সুলতানের শিল্পকর্ম

ঢাকার শল্পিরসিকদের কাছে, বিশেষ করে তরুণদের কাছে, এস . এম . সুলতান এক আশ্চার্য প্রতিভা হিসেবে আবির্ভূত হন শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত প্রথম জাতীয় চিত্রকলা  প্রর্দশনীতে ( ১৯৭৫ )। পঞ্চাশ দশকের প্রতিভাবান শিল্পী সুলতানের শিল্পকর্মের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কম দর্শকেরই পরিচয় ছিল। তারপর ১৯৭৬ এর সেপ্টেম্বরে একাডেমী গ্যালারীতে সুলতানের ৭৫ টিরও বেশী চিত্রকর্ম নিয়ে যে একক প্রদর্শনী হয়, তার মাধ্যমে তিনি ঢাকার সাধারণ শিল্পরসিকদের রীতিমত চমৎকৃত করেন। শিল্পবোদ্ধাদের কেউ কেউ তাঁর ভক্ত ও নিত্য সহচর হয়ে পড়েন। জনপ্রিয়তার কারণেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসানের পাশাপাশি সুলতানের নামও স্থান পেতে থাকে। প্রধানত তাঁদের চিত্রকলার বৈশিষ্টের  জন্যই এই তিন শিল্পীকে একসাথে স্মরণ করা হয়, শুধু বয়োজ্যেষ্ঠতার জন্য নয় । অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের  মধ্যে একটি বৈশিষ্ট এই তিন শিল্পীর কাজ প্রায় অভিন্ন -- পল্লীবাংলার শ্রমজীবী সাধারণ মানুষরে জীবন ও সংগ্রামই এঁদের ছবির প্রধান বিষয়বস্তু । তিনজনের শিল্পশৈলী ভিন্ন  হলেও মূলত বাস্তবভিত্তিক। অবশ্য জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান, উভয়েই সুলতানের তুলনায় প্রচলতি অর্থে অনেক বেশি ব্যাকরণসিদ্ধ আধুনিক ছবি এঁকেছেন। সুলতান সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই অনাধুনকি বা ' নাইভ ' প্রকৃতির ছবি আঁকেন । তিনজন শিল্পীর মধ্যে আরেক ধরনের পার্থক্য আছে । জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান এদেশের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, বিশেষ করে শিল্পকলার প্রতষ্ঠিান প্রর্বতনে, যে অসাধারণ ভূমকিা রেখেছেন বা রাখার সুযোগ পেয়েছেন, সুলতান সে অবদান রাখার সুযোগ পাননি। তিনি আন্দোলন করেছেন ভিন্ন ধরনের , প্রায় এককভাবে গ্রামীণ পরিবেশে শিশুদের নিয়ে । আরেকটি বিষয়  কিছুটা অবাক হতে হয়। ১৯৭৬- এ সুলতানের আলোড়ন সৃষ্টিকারী একক প্রর্দশনীর পর আজ প্রায় তিন যুগ পার হয়ে গেল ; এদেশের অন্য কোনো শিল্পীর কাজে সুলতানের শিল্প বৈশিষ্ট্যের তেমন কোনো প্রভাব চোখে পড়ল না, তেমন কোনো শৈল্পিক অনুসরণও নয়। তা হলে তাঁর স্টাইল কি শিল্পীদের কাছে তেমন গ্রহণীয় নয় ? অপক্ষোকৃত তরুণ শিল্পীরাও এখন সমাজ বাস্তবতার ছবি আঁকছেন, কিন্তু সুলতানের আঙ্গিকের নয়। শাহাবুদ্দিনও এদেশের বিপন্ন মানুষরে ছবি আঁকেন , সংগ্রামী মানুষরেও ছবি এবং সেখানেও মানুষ , বিশেষত পুরুষ, বাস্তবভঙ্গিতে আঁকা, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলাদেশের আরো অনেক তরুণ শিল্পী বর্তমান সমাজ ও মানুষ নিয়ে ছবি আঁকছেন, তাদের ছবির আঙ্গিক ভিন্ন। প্রধানত আধুনিক, প্রতীকী , আধাবিমূর্ত, স্যাটারিকাল। এস. এম. সুলতানের সাম্প্রতিক চিত্রকলার আঙ্গিকগত ও বক্তব্যগত বিশিষ্টতা সর্ম্পূণভাবেই উপলব্ধি করা গেছে তাঁর ১৯৭৬ - এর একক প্রদর্শনীতে। পরবর্তী তিন দশকে তাঁর বৈশিষ্ট্যসমূহ তেমনভাবে পরিবর্তিত হয়নি বরং আরো জোরালো হয়ছেে । কর্মী মানুষ , উৎপাদনকারী মানুষ , অর্থনৈতিক ভিত্তির মূল স্থপতি যে মানুষ , এরাই সুলতানের চিত্রকলার মূল নায়ক - নায়িকা । বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মানুষ যে কৃষক ও কৃষক পরবিার, এই প্রত্যয়টি অতি স্বচ্ছ সুলতানরে কাছে । বাংলার কৃষক ও র্অথনীতি যে এখনও মূলত প্রকৃতি নির্ভর, এই সত্যও সুলতানের কাছে অত্যন্ত পরষ্কিার। উৎপাদনের মূল উপাদান জমি, আর তাই জমিকে দখলে রাখার জন্য কৃষকদের নিজেদের মধ্যে লড়াই অনেক বেশি গুরুত্ব পায় সুলতানের ছবিতে, ভাষার জন্য লড়াইয়ের চাইতে । স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম , সম্ভবত তাও দূরবর্তী বিষয় মনে হয়। যে জমি একবারেই নিজস্ব জীবনধারণরে জন্য, তার ওপর দখলদারত্বিই প্রাধান্য পায় । হয় এইসব কারণে, তা নাহলে গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ব্যক্তিগত নস্টালজিয়ার জন্যই সুলতানের ছবিতে গ্রামীণ জীবনের চিরন্তন রূপ ( অথবা কিছুটা অতীত বাস্তবতা ) বেশি প্রাধান্য পায় । 

১৯৮৭ সনের এপ্রিল- মে তে ঢাকার জার্মান কালচারাল ইন্সটটিউটে এস. এম. সুলতানের শিল্পী জীবনের বিভিন্ন  সময়ের কাজের নমুনা এবং মধ্য আশির অনেকগুলো পেইন্টিং এবং ড্রইং নিয়ে এক বিরাট একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।নিঃসন্দেহে ঢাকার চিত্রকলা জগতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা । প্রর্দশনীতে একশরও বেশি কাজ ছিল। এতে যেমন স্থান পেয়েছিল তাঁর আঁকা পঞ্চাশের দশকের আকর্ষণীয় নিসর্গদৃশ্য    ( বন ) ; তেমনি প্রদর্শনীর সময়ে আঁকা ড্রইং । খুব ছোট ছবি এবং বিরাট  বিরাট  প্যানেল । সম্ভবত এতগুলো এত বড় মাপের তেলরঙ ছবি এদেশের কোনো শিল্পীই কখনও প্রদর্শন করেন নি । হয়তো আঁকেনও নি। এই একটি কারণেও প্রদর্শনীটি স্মরণীয়।

সুলতানের ছবির একটি বৈশিষ্ট্য  বাংলার কৃষকের শরীরকে অস্বাভাবকিভাবে পেশীবহুল, বিশাল ও শক্তিশালী করে দেখানো । অথচ বাঙালী কৃষকের মতো শীর্ণ, দুর্বল দেহ পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। এই দুর্বলদেহ চাষী সুলতানের কাছে অসম শক্তির অধিকারী। অন্ততঃ তাই হওয়া উচতি, হোক , এটাই তিনি চান । যখন দেখি শীর্ণদেহী ষাট-উত্তর এক শিল্পী সুলতানকে এবং তাঁর হাতেই আঁকা পঁচিশ তিরিশ ফুট দীর্ঘ  এবং পাঁচ সাত ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট  বিশাল পটভূমিসহ ক্যানভাসে অসংখ্য ফিগারসমূহ জীবন্ত তেলরঙে , তখন বুঝতে তেমন কষ্ট হয় না কেন সুলতান আপাতশীর্ণ বাঙালীকে এত শক্তিশালী করে দেখাতে ভালবাসতেন । শক্তি আসলে ভেতরের , শুধু বাইরের নয়।

সুলতান প্রথম বয়সে অত্যন্ত প্রতিভাবান নিসর্গ শিল্পী ছিলেন , তাঁর পুরাতন কাজে এটা যেমন পরিস্কার তেমনি আশির দশকেও যে তিনি জলরঙে চমৎকার নিসর্গ - দৃশ্য রচনায় পারদর্শী , তারও প্রমাণ পাওয়া গছেে ১৯৮৭ - র প্রদর্শনীতে ।পঞ্চাশের দশকে আঁকা সুলতানের কয়েকটি নিসর্গ চিত্রের কথা আলোচনা করা যায়ঃ এরকম দু'টি ছবির অনুলিপি পাওয়া যায় জালাল উদ্দিন আহমেদ রচিত পাকিস্থান পাবলিকেশনস প্রকাশিত Art in Pakistan  ( তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৬৪) গ্রন্থটিতে । দুটো ছবিই তেলরঙে , সম্ভবত যশোহর এলাকার নিসর্গ দৃশ্যভিত্তিক । একটিতে গাছঢাকা কাঁচা সড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে একটি গরুর গাড়ী । অনুলিপিটি সাদাকালোয়। অন্যটিতে ছোট বাঁকা নদীর ধারে গাছের নীচে বসে আহার এবং বিশ্রামরত জনাচারেক দরিদ্র গ্রামবাসী। দুটো ছবরিই কম্পোজিশন সুষম । যদিও দ্বিতীয় ছবিতে কেন্দ্রীয় ফোকাস কিছুটা অনিশ্চিত । অঙ্কনরীতি ভ্যান গগীয় ইম্প্রেশনিস্ট। রঙ নির্বাচন এবং তুলির স্ট্রোকের ধরন স্পটতই এরকম ধারণাই দেয়। দ্বিতীয় ছবিটি সুলতানের তখনকার দিনের দার্শনিক চিন্তারও পরিচায়ক কিছুটা।নিসর্গ প্রাধান্য পেয়েছে ছবিটিতে। মানুষ সেখানে গৌণ ভূমিকায় অবতীর্ণ।আশপাশের গাছপালার তুলনায় আনুপাতিকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে উপস্থাপিত হয়েছে মানুষ । সুলতানের পররর্তী পরণত পর্যায়ের শিল্পদর্শনে এর উল্টোটাই লক্ষণীয়, নিসর্গ সেখানে গৌণ, মানুষই বিপুলভাবে মুখ্য । তৃতীয় একটি নিসর্গ চিত্রের রঙিন অনুলিপি রয়েছে ১৯৮৭ সনে জার্মান কালাচারাল ইনস্টটিউটে অনুষ্ঠিত সুলতানের একক প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশতি ক্যাটালগে। এটি একটি বিশুদ্ধ নিসর্গদৃশ্য । প্যাস্টেলে আঁকা । বিষয়  , তিনটি গাছ । ছবিতে কোনো জন প্রাণী নেই । চমৎকার ইম্প্রেশনিস্ট ধারার ছবি । ছবিতে শিল্পীর নাম সাক্ষর নেই, তারিখও নেই । আলাদা করে দেখালে সুলতানেরই ছবি, এমন সনাক্ত করা কিছুটা কঠিন হতে পারে।

বড় মাপের তেলরঙে যে সব ফিগার তিনি ব্যবহার করেন সেগুলো যে অনুপাতহীন বা ড্রইং বিকৃত, তা যে নেহাৎই ইচ্ছাকৃত, সেটাও প্রতীয়মান হয় তাঁর সাম্প্রতিক বেশ কিছু পোর্ট্রেট ড্রইং থেকে। মার্কার পেন অথবা পেন্সিলে আঁকা এসব প্রতিকৃতিতে ড্রইং অনবদ্য। সুলতানের প্রধান ছবিগুলোর বৈশিষ্ট্য বিষয়গত দিক থেকে  ঘটনা - নির্ভরতা। এই ঘটনাসমূহ হতে পারে ফসল বোনা, ফসল তোলা, গোলায় শস্য তোলা অথবা চরদখল বা জমিদখল নিয়ে গোত্রীয় কলহ। কৃষিকাজ ও গৃহস্থালী বিষয়ক আরো অনেক বিষয়ও স্থান পেয়েছে তাঁর ক্যানভাসে । তাছাড়া চিরন্তন গ্রামীণ দৃশ্যাবলী, যেমন: স্নানরতা মহিলারা , কেশবিন্যাসে বা মাছ কুটতে ব্যস্ত মহিলারা, এই সব । সাম্প্রতিক কাজে ঝড় , বন্যা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন গ্রামবাসীদরে দৃশ্যও গুরুত্ব পেয়েছে । তবু বলতে হয়, বিষয়বস্তু নির্বাচনে একটি প্রধান গণ্ডীর মধ্যেই তিনি অবস্থান করেন আর এই বিষয় হলো, কৃষক ও কৃষক পরবিার । অঙ্কন-শৈলীতে সুলতান মূলতই পাশ্চাত্য ধারার শিল্পী  এবং বিভিন্ন কারণে তাঁর ছবি ভ্যান গগ, পল গঁগা অথবা পাবলো পকিাসোর কথা মনে করিয়ে দেয় । তাঁর বেশ কিছু ছবিতে ( যেমন ‘ ধান ক্ষেতে কৃষক ’ , ‘ ধান মাড়াই ' , ' গোলায় ধান তোলা ' ) হলুদ রংয়ের প্রাধান্য এবং তুলির স্ট্রোক এই দুই কারণেই তাঁকে ভ্যান গগের কাছাকাছি মনে হয় । আবার ‘ মাছ কোটা ' কিংবা ' ঝড়ের পরে ' ধরনের ছবিতে রঙের বৈশিষ্ট্য ( গাঢ় সবুজ , মিশ্র লাল, খয়েরী , বেগুনী ) এবং নারীমুখের আদল ( বিশেষত  ' মাছ কোটা ' ছবতিে) পল গঁগার কাজের সাথে কিছু সাদৃশ্য তুলে ধরে। ' মাছ কোটা ' ছবিটি ( মা ঘরে বসে বড় বটিতে রুই মাছ কাটছে , মেয়ে , ছেলে ও বিড়াল সামনে বসে সাগ্রহে দেখছে , পেছনে গাভী এবং বাছুর) একাধারে কালিঘাটের পট এবং পল গঁগার ছবির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । সুলতানের কিছু কিছু ছবিতে তাঁর অত্যন্ত নিজস্ব একটি রঙ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে ।বিশেষ  করে ‘ জমিদখলে কৃষকদের কলহ ' শীর্ষক  ছবিগুলোতে এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এগুলোতে রঙ প্রধানত মেটে সবুজ ( ভূমি ) এবং বাদামী ও খয়েরী ( মানুষের অবয়ব এবং র্বশা , ঢাল) মিশ্র  - চাপা প্রকৃতির রঙ।

সুলতানের চিত্রকর্ম  দেখে পিকাসোর কথা মনে হতে পারে। উভয়ের কাজে মানুষকে বিশাল মূর্তিতে চিত্রিত করার প্রবণতাটি লক্ষণীয় । অবশ্য পিকাসোর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা ছিলো সাময়িক। প্রসঙ্গত পিকাসোর ' উৎস ' ( ১৯২১ ) ইত্যাদি ছবরি কথা স্মরণীয়। মহিলাদের অত্যন্ত মনুমেন্টাল সব উপস্থাপন। পিকাসোর ছবিতে মহিলা চরিত্র হয় অবসরে উপবিষ্টা অথবা বিনোদনে শায়িতা । সুলতানের ছবিতে নারী - পুরুষ প্রায় সময়েই কর্মে এবং উৎপাদনে নিয়োজিত।কর্মী মানুষই সুলতানের মুখ্য চরিত্র।

সুলতানের ছবিতে মানুষের সাথে জন্তুর উপস্থিতি, বিশেষত গরুর ছবি , পিকাসোসহ অন্যান্য শিল্পীর ছবরি কথা মনে করিয়ে দেয়। জয়নুল আবেদিন কিংবা কামরুল হাসানও বিভিন্নভাবে তাঁদের ছবিতে গরুকে প্রধান্য দিয়েছেন। এম. এফ. হোসেন হাসানও ঘোড়াকে দিয়েছেন এক আশ্চার্য প্রতীকী স্থান। তরুণ শাহাবুদ্দিনও কুকুর , ঘোড়া ও গরুকে এনেছেন মানুষের পাশাপাশি । সুলতানের কাজে গরু অত্যন্ত প্রাত্যহিক বাস্তব ও সামাজিক প্রতীক । অন্যদের  ক্ষেত্রে প্রধানত নান্দনকিভাবে প্রতীকী।

সুলতান মানুষের শরীর আঁকেন পেশীবহুলতা দেখিয়ে। সাধারণত পরিলেখ বা কন্টুর রেখা ভেঙ্গে ফেলা হয়। পুরুষ-অবয়ব অঙ্কনে মাইকেলএঞ্জলেীয় ভাব থাকলেও পেশী প্রদর্শনের অতিরঞ্জন রয়েছে । এটা সুলতানের ইচ্ছাকৃত এবং তাঁর ছবির বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ মুখ প্রফাইলে আঁকা, অথচ তাদের শরীর দেখানো হয় সামনে বা পেছন থেকে । কোন কোন ছবিতে ভঙ্গি প্রায় ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যহীন । এমনকি পৌনঃপুনিকভাবে একই । নারীদেহ সুগঠিত তবে কমনীয় । দেহের পরিলেখ দীর্ঘ , কোমল; অনেকটা ধ্রুপদী ভারতীয় চিত্রকলার নারীদেহের মতো । এমনকি এরকম ছবি যেখানে পুরুষ ও নারী উভয়ের একাধিক অবয়ব এসেছে, সেখানে পেশীবহুল পুরুষদের পাশাপাশি কোমল নারীদহে যেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দুই রীতির ড্রইং - এর সুন্দর সমাবেশ ঘটিয়েছে।

সুলতানের চিত্রকলার অন্যতম প্রধান চমৎকারিত্ব তাঁর রঙ নির্বাচন ও প্রয়োগকৌশল ( যদিও একথা তাঁর সব ছবির জন্য প্রযোজ্য নয় ) । নানা ধরনরে হলুদ , সবুজ , নীল এবং লাল তিনি ব্যবহার করেন । সামগ্রিক রঙ বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল । বেশ কিছু  ছবিতে খয়েরী এবং বাদামীর প্রাধান্য ; বৈপরীত্য কম; যে কারণে এসব ছবির সাদা - কালো রিপ্রোডাকশন দেখে ছবির স্বাদ একেবারেই পাওয়া যায়না । মূল ছবি কিংবা কমপক্ষে উত্তম রঙিন রিপ্রোডাকশন দেখোই বাঞ্ছনীয়।

সুলতানের অধিকাংশ গুরুত্বর্পূণ ছবি ব্যাপক গ্রামীণ বিষয়বস্তু নিয়ে । প্রায় প্যানেল চিত্র ধরনের । অনেক ছবিতেই কেন্দ্রীয় ফোকাস জাতীয় কিছু থাকে না। আলোছায়ার সাধারণ ব্যাকরণও অনেকক্ষেত্রে মানা হয় না । পারসপেকটিভের বেলাতেও নিয়মভাঙার উদাহরণ লক্ষণীয়। এসবই সম্ভবত :শিল্পীর ইচ্ছাকৃত এবং এসব সত্ত্বওে চূড়ান্ত পর্যায়ে-সুলতানের চিত্রকলা শিল্পরসজ্ঞ ও সাধারণ, উভয় পর্য়ায়ের দর্শককেই আকৃষ্ট করে, আন্দোলিত করে । শিল্পকলার অন্যতম উদ্দশ্যে যদি হয় জীবনকে সমৃদ্ধ করা, নিঃসন্দেহে সুলতানের চিত্রকলা সে উদ্দশ্যে অনেকটাই বাস্তবায়ন করে। মহৎ বক্তব্য এবং চমৎকার ( যদওি অপ্রথাসিদ্ধ ) চিত্রশৈলীর কারণে সুলতান এক অনন্য শিল্পী । গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী । তাঁর ভিন্নধর্মী ও নির্মোহ ব্যক্তিত্বের কারণেও অবশ্য তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং আকর্ষণীয়।

সুলতানের ১৯৭৬ - এর প্রদর্শনীতে যেমন তেমনি ১৯৮৭'র প্রর্দশনীতে দেখা গেছে , বেশ বড় বড় কাজেও তিনি স্বল্পস্থায়ী চিত্রাঙ্কন উপাদান ব্যবহার করেছেন । কখনো কখনো তাঁর ছবির ক্যানভাস উন্নতমানের নয় । মাঝে মধ্যে তিনি নিজেই ছবির জন্য রঙ তৈরি করতেন । এসব রঙ শেষ পর্যন্ত হয়তো স্থায়ী হয়না। ইংরেজ শিল্পী উইলিয়াম ব্লেকও এরকম করতেন । তাঁর অনেক ছবিই কালক্রমে নষ্ট হয়ে গছে। অবশ্য শিল্পীদের মধ্যে কেউ  কেউ আছেন যারা তাঁদের শিল্পকর্মের স্থায়ীত্বের ওপর গুরুত্ব দেন না, তাঁদের কাছে আঁকাটাই প্রধান , ছবরি প্রর্দশন বা স্থায়ীত্ব ততটা নয়।

সুলতানের ১৯৭৬ - এর একক প্রদর্শনীর পর থেকে তাঁর ছবির পৃষ্ঠপোষকতা বা সমঝদারিতে প্রচণ্ড রকম পরিবর্তন এসেছে সন্দেহ নেই। ১৯৮৭'র প্রর্দশনীতে তাঁর বড় বড় ছবি বেশ উচুদামে বিক্রী হয়েছে । ব্যক্তিগত সংগ্রহে ভাল দামে শিল্পীদের শ্রেষ্ঠ কাজ চলে যাচ্ছে ভাল কথা, তবে সাধারণ মানুষরে ছবি যেন সাধারণ মানুষ সবসময় দেখার সুযোগ পায় সেজন্য গণভবনসমূহেও ( পাবলিক বিল্ডিং অর্থে ) যেন এ ধরনের ছবি স্থায়ী স্থান পায় সেদিকে দৃষ্টি দেয়া  প্রয়োজন।

বাংলাদেশে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে একটি মাত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী চিত্রকলা সংগ্রহ রয়েছে তা হলো জাতীয় যাদুঘরের সংগ্রহটি । এখনো এই সংগ্রহে সুলতানের কোনো ছবি স্থান পায়নি । তথ্যটি বিস্ময়কর। এক্ষেত্রে যাদুঘর কতৃপক্ষ যেমন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, সুলতান অনুরাগী কোটিপতি শিল্পরসিকরাও তেমনী উদাসীনতার উদাহরণ রেখেছেন। তাঁদের যে কেউ অন্তত সুলতানের একটি শ্রেষ্ঠ ছবি জনগণের জন্য জাতীয় যাদুঘর সংগ্রহে দান করতে পারতেন। অনেক শিল্পরসিক নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনা মূল্যে সুলতানের ছবির মালিক হয়েছেন। জাতীয় স্বার্থে তাদের মধ্যে দুয়েকজন প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে পারেন । জয়নুল ও কামরুল সংগ্রহের মতো করে জাতীয় যাদুঘরে সুলতানের বাছাই করা কিছু ছবির একটি বিশেষ সংগ্রহ দাঁড় করানো উচিৎ । অথবা প্রস্তাবিত জাতীয় চিত্রকলা সংগ্রহশালায় এরকম কিছু করা উচিত হবে। সাধারণ মানুষের কাছে সুলতানের ছবির প্রচণ্ড আবেদন আছে বলে মনে করা যায় । তাঁর ( এবং জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসানের) চিত্রকলার প্রকৃতিই এমন যে এগুলোকে শুধু গ্যালারীর দেয়ালে সীমিত না রেখে, গুরুত্বপূর্ণ গণভবনসমূহে দেয়াল -চিত্র হিসেবে রূপান্তর করা যায়। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৬ সনে এদেশে সুলতানের প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনীর ওপর লেখা এবং গণসাহিত্যে প্রকাশিত আমার একটি নিবন্ধের অংশ বিশেষের পুনরোল্লেখ করছিঃ " সুলতানের চিত্র ফ্রেস্কো অথবা দেওয়াল চিত্রে  রূপান্তরিত করবার জন্য অত্যন্ত উপযোগী এবং সামাজিক অর্থে উপকারী হবে বলেই আমার ধারণা। জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের মতই সুলতান বাংলাদেশের গণমানুষ ও গণজীবনকে অত্যন্ত দরদের সাথে ও শৈল্পিক উৎকর্ষতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । এই তিন শিল্পীর চিত্রকলার উপর ভিত্তি করে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় , সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারী ভবনসমূহে দেওয়াল চিত্র বা ফ্রেস্কো চিত্র তৈরি করলে জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা হবে । 


তথ্যসূত্র:

১. ১৯৭৪ সনে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের চিত্রশিল্প : বাংলাদেশের শীর্ষক  উল্লেখযোগ্য বইটিতে জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে নিতুন কুণ্ডু পর্যন্ত ১৬ জন সমকালীন শিল্পীর ওপর আলোচনা স্থান পেয়েছে , কিন্ত এস . এম . সুলতান সেখানে অনুপস্থিত । ১৯৭৫ - পূর্ব সময়য়ের অন্যান্য লেখালেখিতে এরকম পরিস্থিতি লক্ষ করা গেছে ।

২. নজরুল ইসলাম ,"সুলতান:  সামাজিক বাস্তবতার শিল্পী " , গণসাহিত্য , পঞ্চম বর্ষ ১-৩ সংখ্যা , ভাদ্র - কার্তৃক, ১৩৮৩ ( নভেম্বর , ১৯৭৬ ) ।

৩.  Jalal Uddin Ahmed , Art in Pakistan , 3rd Edition . ( Karachi : Pakistan Publications , 1964 ) .

৪. নজরুল ইসলাম , “ সুলতান : সামাজিক বাস্তবতার শিল্পী " , গণসাহিত্য , পঞ্চম বর্ষ ১-৩ সংখ্যা , ভাদ্র - কার্তিক , ১৩৮৩ ( নভেম্বর , ১৯৭৬)। 


Share

Recent Comments

Recent Articles