আমাদের কারও গায়ে গরম কাপড় নেই । কিন্তু লক্ষ্য করলাম সুলতানের গায়ে ফুলহাতা সোয়েটারের ওপর গরম কাপড়ের ওভারকোট সদৃশ আলখাল্লা, পায়ে জুতো ও পশমী মোজা । তার গরম লাগছিল বলে মনে হয় নি আমার। খুব সাচ্ছন্দেই ঘোরাফিরা করছিলেন । এটা দেখে একটা কথাই মনে হল আর তা হল সুফি দার্শনিকদের কথা । তাঁরা ' সুফ ' বা কম্বল গায়ে দিতেন । উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের শক্তি বা এনার্জিকে ধরে রাখা। আমাদের দেহের অভ্যন্তরে যে তাপ উৎপাদিত হয় তা বাইরে বেরিয়ে যায়। এ জাতীয় কাপড় পরে তাপ বা এনার্জি সংরক্ষণ করা এবং তাপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা এবং সম্ভব হলে উপবাস করা । তিব্বতে প্রচন্ড শীতে লামা সন্ন্যাসীরা প্রাণায়ামের মাধ্যমে অধিক অক্সিজেন গ্রহণ করে শরীরকে শীত থেকে রক্ষা করেন । কারণ সেখানে শরীরকে উষ্ণ রাখার মত পর্যাপ্ত খাদ্যের বড়ই অভাব । তাই এই সন্ন্যাসীরা শুধুমাত্র অক্সিজেন গ্রহণ করেই শরীরের তাপ রক্ষা করে থাকেন । 


সুলতানের জীবন বড়ই বিচিত্র। বহু দেশ - বিদেশ তিনি ঘুরেছেন সন্ন্যাসীর বেশে। প্রকৃতি আর মানুষকে দেখেছেন অত্যন্ত কাছ থেকে । হিন্দু ও বৌদ্ধদের তান্ত্রিক সাধনা তিনি করেছেন বলে জানা যায় । এ ব্যাপারে আমি একটু বলতে চাই আমারও যোগ সাধনায় আগ্রহ ছিল। ছাত্র জীবন থেকেই জ্যোতিষশাস্ত্র ও যোগ নিয়ে কিছু পড়াশুনা করেছি । একবার সুলতান চারুকলা ইনস্টিউটে আসেন । ঢাকায় ' কারুকৃৎ ' - এর স্বত্বাধিকারী শিল্পী রশীদ আহমেদ ( প্রয়াত ) -এর দেয়া মধ্যাহ্ন ভোজটি হল চারুকলা ইনস্টিটিউটের তখনকার নতুন ভবন এখনকার গ্রাফিক ডিজাইন ভবনে। সুলতান সাহেবের আগমন আমাকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করেছিল। প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলাম তার চলাফেরা খাওয়া - দাওয়া। কক্ষের এক পাশে অত্যন্ত অল্প পরিমাণ খাবার খুব আস্তে আস্তে খাচ্ছিলেন । অত্যন্ত সংযমী খাওয়া । বেশ গরম পড়ে গিয়েছিল । তার মধ্যেও তাকে পশমী কাপড় আর আলখাল্লায় একটুও ঘামতে দেখি নি । খাওয়া দাওয়ার পর ভবনের উত্তর পাশে গাছতলায় এলেন এবং একটি চেয়ারে বসলেন । আমিই প্রথম কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম। প্রথমেই প্রশ্ন করলাম‘ আপনি কি যোগসাধনা করেন ? উত্তরটা হুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না ।তবে, উত্তরটা অনেকটা এরকম । 'ওসব করে এখন শিব হয়ে বসে আছি।' তার এই ' শিব ' হয়ে বসে থাকা'র অর্থ কি তা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় নি । তবে একটা কথা আমার মনে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে মনে যে তিনি এক সময়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন, যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন এবং সম্ভবতঃ সেই পথে তাঁর কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসে নি । বিফল হয়ে ফিরে এসেছিলেন সাধারণের মাঝে। জীবনের গভীরতম অন্তরালে তাঁর পদচারণা নিসন্দেহে ছিল , তা না হলে একজন মানুষ এত প্রচন্ড শক্তি নিয়ে তুলি ধরতে পারেন না। পারেন না পার্থিব লোভ - লালসা থেকে নিরাসক্ত থাকতে; খ্যাতি, বিত্ত অর্থ থেকে সব সময়ই নির্লিপ্ত ও নিস্পৃহ থাকতে ।

খুলনা আর্ট কলেজটির আমিই ছিলাম প্রথম অধ্যক্ষ। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রথম প্রদর্শনীতে তাঁকে প্রধান অতিথি করে এনেছিলাম। একটা ছবি এঁকে উদ্বোধন করলেন । তাঁকে আনতে পারায় আমি অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছিলাম। তাঁর দাঁত প্রায় সব ক'টিই পড়ে গিয়েছিল । আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম মাংস প্রেশার কুকারে খুব নরম করে রাঁধতে । প্রথমে আমার বাসায় খাওয়া দাওয়া করে কলেজে আসবেন। ' সব দাঁত পড়ে গেল ? ' জিজ্ঞেস করতে একজনের কথা বললেন যে তিনি তাঁর দাঁতগুলো বাঁধিয়ে দেবেন বলে ভালো দাঁতগুলোও উঠিয়ে ফেলেছিলেন ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে । কিন্তু বাঁধিয়ে আর দেন নি। বাকী জীবনটা তাঁর দাতবিহীন অবস্থাতেই কাটাতে হয়েছিল। এগুলো বলতে তাঁকে একটুও কষ্ট পেতে দেখি নি ।

