অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা


প্রিয় অনুসূর্য, 

এই ঘটনার কথা আমি যার কাছে শুনেছি, আর তিনি যার কাছে শুনেছেন তিনিও এমন একজনের কাছে শুনেছেন যিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তবু এই ঘটনা সত্য কি না তা আমি নিশ্চিত নই। যদি সত্য না-ও হয় তবু সত্য ভেবে সেই ঘটনার রূপকথা আমি আজ তোমাকে বলতে যাচ্ছি যেন তুমিও এই রূপকথা আরো আরো অনুসূর্যের কাছে বলতে পারো।

লেফটেনেন্ট জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে তখন দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সেইসময় এক বছর কমনওয়েলথ সম্মিলনে যোগ দিতে এসে ইন্ডিয়া যাওয়ার পথে কুইন এলিজাবেথ ঢাকা ঘুরে গিয়েছিলেন। আর সেই উপলক্ষে তখনকার কুড়ি কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা শহরকে সাজিয়ে বানানো হয়েছিল তিলোত্তমা-টাইপ কিছু।

এলিজাবেথ চার দিন ছিলেন। এ সময় তিনি ঢাকার  আশপাশের গ্রাম ঘুরে দেখেন। এই চারদিনের খুব সম্ভবত দ্বিতীয় দিন তিনি নিজে থেকেই একজন বাঙলাদেশির সঙ্গে দেখা করতে চান খুব আগ্রহ নিয়ে, তার সঙ্গে বসে দুপুরে একবেলা খাবার খেতে চান। তিনি ছাড়া আর কোনো বাঙলাদেশির সঙ্গেই তার আলাপ-পরিচয় ছিল না। তিনি হলেন সুলতান। তখন সুলতানের বয়স ষাট আর এলিজাবেথের বয়স সাতান্ন।

এলিজাবেথের এই ইচ্ছার একতিরিশ বছর আগে লন্ডনে আর্ট এক্সিবিশন হচ্ছিল একটা। সেইখানে সুলতানের আঁকা একটি ছবি ছিল। কোনো এক সন্ধ্যায় এলিজাবেথ সেই প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলেন হবে হয়তো। এমন হতে পারে দেখতে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সুলতানের আঁকা ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে ডুবে গিয়েছিলেন। আর পেইন্টারকে খুঁজে তার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। আর সেই আলাপের স্মৃতি অবিস্মরণীয় হয়ে গিয়েছিল। তখন সুলতানের বয়স উনতিরিশ আর এলিজাবেথের বয়স ছাব্বিশ।

অনুসূর্য, তুমি নিশ্চয়ই সুলতানের নাম শুনেছ? নাম তো শুনবেই। তুমি নিশ্চয়ই তার আঁকা ছবিও দেখেছ! আর তারেক মাসুদের ‘আদম সুরত’-এ তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ তিনি কেমন করে বিশাল বিশাল ক্যানভাসে লাফিয়ে লাফিয়ে রং লাগিয়ে ছবি আঁকেন। হ্যাঁ, সেই সুলতান। আমাদের দেশে একজনই সুলতান ছিলেন।

জীবনযন্ত্রণা ছাড়া আর্ট হয় না, বড়োজোর ক্রাফট হতে পারে। জীবনযন্ত্রণা সকলেরই আছে। তবে সকল মানুষ তা যথার্থ টের পায় না, কেউ কেউ পায়। সুলতান জীবনযন্ত্রণা টের পেয়েছিলেন। আর তিনি প্রকৃত অর্থেই একই সঙ্গে একজন শিল্পী ও সন্তের জীবনকে যাপন করে গেছেন। 

এইবার মূল গল্পে যাই। এলিজাবেথ সুলতানের সঙ্গেই দেখা করতে চান শুনে সংশ্লিষ্ট মহল বিস্ময়ে থ, কিন্তু তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল, তার খোঁজে।

সুলতান তখন নড়াইলে থাকেন। ছিন্নমূল মানুষ আর অনাথ শিশুদের নিজের জীর্ণ ঘরে এনে ভর্তি করে করে ফেলেছেন। তাদের লালনপালন করছেন, খাওয়াচ্ছেন, দাওয়াচ্ছেন। এর মধ্যেই ছবি আঁকছেন। নানা জাতের পশুপাখি এনে ঘরের মধ্যে ছোটোখাটো একটা চিড়িয়াখানাও বানিয়ে ফেলেছেন। আর নিজের ছবি বিক্রির টাকায় শিশুদের জন্য সুন্দরী কাঠ দিয়ে নিজের ডিজাইনে একটি বড়ো নৌকাও তৈরি করে ফেলেছেন। তার ইচ্ছা শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে সমুদ্রযাত্রা করবে। আর আকাশের নিচে আরেক মহাশূন্যতার সুন্দরকে চর্মচক্ষে দেখবে। সেই নৌকার নাম হল শিশুস্বর্গ। সেই শিশুস্বর্গের শিশুরা সুলতানের কাছে ছবি আঁকা শেখে। আর আকাশের দিকে তাকিয়ে সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে। কখনো জলরঙে এঁকে ফেলে সমুদ্রের স্বাদ ও গন্ধ।

সেই সময় একদিন সকালবেলা সুলতান উঠানে ছবি আঁকতে আঁকতে দেখলেন একটা পুলিশের জিপ এসে থেমেছে তার বাড়ির গেইটে। দেখলেন জিপ থেকে নেমে থানার ওসি এসে তার পাশে দাঁড়ালেন। ওসির সঙ্গে সুলতানের নিচের কথাগুলি হল:

ওসি: ডিসি স্যার পাঠিয়েছেন আমাকে। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে এখনই।

সুলতান: আমার অপরাধ? 

ওসি: আপনার কোনো অপরাধ নাই। তিনি আপনার সঙ্গে একটা বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলতে চান। 

সুলতান: প্রয়োজন যেহেতু তার, তাকেই আসতে বলেন। আমি যাব না। আমি ছবি শেষ না করে কোথাও যেতে পারব না। 

ওসির অনুনয়-বিনয়ে কাজ হল না। তিনি ফিরে গেলেন বিফল মনোরথে। ডিসিকে বললেন ঘটনা। ডিসি পড়ে গেলেন মহা বিপাকে। উপরের নির্দেশ আছে সুলতানকে কালকে সকালের মধ্যেই ঢাকা পাঠাতে হবে। অগত্যা তিনি সুলতানের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন তখনই। গিয়ে দেখেন সুলতান তখনো ছবিই আঁকছেন। ডিসির সঙ্গে সুলতানের নিচের কথাগুলি হল:

ডিসি: আপনাকে ঢাকায় যেতে হবে। 

সুলতান: কেন যেতে হবে?

ডিসি: উপরের নির্দেশ। কুইন এলিজাবেথ ঢাকায়। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। 

সুলতান: দেখা যেহেতু তিনি করতে চান, তাকে এইখানে আসতে বলেন। 

ডিসি: (খুবই অবাক হয়ে) কী বলছেন! তিনি ইংল্যান্ডের রানি। তিনি আপনাকে দাওয়াত দিয়েছেন। তার দাওয়াত মানে হুকুমের মতো। আপনি কি বুঝতে পারছেন?

সুলতান: সেইটা আমার কাছে বিষয় না। আমি স্বাধীন মানুষ। আপনি চাইলে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারেন। তার জন্যে ওয়ারেন্ট নিয়ে আসেন আগে।

ডিসি: ভাই, বোঝার চেষ্টা করেন। আমরা বিশাল চাপে আছি... একটু বোঝার চেষ্টা করেন, একটু কোঅপারেট করেন...

সুলতান: আমি আমার বাচ্চাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। পশু-পাখি আছে কিছু, তারা আমার দেওয়া দানা ছাড়া খায় না... আপনি এখন যেতে পারেন। 

ডিসি তার অফিসে ফিরে এলেন। ঢাকায় ফোনে যোগাযোগ করে জানালেন অবস্থা। কিন্তু ঢাকা ডিসির কথা শুনবে কেন? তাকে বলা হল যেকোনো উপায়ে সুলতানকে কালকে সকালে বঙ্গভবনে হাজির করতে হবে, নাহলে কারো চাকরি থাকবে না। ডিসির অবস্থা খারাপ। তিনি আবার তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে বের হলেন। 

ডিসি এক প্রকার হাতে পায়ে ধরে রাজি করালেন সুলতানকে, তিনি ঢাকায় না গেলে তাদের যে চাকরিবাকরি থাকবে না ইত্যাদি বললেন। এইসব কথায় গলে কোমলপ্রাণ সুলতান রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু শর্ত দিলেন যে তিনি নিজের মতো করে যাবেন, বাসে। সরকারি কোনো গাড়িতে যাবেন না। ডিসি শর্ত মেনে নিলেন, কিন্তু সঙ্গে একজন লোক দিয়ে দিলেন যেন সুলতানের এন্ট্রিপাসের ব্যবস্থা করে বঙ্গভবনের ভিতরে নিয়ে যেতে পারে। 

সুলতান নড়াইল থেকে রাতের বাসে রওয়ানা দিয়ে সকালে গাবতলি এসে নামলেন। আর একটা বেবিট্যাক্সি নিলেন। সুলতান মিশুক মানুষ, বেবিট্যাক্সিতে বসতে বসতেই ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললেন। ড্রাইভার যখন জানতে পারল যে সুলতান ঢুকবেন বঙ্গভবনে তখন সুলতানের সঙ্গে তার কী হল তা একটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। সুলতানের সঙ্গে বেবিড্রাইভারের নিচের কথাগুলি হল:

