উপেক্ষিত সুলতান
উপেক্ষিত সুলতান (১) ●
৪৭ উত্তর স্বাধীনতার পর পুরাতন ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি কক্ষে ঢাকা আর্ট ইন্সটিট্যুটের যাত্রা শুরু হয়। এর পর এটি স্থানান্তরিত হয় মোটামুটি বড় পরিসরে সেগুন বাগিচার একটি দোতলা ভবনে। শাহবাগে যে বর্তমান চারুকলা অনুষদ ভবনটি রয়েছে, সেখানে যখন আর্ট ইন্সটিট্যুটটি স্থানান্তরিত হয়, তখন ওটি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। সুলতান সেগুন বাগিচার ঐ ভবনে থাকতেন। ছবি আঁকতেন। অদ্ভূত পোশাক পরে থাকতেন। মানে শাড়ী পরে ঘুরতেন। গাঁজা খেতেন। এ সব কারণে নাকি তৎকালীন অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন তাঁকে ওখান থেকে বের করে দেন। সুলতান পথে পথে ঘুরতে থাকেন। তাঁর বড়ই শখ ছিল শিক্ষক হবার। সেটা তাঁর ভাগ্যে জুটল না। শিক্ষক আর হতে পারেন নি ওখানে। সুলতান আবার নড়াইলবাসী হলেন। সেখানে বনে জঙ্গলে পাগলপ্রায় অবস্থায় দীর্ঘ নির্বাসনে নিরুদ্দেশ থাকলেন। শিল্পী সমাজ ও সাধারণ মানুষের লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গেলেন অনেকটা সময়।
উপেক্ষিত সুলতান (২) ●
সুলতানকে ঢাকার আর্ট ইন্সটিট্যুটে চাকুরী না দেবার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, বা প্রচার করা হয়েছিল যে তিনি আর্ট কলেজের কোর্স শেষ করেন নি, বা তাঁর ডিগ্রী না থাকার বিষয়টি। যতদূর জানা যায় আর্ট ইন্সটিট্যুটের পাঁচ বছরের কোর্সের তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত তিনি পড়াশুনা করেন। কোন কোন সূত্র অবশ্য বলছে শেষ বর্ষে অর্থাৎ পঞ্চম বর্ষে উঠে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। এটি নিয়মের কথা। কিন্তু আমাদের সময়ের বেশ কিছু উদাহরণ আছে, যাঁরা কোর্স শেষ না করেও খ্যাতিমান হয়েছেন। এমনকি সরকারী গুরুত্বপূর্ণ আর্টিস্টের পদে চাকুরি শেষ করেছেন। কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেন নি। আমি তাঁদের নাম বললে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। তবে দুটি বড় উদাহরণ দিতে চাই। একটি হলো পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতের বিখ্যাত শিল্পী সোমনাথ হোর (জন্ম, চট্টগ্রাম, ১৮২১) । ১৯৪৫ এ কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে ৪র্থ বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা করে রাজনৈতিক কারণে আত্মগোপনে চলে যান। পাঁচ বছরের কোর্স শেষ না করেও এবং গোপন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়া সত্বেও ১৯৫৩-৫৮ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ, ১৯৫৮-৬৭ দিল্লী আর্ট কলেজ, এবং ১৯৬৯ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের কলাভবনে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। সেখান থেকেই অবসরে যান। তিনি চিত্তপ্রসাদ ও জয়নুলের প্রভাবের কথা স্বীকার করেন।আর একজন হলেন হাবিবুর রহমান জমাদার। পরে আসছি।
উপেক্ষিত সুলতান (৩) ●
কোলকাতা আর্ট কলেজের যে সমস্ত শিক্ষক পরবর্তীতে ঢাকা আর্ট কলেজে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন, জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমদ ও হাবিবুর রহমান জমাদার। সৌভাগ্য ক্রমে এঁরা সবাই আমার শিক্ষক ছিলেন। কেবল খাজা শফিক আহমদ স্যারকে ক্লাসে সরাসরি পাই নি। কারণ তিনি ছিলেন কমার্শিয়াল আর্টের (এখনকার গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ) বিভাগীয় প্রধান। আমি ড্রইং ও পেইন্টিং বিভাগের ছাত্র হওয়ায় আমার ওখানে ক্লাশ করার কোন সুযোগ ছিল না। আমার অপশনাল পেপার ছিল ছাপচিত্র বা প্রিন্টমেকিং। আমাদের বিভাগের অনেকেই অপশনাল হিসেবে ভাস্কর্য নিয়েছিল। ছাপচিত্রে দুজন কিংবদন্তি শিল্পী শিক্ষক ছিলেন। তাই আমার ওখানে যাওয়া। এ ছাড়া পাশ করার পর নিজের প্রেস না থাকলে এ মাধ্যমে কাজ করা সম্ভব নয়। ছাপচিত্রে ছিলেন সফিউদ্দিন আহমেদ আর মোহাম্মদ কিবরিয়া। আর ছিলেন এক কালের অনবদ্য কাঠখোদাই মাস্টার হাবিবুর রহমান জমাদার। তিনিও ছিলেন কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষক। সেই সাথে ওখানে সফিউদ্দিন স্যারেও শিক্ষক। এঁরা তিনজনই আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন বলে গর্ব করে থাকি। হাবিবুর রহমান স্যার (কোলকাতা আর্ট কলেজে) তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময়েই কলকাতা আর্ট কলেজের শিক্ষক হয়ে যান। অসম্ভব ভালো কাজ করতেন বলেই কলকাতা আর্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে তখন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু এস এম সুলতানের মত এত শক্তিশালী একজন শিল্পী ঢাকা আর্ট কলেজে সে সময়ে শিক্ষক হতে পারেন নি। এটা আখেরে তাঁর জন্যে বা এ দেশের শিল্পকলার জন্য ভালো হয়েছিল কিনা, সেটা বলা সত্যিই কঠিন।
উপেক্ষিত সুলতান ( ৩ ) ●
সুলতান তো কোলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে। কোর্স শেষ না করেই অনেকের মতে ৩য় বর্ষে, আবার কারো মতে ৫ম বা শেষ বর্ষে কলেজ ত্যাগ করেন। পৃথিবীর অনেক বড় বড় খ্যাতিমান শিল্পী তো আর্ট কলেজের দরোজাতেই পা রাখেন নি। এ উপমহাদেশের দুজনের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। একজন ভারতের পিকাসোখ্যাত মকবুল ফিদা হুসেন। আর একজন পাকিস্তানের সাদেকাইন। হুসেন প্রথম জীবনে সিনেমার হোর্ডিং এঁকে জীবনধারণ করেছেন। পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছেন। সাদেকাইন শিল্পশিক্ষা নিয়েছেন এস এম সুলতানের কাছে, যখন সুলতান করাচীতে বসবাস করতেন। হুসেনকে শিক্ষকতার অফার দেয়া হয়েছিল। তিনি নেন নি। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষক হতে হলে তাঁকে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতে হবে। আর সেটা করতে গেলে তিনি স্বাধীনভাবে শিল্পসৃষ্টি করতে পারবেন না। তাই, আমার মতে সুলতানের শিক্ষকতা করার সুযোগ না পাওয়াটা তাঁর জন্যে হয়তো আশীর্বাদ হয়েই এসেছিল। শিক্ষকতার বেড়াজালে আটকালে তাঁর পক্ষে এত সব কালজয়ী শিল্পকলা সৃষ্টিতে ব্যত্যয় ঘটত বলেই আমি মনে করি।
শিল্পী এম. রফিকুল অালম
অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Recent Comments