প্রদর্শনী শেষে সার্কিট হাউসে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু সেখানে থাকতে চাইলেন না । চলে গেলেন কমার্স কলেজের ইংরেজির শিক্ষক অসিত বরণ ঘোষের বাসায় অসিত বাবু বিজ্ঞজন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বরাবরই জড়িত । তাঁর স্ত্রী ভারতী ঘোষ খুলনার সঙ্গীত জগতে সুপরিচিত। আমার পরিচয় তাঁদের সাথে সঙ্গীতের কারণে । অসিত বাবুর সাথে সুলতান সাহেবের পরিচয় বহু দিনের । বেশ সকালে অসিত বাবুর বাসায় গেলাম নাস্তা করে । কিন্তু আবারও নাস্তা করতে হল তাঁদের সাথে। অসিত বাবু সুলতানের বহু আগে আঁকা কিছু ছবি বের করলেন তাঁর সংগ্রহ থেকে । খুব যত্ন করে রেখেছিলেন ওগুলো। সুলতান সাহেবের উপস্থিতিতেই অসিত বাবু তার (সুলতানের অনেক গুণগান করছিলেন । এতে সুলতান সাহেব কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিলেন । অসিত বাবুর কাছে আবারো জানলাম সুলতান কত ভালো নাচতে পারতেন । একবার তো নাচ অভ্যেস করবেন বলে তাকে ঘরে ডেকে দরোজা - জানালা বন্ধ করে হারমনিয়াম বাজাতে বললেন। হারমনিয়াম বাজতে থাকলো আর সুলতান নাচতে শুরু করলেন । অসিত বললেন তিনি যে এত ভালো নাচতে জানেন তা কিন্তু সবাই জানে না । সুলতানের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো ।

আর একটি স্মৃতি আমার হয়তো সারাজীবন মনে থাকবে । নড়াইল গেলাম খুলনা থেকে । আমার সহকর্মী খুলনা আর্ট কলেজের প্রভাষক বিমানেশ বিশ্বাসের বাড়ীও নড়াইল । প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ী যায়। শনিবার এসে কলেজ করে । পরিবার পরিজন থাকে দেশের বাড়ীতে । ছোটবেলা থেকেই সুলতান সাহেবের প্রিয়ভাজন শিষ্য। সুলতানের কাছেই তার ভিত্তি শিক্ষা। বিমানেশ তার কথামত যথাস্থানে ছিল । নড়াইলে সেটা আমার প্রথম যাওয়া। এরপর আর সময় সুযোগ ঘটেনি যাবার জন্য । আমার আর এক ছাত্র আব্দুল্লাহ্ আল মামুনের বড় ভাই সেখানে মুন্সেফ । সেও মাঝে মাঝে সেখানে যায় , তার বাড়ি অবশ্য কুষ্টিয়ায়। তারও আমন্ত্রণ ছিল যাবার জন্য । আমার উদ্দেশ্য কিন্তু সুলতান সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করা। রাত্রিটা মামুনদের বাসায় ছিলাম । অনেক যত্ন পেয়েছিলাম। আমার টেপ রেকর্ডারটি নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর কথাবার্তা রেকর্ড করবো বলে । যাইহোক যাবার পর যথারীতি নাস্তা এবং দুপুরের বাওয়া । গোপনে তাঁর কথা রেকর্ড করা শুরু করলাম । কিন্তু টের পেয়ে কিছুটা সচেতন হয়ে পড়লেন। টেপটি এখনও আছে । কিন্তু শব্দ উদ্ধার করা কঠিন ।

চিত্রা নদীর তীরে জমিদারবাড়ি সংলগ্ন জায়গায় সরকারের করে দেওয়া ছোটখাট বাগান আর শ্যামলিমায় ঘেরা তার বাসস্থান । খুব ভালো লাগলো । ফুলের বাগান করেছেন । সেখানে এক চিলতে রাস্তা এবং তারপর শান বাধানো বসার জায়গা । শান বাধানোটি তার পছন্দ হয় নি । বললেন সুরকি দিয়ে এটি করলে আরো ভালো হত, মাটির সাথে সামঞ্জস্য থাকতো, সবুজ বাগানে সুরকির রঙ বড়ই মানানসই হত। আর গরমও কম লাগতো । 

তিন কামরার বাড়ী। বেশ বড় শয়নকক্ষটি পোষ্যদের থাকার খাবার ঘরে টেবিল পাতা, ক'খানা চেয়ার । বই-এর আলমারি, তাতে বেশ মোটামোটা আর্টের বই । বেশীর ভাগই মনে হল ইউরোপীয় বই এবং ইংরেজীতে লেখা। ছোট্ট বসার ঘরটিতে একটি সিঙ্গল খাট । একটি সোফাসেট । এ ধরেই তিনি ঘুমোন । সামনে বারান্দা। বিরাট একটি টুল বারান্দায় রাখা শেকল দিয়ে বাধা হনুমান । নাম সম্ভবত মন্টু । তার সাথে কথা বলেন । বেড়াল, মুরগি, খরগোশ, কুকুরসহ বহু জীবজন্তু । এদেরকে তিনি তাঁর সন্তান বলতেন ।

মজার ব্যাপারটি ঘটলো দুপুরে খাবার সময় । ভাত , মাছ , ডাল , শবজির নানা তরকারী । মাছ ভাজা ছিল মনে হয় । খাবার আগে বললেন ‘ ওদের ’ কিছু না খাইয়ে আমি কখনো খেতে বসি না । ' ওদের ’ দেখার জন্য তাঁর পিছু নিলাম । পেছনের খোলা উঠোনে চলে গেলেন । হাতে ভাতের থালা । ' আয় আয় ' বলে ডাকতেই অসংখ্য কাক ও পাখি এসে তাঁর চারদিকে ভিড় করে ডাকাডাকি করতে লাগলো । কয়েকটি তার পিঠে মাথায় বসলো । হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন । বললেন ‘ যা যা’ । খাবার ছিটালেন । পাখিরা ভাত খাওয়া শুরু করে দিল । তারপর হনুমানকে খাওয়াতে বললেন। ঝকঝকে কাঁসার বাটিতে দেয়া হল খাবার। অবশেষে আমরা খেতে বসলাম। সাথে বিমানেশও ছিল। খেতে খেতে অনেক কথা হল । আমার কৌতূহল থেকে দু' একটা প্রশ্ন করলাম । খেতে খেতে উত্তর দিলেন ।

