সুলতানের শেষ জন্মদিনে

একটুও বুঝিনি যে লাল ভাইয়ের সাথে আর দেখা হবে না। আর কোনোদিন তাঁকে লাল ভাই বলে ডাকতে পারব না। সেদিন ১০ই আগস্ট গিয়েছিলাম ঢাকা থকেে নড়াইলরে মাছমিদিয়া গ্রামে। এস এম সুলতানরে প্রিয় ‘শিশু স্বর্গে' । লাল ভাইয়রে বড় সাধের শিশুস্বর্গ। নড়াইল শহর থেকে মাত্র ১ কলিোমটিার আর রূপগঞ্জ বাজার থকেে সিকি কিলোমিটার দূরে সুলতানের বাড়ি। রূপগঞ্জ থেকেই মানুষের ভীড় । সবাই চলেছে সুলতানরে বাড়ী। তাঁর ৭০তম জন্মদিনে। শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁকে এক পলক দেখতে আমার মনটা ভীষণ ব্যগ্র । কখন পৌছব । কখন দেখব আমার প্রিয় লাল ভাইকে । বাস থেকে রূপগঞ্জ বাজারে নেমে রিকশা  নিলাম কিন্তু রাস্তায় মানুষরে ঢল। কোনো পর্ব নেই, উৎসব নেই, মেলা নেই অথচ উপচেপড়া মানুষ রং বেরং - এর পোশাকে সেজে চলেছে সুলতানের জন্মদিনে তাঁকে আর্শীবাদ করতে । আমার উৎকন্ঠার শেষপ্রান্তে এসে আমি যখন লাল ভাইয়রে শিশুস্বর্গের  কাছে পৌঁছলাম তখন সকাল ৯-৩০ মিঃ। রূপগঞ্জ — গোবরা পাকা রাস্তা থকেে শিশুস্বর্গ প্রায় ৭০/৮০ গজ পথ । বড় একটি ঝলমলে গেটে নানা বর্ণে সাজানো । রাস্তার দু'পাশেও শিল্পীর ছবিআঁকা কাগজে সাজানো। নানা রং বেরং - এর কাগজ দবেদারু পাতায় সাজানো ' শিশুস্বর্গ ' । আমার কাছে বড় মনোরম মনে হলো । আমার দীর্ঘ  জীবনে কতবার এসেছি, , কতদিন এসেছি শিল্পীর বাড়ীতে । সেই জীর্ণশীর্ণ ভাঙা দোতলা বাড়ী থেকে আরম্ভ করে সরকার প্রদত্ত নতুন বাড়ী । অনেক দিনের কথা । এমন আলো ঝলমল কখনো দেখিনি।

রিকশা থেকে নেমে প্রায় ছুটে গেলাম মঞ্চে, যখোনে শল্পিীকে তাঁর ৭০ তম জন্মদিনে দেয়া হচ্ছে মনোজ্ঞ সংর্বধনা। আমার পৌঁছতে একটু বিলম্ব হয়ছেে । সবাই তখন মঞ্চে । আমার আগেই পৌঁছে গেছেন সকল আমন্ত্রতি অতথি।আমার প্রিয় কবি আসাদ ভাই আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন। আমি নিম্নস্বরে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর পাশেই আরও একজন বিশিষ্ট অতিথি, নামটি এ মুর্হূতে মনে পড়ছে না । তারপরই সেই বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী  এসে. এম. সুলতান যিনি তাঁর কীর্তিতে  তাঁর সৃষ্টিতে অম্লান । তাঁর নামে নয়, তাঁর কর্মে।

আমার চোখ শিল্পী সুলতানের দিকে । মঞ্চে উপবিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দিকে নয় । সুন্দর একটি ফুলের মালা পরে শিল্পী মঞ্চে । প্রথম দর্শনে বেশ উৎফুল্ল মনে হলো । অবশ্য আজকের সুলতানের সাথে আগের দেখা সুলতানের  অনেক অমিল । বেশভুষা অনকে সুন্দর ও সাবলীল আজকের সুলতানের। আগের সেই আলুথালু বাউন্ডুলে ভাব আমি দখেছি না । এ যেন আমার চেনা অতি প্রিয় সেই সুলতান নন । আজ তাঁকে সাজিয়ে গুছিয়ে মঞ্চে আনা হয়ছে।