ড্রাইভার: বড়োভাই, আমারও ইচ্ছা হয়, ওই বিল্ডিং-এর সামনে নিয়ে যখন যাই, ওইখানে একবার ঢুইকা দেখি। কিন্তু কখনোই ঢুকতে পারি নাই। কত প্যাসে›জার তুলছি আর নামাইছি! অথচ আমাগো ট্যাক্সের টেকা দিয়া হালার পুতেরা ওইসব বানাইয়া রাখছে।

সুলতান: দাঁড়াও। ব্যবস্থা করছি। আজকে তোমাকে নিয়েই ঢুকব। 

পাশে বসা ডিসির লোকটা শুনে অবাক হল। বঙ্গভবনের সামনে বেবিট্যাক্সি থামল। ডিসির লোকটা নামল। কিন্তু সুলতান নামল না। লোকটা গিয়ে সুলতানের জন্যে রাখা এন্ট্রিপাস নিয়ে এল। সুলতানের সঙ্গে ডিসির লোকটার নিচের কথাগুলি হল:

ডিসির লোক: (সুলতানের হাতে দিয়ে) স্যার, চলেন যাই ভিতরে ঢুকি। 

সুলতান: আমি বেবিট্যাক্সি নিয়েই ঢুকব। না হয় ঢুকব না। 

ডিসির লোক: সেটা তো সম্ভব নয়, বেবিট্যাক্সি ভিতরে নেওয়ার পারমিট নাই। কার হলে ঢোকানো যেত।

সুলতান: ঢুকলে বেবি নিয়েই ঢুকব নাহয়, নড়াইল ফিরে যাব। এই বেবি নিয়েই গাবতলি যাব। আপনি যান ড্রাইভার আর ট্যাক্সির পাস নিয়ে আসেন। 

সুলতানের অবস্থা দেখে লোকটা ভড়কে গেল। ভিতর থেকে আরো লোকজন এল, সিকিউরিটি চিফ এলেন সুলতানকে মানাতে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। অবশেষে সুলতান বেবিট্যাক্সিসহই বঙ্গভবনের গেইট দিয়ে ঢুকলেন। এবং ড্রাইভারসহই বঙ্গভবনের ভিতরে ঢুকলেন। স্নান করে ফ্রেশ হলেন। 

দুপুরে খাবার টেবিলে কুইন এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা হল সুলতানের। সুলতানের পরনে একটা গেরুয়াপাড় শাদা শাড়ি, আর বেণি করা দীর্ঘ চুল, বাম হাতের কবজিতে বাঁধা একটা গেরুয়া রং রাখী। 

টেবিলে মাত্র তারা তিনজন। সুলতান, এলিজাবেথ আর সুলতানের পাশে বসা বেবিড্রাইভার। সে খুব আয়েস করে খাচ্ছে রাজকীয় খাবার। তার চোখে কোনো বিস্ময় নেই, যেন এই টেবিলেই প্রতিদিন খায়, যেন এটাই তার অধিকার। খেতে খেতে সুলতানের সঙ্গে কুইন এলিজাবেথের নিচের কয়েকটি কথা হল:

কুইন এলিজাবেথ: আমার কথা তোমার মনে আছে? 

সুলতান: ঝাপসা মনে আছে? 

কুইন এলিজাবেথ: তোমার সেই শীতের ছবি... 

সুলতান: একতিরিশ বছর। কম সময়ও তো নয়। 

কুইন এলিজাবেথ: তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সেই সন্ধ্যায় ফিরে গেছি। 

কথার এক পর্যায়ে সুলতান আনমনা হয়ে গেলেন। আর হঠাৎ করে একটা বাটি থেকে কী একটা বড়ো মাছের মাথা হাতে নিয়ে এলিজাবেথকে বললেন, ‘এইটা কি সঙ্গে করে আমি আমার বিড়ালগুলির জন্যে নিয়ে যেতে পারি?’

সুলতানের কথা শুনে এলিজাবেথ প্রথমে অবাক হলেও মুহূর্তেই হো হো হো করে হেসে উঠলেন। তার হাসিতে সেই মুহূর্তটি যেন একটা আঁকা ছবি হয়ে গেল।

ইতি

একজন নৈঃশব্দ্য

১০ আগস্ট ২০২১


পুনশ্চ: 

অনুসূর্য, তোমার জন্যে বলা একটা রূপকথা মাত্র শেষ হল। আরো একহাজার একটা রূপকথা তোমাকে বলার আছে, জানো তো! 


আজ সুলতানের জন্মদিন। আসো, আমরা মনে মনে তার আঁকা ছবির ভিতর ঢুকে পড়ি, যুদ্ধ দেখি, গ্রাম দেখি, বৃক্ষ দেখি, গোরু দেখি, মানুষ দেখি, নারী আর নারীশক্তি দেখি, তোমার ভিতর যেমন দেখি, জীবনদাশের কবিতার সেই আদিম শকতির মতো নারীরা সব সুলতানের ক্যানভাসে খেলছে জীবন...

Share

Recent Comments

Recent Articles