প্রশ্ন ছিল শিল্পকলা, ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা নিয়ে। নানা কথার মাঝে স্বীকার করলেন যে তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতা না থাকলেও মরমীবাদ ( Mysticism ) আছে । আগে অনেক কাহিনী শুনেছি, তিনি সাপ নিয়ে বসবাস করেন। এটি স্বয়ং রফি ভাইও বলেছিলেন । সে কথায় পরে আসছি ।জিজ্ঞেস করলাম সাপের মন্ত্র জানেন ? সরাসরি উত্তর ' সাপের কোন মন্ত্র নেই । তা হলে কি করে সাপকে পোষ মানান? হেসে বললেন যে‘ সবটাই কনফিডেন্স' । আরো বললেন যে সাপ মানুষকে ভয় পায় । তারও অনুভূতি আছে, বুদ্ধি আছে । সে যদি মনে করে আপনি তাকে মারবেন না, তাহলে সেও আপনাকে কামড়াবে না। সুলতান সাপকে সেই অভয় দেবার ক্ষমতা রাখতেন। পশুপাখি সরীসৃপের কথা বুঝতে পারতেন, তাই তারাও অসীম নির্ভরতায় তাঁর কোলে বসে থাকতে পারতো। অনেকের কাছেই শুনেছি যে তিনি রাস্তা থেকে মৃতপ্রায় কুকুর বা বেড়ালের ছানা কুড়িয়ে আনতেন । পরম যত্নে আদরে বাচিয়ে তুলতেন সেই সব অবহেলিত প্রাণীদের। বন্য প্রাণীর প্রতি অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর বিরল চরিত্রের অন্যতম আকর্ষণ ।

বেনারসে গবেষণা করতে গিয়েছিলাম ১৯৭৯ সালে সরকারী বৃত্তি নিয়ে। সোনারগাঁ যাদুঘরের গবেষণা অফিসার সাইফুদ্দিন চৌধুরী এলেন বেনারসে। এখন তিনি ডক্টর সাইফুদ্দিন চৌধুরী। রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়ামের পরিচালক । আমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল ।

এক সময় সুলতান সাহেব সোনারগাঁতে ছিলেন । সরকার তাঁকে নাকি একটা বাড়ি দিয়েছিল থাকার জন্য । শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি থাকেন নি। অনেক গোলমাল এবং শেষ পর্যন্ত মামলা - মোকদ্দমাও নাকি হয়। আবার ফিরে গিয়েছিলন তার প্রিয় জন্মভূমি নড়াইলের মাটিতে। প্রচন্ড ভালবাসতেন তিনি নড়াইলকে। দেশ - বিদেশে ঘুরে বেড়ানো এই বোহেমিয়ান শিল্পী শেষ পর্যন্ত তার মাতৃক্রোড়েই আশ্রয় নিয়ে জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়ে গিয়েছেন সেটা আমরা সবাই জানি ।

ড. সাইফুদ্দিন সুলতানের একটি গল্প বললেন আমাকে । তাঁর বয়ানেই সেটি শোনা থাক:“একদিন সুলতান বললেন চলুন মাছ ধরতে যাই । সাইফুদ্দিন সাথে গেলেন । সোনারগাঁয়ে অনেক পুকুর । জাল ফেলা হল । মাছ শেষ পর্যন্ত মিলল না, মিলল একটি কচ্ছপের বাচ্চা। ওটাকে নিয়ে আসলেন বাসায় । আদরযত্ন শুরু হল তার চিরকালের অভ্যাস মত। একদিন গভীর রাতে সাইফুদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেল কে যেন দরোজার কড়া নাড়ছে । মৃদু অথচ ভরাট গম্ভীর গলায় আওয়াজ: সাইফুদ্দিন একটু উঠুন । সাইফুদ্দিন বুঝলেন সুলতান সাহেব । এত রাতে কোন বিপদ হয় নি তো? কোলে সেই কচ্ছপের বাচ্চাটি । বললেন, ' চলুন ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসি । ওর মা ওর জন্যে কাঁদছে'। ড. সাইফুদ্দিনকে সেই গভীর রাতে বনবাদাড় ডিঙিয়ে যেতে হল সেই নির্দিষ্ট পুকুরের পাড়ে যেখান থেকে কচ্ছপের বাচ্চাটি আনা হয়েছিল। ওটাকে পানিতে ছেড়ে দিলেন সুলতান। দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন । এ ঘটনা থেকে একটা জিনিষই প্রতীয়মান হয় যে তার মধ্যে এক ধরনের খ্যাপামি ছিল, খেয়ালিপনা ছিল । আবার এটাও মনে হয়, অশ্রুত কান্না বা শব্দ শোনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও নিশ্চয়ই ছিল ।

” যশোরের রফি ভাই - এর কাছ থেকে আর একটা মজার গল্প শুনেছিলাম । যশোর কলেজের একজন অধ্যাপক ছিলেন কাশেম সাহেব । অকৃতদার এই অধ্যাপক ছিলেন সুলতান সাহেবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন । মাঝে মাঝে সুলতান কাশেম সাহেবের বাড়িতে থাকতেন ।

এক পূর্ণিমার রাতে কাশেম সাহেব এবং সুলতান এক বিছানায় শুয়ে আছেন । হঠাৎ কাশেম সাহেবের ঘুম ভেঙে যায় । যা দেখলেন তাতে প্রচন্ড ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন। দেখেন পাশে শায়িত সুলতানের বুকের ওপর একটি গোখরো সাপ। হাত দিয়ে আদর করছেন । জানালা দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।চিৎকার করে উঠাতে সুলতান অভয় দিলেন, কোন ভয় নেই 

আমি তখন খুলনা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ।আর্থিক অনটন আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে একটি কলেজকে প্রতিষ্ঠা করছি তখন। সাহায্য সহযোগিতাও যেমন পেয়েছি, বাধা - বিপত্তি এবং নিজের আর্থিক অনটনকে সঙ্গী করে টিকে থাকার চেষ্টা করছি। একটি পর্যায়ে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি । অত্যন্ত স্বল্প বেতনের চাকুরি গিন্নি মাস্টারি করে সাহায্য করে । তবুও চলে না । বাড়ীর সম্পত্তি বিক্রি করে করে বাড়তি খরচের সামাল দিই । এটা তো কেউ জানে না । ঠিক করলাম চলে যাব । এত ত্যাগ স্বীকার করে কি হবে? স্বীকৃতিটাও হয়তো শেষ পর্যন্ত পাব না । অবশ্য জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের পুরো সহযোগিতা ও নিরাপত্তা ছিল । কারণ আমার প্রতি তাদের সবার ছিল অগাধ বিশ্বাস আর ওটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া । তবুও চলে যাব ঠিক করলাম । একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে । এই সিদ্ধান্তটি আমার স্ত্রী ছাড়া কাউকে বলি নি । কিন্তু একটি ঘটনা আমাকে চমকে দিয়েছিল । সেটাই এখন বলব ।

শরীরটা অত ভালো ছিল না ঐদিন তারিখটাও সঠিক মনে করা মুশকিল । কলেজে যাই নি । বাসাতেই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। বেলা চারটা নাগাদ আমার ছাত্র হাবিব এসে খবর দিল সুলতান সাহেব এসেছেন কলেজে । আপনি আসুন । ছাত্র যেতে না বললেও যেতাম । কারণ এই বৃদ্ধ মানুষটি বিনা নোটিসে হঠাৎ খুলনায়। প্রতি সপ্তাহেই নড়াইল থেকে কলেজের শিক্ষক বিমানেশ আসে , ছাত্র আসে । খবর তো দিতে পারতেন । একটা রিক্সা নিয়ে প্রচন্ড এক আকর্ষণে ছুটলাম কলেজের দিকে । সুলতান সাহেব এসেছেন এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া । আমি তখন দোলখোলা বাজারের কাছে একটা ছোট্ট বাসায় থাকি। পরিবারও ছোট । এক পুত্র তখন । গল্লামারিতে কলেজ । এখন যেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। আমি চলে আসার পর কলেজকে স্থানান্তরিত করে দেয়া হয়েছে। এর আগে উল্লেখ করেছি যে কলেজের প্রথম বার্ষিক প্রদর্শনীতে তাকে প্রধান অতিথি করে এনেছিলাম । জায়গাটি তার খুব ভাল লেগেছিল বোধহয় , তাই চলে এলেন হঠাৎ। শিল্পী কামরুল হাসানও জায়গাটা খুব পছন্দ করেছিলেন । আমিনুল ইসলাম সহ অনেক গুণিজনই গিয়েছিলেন । 

কলেজের কাছাকাছি যেতেই দেখি কালো আলখাল্লা আর কালো প্যান্ট , জুতো, মোজা পায়ে ঋজু ভঙ্গিতে তিনি আসছেন । তখন কলেজ ছুটির সময় । পেছনে ছাত্র শিক্ষকের মিছিল মনে হল তাকে, হ্যামিলনের সেই বংশীবাদক। পেছনে সব শিল্পী শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রী। গেটের কাছে ততক্ষণ চলে এসেছি । রিক্সা কাছে আসতেই নেমে শুভেচ্ছা বিনিময়। আমার শারীরিক অবস্থার কথা জানলেন । হাত দিয়ে আমার মুখের ওপর পড়া একটা কুটো নিজের হাতে তুলে নিলেন । বললাম , ' রিক্সায় উঠুন । বাসায় চলুন। বেশ কয়েক কিলোমিটারের পথ আমার বাসা । কথা বলতে বলতে চলেছি। হঠাৎ আস্তে করে বলে উঠলেন , ' এখন যেয়েন না । আমি চমকে উঠলাম । জিজ্ঞেস করলাম , " কোথায় ? " তিনি বললেন , যেখানে মনস্থির করেছেন , সেখানে ' । আমি যে ' মনস্থির করেছি চলে যাও , তা আমি ও আমার স্ত্রী এবং অন্তর্যাম ত তো কেউ জানে না । কারণ, কলেজের গভর্ণিং বডি আমাকে ছাড়বে না আমি জানি । তাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হলে পদত্যাগ করবো। তারা তো আটকাতে পারবেন  না । কারণ , আমি কোন বণ্ড সই করে চাকুরিতে ঢুকিনি । এখনও আমাকে সেদিনের সেই স্মৃতি ভাবায় । অবাক করে । কি করে তিনি জানলেন । আরো বললেন , ‘ আরো কিছুদিন থাকুন , আরো একটু গড়ে দিয়ে যান । " তাঁর কথাই শেষ পর্যন্ত ফলেছিল । আরো অনেকদিন ছিলাম। সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার ইন্টারভিউ লেটারে বিঃ প্রঃ দিয়ে লিখলো নিয়োগকৃত কর্মকর্তার অনুমোদন নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে । সেটা তো না নিয়েই উপাচার্যের সাথে কথা বলে দরখাস্ত করেছিলাম । আর যাওয়া হয় নি । পরে ওখানকার এক বন্ধু খুব রাগ করে আমাকে ফোন করলো । কেন আসলে না ? কারণটি বললাম কর্তৃপক্ষের চিঠির কথা । উত্তরে বলল ওটার জন্য আটকাতো না । যাইহোক , যাওয়া হয় নি সেটাই সত্যি । তার কথা মত আরো কিছুদিন থাকুন' - ই শেষ পর্যন্ত সত্যি হল । তার পরেও অনেকদিন ছিলাম । কয়েক বছর পর ঢাকায় চলে আসি ।