বক্তারা খুব ভালো কথা বলছেন । কেউ বলছেন সুলতানের ' শিশুস্বর্গ' প্রতষ্ঠিার কথা , কেউ বলছেন শিল্পীকে জাতীয়ভাবে সুচকিৎিসার কথা । কিন্তু আমার কানে কারো কোনো কথাই ঢুকছে না । আমি শুধু অপেক্ষা করছি লাল ভাইয়রে কথা শোনার । কখন তাঁর দু'টি কথা শুনবো । অনুষ্ঠানের  শুরুতে কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে  গেছে । মঞ্চে আমার মাথার উপরের সামিয়ানা নিচু হয়ে মাঝে মধ্যে এক ঝলক করে পানি পড়ছে । আমরা দু'একজন উঠে পানি ঝেড়ে আবার বসছি । একবার আসাদ ভাইও কছিুটা ভিজে গেলেন । মঞ্চে একেবারে ঠাসা ভীড় । আর উপচেপড়া মানুষরে ঢল মঞ্চের সামনে অসমাপ্ত শিশুস্বর্গের মধ্যে । বাইরে , দুপাশে , রাস্তায় র্সবত্র মানুষ আর মানুষ । অনকক্ষণ, অনেক মানুষের কথা বলার পর লাল ভাই কথা বললেন। মঞ্চে তাঁর আসনে বসে । সেই মর্মর্স্পশী কথা । আমার কানে শোনা লাল ভাইয়রে শেষ বক্তৃতা । খুব আস্তে আস্তে ছোট ছোট কথা। যেমন আমি বহুবার শুনেছি , বহু অনুষ্ঠানে , ঘরোয়া পরিবেশে , একান্ত অন্তরঙ্গ মুর্হূতে আমার বাসায় । লাল ভাইয়রে সেই ভাঙা দোতলায় , ঠিক সেই রকম লাল ভাই বলছিলেন— ' আমার স্বপ্নের সাধ আমার এই ‘ শিশুস্বর্গ' । এখানে আসবে সব দেবশিশুরা । যারা নিষ্পাপ , যারা সুন্দর , যারা সত্যিকার ছবির মত । যে শিশুরা দু'বেলা খেতে পারে না , যারা ন্যাংটো থাকে , পরার কাপড় নেই, উদোম গায়ে থাকে , যাদের পাঁজরের হাড়গুলো গুনে নেয়া যায় তাদের নিয়ে আমি শুরু করেছিলাম এই ‘ শিশুস্বর্গ। ওদের দেখে আমি ছবি আঁকা ভুলে গিয়েছিলাম । আমি তখন ভালো ছবি আঁকতে পারতাম না । আমার তুলতিে ওই হাড় জিরজিরে কঙ্কালসার শিশুগুলির ছবি ভাসতো । এখন গ্রামের অনেক শিশু এখানে আমার ‘ শিশুস্বর্গে ' এসেছে । তারা এখন বই নিয়ে পড়তে পারে । ছবি আঁকতে পারে । আগে ওদরে মা - বাবা এখানে আসতে দিতে চাইত না । ছবি আঁকতে দিতো না । এখন আর বাধা দেয় না । তারা বুঝতে পেরেছে হয়ত মানুষ হবে । আমি দেশের সব শিশুকে আমার ছবির মানুষের মত হৃষ্টপুষ্ট দেখতে চাই । আমি চাই সব শিশু পেটপুরে দুধভাত খাবে । সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশু হবে । ওরা প্রাণ খুলে গান গাইবে , ছবি আঁকবে , খেলবে । এখন আমি আর আগের মত গ্রামের মানুষের মুখে গান শুনি না। আমি আর নদীর বুকে মাঝির কন্ঠে সেই মনমাতানো গান শুনি না । এখন আর রাখাল বাঁশি বাজায় না । এমন কেন হলো।'

 শিল্পী আর কথা বলতে পারলনে না । ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন । শেষে আধো আধো গলায় সবাইকে তার জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন । মঞ্চ থেকে তার চলে আসার ব্যস্ততা । সবাই ঝুঁকে পড়ছেে । এমন সময় আমি আমার ডায়রির ১০ আগস্ট ৯৪ - এর পাতা খুলে সামনে ধরলাম । বললাম কছিু লিখুন আপনার জন্মদিনে । শিল্পী তাঁর অটোগ্রাফ দিলেন কোনরকমে । কারণ তিনি তখন ভালো করে দেখতে পান না ।

তারপর অনকেগুলো ছবি তুললাম । আমার সাথে  শিল্পীর একার । আরতি এবং খুলনা র্আট কলেজের লাল ভাইয়রে এক ছাত্রীর সাথে । প্রায় ১৫ / ১৬ টি । এরপর খুব আব্দার করে আবার ধরে বসলাম লাল ভাইকে । আমার ডায়ররি ১০ আগস্টরে পাতা খুলে অনুরোধ করলাম একটি স্কেক করে দিতে। প্রথমে একটু না না করলেন। কন্তিু আমার পীড়াপীড়িতে কলম হাতে নিলেন । বললেন , কি আঁকবো। আরতিকে কাছে আসতে বললেন। প্রায় হাতের আন্দাজে বলপেন দিয়ে আঁকলেন এক মানবী র্মূতি । তার সেই চিরাচরিত পশেীবহুল ছবি । নিচে অস্পষ্ট তাঁর স্বাক্ষর এবং তারিখ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫


Share

Recent Comments

Recent Articles