যেভাবে 'আদম সুরত'

ফিল্ম নিয়ে  পড়াশােনার জন্য ১৯৮২ সালে আমি ভারতের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে আবেদন করেছিলাম এবং স্কলারশিপও হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে সবে বেরােচ্ছি। মার্চের ২৪ তারিখে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর ভারতবিরােধী মনােভাব দেখানাের জন্য ভারতের সব স্কলারশিপ বাতিল করে দেন। ফলে আমার স্কলারশিপটাও চলে গেল। ওটাকে কীভাবে ফেরত আনা যায় সে জন্য চেষ্টা শুরু করি। এরশাদের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা নাট্যকার সাঈদ আহমেদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁকে দিয়ে আমার স্কলারশিপটি ফিরিয়ে আনার পর পুনায় গিয়ে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পরিচালক কৃষ্ণমূর্তির কাছ থেকে ‘নাে অবজেকশন' সার্টিফিকেট আনলাম যে তারা আমাকে নেবে। কিন্তু এই ছােটাছুটিতে দেরি হয়ে যাওয়ার ফলে সেখানে তত দিনে সেশন শুরু হয়ে যায়। ফলে আমার আর যাওয়া হলাে না। রাগে-দুঃখে তখন আমি পারিবারিকভাবেই অর্থ জোগাড় করে ফিল্মের ওপর পড়াশােনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।

এদিকে শিল্পী এসএম সুলতান তখন আমাদের মতাে যুবকদের কাছে কিংবদন্তি।তার ওপর আহমদ ছফার একটি লেখা সুলতানের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। আমরা তখন বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকজন মিলে সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার কথা ভাবছিলাম। যেমন — সাজেদুল আউয়াল, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। আমরা যারা চলচ্চিত্রের বিকল্পধারা নিয়ে  ভাবছিলাম, তাদের কাছে মনে হয়েছিল, সুলতানের ওপর ছবি করাটা খুবই জরুরি। চিত্রগ্রাহক আনােয়ার হােসেন সুলতানের প্রতি আমার এই আগ্রহের বিষয়টি জানতেন। আমি তখন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেছি। আনােয়ার ভাই আমাদের ক্যামেরার শিক্ষক ছিলেন।তিনি সব সময় উৎসাহ দিতেন ছবি বানানাের জন্য। আমি তাঁর জিগাতলার বাসায় গিয়ে পড়াশােনার জন্য আমার বিদেশে চলে যাওয়ার কথা জানালাম। তখন উনি বললেন, আজকের কাগজ দেখেছ ? আমি বললাম, না।' উনি আবার বললেন, ‘ইত্তেফাক খুলে দেখাে । ব্যাক পেজে বড় করে নিউজ — শিল্পী সুলতান হাসপাতালে, ভীষণ অসুস্থ। মনে আছে, তুমি বলেছিলে সুলতানের ওপর ডকুমেন্টারি করবে । তুমি যদি এখন পড়তে বাইরে চলে যাও, ফিরে এসে দেখবে শিল্পী নেই। তােমার মনের মধ্যে কিন্তু একটা বিরাট আফসােস থেকে যাবে। আমি আনােয়ার ভাইকে বললাম, আমি বাইরে যাওয়ার যাবতীয় কাজ সেরে ফেলেছি, আমি চলে যাব।'

তারপর জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কাকতালীয়ভাবে বাসটি সেদিন আসতে অনেক সময় নিয়েছিল। বাসটা এত দেরি না করলে হয়তাে মাথার মধ্যে এই উল্টো বুদ্ধিটা আসত না। সেখানে দাড়িয়েই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিদেশে যাব না, ওই টাকা দিয়েই সুলতানের ওপর ছবি বানানাে শুরু করে দেব। আমেরিকায় ফিল্ম নিয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য যে অর্থ জোগাড় করেছিলাম, সেটা দিয়েই ছবির কাজ শুরু করে দিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সুলতানকে নিয়ে ছবিটা বানালে একদিকে যেমন একজন বড় মাপের মানুষের ডকুমেন্টেশন হবে, ঠিক তেমনি ছবি বানাতে গিয়ে ছবি বানানাের শিক্ষাটাও হবে, স্বশিক্ষিত হওয়া যাবে। আমার উপলব্ধিতে বারবার মনে হয়েছিল, শিল্পী সুলতানের জীবনের প্রামাণ্যকরণ অনেক বেশি জরুরি।

তবে আমার অনভিজ্ঞতা ও অল্প বয়সের অপরিপকৃতার জন্য আমি যে শিক্ষাটা পেলাম, তা হচ্ছে ইচ্ছা ও চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবজগৎ অনেক ভিন্ন। আমি জোগাড় করতে পেরেছিলাম দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ভেবেছিলাম, ছবিটি সম্পন্ন করতে ওই অর্থই যথেষ্ট। কিন্তু যা করতে চেয়েছিলাম, তাতে ওই অর্থ দিয়ে তার সিকি ভাগও হয়নি। ফলে রীতিমতাে ফেঁসে গেলাম। যেখানেই পেয়েছি ধার-দেনা করেছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য-সহযােগিতা পাওয়ার আশায় ছুটে বেরিয়েছি। কারিগরি সাহায্য হিসেবে আমি ডিএফপি ( ডিপার্টমেন্ট । অব ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশনস ) থেকে অনেক সহযােগিতা পেয়েছি। সেখানকার পরিচিত লােকজন ধরে কখনাে কখনাে ক্যামেরা ফ্রি পেয়েছি, এডিটিং করতে পেরেছি। কিন্তু এসএম সুলতানের মতাে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জীবনকে সেলুলয়েডে ধরতে হলে শুধু এ ধরনের কারিগরি সমর্থনই যথেষ্ট নয়, অর্থও লাগে। যেমন, ছবির শুটিং করার জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার প্রয়ােজন পড়ল। '৮৩ সালে আমি বাংলাদেশ বিমানের দুটো টিকিট ফ্রি পেয়েছিলাম। কিন্তু টিকিট ছাড়াও তাে আনুষঙ্গিক খরচের জন্য অনেক টাকা লাগে, সেটা আমাকে জোগাড় করতে হয়েছে । সেই সময় আমাদের বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক আনােয়ার হােসেন ১০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন। মূলত তাঁরই ক্যামেরাম্যান হিসেবে ছবিতে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময়ে তিনি ইউনেসকোর স্টিল ফটোগ্রাফির একটা অ্যাসাইনমেন্টে আফ্রিকায় চলে গেলেন। ফলে সহকারী চিত্রগ্রাহক হিসেবে যার কাজ করার কথা ছিল, সেই মিশুক মুনীর মূল দায়িত্ব পালন করলেন। শুটিং করতে গিয়ে যেটা দেখলাম, অর্থাৎ যে কষ্টকর ও বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে শুটিং করেছি, সেখানে আনােয়ার ভাইয়ের মতাে একজন বয়ােজ্যেষ্ঠ মানুষের পক্ষে কাজটি করা খুব সহজ হতাে। কারণ, আমার ও মিশুকের জন্য এক রকম সাপ, ব্যাঙ, মুরগির বিষ্ঠা, পচা ক্যানভাস ইত্যাদির মধ্যে রাত যাপন করা হয়তাে কোনাে ব্যাপার ছিল না ; কিন্তু আনােয়ার ভাইয়ের জন্য তা খুবই কষ্টকর হয়ে যেত।

তা ছাড়া এসএম সুলতানের দুই ঘণ্টার ফুটেজের জন্য হয়তাে তাঁর সঙ্গে সময় কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। কারণ, ওনার সঙ্গে ঘুরতে হতাে ওনার মতাে করে। আমরা সব সময় ওনার শুটিং করলে উনি বিরক্ত হতেন। উনি বলতেন, ছবি থেকে জীবন অনেক বড়। হয়তাে বলতেন, 'চলুন , আমরা বিজয় সরকারের বাড়ি ঘুরে আসি। আমরা বললাম, ক্যামেরাটা নিয়ে যাই।' উনি বললেন, ‘রাখুন না ক্যামেরা, যন্ত্রটন্ত্র থাকুক। আপনার ক্যামেরা ( চোখ ) দিয়েই কাজ হবে। কিন্তু বিজয় সরকারের বাড়িতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হবে, সেটা আর উপলব্ধি করতে পারবেন না।'

এ রকম করে এক ধরনের বাউলাঙ্গের চলচ্চিত্র নির্মাণে আমরা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। সম্ভবত সেটা ওই বয়সেরই ধর্ম ছিল। ছবি শেষ করতে হবে- ওটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোনাে মাথাব্যথা ছিল না। সুলতানের মতাে অসাধারণ এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছি, বিভিন্ন লােক- উৎসবে যাচ্ছি এবং বাংলাদেশকে তার চোখ দিয়ে দেখছি, নতুন করে আবিষ্কার করছি-এটা এতই আনন্দের এবং এর মধ্যে এতই প্রাপ্তি ছিল যে, ছবি বানানােটা অনেকটা উপজাতের মতাে ছিল। আমরা সুলতানেরই আশকারায়, উসকানিতে প্রচুর অর্থ, সময় ও ফুটেজ ব্যয় করেছি। বিভিন্ন লােকজ উৎসব, যেমন - কুমিল্লার -পাগলার মেলা থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারি, তারপর কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উৎসব, ফরিদপুরের নৌকাবাইচ, ধামরাইয়ের রথযাত্রা—যেখানেই শুনতাম লােকসংস্কৃতির কোনাে যজ্ঞ চলছে, সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম।

ছবিটির একটা কাঠামাে চিন্তা করে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। সুলতান তাে গণমাধ্যম বা ক্যামেরার সামনে আসতে রাজি হতেন না। তবে শেষ পর্যন্ত যে শর্তে রাজি হলেন তা হচ্ছে, তিনি যেন ছবির প্রধান বিষয়বস্তু না হন। তিনি বললেন, 'আমি বরং নিমিত্ত, আমাকে উপলক্ষ করে আপনারা বাংলার কৃষকের ওপর ছবি বানান। আমি আপনাদের সঙ্গে ক্যাটালিস্ট হিসেবে থাকব।' তাঁর এই নির্দেশনা আমাদের জন্য এক রকম পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়, আমরা সুলতানের সঙ্গে ঘুরব এবং তাঁর সঙ্গে গ্রামীণ বাংলাকে দেখৰ। ফলে যেখানেই যাচ্ছি, সেটাই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত পর্যায়ে ছবিটায় তত বেশি লােকসংস্কৃতির বিষয়গুলাে রাখা হয়নি। সম্পাদনার টেবিলে আমরা সব ব্যবহার করিনি, তা হলে ছবিটি অনেক বড় হতাে, অনেক বড় বাজেটের হতাে। এ ছবির উপস্থাপনায় আমাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল—সুলতানের সকাল, দুপুর, রাত আর বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষি । আরেকটি সিদ্ধান্ত গােড়াতে ছিল ; ছবিটি জীবনীমূলক হবে না। অর্থাৎ শিল্পীর একক জীবনবৃত্তান্ত বলার জন্য ছবি নির্মাণ নয়। তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন - জীবনই আমাদের মূল বিষয়। সে কারণে ছবিটির টাইটেলের আগেই তাঁর জীবন পরিচিতির পাট চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমি যখন ছবিটি শুরু করি, তখন নাগরিক সমাজে সুলতান কিংবদন্তির মতাে । তাঁর অতীত, এমনকি বর্তমান জীবন নিয়ে অতিমানবীয় গল্পের শেষ নেই । তিনি শাড়ি পরে, নূপুর পায়ে থাকেন। তিনি গােখরা সাপের সঙ্গে ঘুমান, বাঘকে বশ করতে পারেন ইত্যাদি। এই মিথের মিথ্যা এড়িয়ে , বর্ণাঢ্য অতিপ্রাকৃতিক ভাবমূর্তি ছাড়িয়ে শিল্পীর বাস্তব জীবন ও শিল্প অন্বেষণের সিরিয়াস দিকটার প্রতি নজর দিতে চেয়েছি। আরেকটি বিষয় ছবির শুটিং শুরু করার আগেই পরিষ্কার ছিল, শিল্পী হিসেবে সুলতানের তুল্যমূল্য বিচার আমার লক্ষ্য ছিল না, বরং ধারণা পর্যায়ে যদি কোনাে কিছু কাজ করে থাকে তা হলাে, একজন শিল্পীকে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা কীভাবে পরিবর্তিত করে তুলতে পারে, ছবিটি হবে তারই একটি সমীক্ষা। আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর সব খ্যাতি, যশ ও পশ্চিমা লাইফস্টাইল — সব কিছু পেছনে ফেলে তিনি যখন তাঁর গ্রামে ,তাঁর শৈশবে ফিরে এসে কৃষকদের সঙ্গে মিশে যান, দীর্ঘদিনের এই সম্পর্ক কৃষকসমাজ কীভাবে তাঁর শিল্পাদর্শ ও জীবনাদর্শকে প্রভাবিত করেছে, সেটা তুলে ধরা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বিবর্তনের যে বিশ্লেষণ ছবিতে আছে, সেটা মূলত তাঁর পরিক্রমণশীল অভিজ্ঞতার নিরিখেই এসেছে।

পাঠককে মাথায় রাখতে হবে, ছবিটি আমি সাত বছর ধরে নির্মাণ করেছি। এটি এক অর্থে আমার জন্য শাপে বর হয়েছে—কোনাে নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট নিয়ে হয়তাে কাজটি শুরু করিনি। যে সময়ে কাজটির শুরু, তখন অভিজ্ঞতা, বয়স — অনেক ক্ষেত্রেই আমি কাঁচা ও অপরিণত।

চিত্রনাট্যের কোনাে আঁটসাঁট ছকে শুটিং না করায় সম্পাদনার শেষ মুহূর্তে সৃজনশীল স্বাধীনতার সুযােগ পেয়েছি।তাই আদম সুরত-এর 'চিত্রনাট্যকে‘ চিত্রনাট্য’ না বলে নাট্যহীন চিত্র’ বলতে চাই। মনে পড়ে অন্য দু-একজন, যারা সুলতানকে নিয়ে ছবি বানানাের কথা ভাবছিলেন, তাঁদের প্রায় কাহিনিচিত্রের মতাে কাঠামাে বা এক রকম চিত্রনাট্য ছিল। আমি যখন ছবি শুরু করি, তখন চিত্রনাট্য তাে দূরের কথা, কোনাে খসড়া ধারাভাষ্য বা সুস্পষ্ট রূপরেখাও ছিল না। এটা খামখেয়ালি বা আলসেমির কারণে নয়, বস্তুত। সচেতন ভাবনা থেকেই । ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে অনেক দিন ধরে শিল্পীকে অনুসরণ করব, তাঁর সঙ্গে বসবাস করব, তাঁর সঙ্গে গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াব, তাঁর নৈমিত্তিক জীবন তুলে ধরব—এ রকম নির্মাণের সঙ্গে সঞ্চিত অর্থ ও আয়ত্তাধীন প্রযুক্তির সম্পর্কটা ছিল সাংঘর্ষিক। এ ধরনের পর্যবেক্ষণধর্মী প্রামাণ্যচিত্রের জন্য দরকার প্রচুর অর্থ ও সাউন্ড সিংক ক্যামেরা। বলা বাহুল্য, দুটোর একটিও আমাদের ছিল। শুটিং শুরু করার পরে জেনেছি, দেশে লাইভ সাউন্ড ক্যামেরা নেই। আসলে সুলতানকে নিয়ে ছবির প্রজেক্ট আজকের টেপলেস ডিজিটাল ক্যামেরা প্রযুক্তির যুগে করা উচিত ছিল। এখন স্বপ্ন দেখতে ভালাে লাগে, মনের আশ মিটিয়ে দিনরাত বিরতিহীন শুট করছি, কোনাে ফিল্ম রান-আউট হওয়া তাে দূরের কথা, টেপের পয়সাও খরচ হচ্ছে না!

যদিও কোনাে ধরাবাঁধা চিত্রনাট্য ছিল না, কিন্তু গাইডলাইন ছিল। চূড়ান্ত ছবিতে ভাের থেকে রাতের যে ধারাবাহিক কাঠামাে রয়েছে, গােড়াতেই তা লেখা ছিল । সকাল - দুপুর - বিকাল - সন্ধ্যা - রাতের ধারাক্রমটা অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম । ছবিতে কী থাকবে আর কী থাকবে না, তার একটা বিস্তারিত তালিকাও ছিল। যেমন, বিশেষজ্ঞ বা চিত্রসমালােচক অথবা সুলতানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বা চিত্রশিল্পীদের সাক্ষাৎকার থাকবে না । আদি পরিকল্পনা ছিল, ধারাভাষ্য একদমই থাকবে না। সাউন্ড সিংক ক্যামেরার অভাবে যখন সুলতানের পর্যাপ্ত সাক্ষাৎকার নিতে ব্যর্থ হলাম, তখন আত্মকথনের শরণাপন্ন হলাম। সম্পাদনা পর্যায়ে এসে অবশ্য সীমিত ধারাভাষ্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিই।

দীর্ঘ সময় ধরে কাজ চলার কারণে এর নির্মাণপ্রক্রিয়া অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হতে লাগল। ফলে আমার ঋণ বাড়তে লাগল। আমার মনে আছে, ঢাকা শহরের বেশ কিছু এলাকা তখন আমি এড়িয়ে চলতাম। কারণ, ওই সব এলাকাতেই আমার পাওনাদাররা ছিল।

আমি '৮২ সালে সুলতানের ওপর ছবির শুটিং শুরু করার পর মােরশেদুল ইসলাম আগামী ও তানভীর মােকাম্মেল হুলিয়ার কাজ শুরু করলেন এবং যথাসময়ে সুন্দরভাবে নির্মাণকাজ শেষ হয়ে এগুলাের প্রদর্শনও চলতে লাগল। আগামী ১৯৮৪ এবং হুলিয়া ১৯৮৫ সালে মুক্তি পেল। কিন্তু আমার ছবি তাে শেষ হচ্ছিল না। আমার ছবির কাজ শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় আমাকে সবাই ঠাট্টাতামাশা করতে লাগল। তখন আমার খুব খারাপ অবস্থা। রাতে কোথায় ঘুমাব, দিনে কোথায় খাব, তার কোনাে ঠিক নেই। অনেকেই বলাবলি শুরু করে দিল, এ ছবি কোনাে দিন শেষ হবে না । সুলতান ভাই নিজেও মাঝে মধ্যে ঠাট্টা করতেন। আবার অনেকেই ঠাট্টা করে এমন কথাও বলতেন, ‘এসএম সুলতানের মৃত্যুর জন্য পরিচালক অপেক্ষা করছেন।' আরেকটি বিষয়, তখন বহির্বিশ্বে ‘সিনেমা-ভেরিতে’ নামের একটি আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। এর বৈশিষ্ট্য ছিল, দ্রুত শুটিং শেষ করা এবং অনেকটা রাফ অবস্থাতেই ছবিটা দেখানাে । আমিও তখন বন্ধুমহলে তামাশা করে বলতাম, আমি নতুন একটা আন্দোলনের জন্ম দিচ্ছি, সেটা হচ্ছে, ‘সিনেমা - দেরিতে।

তবে ছবিটা বানাতে গিয়ে আমি যতই বাস্তবতাবর্জিত কাজ করি না কেন, সুলতানের মতাে এমন এক আলােকপ্রাপ্ত মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকা ও চলার ফলে আমার যে আত্মােন্নয়ন ঘটেছে, তাতে আমার কোনাে সন্দেহ নেই। শুধু গ্রামবাংলা নয়, শিল্প সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা আমার মধ্যে বিকশিত হয়েছে। নিজের মধ্যে এক ধরনের স্থৈর্য এসেছে, আত্মবিশ্বাস জন্মেছে এবং একটুতেই ভেঙে না পড়ার শক্তি জন্মেছে । তা ছাড়া শিল্পী সুলতানের সংস্পর্শে আসায় আমার মধ্যে খুব দ্রুত চলচ্চিত্রকার হওয়া এবং নাম বা যশের পেছনে দৌড়ানাের যে মানসিকতা, সেটা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি। আমি এখনাে পেশাদার চলচ্চিত্রকার নই। প্রতিবছরই একটার পর একটা ছবি আমি বানাই না, বরং আমার উপলব্ধিতে যে বিষয়টি নাড়া দেয়, সেটির ওপর সময় নিয়ে শুদ্ধভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের চেষ্টা করি। একজন স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে এই যে এক ধরনের মনমানসিকতা তৈরি হয়েছে, সেটাকে আমি তুলনামূলকভাবে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করি।

সবশেষে বলা প্রয়ােজন, সম্ভাব্য সব অঙ্গ- ভঙ্গিমায় মানুষের দেহসৌষ্ঠবের সংবেদনশীল ও শক্তিময় চিত্রায়ণের মধ্যেই সুলতানের নিজস্বতা নিহিত। তাঁর অবয়বগুলাে সুকঠিন কষ্টিপাথরে খােদাই করা । প্রায় উলঙ্গ কৃষকের গ্রন্থিল পেশি তাদের দেহ-মনের দৃঢ়তাকেই বিধৃত করে। এ যেন তাদের আত্মশক্তির বহিঃপ্রকাশ। মায়াবী তুলির স্পর্শে সুলতান তাঁর সমস্যাপ্রবণ ফিগারেটিভ ছবিকে এক অপার্থিব মাত্রায় রূপান্তরিত করেন । তাঁর ছবির এই স্বাপ্নিক মহিমা উপেক্ষা করার উপায় নেই। 

তথ্যসূত্রঃ চলচ্চিত্রযাত্রা

তারেক মাসুদ 

কথাপ্রকাশ

কথাপ্রকাশ সংস্করণ 

আগষ্ট ২০২১

Share

Recent Comments

Recent Articles