খুলনা মহেশ্বর পাশা আর্ট স্কুলের উপর ভিত্তি করেই আর্ট কলেজ - টি গড়ে ওঠে । ১৯০৪ সালে রায় বাহাদুর শশীভূষণ পাল এটি প্রতিষ্ঠা করেন । পরে বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সেখানে স্থানান্তরিত হয়। আর্ট স্কুলের জনাব আলাউদ্দিন আহমদ ছিলেন অধ্যক্ষ । বন্ধ হয়ে যাওয়া আর্ট স্কুলটিকে তিনি প্রচণ্ড মায়ায় আগলে রেখেছিলেন। ১৯৬৪ বা ৬৫ - তে তৎকালীন অধ্যক্ষ সুরেন পালের দেশ ত্যাগের সময় তাকে ( তার ছাত্র ) দেখাশোনার ভার দিয়ে ভারতে চলে যান ।

আর্ট কলেজ করার সময় খুলনায় আমার থাকবার সমস্যা হয়। আলাউদ্দিন সাহেব তার বাড়ীতে থাকার আহবান জানালেন। রাজি হলাম তাঁর আন্তরিকতায় । সাধ্যমত খাতির যত্ন করতেন তিনি ও তার পরিবারের সবাই। অনেকটা পেয়িং গেস্টের মতই ক' মাস থাকতে হয়েছিল । তারপর মহেশ্বর পাশাতে ছোট্ট বাসা নিয়ে চলে আসি। আলাউদ্দিন সাহেব সম্বন্ধে এত বলতে হল এই জন্য যে শিল্পী সুলতান তার খুব ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।বহুবার খুলনার এই আর্ট স্কুলে এসেছেন । তার কাছে থেকেছেন পরম আত্মীয়ের মত । 

আলাউদ্দিন সাহেবের বয়ান : সুলতান সাহেব নড়াহল থেকে খুলনা এসেছেন ।আলাউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে অতিথি । রাত্রি যাপন শেষে খুলনার জেলা প্রশাসকের কাছে যাবার এপয়েন্টমেন্ট পরদিন সকালে। আলাউদ্দিন সাহেব তাঁকে তাগাদা দিচ্ছেন তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিন। তিনি বের হতে চাইলেন না । বললেন , 'ভালো লাগছে না । একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি রাতে। ' আলাউদ্দিন বিরক্ত হলেন । বললেন , ' স্বপ্ন দেখেছেন তো কি হয়েছে ? চলুন। ' সুলতান কিছুতেই যেতে চাইলেন না। সব গুঁড়িয়ে ভেঙে দিচ্ছে , খুব খারাপ সময় ... ইত্যাদি বলেছেন । কিছুক্ষণ পর খবর হল রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন চট্টগ্রামে দেশে এক থমথমে অবস্থা । ডিসি সাহেবের কাছে তখন যাবার তো প্রশ্নই আসে না। এই ধরনের অলৌকিকতা নিয়ে আরো অনেক গল্প কাহিনী ছড়িয়ে আছে নড়াইল-যশোর, খুলনা কুষ্টিয়া অঞ্চলে । আর একটি কথা বলেই এ প্রসঙ্গটি শেষ করতে চাই । কাহিনীটি বলেছিল । আর্ট কলেজের শিক্ষক বিমানেশ বিশ্বাস । আগেই উল্লেখ করেছি সে সুলতান সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ স্নেহভাজন শিষ্য । সে তো তাকে “ ওস্তাদ ” বলেই সম্বোধন করত ।

বিমানেশের বিবরণ :

একবার যশোর থেকে নড়াইল যাবেন সুলতান । রাত হয়ে গেছে । শেষ বাস । তাই যাত্রীর ভিড় খুব বেশী । সবাই বাসে জায়গা করার জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে। বিভিন্ন বাসযাত্রী টানার প্রতযোগিতায় ব্যস্ত। বসার জায়গা পাবার আশ্বাস পেয়ে সুলতান সাহেব উঠলেন। সাথে বিমানেশ। তাঁকে মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসতে দিল তারা । বাস ছাড়বার আগ মুহূর্তে তাকে আবার উঠতে বলা হল । কারণ একজন মহিলা যাত্রী উঠেছে । তাই সীট ছাড়তে হবে । কণ্ডাকটর বলল , ' এই বুড়ো ওঠো।সুলতান ক্ষেপে গেলেন এবং খ্যাপাই স্বাভাবিক। কারণ তারাই তাঁকে সিট দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐ নির্দিষ্ট আসনে বসতে দেয় । বলে রাখি যে বৃহত্তর যশোর এবং আশেপাশের জেলাগুলোতে সুলতান সাহেবকে বহু লোক চেনে । কণ্ডাকটর তাকে চিনতো না। তাই একজন সাধারণ লোক ভেবে এ রকমটি করছিল । কিন্তু সুলতান ক্ষিপ্ত হলেন যে একজন বৃদ্ধের সাথে সে এ ব্যবহার করছে। যাইহোক, বাসের মধ্যে হৈ চৈ । সুলতানের সাথে এ রকম আচরণ যাত্রীরা সহ্য করবে না। অনেকেই কণ্ডাকটরকে মারতে উদ্যোত হল । সুলতান বাধা দিলেন । বিমানেশকে বললেন চল, দেখি অন্য বাসে জায়গা পাওয়া যায় কিনা । কিন্তু তারা নেমে দেখলেন পরের বাসটিতেও জায়গা নেই । কারণ শেষ বাসে ভীড় হয় অত্যন্ত বেশী । শেষে অনেক বেশী খরচ করে তারা বেবী ট্যাক্সি দিয়ে নড়াইল যাত্রা করলেন । বাসের অনেক আগেই তাঁরা নড়াইল পৌছুলেন। বিমানেশ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়েছিল, নেমেই স্থানীয় তরুণদের ঘটনা বলতেই সবাই সেই বাসটিকে ধরার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো ।

ওস্তাদের সাথে বেয়াদবি এবং এ ধরনের আচরণ তারা কেউই সহ্য করবে না । কণ্ডাকটরকে মারবে তারা । সুলতান অনেক নিষেধ করলেন। কিন্তু সেই স্থানের এক রেস্তোরায় তাকে বসে থাকতে হল । শীতের রাত ক্রমেই ঠাণ্ডা বাড়ছে । রাস্তার লোক চলাচল কমে আসছে। সুলতান বারবার তাদের বললেন , বাড়ী যা , এ সব দরকার নেই।' তরুণরা নাছোড়বান্দা। বিমানেশও কিছু করতে পারছে না । মারমুখী তরুণের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে । বিমানেশকেও থাকতে হবে। কারণ বাস ও কণ্ডাকটরকে চেনাতে হবে। বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকলো সবাই । বাস আর আসে না। অবশেষে সুলতান বললেন, ' ঐ বাস আর কোনদিনই আসবে না , তোরা বাড়ি যা। " পরে খবর আসলো গাড়িটি আসবার পথে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়েছে এবং সুলতান যে সিটে বসেছিলেন এবং তাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় সেই অংশ ভেঙে উড়ে গেছে । এই ঘটনাকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেয়া যেতে পারে । কিন্তু সুলতান ভক্তদের বিশ্বাস অন্য রকম । এটাকে তারা সুলতানের অভিশাপ বলেই বিশ্বাস করেন। কারণ , যখন তাকে নেমে যেতে বলা হচ্ছিল তখন তিনি অত্যন্ত কষ্ট পান এবং ক্ষেপে যান । যেটা সচরাচর দেখা যেত না । আর একটা লক্ষণীয় ব্যাপার হল তিনি যে সিটটিতে বসেছিলেন সেটি বাসের পিছনের দিকের এক পাশে ছিল ( মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত) সেই অংশটিই গুঁড়িয়ে যায় । চলন্ত গাড়িটি সামনে ধাক্কা খায় রাস্তার পাশের গাছের সাথে আর ভাঙে পেছনের অংশ ।

সুলতানের সাথে বাঁশীর সম্পর্ক ছিল বড় নিবিড় । বাঁশী বাজাতে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। তার আলখাল্লার ভিতরে রাখা অনেক পকেটের ভেতর সাপ ও বাঁশী পাশপাশি থাকত বলে শোনা গেছে । গভীর রাতে আপন মনে যখন তিনি বাশী বাজাতেন, যারা (শুনেছে তাদের মতে) তখন সুর, প্রকৃতি এবং পরিবেশ একাকার হয়ে যেত। সে আর এক সম্মোহনী বাঁশী ।

প্রকৃতির সন্তান ছিলেন সুলতান। প্রকৃতি আর আবহাওয়াকে অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন । এ প্রসঙ্গে শিল্পী রফিকুন নবীর বলা তাঁর ছাত্রজীবনের একটি ঘটনা তিনি আমাদের বলেছিলেন আমাদের ছাত্র অবস্থায় । তখন তিনি আমাদের তরুণ শিক্ষক । সুলতান সম্বন্ধে তার বলা বিবরণ :

তিনি তখন আর্ট কলেজে পড়েন। ভালো জলরঙ করেন। সুলতানও ভালো জলরঙ আঁকিয়ে হিসেবে খ্যাত । একদিন সুলতানের সাথে কলেজের গেটে দেখা । কলেজ হয়ে গেছে । নবী স্যারের হাতে সদ্য আঁকা একটি জলরঙ ছবি। সুলতান দেখতে চাইলেন ; তিনি দেখালেন । কাজটা সুলতানের খুব ভালো লাগলো বলেই তার ( নবী স্যারের ) মনে হয়েছিল । পাবলিক লাইব্রেরীর ( বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী ) দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছিল । সুলতান বলে উঠলেন , ' এখুনি বৃষ্টি নামবে ' । এই বলে ছবিটি গোল করে পেঁচিয়ে পরম যত্নে তার আলখাল্লার মধ্যে আড়াল করলেন । বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । আর্ট কলেজের গেট থেকে লাইব্রেরীর দূরত্ব মাত্র কয়েকশ ' গজ । এত তাড়াতাড়ি বৃষ্টি আসবে নবী স্যার বুঝতে পারেন নি সেদিন । তিনি বলেছিলেন সুলতান আকাশ, মেঘ আর বৃষ্টি এত স্টাডি করেছেন যে হঠাৎ বৃষ্টির আগমন বার্তা তিনি এত সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।

আর্ট কলেজে পড়ার সময় আমাদের লাইব্রেরীতে একটা বই পেয়েছিলাম Art in Pakistan নামের লেখক প্রকাশক কারোরই নাম মনে নেই। তবে বইটি করাচি কিংবা লাহোর থেকে পঞ্চাশের দশকের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল বলে মনে পড়ে । তাতে একটা মজার জিনিষ মনে পড়ে । পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পীদের জীবন ও পরিচিতি দেওয়া আছে । তাতে জয়নুল আবেদিন প্রমুখের নাম পূর্ব পাকিস্তান অংশে আছে আর সুলতানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশে পশ্চিম পাকিস্তানী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে । পড়ার পর বুঝলাম ইনি আমাদেরই সুলতান। তাতে প্রকাশিত হয়েছিল তার আঁকা কিছু ছবি । তার মধ্যে বিখ্যাত ' কাশ্মীরে শরৎকাল ' ( Autumn in Kashmir) অন্যতম। লেখক সুলতানের আলোচনার শুরুতে যা লিখেছিলেন তা তিরিশ বছর পরে এখনও আমার মনে আছে Perhaps the most promising artist in Pakistan is Sultan . পশ্চিম পাকিস্তানীরা সুলতানকে তাদের নিজেদের শিল্পী বলে গর্ব করতো। সুলতান বহুদিন পাকিস্তানে ( পশ্চিম) ছিলেন । সেখানকার প্রখ্যাত চিত্রকার সাদেকাইন তাঁর শিষ্য। আমি বেনারসে থাকতে ( ১৯৭৯ - '৮২ ) সাদেকাইন সেখানে এসেছিলেন এবং কাশী  বিশ্ববিদল্যায়ের যাদুঘর ভারত কলাভবনে তার প্রদর্শনী হয়েছিল। প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেছিলেন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও বেনারসের রাজা মহোদয় । ২০ × ১০ এর একটি বিশাল তেল - রং ছবিতে আমি একই সাথে সুলতান ও পিকাসোর প্রভাব লক্ষ্য করেছিলাম । হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় এই দু ' শিল্পীকে যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন ।

এটা অনেকেই জানেন যে সুলতান নামটি শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর দেওয়া ।তার আসল নাম হচ্ছে লাল মিয়া তার শিল্পী হওয়া এবং একজন রুচিশীল শিক্ষিত মানুষ হবার পেছনে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান সবচেয়ে বেশী। তিনিই তাঁকে কলকাতা গভঃ আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন । তার বাড়ীতে থেকেই সুলতানের চারুপাঠ শুরু । সোহরাওয়ার্দীর মূল্যবান গ্রন্থাগারে ছিল সুলতানের অবাধ প্রবেশাধিকার যা সুলতানকে নিয়ে গিয়েছিল জ্ঞান ভাণ্ডারের বেশ গভীর তলদেশে । এছাড়া তার অমায়িক ইউরোপীয় আচরণ, ইংরেজী, উর্দু - হিন্দুস্থানীসহ আরও সংস্কৃত ভাষায় তার জ্ঞান, শীতল অথচ বুদ্ধিদীপ্ত সম্মোহনী বক্তৃতা সবই সেখান থেকে পাওয়া । দেশ - বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে আরো দৃঢ়মূল করেছিল ।

আধুনিক যুগের একজন মানুষ হয়েও সুলতান গ্রাম বাংলার মোহকে কখনই ছাড়তে পারেন নি।গ্রামের অতি সাধারণ কৃষক, জেলে, কামার- কুমার, তাঁতী এদের সাথেই ছিল তাঁর প্রাণের সখ্য। ধর্ম - বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ছিল তার পরম আত্মীয়জন।দেখেছি অনেক সাধারণ হিন্দু তাকে 'গোসাই ' বলে সম্বোধন করছে।সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাঁকে একজন ‘ দরবেশ ' বা পীরের মতই ভাবতো । কিন্তু, কোনো ধর্মের আচার - অনুষ্ঠান তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে পালন করতেন কিনা আমার জানা নেই। অত্যন্ত উদার ও সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন একজন ‘ সেক্যুলার ' ব্যক্তি । আবার ধর্মের মূলতত্ব তাঁর অজানা ছিল না যা একটি ঘটনা দ্বারা বুঝতে পারা যায় । ঘটনাটি বিমানেশ আমাকে বলেছিল :

একদিন এক ধর্মপ্রাণ ( ? ) ব্যক্তি তার কাছে এলেন হেদায়েত করতে। ভদ্রলোক দেশের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।বললেন, 'সুলতান ভাই বয়স তো অনেক হল, এখন একটু নামাজ কালাম করেন ' ইত্যাদি । সুলতান তাকে প্রশ্ন করলেন ‘ নামাজ কয় ওক্ত ? " ভদ্রলোক উত্তর দিলেন পাঁচ ওয়াক্ত । সুলতান আবার প্রশ্ন করলেন, আর কোনো ' ওক্ত ' নেই ? ভদ্রলোক আরো ২ / ৩ টি ওয়ার্কের কথা বললেন । সুলতান আরও প্রশ্ন করলেন, 'আর নেই ? ভদ্রলোক বললেন' জানি না। ' সুলতান রাগান্বিত হয়ে বললেন, ' যার চব্বিশ ঘন্টাই ওক্ত তাকে ওরু শিখাতে এসো না । ' আগে ' ওক্ত ' কটি জেনে এসো । ভদ্রলোক পালিয়ে বাচলেন ।

নড়াইলে আমার প্রথম ও শেষ ভ্রমণের অবস্থান ছিল দু' দিনের। প্রথম দিন সারাটা সময় কেটেছে তাঁর সান্নিধ্যে। আমাকে নিয়ে 'চিত্রা নদী' পার হয়ে ওপারের গাঁয়ে নিয়ে গেলেন ।অনভ্যাস এবং পায়ের অসুস্থতার জন্য আমি উঁচু পাড় দিয়ে উঠতে পারছিলাম না। তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে তুললেন। তাঁর হাতের স্পর্শে ধন্য হলাম । গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির আঙিনা দিয়ে যেতে থাকলাম। সবার সাথেই কুশল বিনিময় । এক কৃষক পরিবারে বসতে হল । বড় আদর যত্ন করলো তারা।গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়ালো। কোনো একটা পূজা হচ্ছিল। পূজা মণ্ডপগুলোও ঘুরে দেখা হল। ছোট ছোট শিশুদের তিনি আদর করছিলেন। শিশুদের প্রতি তাঁর ছিল অসীম ভালবাসা। নিজের কোনো সন্তান তাঁর ছিল না। তাই সব সন্তানদেরকেই তিনি নিজের সন্তানের মত দেখতেন এবং তাদের জন্য কিছু একটা করার কথা ভাবতেন। শিশুদের জন্যেই সুলতান বোধ হয় সবচেয়ে বেশী উকণ্ঠিত ছিলেন । কারণ , তিনি বলতেন এরাই দেশের ভবিষ্যৎ বংশধর। এরাই ভবিষ্যতের শিল্পী। তাই ছোটবেলা থেকেই এদের মধ্যে সৌন্দর্য চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে , তবেই এরা ভবিষ্যতে সৎ , সুন্দর এবং নান্দনিক জীবনের অধিকারী হবে । তিনি আরো বললেন শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে আর তাদের স্কুলে আনার জন্য দুপুরে একটু খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, এরা খেতে পায় না । খাবারের লোভ দিয়ে স্কুলে আনতে হবে। একই সাথে চলবে সাধারণ শিক্ষা ও ছবি আঁকা। স্বতঃস্ফূর্ত আঁকাজোকার মধ্যে দিয়ে তাদের মাঝে গড়ে উঠবে সৃজনশীলতা তা সে যে কোন ক্ষেত্রেই হোক। একজন শিশু সে স্থপতি, ভাস্কর, প্রকৌশলী, ডাক্তার, প্রশাসক শিল্পী যাই হোক না কেন শিল্পকলার শিক্ষা তাকে একজন সৃষ্টিশীল, রুচিবান এবং কল্পনাশক্তির অধিকারী করে তৈরী করবে । ইউরোপ , আমেরিকা ও জাপানের মত দেশে শিল্প শিক্ষা বাধ্যতামূলক বলে সেখানকার মানুষেরা সবাই মোটামুটি রুচিশীল ও সৃষ্টিশীল হয়ে গড়ে উঠে সারা বিশ্বে অবদান রেখেছে। আমাদেরকেও সেই পথে এগুতে হবে এই স্বপ্নকে সামনে রেখে তিনি গড়ে তুলেছেন তার প্রাণপ্রিয় 'শিশু স্বর্গ'। আমাকেও বলেছিলেন খুলনা আর্ট কলেজের সাথে এ ধরনের কিছু একটা করতে । আমি সেটা করে আসতে পারি নি । এটা আমার ব্যর্থতা। সুলতান সাহেবের জীবনে আর একটা স্বপ্ন ছিল যা তিনি আমার নড়াইলে অবস্থানকালে বলেছিলেন । একটা বিশাল নৌকা তৈরী করাবেন । তাতে শিল্পীদের (শতাধিক) নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে সফর করা হবে । শিল্পীরা নিজের হাতে পাড় বাইবে । নদীর খোলা বাতাস আর দাড় বাওয়াতে তাদের শরীরও ভালো হবে। যেহেতু বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই নদী বা তার শাখা প্রশাখা আছে তাই দেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া সম্ভব হবে । নৌকার মধ্যে সবার বসবাস, স্নান, আহার, বিশ্রাম সবই চলবে । চলবে আলোচনা , গান, আবৃত্তি আর শিল্প সমালোচনা । স্থানে স্থানে নৌকা ভিড়বে। শিল্পীরা ছবি আঁকতে বেরিয়ে পড়বেন। কয়েকদিন অবস্থান করে আবার নতুন গন্তব্যে যাত্রা । দেশকে ভালো করে দেখা এবং সবাই একটি বিশাল পরিবারের মত হয়ে শিল্পচর্চার এক অদ্ভুত স্বপ্ন তিনি লালন করেছেন আমৃত্যু ।

সুলতানের শিল্পকর্ম সম্বন্ধে এখানে বিশেষ আলোচনা করতে চাই না । কারণটা শুরুতেই বলেছি । তবে , তার সমগ্র কাজের মধ্যে বাংলাদেশের আপামর কৃষক সমাজ প্রতিফলিত । তার শিল্পকলায় এদেশের মাটির গন্ধ পাওয়া যায় । কারণ , ‘ মাটির ’ খুব কাছকাছি ছিল তাঁর অবস্থান। জয়নুল এদেশের দুর্ভিক্ষ আর বুভুক্ষু মানুষকে উপস্থাপন করেছেন। কামরুল বাংলার আবহমান লোক- ঐতিহ্যকে লালন ও ধারণ করেছেন আর সুলতান বাংলার বুভুক্ষু মানুষের কাছে এক অনাগত সম্পদশালী শক্তিমান জাতির স্বপ্ন রচনা করেছেন। 

এ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে সারা পৃথিবী যখন পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন , তখন আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তার বিখ্যাত ছবি ' প্রথম রোপন ' (The First Plantation) আদম মাটির পৃথিবীতে এসে প্রথম বৃক্ষ রোপণ করছেন। বাদামি শরীরের প্রচণ্ড শক্তিশালী এক মানুষ। তার দেহ এই মাটির সাথে দৃঢ়বদ্ধ । মাটি আর দেহের রঙ একাকার। ওপরে ' কিউপিড ' , যা রেনেসাঁস চিত্রকলায় আমরা দেখেছি । আদমের চোখে এক সম্মোহনী দৃষ্টি । কী দেখছেন আদম ? অনেক কথা কিন্তু এই ঈষৎ বাঁকা চোখে ! সুলতান এ চিত্রের মাধ্যমে তার সারা জীবনের অনুভব, মাটি ও দেশ আত্মস্থ করে ধর্ম ও ইতিহাস মিশ্রিত করে নির্মাণ করেছেন অত্যন্ত আবেদনময়ী এই শক্তিশালী চিত্র ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles