চারুশিল্পের সোনালী পুরুষ এস . এম . সুলতানের কথা

একজন বিরহী বাউলের মতো অন্তরমুখী অথচ মানবকল্যাণব্রতী মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল গতকাল । লম তাঁর এস.এম. সুলতান । একজন মানবদরদী প্রতিবাদী বাউলের নাম । চারুশিল্পের একজন সোনালী পুরুষের নাম। এর আগেও দেখা হয়েছে অনেকবার । কখনো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে, কখনো বাংলা একাডেমীতে, কখনো কোনো আর্ট গ্যালারীতে , কখনো বা সেমিনারে ।

গতকাল চারুশিল্পের এই মরমী বাউলের সঙ্গে দেখা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীতে । তৃতীয় আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছেন প্রধান অতিথি হয়ে । বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, অতিথিরা সবাই তখনো এসে পৌঁছান নি। তাই দীর্ঘ বিলম্ব ।এস.এম. সুলতান হাতে ছড়ি নিয়ে প্রবীণ শরীরকে সপে দিয়েছেন চত্বর ঘেরা দেয়ালের গায়ে । ছড়ির মধ্যে খানিকটা ভর ছিল শরীরের ।

এগিয়ে গেলাম চিরাচরিত নিয়মের কেশ বিন্যাসে বাউল গাথার বরপুত্র এস.এম. সুলতানের কাছে । কুশল জানলাম । হাসলেন সেই আগে দেখা, অনেক চেনা মানুষের মতো । বললাম , আপনার শরীর কেমন ? এক হাত ছড়িতে ভর রেখে অন্য হাত নেড়ে বললেন , ' ভালোইতো আছি । তাঁর সঙ্গে আরেকবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে দেখা হওয়ার পর যখন কুশল জানতে চেয়েছিলাম , তখন সেই কালো পোশাক পরিহিত সোনালী পুরুষ ক্রোধের সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন ‘ সত্য বলবো , না মিথ্যা বলবো ? ” তখন তাঁর আত্মজার মতো কন্যাটি তাঁকে উত্তেজিত হতে বারণ করেন । মূলতঃ তখন তাকে শিল্পকলা একাডেমী ' আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স ' হিসেবে চাকরী দেয়ার নাম করে কি যেন ঝামেলা করছিল । কিন্তু গতকালের এস.এম. সুলতান অনেক বদলে গেছেন । শরীর ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছে । বললাম , ‘ এখানে কষ্ট করে দাড়িয়ে না থেকে ভেতরে গিয়ে বসলে ... । আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন , ' না না , এখানেই উদ্বোধন হবে । তারপর ভেতরে হবে অনুষ্ঠান । তাই এখানে থাকাটাই ভালো ।'

বললাম, অতিথিরা সবাইতো এখনো এসে পৌঁছান নি । তাই একটু দেরী হচ্ছে । উত্তরে তিনি বললেন , 'আমাদের সব কিছুইতো দেরী হয়ে যাচ্ছে । কোনো কাজইতো সময় মতো শেষ করতে পারছি না । জানিনা আর পারবো কিনা ।'

এবার তিনি ছড়িটি পাশে রেখে বসে পড়লেন ঘাসের ওপর । আমিও বসলাম মুখোমুখি । ভাবলাম , হয়তো এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। নীরব , নিশ্চুপ এমন একজন মহান শিল্পীর নিঃসঙ্গতা দূর করার অজুহাতে জানতে চাইলাম ,‘ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রধান অতিথি হলেন কি ভেবে ? ’ বললেন , ‘ ছেলেরা সবাই ধরেছে , তাই রাজী হয়ে গেলাম ।'

: চলচ্চিত্র নিয়ে কখনো কিছু ভাবেন ?

:বর্তমান যুগে বিজ্ঞানের রাজত্বে মানব কল্যাণে চলচ্চিত্রের মতো গ্রহণযোগ্য, বৃহৎ এবং শক্তিশালী আর কোনো মাধ্যম আমি দেখিনা । একটি ছবি একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে আমার বিশ্বাস । ভাববেন না কথার কথা বলছি । এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস । তবে আমাদের দেশে শুধু নয় , সারা বিশ্বেই চলচ্চিত্রের দু'টি ধারা বিরাজমান । আসলে এটা শুধু চলচ্চিত্রে বলা ভুল হবে ।সব ক্ষেত্রেইতো একই অবস্থা । ভালো আর মন্দের দ্বন্দ্ব নিয়েইতো সারা বিশ্বে যত সংঘাত, যুদ্ধ আর হানাহানি। চলচ্চিত্রেও এরকম ভালো মন্দের বিরোধ রয়েছে ।এবং তা থাকবেও। তবে সাময়িকভাবে খারাপটাই প্রতিষ্ঠিত হয় । যেমন ‘ সৎ চলচ্চিত্র ' সিনেমা হলে চলে না । অথচ নাচ গানের ছবির নাকি টিকেট ব্ল্যাকে বিক্রি হয়। তবে ভালোর কদর কিন্তু পারমানেন্ট।

: এমন কোনো চলচ্চিত্রের কথা আপনার মনে পড়ে , যা নিয়ে কিছু বলতে পারেন ?

: কেন ‘ জীবন থেকে নেয়া।' আগেই বলেছি, একটি চলচ্চিত্র একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে । তার প্রমাণ আমাদের জহির রায়হানের ' জীবন থেকে নেয়া ' । আমি এই ছবির কথা কখনো ভুলবো না । এখানেই প্রমাণ হয়, পেশার প্রতি মানুষের সততার মূল্য কত । সততা ছাড়া এমন ছবি করা যায় না । এই ছবিটা আমার কাছে একটা বিপ্লবের সমান মনে হয়েছে । এখানে সততা ছিল , প্রতিশ্রুতি ছিল , সৎ সাহস ছিল , যুদ্ধ ছিল ।

: আমাদের চারু শিল্প নিয়ে আপনার ভাবনা কি ? :ভাবনা আর কি । ভালো হচ্ছে কাজ । অনেক নতুন নতুন শিল্পীরা আসছেন । তাদের কাজও ভালো হচ্ছে । তারা সুযোগও অবশ্য বেশী পাচ্ছে । তবে তাদের আরও বেশী আন্তরিক হতে হবে । রাতারাতি নাম ডাক খুঁজলে চলবে না । অনেকেই কাজ রেখে নাম ডাকের জন্য ব্যস্ত । এ ব্যাপারে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও নজর দিচ্ছেনা । বরং ওখানেও নানান রঙের রাজনীতি।ফলে প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে প্রতিভার প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে পারছে না । কিছু মনে করবেন না, সবাই আসলে অসৎ হয়ে পড়েছে । সবাই বলতে সর্বক্ষেত্রে । ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এমন আকার ধারণ করেছে যে, গুণের কদর নীরবে কাঁদে। তাই প্রশাসনে সৎ মানুষের দরকার।

: এই সময়ে দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে আপনি কোন বিষয়কে চিহ্নিত করবেন ?

: সমস্যাতো পদে পদে । তবে আমি শংকিত যুবকদের নিয়ে । যুব সমাজকে সংযত করে মানব কল্যাণে নিযুক্ত করতে পারলেই দেশ ও জাতি সবচাইতে বেশী উপকৃত হবে।যুবকরাইতো আমাদের ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছে, যুবকরাইতো স্বাধীনতা দিয়েছে । কিন্তু যুবকদের আমরা কিছুই দিতে পারি নি । তাই তারা এখন পঙ্কিলতার পথে এগুচ্ছে। যুব শক্তির পতন একটি জাতির পতনের চাইতে কম কিছু নয় । যুবকদের এই পরিস্থিতির কথা ভাবলেই আমি শংকিত হই। তাহলে জাতিকে রক্ষা করবে কারা । তাই এই ব্যাপারে বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসা উচিৎ । অন্যথায় বিজয়ী জাতির বিপর্যয় অসম্ভব কিছু নয় ।

আমাদের কথার এই মুহূর্তে বেশ ক'জন অতিথি এসে গেলেন । আয়োজকদের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন উৎসব শুরুর জন্যে । এস.এম. সুলতানও ভাবলেন, তাঁকে এক্ষুণই বুঝি উঠতে হবে। বললেন :কত কথাইতো বললাম, লিখে আর কি হবে।

এমন সময় ডাক এলো তৃতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উদ্বোধনে তাঁকে যোগদানের জন্যে । আমার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাতে তুলে দিলাম ছড়িটা।ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন পায়রা ও বেলুন ওড়ানোর পর্বের অনুষ্ঠানে। 

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles