আমার দেখা সুলতান

আমার দেখা সুলতান
রফিকুন নবী

১৯৫৯ সালে আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম । বলা চলে নতুন এক জগতে প্রবেশ ঘটলো । ছবি আঁকা এবং আঁকিয়ে দুটোতেই মনযোগ। অর্থাৎ ছবি আঁকার অ আ ক খ শিখছি, সেই সাথে শিল্পীদের বিশেষ করে শিক্ষকদের ভাবভঙ্গি, চালচলন ইত্যাদির দিকেও নজর করছি। কারণ নতুন এই জগতের মানুষগুলির মধ্যে শিল্পী বলে অসাধারণত্বের কি কি গুণাবলী দৃশ্যমান আছে তাও দেখা প্রয়োজন। গল্প উপন্যাস পড়ে বা লোকমুখে শুনে শিল্পীদের সম্বন্ধে যে নানা ধরনের ধারণা পোষণ করতাম তার সাথে মিলিয়ে দেখাই ছিলো এর কারণ। 
শুনতাম শিল্পীরা আত্মভোলা হন, পৃথিবীর কোন জাগতিক দিকে মোহ থাকে না। রং তুলি ক্যানভাস আর প্রেমিক হৃদয় দিয়ে সর্বক্ষণে মগ্ন থাকেন ।
ভুলটা ভাঙ্গতে বিলম্ব হয়নি । দেখলাম অধ্যক্ষ জয়নুল আবেদিন , কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ থেকে শুরু করে প্রায় সবাই-ই সুবেশী, চলাফেরাও সাধারণ মানুষের মতই । তবে শিল্পকলা নিয়ে যখন কথাবার্তা বলেন তাঁরা, বা ছবি আঁকা শেখান অথবা আঁকেন তখন ভিন্নতর।অন্য জগতের মানুষ হয়ে যান। তাঁদের দেখার, গ্রহণ করার এবং বোধের ব্যাপারটি একজন নতুন ছাত্র হিসেবে আমার কাছে অবাক ঠেকতে থাকে । 
এই ভাবেই ধীরে ধীরে সবকিছু ধাতস্থ হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু বছরখানেক পরেই একরকম ভাবে দেখে আসা , সইয়ে ফেলা ধারণায় ব্যাঘাত ঘটলো । এক সকালে ক্লাশ শুরুর সময় এই ঘটনাটি ঘটলো ।
ঘটনাটি এই রকম - আর্ট কলেজের অর্থাৎ চারুকলা ইন্সটিটিউটের চত্বরে অবস্থিত গোলাকার ছোট্ট জলাশয়কে ঘিরে আবেদিন স্যারসহ বেশ কয়েকজন শিল্পী বসে । গল্প করছেন একজন মহিলা অতিথির সাথে । আমরা ক্লাশের বারান্দা থেকে দেখলাম মহিলাটি আমাদের দিকে পেছন ফিরে বসে আছেন। পিঠে ঢেউখেলানো লম্বা কালো চুল। পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ী । দৃশ্যটি নতুন ঠেকলো । ক্লাশ চলাকালীন শিক্ষকরা কেউ ওখানে গল্প করতে বসেন না । মহিলাটিই বা কে যে তাঁকে ঘিরে স্যারদের এই অনিয়মে যাওয়া । ক্লাশে ঢুকে গেলাম । সেটাই স্বাভাবিক । কারণ ওখানে বসে থাকা শিক্ষক মণ্ডলীর দৃষ্টিতে পাড়লে আর রক্ষা থাকবে না ।
এগারোটার দিকে হঠাৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী আনোয়ারুল হক দরজা খুলে ক্লাশে ঢুকলেন । সঙ্গে সেই অতিথি । চমকে উঠলাম । অতিথিটি মহিলা নন, একজন জলজ্যাস্ত পুরুষমানুষ ।এবং হাতে বাঁশের বাশী, কাঁধে ঝোলা । আবেদিন স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সাথে সব ছাত্রছাত্রীর।নাম বললেন, শিল্পী সুলতান।
শিল্পীদের সম্বন্ধে যে ধারণাটি পোষণ করা শুরু করেছিলাম তা গোলমেলে হয়ে গেলো। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না- যে এই শিল্পীর এমন ধারা অবস্থা কেন ? আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে শিল্পীদের সম্বন্ধে যা শুনলাম তার সাথেও যেমন মিল নেই তেমনি ভর্তির পরে যা দেখেছি, জেনেছি তার সাথেও । 
কয়েকদিন পর আবেদিন স্যার ক্লাশে শিল্পী সুলতান সম্পর্কে গল্পচ্ছলে অনেক কথা বললেন। এস.এম. সুলতান যে দারুণ প্রতিভাবান শিল্পী সে কথা প্রথম জানতে পারি তাঁরই মুখে।সেই সাথে এও জানতে পেরেছিলাম যে, শিল্পী সুলতানের জীবনটাও বেশ বৈচিত্রে ভরা। জীবন সম্পর্কে উদাসীন , ভবঘুরে চালচলন , দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান , সন্যাসীদের সাথে হিমালয়ের কোন মন্দিরেও দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন এবং নিজেও প্রায় সেই রকমের নির্লোভ জীবনে বিশ্বাসী , চমৎকার বাঁশী বাজান।
শিল্পাচার্য শিল্পী সুলতানের প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁর জলরঙের কথা উল্লেখ করেছিলেন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে।তখন অবশ্য শিল্পীর কোন জলরঙ ছবি দেখিনি । দেখার সুযোগ হয়েছিলো আরো পরে, লাহোরে প্রকাশিত কোন এক পত্রিকায় ছাপান নিসর্গ ছবি দেখে । মনে আছে , ছাপা তেমন ভাল না হলেও জলরঙের গুণগত মানে টইটম্বুর একটি টলটলে ছবি ছিলো সেটি। এইটুকুই ছিলো তাঁর ছবি সম্বেন্ধে আমার তখনকার জ্ঞান ।
দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় শিল্পীর সাথে প্রথম আমার আলাপ হয় হঠাৎ করেই । বিকেলে ক্লাশ ছুটির পর ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে কলেজের গেট দিয়ে বের হচ্ছি, দেখলাম শাড়ীর মত করে পরা গেরুয়া রং - এর কাপড়ে সুলতান সাহেবও বের হচ্ছেন। আকাশে অন্ধকার মেঘ । আমি দ্বিধান্বিত। মেঘ মাথায় করে রাস্তায় নামবো কি না । কারণ সাথে এক বাণ্ডিল ক্লাশে আঁকা ছবি। ভিজে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
সুলতান সাহেব এগিয়ে এলেন । জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাবো । বললাম , তিনিও আমার পথেই যাবেন উল্লেখ করে সিদ্ধান্ত দিলেন যে , হাঁটা শুরু করাই ভাল । কি মনে করে তাঁর সাথে রওনা দিলাম বাঁয়ে রেসকোর্সের কাঠের সাদা বেড়ার পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে । কিছু দূরে দূরে রেসের ঘোড়া ঘাস খাওয়ায় ব্যস্ত । সহিসরা আবার কিছু ঘোড়াকে দলাই - মলাই করছে । এই দৃশ্য দেখতে শিল্পী সুলতান দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে। গভীর মনোনিবেশে কিছুক্ষণ দেখলেন তারপর আবার হাঁটলেন ।সহিসরা তাঁর বেশ-ভূষা দেখে নিজেরা ফিসফাস করে কিছু বলে হাসলো । কিন্তু শিল্পী নির্বিকার।এইভাবে বর্ধমান হাউসের কাছে ( বাংলা একাডেমী ) আসতেই বাঁয়ে মাঠে অন্ধকার করে বৃষ্টি নামলো । এমন বৃষ্টি যে , মাঠের মাঝে অবস্থিত কালী বাড়ীটিও ঝাপসা হয়ে গেলো।কিন্তু তখনও আমাদের দিকে বৃষ্টি এসে পৌঁছায়নি । আমি আতঙ্কিত । কি করবো ভাবছি । শিল্পী সুলতান বললেন, ' ছবি ভিজে যাবার জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে বুঝি ? ' আমি কোন উত্তর দেবার আগেই তিনি হাত বাড়িয়ে আমার ছবির বান্ডিলটি ধরে বললেন, 'দিন, এটা আমার কাপড়ের ভেতরে ঢেকে রাখি । মোটা কাপড় , ভিজতে সময় লাগবে ।

বলা বাহুল্য , তাঁকে চিরকাল বয়সে ছোট - বড় সবাইকে ' আপনি ' সম্বোধন করতে দেখেছি । যাইহোক , শিল্পী সুলতান আর আমি হাঁটছি । আমি ভাবছিলাম বড় কোন কড়ইবৃক্ষের নীচে গিয়ে দাঁড়াবো । বললামও তাই। তিনি বললেন, 'হ্যা তাই ভাল । তবে এমন ঘনকাল মেঘ অথচ বৃষ্টির যে ধরন তাতে মনে হয় এটা আসল বৃষ্টি নয় । থেমে যাবে । আসলটা আসবে পরে । তার আগে আমরা কার্জন হলে পৌঁছে যেতে পারবো।'

বৃষ্টি থামলো না। কিন্তু বেগ কমে এলো কিছুটা। কার্জন হলের কাছে রিকসা পেয়ে যাওয়ায় দু'জন দু'দিকে চলে গেলাম । তিনি চকবাজারের দিকে আর আমি এলাম গুলিস্তান হয়ে নারিন্দার দিকে । 
সেই সাক্ষাতের পর বহুকাল তাঁর সাথে আর আমার দেখা হয় নি । শুধু আমার সাথেই নয় অনেকের সাথেই । তাঁর সম্বন্ধে কথা উঠলেই শোনা যেতো হয় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে , নয়তো বিদেশে কোথাও গেছেন । এমনও শোনা যেতো যে , হয়তো আবার কোন সাধু - সন্ত বা আখাড়ায় মনোযোগী হয়ে পড়েছেন । 
যতদূর জানি এই সময়টুকু তাঁর জীবনের সব চাইতে অনিশ্চয়তার। নিয়মিত ছবি আঁকতেন কি না তার কোন সঠিক হদিস পাওয়া যায় নি । দেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় সাত বছর পর তাঁকে আবার ঢাকাতে পেলাম । বেশ বয়স বেড়েছে । তখন কালো আলখাল্লা পরেন । শিল্পীদের নানান আসরে আসেন । হাস্যচ্ছল চেহারা । এখানে ওখানে বক্তৃতাও দেন। শারীরিক সুস্থতার এবং মানসিকভাবে অনেক স্থিতি এসেছে।শুনলাম দেশের অনেক শুভানুধ্যায়ী তাঁকে জোর করে ধরে ধরে ছবি আঁকছেন । এবং তিনি এন্তার ছবি আঁকছেন।আশির দশকের প্রথম দিকে তাঁর ছবি প্রায় নিয়মিত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে দেখতে পাবার সৌভাগ্য হলো । লক্ষ্য করলাম একটা নির্দ্দিষ্ট ধরনে তিনি ছবি আঁকছেন । যার বিষয় মূলতঃ গ্রাম - বাংলা । সব ছবিতে সহজিয়া একটা ভাব । ' ফ্রি - হ্যান্ড' মতন ।তাঁর বসবাস অবশ্য তখন নড়াইলে। কেউ ডাকলে বা নিয়ে এলে অথবা প্রয়োজনে ঢাকা আসেন। 
আরো কিছুদিন পর, চারুশিল্পী সংসদের সম্মাননা গ্রহণ করতে তিনি ঢাকা এলেন । উঠলেন আমার বাসায় । অতএব জীবনে ওই প্রথম তাঁকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখার সুযোগ হলো । গভীরভাবে জানতে পারলাম । প্রতিদিন গল্প হতো ঘন্টার পর ঘন্টা । তা থেকে আবিষ্কার করলাম এক ভিন্নতর সুলতানকে । সেই গল্পে গল্পে তাঁর বৈচিত্র্যে ভরা জীবনের পুরোটাই প্রায় তিনি বলে ফেলেছিলেন । কিছু কিছু পর্যায়ে অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন । বিশেষ করে ছবি আঁকার জগত থেকে প্রায় নির্বাসিত সময়কে স্মরণ করে এবং কিছু সাধারণ অথচ অসাধারণত্বের অধিকারী মানুষ, যাঁদের সাথে তিনি মিশেছেন, ভালবাসা পেয়েছেন , অনেক ক্ষেত্রে দীক্ষা অথবা পরামর্শ পেয়েছেন তাঁদের কথা স্মরণ করে।এই মানুষগুলির মধ্যে তাঁর গাঁয়ের কাছের কেউ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিদেশে মেশা কোন অত্যন্ত সাধারণ কেউ । তিনি সবটাই বলেছিলেন প্রায় রূপকথার ঢঙ্গে ।

শিল্পী সুলতানকে কাছে পাওয়ার এইখানেই সমাপ্তি ।কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি কিংবদন্তীর নায়কে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন । এস. এম. সুলতান তখন এক অসাধারণ শিল্পী ব্যক্তিত্ব ।এর পরে মাঝে মধ্যেই দেখা হয়েছে, আলাপও হয়েছে । ক্রমশঃ অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেছি ।কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে নৈরাশ্যে ভুগতে দেখিনি।প্রবল আত্মবিশ্বাসী এক শিল্পীকে আবিষ্কার করেছি তখন ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles