আমার কাছে ‘সুলতান’ আছে

১৯৭৬-এর সেপ্টেম্বরে আমি কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় আসি। প্যারিসে থাকতে খবর পেয়েছিলাম শিল্পী এস এম সুলতানের প্রদর্শনী হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারিতে। তাঁর অনেক গল্প শুনতাম আমার শিক্ষকের কাছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলতেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এই মানুষটি কীভাবে ছবি আঁকতেন, আবার কাউকে কিছু না বলে কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন।বোহেমিয়ান। বন্য পশু ও বিরল প্রজাতির বিষধর সাপদের সঙ্গে বসবাস করতেন নড়াইলে তাঁর বাড়িতে। সেটি ছিল নড়াইল জমিদারদের ফেলে যাওয়া এক অন্ধকার পোড়াবাড়িতে। চিত্রা নদীর পাড়ে ঝোপজঙ্গল আর সবুজ শ্যাওলা বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে। আগে থেকেই সেখানে বিষধর সাপ বসবাস করত।তিনি নাকি জঙ্গল পরিষ্কার করে একসময় বসবাস আরম্ভ করেন। কিন্তু সাপসহ কোনো জীবজন্তুদের মারেননি। তারা ছিল তাঁর পরিবারের সদস্য। সাপ গলায় পেঁচিয়ে চুমু খেতেন। দাঁড়কাক এসে তাঁর হাতে বসে খাবার খেয়ে উড়ে চলে যেত গাছের ডালে, আবার ফিরে আসত। আশ্চর্য হওয়ার মতো সত্যিকারের সব ঘটনা আমাকে আলোড়িত করত । এ রকম ব্যতিক্রমী জীবন যাপনকারী শিল্পী আমাদের দেশে দেখি না। তাঁর শিল্পকর্ম কেমন দেখার আগ্রহ আমাকে তাড়া করল। সে সময় নাসির আলী মামুন এসে আমাকে শিল্পকলায় তাঁর প্রদর্শনীতে নিয়ে গেল । নাসিম আহমেদ নাদভী এবং সুবীর চৌধুরীর সাথে দেখা হলো।প্রদর্শনীটি শেষ হয়ে গেছে, গ্যালারি বন্ধ! বাংলাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল সুলতানের একক প্রদর্শনীটি। শিল্পকলার বাইরে ব্যানার দেখলাম। আমি ভাবছি বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রদর্শনী, ভেতরে সবগুলো ছবি আছে–তো। সুবীর ক্রমে দরজা খুলে দিয়ে তার রুমে চলে যায়। ভেতরে ঢুকে আমি হতবাক ও বিস্মিত,মাই গড মাই গড, একি অবস্থা! বিশাল সাইজের সম্ভবত ৪×৮ কয়েকটি পেইন্টিং আমার চোখের সামনে। কয়েকটা ছবি গ্যালারির দেয়াল থেকে নামানো। কোনো কোনো ছবি থেকে রঙের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে, সাথে বিশেষ ধোঁয়ার গন্ধও নাকেবএল! মনে হলো শিল্পী গ্যালারির ভেতর কোথাও অবস্থান করছেন। কিন্তু সব সুনসান। বিরাট বিরাট কাজ রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো আঁকা। কিন্তু না, সব বাংলার গ্রামের মাটির কাছাকাছি মানুষদের ছবি। তিনি এঁকেছেন কৃষকদের,কোনো কোনো ছবি বার্ডস আই ভিউ, কম্পোজিশন ও অঙ্কনশৈলী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।এমন চিত্রকলা অন্য কোনো শিল্পীর কাজের সঙ্গে মেলানো গেল না। পেশিবহুল সব কিষান-কিষানী তাদের ঘরবাড়ি পুকুর ফসলের ক্ষেত গাছ দিগন্তে আকাশে গিয়ে মিলেছে। ছবিতে আছে নারী ও পুরুষেরা দল বেঁধে কৃষিকাজ করছে।অদ্ভুত মানুষগুলোর আকার। আসলে আমাদের কৃষকরা কৃষকায় ও দুর্বল।এমন বলশালী মানুষ তিনি আঁকতে গেলেন কেন। কাগজে পড়েছিলাম বাংলার কৃষকসমাজকে শিল্পী সবচাইতে শক্তিশালী বলে মনে করেন। তাঁর কল্পনার কৃষক বলিষ্ঠ এবং দীর্ঘাকার । নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূলতার মধ্যে সোনার ফসল ফলিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন তারা। ছবির ভেতরকার ছোট-বড় চরিত্রগুলো তিনি এমনভাবে এঁকেছেন, যা তাঁর শিল্পকর্মকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।তাঁর মোটা ব্রাশের ও তুলির টানগুলো হৃদয়ে নাড়া দেয়। একজন দর্শক হয়ে যখন তাঁর প্রদর্শনীর ছবিগুলো দেখছিলাম মনে হচ্ছিল দীর্ঘদেহী কোনো শিল্পীর আঁকা এই সকল চিত্রকর্ম । প্রবল কল্পনাশক্তি অন্তরে না থাকলে এমন ছবি কারো পক্ষে আঁকা সম্ভব নয়। ছবির বিষয়বস্তু আঁকার ফর্ম ও কম্পোজিশন অন্য এক জগতে নিয়ে যায় দর্শকদের। আমি একজন শিল্পী, তাই বুঝতে পারছিলাম অন্য আরেক শিল্পী কতটুকু দরদ ও শক্তি দিয়ে ছবিগুলো সৃষ্টি করেছেন। মেঝেতে রাখা আরেকটি পেইন্টিংয়ের খুব কাছে গিয়ে দেখলাম ছবির চরিত্রগুলো কত অস্থির ক্লান্ত এবং ধাবমান । আবার কোনো ছবিতে সবাই কর্মরত। মায়ের কোলে শিশু যেন অজানা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পরিবারের সঙ্গে। মায়ের ডাগর চোখে বিষণ্নতা আর অনিশ্চয়তা, সবকিছু মিলেমিশে এমন একটি আবহ তৈরি হয়েছে যে অনেকক্ষণ ছবিকে পর্যবেক্ষণ না করে উপায় থাকে না। নাকে কাঁচা অয়েল কালারের ঘ্রাণ পাচ্ছি। আবার আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে গ্রামের কৃষকেরা তির-ধনুক নিয়ে চর দখল ব্যস্ত, মনে হতে পারে যুদ্ধ হচ্ছে। ছবিটির শিরোনাম 'চর দখল'। এমন ছবি আমি আগে কখনো দেখিনি।আমি ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম । যুদ্ধ করেছি। তখন দেখেছি, গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশু ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। তাদের চোখে-মুখে ভয় ও জন্মভূমি ফেলে যাওয়ার বেদনা তীব্র । অভাবনীয় চোখ ও মুখ যেন জড়ো হয়েছে সুলতানের চিত্রকর্মে। এমন বিশ্বমানের চিত্রকর্ম, যিনি সৃষ্টি করতে পারেন তাঁর অবস্থান কোথায় হতে পারে, সেটি বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার । অতুলনীয় এবং মহামূল্যবান এসব চিত্রকর্ম গ্যালারিতে ফেলে প্রদর্শনী শেষে কাউকে না বলে নড়াইল চলে গেছেন সম্প্রতি। ছবিগুলো ফেরত নেওয়ার জন্য তাঁকে কয়েকবার খবর দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছিল না। শুনেছি, অতীতে তাঁর প্রদর্শনী শেষে এভাবে ছবি রেখে তিনি কোথাও না বলে হারিয়ে যেতেন। ধরাবাঁধা জীবন তাঁর চরিত্রে নেই। তাই বলে মূল্যবান সম্পদ রেখে চলে যাবেন! এমন চরিত্রের মানুষ যার কোনো পিছুটান নেই তাঁর তীব্র কল্পনাশক্তি শ্রদ্ধা জানায়। সেদিন অনেকক্ষণ শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারিতে ছিলাম। ফিরে আসার সময় জানতে পারলাম, নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এস এম সুলতানকে দিয়ে এমন সব ব্যতিক্রমী ও বিশ্বমানের ছবি আঁকানো সম্ভব হয়েছে, এটি আরেক কাহিনি।তাঁকে বেশি দিন কোনো কাজে বা কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখা যায় না।তিনি কখন যে কী করবেন, কেউ জানে না। এমন বিচিত্র মেজাজের শিল্পী ভারত উপমহাদেশে একজনই । আমাদের আবেদিন স্যার কলকাতায় সুলতানের শিক্ষক ছিলেন। তিনিও তাঁকে ছবি আঁকার জন্য ঢাকায় রাখতে পারেননি। না বলে পালিয়ে গেছেন।১৯৮৬-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বইমেলা চলছে। সেখানে বর্ধমান হাউসের নিচতলায় আমার একক প্রদর্শনী চলাকালে হঠাৎ একদিন সকালে সুলতান ভাই কালো পোশাক পরে হাজির, হাতে দুইটা বাঁশের বাঁশি।এতদিনে তাঁর বিচিত্র স্বাধীন জীবন এবং চিত্রকর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছি। আমরা অনেক কথা বললাম। আপনার প্রিয় শিল্পী কে জিজ্ঞেস করি।জানালেন অনেকেই, তবে ভ্যান গঘের জীবন ও শিল্প তিনি নিবিড়ভাবে জানার চেষ্টা করেছেন। কাজের স্টাইল ও দর্শন তিনি এমনভাবে আলোচনা করলেন যে আমার মনে হলো শিল্পী ভ্যান গঘ তাঁর পরমাত্মীয়। সুলতান ভাই শিশুদেরকে চিত্রকলায় আগ্রহী করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। ওদের যদি পরম যত্নে শৈশব ও কৈশোর সময়টায় আর্টের দিকে উৎসাহী করতে পারা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে, এই শিশুরা ভবিষ্যতে বিপথগামী হবে । সিনিয়র শিল্পীর ওদের দিকে দৃষ্টি দেওয়া এবং ছবি আঁকায় উদ্বুদ্ধ করা। যে ছবি আঁকবে, সে ক্রাইম করবে না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা একসাথে অবসর সময়ে যদি ছবি আঁকায় মনোযোগ দিতে পারে, তাহলে আমরা ভবিষ্যতে ওদের মধ্য থেকে বড় বড় শিল্পী পাব। তাদের পেটে ক্ষুধা, পর্যাপ্ত খাবার নেই।ওদের জন্য আমাদের খাবারের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। কৃষকের সন্তান যদি ছবি আঁকে তার ছবি হবে মাটি ও প্রকৃতির কাছাকাছি। আমাদের মাটির কাছে ফিরে যেতে হবে । বাঙালির সংস্কৃতি নিজস্ব জল, হাওয়া, মাটি ও লোকসংস্কৃতি থেকে উদ্ভব হয়েছে। আমাদের শিকড়ের সন্ধান জরুরি। এবার নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সুলতান যেন ফিরে গেলেন তাঁর জন্মস্থান চিত্রা নদীর পাড়ে নিসর্গ বাড়িতে। চোখেমুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির একমুহূর্ত। আমি মন দিয়ে শুনছিলাম শিল্পীর কথা। মুখের মধ্যে তাকাই, তিনি আবার অতীতে ফিরে যাচ্ছিলেন, কলকাতা আর্ট স্কুলের স্মৃতি হাতড়ে বললেন অনেক ঘটনা। সবকিছু আজ আমার মনে পড়ছে না। প্রদর্শনীতে দর্শকেরা ঘুরে ছবি দেখছে, কেউ আমার সাথে কথা বলার জন্য ঘুরঘুর করছে মনে হলো, কিন্তু আমার অনুমান ঠিক ছিলনা। আসলে সবাই কাছ থেকে ও দূর থেকে লম্বা চুলওয়ালা বাঁশি হাতে এস এম সুলতানকে দেখছিলেন বেশ কৌতূহল নিয়ে। কীভাবে ঘণ্টা পার হয়ে গেল,বুঝতে পারিনি। বিদায়ের সময় আমাকে নড়াইল যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমি সম্মতি দিই । লম্বা পা ফেলে তিনি মামুনের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে আমার ছবির প্রশংসা করে বললেন, আপনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে ক্যানভাসে এঁকেছেন আর কোনো শিল্পী এমন বলিষ্ঠভাবে আঁকতে পারেনি।মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলে আপনি হয়তো এমন ফিগারেটিভ কাজ করতে পারতেন না।সুলতান চলে গেলেন। আমার কাছে রেখে গেলেন উদারতা ও সম্মান। বড় শিল্পী না হলে এমন উচ্চতায় কেউ যেতে পারে না। তাঁর পেইন্টিং এখন আর কিনতে পাওয়া যায় না। যা তিনি এঁকেছেন, সেগুলো তাঁর সংগ্রাহকদের কাছে থাকলে গর্ব করে বলতে পারেন আমার কাছে ‘সুলতান’ আছে।

তথ্যসূত্রঃ

এস.এম.সুলতান 

স্বদেশ প্রকৃতি মানুষ

সম্পাদক- নাসির আলী মামুন

প্রকাশকঃবাতিঘর

প্রথম প্রকাশ:ফাল্গুন ১৪২৯, ফেব্রুয়ারী ২০২৩

Share

Recent Comments

Recent Articles