শিল্পী এস এম সুলতান

আহমদ ছফা। যাকে আমরা ছফা ভাই বলে ডাকতাম। তিনি পারিবারিকভাবে আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন । তিনি ছিলেন শিল্পী এস এম সুলতানের খুব প্রিয়ভাজন। প্রায়ই ছফা ভাই এস এম সুলতানের নানান সব মজার গল্প বলতেন। হয়তো কিছু গল্প তিনি বানিয়েও বলতেন। যেমন—একটি গল্প আমার এখনো মনে আছে। শিল্পী সুলতান বিশাল জোব্বা টাইপ একটা কালো আসকানের মতো একটা পোশাক পরতেন। সেই আসকানের পকেটে প্রায়ই নাকি একটা দুটো বিড়ালের বাচ্চা থাকত; বিড়াল তিনি খুব পছন্দ করতেন। একদিন তিনি টিএসসি এলাকা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, পকেটে যথারীতি গোটা কয়েক বিড়ালছানা।হঠাৎ এক পকেটমার তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। টাকা-পয়সা মেরে দেওয়ার তালে ছিল হয়তো... তারপর আর কি বিড়ালের কামড় আর পকেটমারের আর্তচিৎকার!!পরে বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একবার আম-কাঁঠালের ছুটিতে আমরা সব ভাইবোন বাচ্চাকাচ্চা গেলাম যশোর শহরে বেড়াতে। যশোরের অনেক কিছু দেখলাম।সার্কিট হাউসে থাকলাম একদিন। শেষ আকর্ষণ হিসেবে গেলাম আমাদের দেশের বিখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের বাসায়। গিয়ে দেখি তার বাসা ভর্তি বিড়াল বিড়াল আর বিড়াল (বিড়াল অবশ্য আমাদেরও খুব পছন্দের প্রাণী)। বুঝলাম ছফা ভাই সত্যিই বলেছিলেন বিড়াল তার প্রিয়। পরে দেখলাম শুধু বিড়াল না তার বাসা মোটামুটি একটা মিনি চিড়িয়াখানা। অনেক ধরনের প্রাণী আছে। বেশির ভাগই অবশ্য খাঁচার ভিতর।হঠাৎ করে দলে-বলে আমাদের দেখে তিনি মনে হলো বিরক্ত না হয়ে খুশিই হলেন।বিশেষ করে বাচ্চাদের দেখে। আমার মেয়ে এষা তখন একবারে ছোট, কোলে থাকে;বড় ভাইয়ের ছেলে নুহাশও ছোট, কোলে থাকে। অন্য বাচ্চারা একটু বড়। তবে তারা কেউই বুঝতে পারছিল না যে আমরা খুব বড় একজন শিল্পীর বাসায় এসে হাজির হয়েছি।যদিও বড় ভাই বারবার বলছিল বাচ্চারা, উনি কিন্তু পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী...!' শিল্পী সুলতান নিঃশব্দে হাসছিলেন শুধু। বড় ভাই তার লেখা দুটো মোটা মোটা বই তাকে শিল্পী সুলতান উপহার দিল । তিনি আগ্রহভরে গ্রহণ করে বই দুটো হাতে নিয়ে চললেন তার স্টুডিওতে আমাদের নিয়ে। স্টুডিও মানে বারান্দার মতো একটা বড় লম্বা জায়গা। সেখানে সারি সারিভাবে সাজানো বিশাল বিশাল সব ক্যানভাস। কোনোটা পুরোটা আঁকা হয়েছে,কোনোটা অর্ধ সমাপ্ত। কোনোটা বা সিকি ভাগ আঁকা হয়েছে। বড় বড় তুলি মাটিতে পড়ে আছে, তার পাশে নানান সাইজের রঙের বাটি। তিনি নাকি বাজার থেকে রং কিনে ছবি আঁকতেন না। প্রকৃতির গাছপালা থেকে নিজেই রং তৈরি করতেন। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখলাম তার বিখ্যাত সব শিল্পকর্ম।এবার ছবি তোলার পালা। এই পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে একটা ছবি না তুললে হয় নাকি। গ্রুপ ছবিতে আমি পড়ে গেছি সবার পিছনে। আমি ভাবলাম আমাকে তো বোধহয় দেখাই যাবে না শিল্পীর পাশে, বরং আমার মেয়েটা থাকুক তাই তাকে উঁচু করে ধরে শিল্পীর কাছাকাছি নিয়ে গেলাম। আর সে তখন তারস্বরে কাঁদতে শুরু করেছে।শিল্পীর বাঁ হাতে তখন বড় ভাইয়ের দুটো বই আর ডান হাত মুক্ত। তিনি পিছন ফিরে হাসি মুখে সেই ডান হাতে তার গাল ছুঁয়ে দিলেন।আমার মেয়ে এখন একজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট। ওকলাহামা থাকে। কিন্তু সে হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে ছবি আঁকা শুরু করেছে। তার নাকি ছবি আঁকতেই ভালো লাগে বেশি, আঁকেও সে চমৎকার। আমার মনে হয় কে জানে পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের সেই ছোট্ট একটু ছোঁয়ায় হয়তো এখন সে শিল্পী হয়ে উঠেছে।ওদিকে সাদা শাড়ি পরা যে বয়স্ক মহিলাটি শিল্পীকে দেখভাল করতেন। তিনি মনেহয় খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন, শুরু থেকেই। এতগুলো মানুষ বলা নেই কওয়া নেই দুপুর টাইমে এসে হাজির, নিশ্চয়ই শিল্পীর খাওয়ার সময় হয়েছে বলেই তিনি বিরক্ত। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে, কথাবার্তায় সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। শিল্পী অবশ্য গুরুত্ব দিলেন না। আমাদের নিয়ে বেরোলেন বাইরে তার বাসার সামনের ছোট্ট খালের ওপর বাঁধা একটা রঙিন নৌকা দেখালেন, নূহ নবীর নৌকার মতো বিশাল এক নৌকা। বললেন এই নৌকায় করে তিনি বাচ্চাদের নিয়ে মাঝে মাঝে মাঝনদীতে গিয়ে ছবি আঁকেন।বাচ্চারাও আঁকে। অনেকটা ছবি আঁকার স্কুলের মতো।এবার বিদায়ের পালা। আমরা বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব। তখন দেখি সেই সাদা শাড়ির বয়স্ক মহিলা যিনি আমাদের ওপর রীতিমতো ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি হঠাৎ আমাদের চা খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ব্যাপার কী! তিনি আসলে তখন বুঝতে পেরেছেন শিল্পীর কাছে আসা এই লোকটা হুমায়ূন আহমেদ, এই সব দিনরাত্রী নাটকের লেখক। তখন এই নাটক খুব জনপ্রিয়। আমরা অবশ্য ততক্ষণে বিদায় নিয়ে মাইক্রোবাসে উঠে পড়েছি। বিদায়ী হাত নাড়ছি মহান শিল্পীর উদ্দেশে, কী আশ্চর্য তিনিও হাত নাড়ছেন আমাদের দিকে। যেই হাত সৃষ্টি করেছে মহান সব শিল্পকর্ম।

লেখক : কার্টুনিস্ট, 'উন্মাদ'-এর সম্পাদক

Share

Recent Comments

Recent Articles