চিত্রার চিত্রকর লাল মিয়া

১৯৬৯ সাল । আমার কর্মক্ষেত্র কোহিনুর শিল্প গোষ্ঠীর চাকুরী ছেড়ে আমি চাকুরী নিলাম আইডিয়াল লাইফ ইন্সুরেন্সে। এজেন্সী ম্যানেজার ,সি . এণ্ড বিতে একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর ঠিকাদারের লাইসেন্স আর কিছু নগদ টাকা ও একটি ভেসপা মোটর সাইকেল নিয়ে নিজ মহকুমা নড়াইলে পৌঁছি।রাজনীতি করবো, ব্যবসা করবো, ইন্সুরেন্সের চাকরী করবো, সমাজ সেবা করবো ইত্যাদি চিন্তা মাথায়। কিন্তু ভাবাবেগে বুঝতে পারিনি যে মহকুমায় আমার থাকার কোনো জায়গা নেই।পরিবার পরিজন নিয়ে শ্বশুর বাড়ীতে উঠলাম । কিন্তু ব্যাংক থেকে তোলা ৬০ হাজার টাকা যে ৬ মাসে শেষ হয়ে যাবে সেটা বুঝিনি । রাজকীয়ভাবে মহকুমার চৌরাস্তায় দু'টি রুম ভাড়া নিলাম । অফিস করলাম । ছেলে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ী রেখে শুরু হলো আমার নড়াইলের জীবন । সারা শহরে আমিই একটা ভেসপা চালাই। সমাজের সকল ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ডানে বামে পয়সা খরচ করে অল্প দিনে স্থান করে নিয়েছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতিতে । আমাকে একটা কেউকেটা ব্যক্তি হিসাবে ভাবতে শুরু করে নড়াইলের মানুষ ।

এক শীতের বিকেলে নড়াইল ভিকটোরিয়া কলেজের ছাত্র ও প্রিন্সিপালের মধ্যে একটি মতবিরোধ নিরসনকল্পে একটি সভা হয় । সভায় তদানীন্তন এমপি পরবর্তীকালের বীর মুক্তিযোদ্ধা নড়াইলের কৃতী সন্তান মরহুম লেফটেনান্ট মতিউর রহমান আসেন । সেখানে বক্তব্য রাখি , শিক্ষক ও ছাত্র সমাজে পরিচিত হই। ফেরার পথে রূপগঞ্জ বাজারের মুখে এক ঘোষের দোকানের সামনে দেখি গোলমাল । অনেক লোকের ভীড় । রাস্তা বন্ধ । বারবার হর্ণ বাজানোর পরও কেউ রাস্তা ছাড়ছে না । তখন অগত্যা ভেসপা থামিয়ে সামনে এগিয়ে দেখি কয়েকজন যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ভীষণ উত্তেজিত, লম্বা কালো পোশাক পরিহিত এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক যাকে সবার মাথার উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ইংরেজী ভাষায় গালাগালি করছেন । হাতে একটা বাঁঁশের বাঁঁশী যা ভেংগে ফেটে চৌচির হয়ে ঝাড়ুর মত হয়ে গেছে।একজন চুপচাপ দাঁড়ানো দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলাম উনি কে ? বললেন উনি লাল মিয়া, শিল্পী । আসলে গাঁজাখোর। দোকানে চা মিষ্টি খায় । তাও আবার বাকিতে । তাই ছাত্ররা তাঁকে জোর করে বের করে দিয়েছে । তার জন্য দেখেন না কয়টি ছেলেকে মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছে । প্রথম দর্শনে আমি তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ি । তাঁর অনেক গল্প শুনেছি । সাপ নিয়ে খেলা করেন , শাড়ি পরে ঘেটুর দলে নাচেন , বাঁশি  বাজান , যার ফলে কিছুটা ঘৃণা বোধও ছিল । মুহূর্তে সেই ঘৃণাবোধ কোথায় উবে গেল জানি না । আমি ক্ষিপ্ত হয়ে জিজ্ঞেস করি কে তাঁর কাছে টাকা পাবে , কত টাকা পারে । তখন দেখা গেল আস্তে আস্তে একজন একজন করে সবাই স্থান ত্যাগ করতে থাকে । দোকানদাররা যারা এতক্ষণ উসকানি দিচ্ছিল , তারা সরে পড়তে থাকে । এই পর্যায়ে আমিও কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলি । হঠাৎ ঘোষকে একটা ঘুষি মেরে বসি ও মানিব্যাগ তার মুখে ছুড়ে মেরে বলি কত টাকা পাবি নে । আর শিল্পীর অপমানের খেসারত তোকে দিতে হবে । মাত্র ৭০ টাকা। ঘোষ ভয়ে ভয়ে টাকাটা নিল । আমি সুলতানকে আমার ভেসপায় উঠতে বলি । এতক্ষণ নির্বাক হয়ে সুলতান দেখছিলেন । এবার বলতে শুরু করলেন । আপনাকে আমি চিনি না । আমি তো কুলিদের সাথে শিব মন্দিরে থাকি। এক প্রকার জোর করে তাঁকে ভেসপায় উঠিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে মহকুমায় আমার সেন্টারে নিয়ে আসি । খাটের ওপর মাথায় হাত রেখে বিপর্যস্ত অবস্থায় তিনি বসে থাকেন । আমার খাটের নিচে রাখা মাটি দিয়ে তড়ি ঘড়ি করে ঐ অবস্থায় একটা মূর্তি বানিয়ে টেবিলে তার সামনে রেখে বলি আমিও একজন ছোট শিল্পী । তাই শিল্পীর অপমান আমার খুব লেগেছে । আজ থেকে আর চায়ের দোকানে গাঁজা খাবেন না।এখানে থাকবেন, নিচের হোটেলে খাবেন । এই নিন এক পোয়া গাঁজা যত খুশি খাবেন । সুলতান বললেন এটা আপনার অফিস , আপনার ছেলে মেয়ে আছে । আমার কেউ নেই । আমাকে নিয়ে এত কষ্ট করার কি প্রয়োজন । আমিতো একলা গাঁজা খুব বেশী খাইনা । যাদের সাথে খাই তারা ভয়ে আপনার এখানে আসবে না । আমিতো একলা নই , আমার অসংখ্য বন্ধু - বান্ধব । আমি জিজ্ঞেস করি , তারা কারা । তিনি বলেন হসপিটালের মরাকাটা ডোম রাম গোপাল একজন , এমনি অসংখ্য বন্ধু আমার । আমি তাকে বলি সবাই এখানে খাবে , আমার কোন জাত বিচার বা বাছ বিচার নাই । এভাবে বেশ কয়েকদিন তাকে আটকে রাখার পর তিনি বুঝতে পারেন , আমি তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই । এই পর্যায়ে তিনি বলেন আমি আঠারো বৎসর ভাত খাই না । কোথাও স্থায়ীভাবে থাকি না , শিব মন্দির আমার আশ্রম আর মুটে মেথর , কুলি আমার সাথী । তখন আমি বলি এইসব লোকের দলে যদি আমি দাঁড়াই, তাহলে কেমন হয় ? সুলতান অত্যন্ত খুশি হলেন । শিব - মন্দিরে যাচ্ছে আর একটা নতুন লোক। মেশা যাবে কথা বলা যাবে । এর মধ্যে বাজি হলো একুশ দিন না খেয়ে থাকতে হবে । একুশ দিন আমি তাঁর সাথে শিব মন্দিরে থাকবো । শুরু হলো সুলতানের সাথে পাগলামির জীবন । তাও শ্বশুর বাড়িতে ছেলে মেয়ে বউ রেখে একই শহরে । গাঁজাখোর ঘোষিত হলাম । বদনামে চতুর্দিকে হৈ চৈ পড়ে গেল । গনি মুন্সির জামাই সুলতানের সাথে গাঁজায় যোগদান করে পাগল হয়ে গেছে । আঠারো দিনের সময় সুলতান তাঁর প্যাট্রোন তথা নড়াইলের না খেয়ে থাকা গরীবের বন্ধু সাইদুরকে গিয়ে বললেন , সাইদুর , আমাকে পাগলে ধরেছে, আমি আঠারো দিন ভাত খাইনি । আমাকে কিছু টাকা দাও । সাইদুর পাঁচ টাকা দিলে লঞ্চ ঘাটে সোনাগাঁর হোটেলে রাত এগারোটার সময় পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজা খেয়ে জ্বর উঠলে সুলতান শিব মন্দিরে চলে যান । রাত বারোটা পর্যন্ত তার অপেক্ষায় আমি বসে আছি।একজন রিকসাওয়ালাকে দিয়ে আমাকে খবর দেন শিব মন্দিরে যাবার জন্য । আমি গিয়েই দেখি সুলতান জ্বরে কাঁপছেন । ঢুকতেই বলেন আমি ওয়াদা রাখতে পারিনি। আমি চুরি করে ভাত খেয়ে ফেলেছি । আপনিও খেয়ে আসেন । আমি বলি না এখনো তিন দিন বাকী । তারপর তিন দিন পার হলো । আমার আট পাউণ্ড ওজন কমেছে । রাস্তায় গাঁজাখোর ও পাগল নাম হয়েছে । সামনা সামনি না বল্লেও ভেসপাটা পার হলেই বলে এই সেই নতুন গাঁজাখোর গনি মুন্সির জামাই । সারা শহরের ভদ্রলোকের কাছে আমি হেয় প্রতিপন্ন হলাম । কোথায় আইডিয়াল লাইফ ইন্সুরেন্স, কোথায় ঠিকাদারী লাইসেন্স , কোথায় রাজনীতি , সব শেষ । ব্যাংকের টাকাও প্রায় শেষ । এই সময় রাতে জমিদার বাড়ীর বাঁধা ঘাটে লাল পদ্ম ও সুলতানের বাঁশী আর খাদ্য হিসাবে সাইদুরের দান করা আটা , ময়দা , চাল হলো আমাদের একমাত্র উপজীব্য। জ্যোৎস্না রাতে বাঁশী বাজাতেন সুলতান । সেই বাঁশীর সাথে নাচতে দেখেছি দীঘির জলের লাল শাপলা ফুলকে। অবিশ্বাস্য হলেও আমি দেখেছি , পাগল হওয়ার অনেক কিছু ছিল । একদিন দেখলাম একটি সাপ সুলতানকে কামড় দিয়ে মরে আছে । ভয়ে আমি শিব মন্দির ছাড়লাম । আরো অনেক কিছু দেখেছি আমি । এভাবে দিন যেতে যেতে আস্তে আস্তে নিঃস্ব হয়ে আসছি । সেই সময় জিজ্ঞাসা করলাম আপনার তো অনেক প্যাট্রোন ছিল , তার মধ্যে নাম মনে পড়লে চলেন সেইখানে যাই । আপনি শিল্পী । আপনার পরিচয় ছবি আঁকা। শেয়াল , বেজি পালা আর গল্প করা আপনাকে মানায় না । সেদিনও ছিল পূর্ণচন্দ্র জ্যোৎস্না। অনেকক্ষণ বাঁশী বাজালেন , তবুও ঘুম আসছে না । কেবল রাত ১২ টার দিকে একটু শুয়ে পড়েছি । তদ্রার মত লাগছে । সুলতান উঠে বললেন , আমাকে রং তুলি আর কাগজ দেন । আমি ছবি আঁকবো । রাত পৌনে একটা বাজে । সমস্ত এলাকার মানুষ ঘুম -ঘোরে । কোথায় পাবো রং তুলি । হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো । হরিপদ দাসের দোকানে সিগারেটের প্যাকিংয়ের কাগজ আছে । ছুটলাম ভেসপা নিয়ে। গিয়ে হৈ চৈ করে হরিপদ দাসকে উঠতে বল্লাম । কিছু প্যাকিংয়ের কাগজ দেন । রাতে থতমত খেয়ে বললো জামাই আপনি পাগল হয়ে গেছেন ? এই রাতে লাল মিয়া ছবি আঁকবে আর আপনি এসেছেন কাগজ নিতে । অগত্যা বেচার ৷ কয়েক শিট কাগজ দিল । খেজুরের শুকনো ডাল চিবিয়ে তুলি বানানো হলো । শিব- মন্দিরে এক পাগলা সাধুর পরিত্যক্ত একটি হলুদ রংয়ের কৌটার মধ্যে কুপির তেল ঢেলে রং প্রস্তুত হলো । আঁকা হলো ১′×৯ ″ একটি ছবি যাতে কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না । খুলনা প্রদর্শনীতে ঐ ছবিটার নামকরণ করা হয়েছিল “ দি ড্রিস ” ।

এনাম আহমেদ চৌধুরী তখন যশোরের ডিসি । শওকত আলী নড়াইলের এসডিও। সুলতান এনাম চৌধুরী ও সুলতানুজ্জামান খান সমন্ধে অনেক গল্প করেছেন আমার কাছে। তাই চৌধুরী সাহেবের কাছে সুলতান সাহেবকে নিয়ে গেলাম , তিনি মহাখুশি শুনে যে সুলতান ছবি আঁকছেন । তার একটা আখড়া বানানোর অভিপ্রায় জানানোর সাথে সাথে তিনি বললেন, ' ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট , নড়াইল ' নাম দিয়ে একটা সাদা কাগজে দরখাস্ত জমা দিন । আমি দরখাস্ত দিলাম।প্রস্তাবিত আর্ট কলেজের নামকরণ করা হলো । সুলতান থাকবেন তার ডাইরেক্টর এবং গ্রিন্সিপাল । আর আমাকে বলা হলো আপনি সেক্রেটারী হিসাবে ও ভাইস প্রিন্সিপাল হিসাবেও কাজ করবেন।কারণ সুলতান ভাইতো কোন অফিসিয়াল ফর্মালিটি জানেন না । তাই সরকারের কাছ থেকে কিছু পেতে হলে তার আইন কানুন মত কাজ করতে হবে। ডিসি অফিসে বসেই দুটি দরখাস্ত করা হলো । একটা ছবির প্রদর্শনী করার জন্য আর্থিক সাহায্য এবং একটা পরিত্যক্ত বাড়ীর জন্য । স্ট্যানো দিয়ে ডিসি সাহেব দরখাস্ত দু'টি টাইপ করে সই করালেন । জেলা পরিষদ থেকে প্রস্তাবিত আর্ট কলেজের নামে চার হাজার টাকার একটা অনুদান ও একটা পুরনো দালান বরাদ করলেন ডিসি সাহেব । ' কুড়িগ্রাম ' নামে রূপগঞ্জের কাছে শৈলেন ঘোষের দুতলা বাড়ী । শুরু হলো ছবি আঁকা আর বাড়ী মেরামত ও ফুলের বাগানের কাজ । ৫/৭ জন লোক লাগিয়ে দেওয়া হলো বাগানের কাজে।

সুলতানের সাথে বসবাস কালে এক বছরে তাঁর যে সব আত্মীয়দের দেখেছি তাদের মধ্যে নুরুমামু চুন বিক্রি করতেন । তাকে সুলতানের অমতে আর্ট কলেজে স্থান দিই এবং অনেক আর্থিক সাহায্য দিই । সুলতানের এক সৎ ভাই যিনি সামরিক বাহিনী ছেড়ে দিয়েছিলেন , তিনিও অনেক বার এসেছেন আর্ট কলেজে । যিনি সুলতানকে দেবতার তুল্য মনে করতেন এবং বাড়ীতে স্থান দিতেন তিনি ছিলেন নন্দের বাপ ইন্দু বাবু । আমাদের পুরুলিয়া ইউনিয়নের কেরানী , যার বাড়ীর বউ ছেলে মেয়ে সবাই ছিল শিল্পী , কেউ গান গায় , কেউ ছবি আঁকে । আঠারো বছর পর সুলতানের প্রথম প্রদর্শনী হয় খুলনা ক্লাবে ২০ শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ , ৩৪ টি ছবি নিয়ে ।

ইতিমধ্যে এনাম সাহেব বদলী হলেন ডিসি হিসাবে খুলনায়। কাজে যোগ দিয়েই তিনি গাড়ী পাঠিয়ে সুলতানকে খুলনায় নিয়ে যেতে বললেন । গেলাম খুলনায়, প্রস্তাব হলো খুলনা ক্লাবে এক রাতের জন্য সুলতানের প্রদর্শনী হবে । দিন ধার্য্য হলো । এক মাস হাতে রেখে কাজ শুরু হলো । সমস্ত ম্যাটেরিয়াল দেশী মোটা মার্কিন কাপড়, এলা মাটি , ভুসো কালি , পিউরী , পাউডার , আর আসল হার্ডবোর্ড ।

বড় বড় হার্ডবোর্ড ও ক্যানভাসের ট্রিটমেন্ট করা হলো সাবুদানা জ্বালিয়ে ব্যাক কোটিং দিয়ে এক সাথে । কয়লা দিয়ে ড্রইং করা হলো ২০ / ২৫ টা ক্যানভাস ও বোর্ডে । তুলি দিয়ে চলছে অয়েল পেইনটিং , স্প্যাচুলা দিয়ে চলছে অয়েল , আর ড্রইং বোর্ডে চলছে  ওয়াটার কালার । মনে হচ্ছে একজন শিল্পী বোধহয় কোন এজমালি প্রদর্শনীর কাজ করছেন । সে এক অভাবনীয় শক্তির বহিঃপ্রকাশ । দেখতে দেখতে প্রদর্শনী এসে গেল । আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি । পরিবর্তন হয়েছে মহকুমা প্রশাসক শওকত সাহেবের । এডিসি হয়ে তিনি গেলেন খুলনায় । রওশন জামির এসডিও হয়ে আসছেন নড়াইলে । সুলতানুজ্জামান সাহেব বদলী হয়ে গেছেন । কমিশনার হয়ে আসছেন কফিল উদ্দিন মাহামুদ সাহেব । সুলতান ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসছেন । ইতিপূর্বে তিনি বলেছেন আমার সাথে আপনি একসাথে গ্রুপ শো করবেন। আপনি একটা মডেল বানালে আপনাকে আমি চারটি ছবি দেবো । তাকে উৎসাহিত করার জন্য আমি মাটি ও কাঠের কিছু কাজ শুরু করলাম । যার সংখ্যা প্রায় ২৫ / ৩০ টা । দিন যত কাছে আসছে এনাম সাহেব তত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন । বারবার টেলিফোন আসছে মতিউর রহমান কাজ কতদূর অগ্রসর হলো ? ও দিকে ক্লাব মেম্বাররা ক্লাব বন্ধ থাকায় সুলতান ছবি আঁকা ভুলে গেছে একথা বলে ডিসি কমিশনারের কান ভারী করছে । তাদের বক্তব্য ছিলো প্রদর্শনী হবে না । অহেতুক ক্লাব বন্ধ রেখে সদস্যদের কষ্ট দেয়া হচ্ছে। এনাম সাহেব তাৎক্ষণিকভাবে এডিসি শওকত সাহেবকে গাড়ী দিয়ে পাঠালেন ছবি নেয়ার জন্য । শওকত সাহেবকে দেখে এবং ছবির জন্য তাগিদ দেয়ায় সুলতান বিগড়ে গেলেন। কাজ বন্ধ করে বসে থাকলেন । অগত্যা ডিসি খবর পাঠালেন ছবির কাজ খুলনায় বসে করা হবে । কাঁচা রং করা সমাপ্ত অথবা আধা সমাপ্ত ছবি পিকআপে করে কয়েক ট্রিপে খুলনা ক্লাবের টিনসেড অডিটোরিয়ামে পৌঁছানো হলো । সবাই সন্দেহ করছে এত ছবি কবে শেষ হবে । খুলনায় ডিসি কমিশনার এডিসি ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট সবাই এসে সঙ্গ দিচ্ছিলেন । ঔষধ পত্র চাহিবা মাত্র ক্লাবে হাজির হচ্ছে । সুলতানের কাজের গতি হঠাৎ করে বেড়ে যায় । মেশিনের মত দ্রুত গতিতে মাত্র দুই দিনে সকল ছবি আঁকা শেষ হলো কিন্তু রং কাঁচা ।

সবাইকে তাক লাগিয়ে অডিটোরিয়ামে উদ্বোধনী সভা হ'ল।বক্তৃতা রাখলাম আমি, ডিসি ও কমিশনার সাহেব। এই প্রদর্শনীতে প্রায় ৩০/৩৫ হাজার টাকার ছবি বিক্রি হয় । সমৃস্ত টাকা খুলনা ক্লাবের মাধ্যমে উপস্থিত নড়াইলের মহকুমা প্রশাসক জনাব কামাল সিদ্দিকী ও ইউনাইটেড ব্যাংকের ম্যানেজার , নড়াইল এর মাধ্যমে ব্যাংকে একাউন্ট খুলে আর্ট ইন্সটিটিউটের নামে রাখা হয় । প্রদর্শনী শেষে ডিসি সাহেবের মেহমান হিসাবে আমরা হোটেল শাহীন - এ এক সপ্তাহ অবস্থান করি । কালেকশনের কিছু নগদ টাকা দিয়ে এনাম চৌধুরী সাহেব প্রায় ৮/১০ হাজার টাকার আর্ট ম্যাটেরিয়েল কিনে দেন । সমস্ত জিনিস নিয়ে আমরা নড়াইল শৈলেন ঘোষের বাড়ীতে ফিরে আসি। ইতিমধ্যে চারদিকে জানাজানি হয় যে , লাল সাহেব লক্ষ লক্ষ টাকার ছবি বিক্রি করেছেন । ভক্তবৃন্দ , সাধু - সন্ন্যাসী , ফকির , পাগল দলে দলে আর্ট কলেজে আসতে আরম্ভ করল।সুলতান সাহেব ও এসডিও সাহেবের যৌথ স্বাক্ষরে হিসাব পরিচালিত হত । সাধু সন্ন্যাসীদের টাকা পয়সা দেওয়ার জন্য তিনি এসডিও সাহেবের সই আনতেন এবং ব্যাংক হতে টাকা পয়সা তুলে সাধু সন্ন্যাসী গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে শুরু করেন । এক পর্যায়ে এসডিও সাহেব বলেন যে , এসব আর্ট কলেজের টাকা , এভাবে যথেচ্ছা বিলানোর জন্য নয় । তখন ১৫/২০ জন সাধু সন্ন্যাসীসহ সুলতান এসডিও - এর বাংলোয় গিয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকলে এসডিও সাহেব চেক বইতে সই দিয়ে দোতলা থেকে নীচে ফেলে দেন । এরপর সুলতান এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত টাকা উঠিয়ে সাধু সন্যাসীদের মধ্যে বিতরণ করে দেন । এভাবেই প্রস্তাবিত আর্ট কলেজের অপমৃত্যু ঘটে এবং সুলতানের না খেয়ে থাকা জীবন আবার আরম্ভ হয় ।

১৯৭১ - এ মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো । দেশ স্বাধীন হলো সর্বস্বান্ত হয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে কি করবো ভেবে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় । খুলনায় অবস্থান করছি । ছোট ভাই ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল আলমের সঙ্গে কিছু একটা করবো চিন্তাভাবনা করছি । কামাল সিদ্দিকী সাহেব খুলনায় ডিসি হয়ে এসেছেন । কাজ নাই , তাই নাজমুল আলমের সাথে ডিসি অফিস যাই । সদ্য স্বাধীন দেশে সমস্যার সীমা নেই। একদিন ডিসি'র চেম্বারে বসে আছি । এরমধ্যে কোহিনুর শিল্পগোষ্ঠির ফরহাদ নামে একজন কর্মকর্তা খুলনাস্থ কোহিনুরের গুদামের তালা খোলার জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করার জন্য একটা দরখাস্ত এবং তার সাথে একটি ভিজিটিং কার্ড ডিসি সাহেবের কাছে দিলেন । ম্যাজিস্ট্রেট বলতে তখন খুলনায় একজনই আছেন । কোন ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া সম্ভব নয় বলে ডিসি সাহেব দুঃখ প্রকাশ করে যখন কাগজগুলো ফেরত দিচ্ছিলেন তখন কার্ডটা নিয়ে দেখলাম ফরহাদের এবং কোহিনুর শিল্পগোষ্ঠির নাম । তখন তাকে ডাকানো হলো । তিনি বললেন, কোহিনুর শিল্পগোষ্ঠী সরকারের অধীনে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসাবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে । সাত্তার সাহেব প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন । প্রাক্তন সকল কর্মচারী কর্মকর্তাদের কাজে যোগদান করার আহবান জানানো হয়েছে । তিনি বললেন, আপনি ঢাকায় চলে আসেন । ফ্রেব্রুয়ারির দু'তারিখ ঢাকায় পৌঁছে গেলাম । ১৪ ই ফেব্রুয়ারি আবার নতুন করে কোহিনুর শিল্পগোষ্ঠিতে কাজে যোগদান করলাম । একদিন অফিসে গিয়ে একটা চিঠি পেলাম সুলতান ভাই লিখেছেন ‘ প্রিয় মতি ভাই , আমার না খেয়ে থাকার জীবন শুরু হয়েছে । তাই আপনার কথা মনে পড়লো। আপনার শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে জানতে পারলাম আপনি ভাল চাকুরী পেয়েছেন , সুখে আছেন । কষ্ট করে আপনার ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি লিখছি । আশাকরি আমাকে ভুলে যান নি ।'চিঠির বিষয়বস্তু ছিল অত্যন্ত করুণ ।

সুলতান ভাইয়ের অবস্থা জেনে খুবই খারাপ লাগলো । ভাল আছি তাই নড়াইলের ব্যথা , দুঃখ কষ্ট ও ক্ষতি সব ভুলে চিঠি দিলাম ও টাকা পাঠালাম । ঢাকায় চলে আসার জন্য অনুরোধ জানালাম । এই সময় আমি বাসা পাল্টে নাখাল পাড়ায় বাসা নিয়েছি । সুলতান ঢাকায় এলেন সঙ্গী ঝড়ুকুন্ডু নিয়ে । শুরু হলো আবার সেই পুরানো প্রচেষ্টা । ভরসা তখন এনাম সাহেব , সুলতানুজ্জামান খান ও বিগ্রেডিয়ার মশুরুল হক , যিনি তখন ঢাকায় । এনাম সাহেব তখন এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর ভাইস প্রেসিডেন্ট। সুলতানুজ্জামান সাহেব ওয়াটার ও পাওয়ারের সচিব । বিগ্রেডিয়ার মশুরুল হক তখন চিফ অব প্রোটকল । ভাবলাম সুলতান ভাইয়ের ছবি দিয়ে ঢাকায় একটি প্রদর্শনী করতে হবে , কারণ খুলনা ক্লাবের প্রদর্শনী ১৮ বৎসর পরে হলেও তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে নি । সুলতান বেঁচে আছেন এবং ছবি আঁকছেন এই খবর ঢাকায় শিল্পীদের তথা বাংলাদেশের সকল শিল্পীদের জানানোর জন্য শিল্পকলা একাডেমীতে প্রদর্শনীর সিদ্ধান্ত নিলাম ।

এই সময় আমি নিজে একটা বোল্ডার কাটার এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেছি । শেরে বাংলা নগরে থাকাকালীন প্রচুর বোল্ডার যোগাড় করে কাটা শুরু করেছিলাম । ১০ / ১২ টি কাজ তখন শেষ করেছি । নাখাল পাড়ার বাসায় টিনের ঘরে থাকতাম । একদিকে বিদ্যুৎ ছিল না , অন্য দিকে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না । সুলতান ভাইয়ের বন্ধুরা লাইন লাগিয়ে ঢাকায় আসতে শুরু করেছে । তখন আবার বাসা পাল্টে চলে এলাম মগবাজার ওয়ারলেস রোডে লণ্ডন হোটেলের পেছনে একটি চার কামরার একতলা বাড়ীতে । এখানে একটা বড় হল রুম ছিল । সেইটিতে আমার কাজ ও সুলতান ভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা করা হলো । ২/৪ জন মেহমান আসলেও অসুবিধা হচ্ছিল না । ইতিমধ্যে মাটি , কাঠ , বোল্ডার , সিমেন্ট ও পোড়া কাঠ মিলিয়ে ২০ / ৩০ টা কাজ আমার হয়ে গেছে । আমার বোল্ডার কাটার গল্প শুনে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন সেগুলো দেখার জন্য আমার বাসায় আসলেন এবং আর্ট কলেজে একটা প্রদর্শনী করার অনুরোধ করলেন । আমি প্রদর্শনীর জন্য জোর কাজ করছি । সুলতান ভাইও বেশ কয়েকটি ছবি আমার এই বাসায় বসে করলেন । ভাবলাম আমি প্রথমে প্রদর্শনী করে কিছু টাকা আয় করে পরে সুলতান ভাইয়ের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবো । এই সময় আমার বাসায় সুলতান ভাইকে প্রচুর ম্যাটেরিয়াল কিনে দিয়েছি । সুলতান ভাই জোরেশোরে ছবি আঁকছেন । মাধ্যম হলো হার্ডবোর্ড , দেশি ক্যানভাস , এলামাটি , ভুসো কালি , পিউরী , হ্যাভক তুলি ও স্পেচুলা । আমার ভাস্কর্য ও সুলতান ভাইয়ের স্পেচুলা ওয়ার্ক , ওয়াটার কালার ও ক্যানভাসে কয়লা দিয়ে চলছে ড্রইং ।

আমি প্রদর্শনী করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কোহিনুর শিল্পগোষ্ঠী থেকে ব্রুসিয়ারে বিজ্ঞাপনের অগ্রিম হিসাবে প্রায় ২০/২৫ হাজার টাকা যোগাড় করেছি । নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে দু'জন কাজ করে চলেছি । আমার প্রদর্শনীর স্থান নির্ধারণ হলো ঢাকা আর্ট কলেজে । ইতিমধ্যে পচাত্তর সালে শিল্পকলা একাডেমীতে প্রথম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ২ টি বোল্ডার জমা দিলাম । সুলতান ভাইয়ের একটি ছোট ছবি জমা দিই । আমার প্রদর্শনীর দিন আবেদিন সাহেব ধার্য করলেন ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে । প্রধান অতিথি হিসাবে আবেদিন সাহেব টেলিফোনে আওয়ামী লীগের তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলীকে সম্মত করান । প্রেসে ব্রুসিয়ার ছাপতে দেওয়া হলো । সভাপতিত্ব করবেন আবেদিন সাহেব নিজে । কয়েক দিনের মধ্যে কোরবান আলী সাহেবের মন্ত্রীত্ব চলে গেল । প্রেসে ছাপার কাজ বন্ধ করে আবার প্রধান অতিথির জন্য আবেদিন সাহেবকে বললাম । তিনি উপদেশ দিলেন পর্যটনের চেয়ারম্যানকে প্রধান অতিথি করার জন্য । গেলাম আমার প্রাক্তন শিক্ষক চেয়ারম্যান রফিকুল চৌধুরীর কাছে । তিনি সব শুনে সাগ্রহে সম্মতি দিলেন । আবার প্রেসে ছাপার কাজ শুরু হলো । মাত্র এক মাস আছে । দু ' দিন পর কাগজে পড়লাম রফিকুল চৌধুরী ওএসডি হয়ে গেছেন । আবার বাতিল হলো প্রধান অতিথি । সভাপতিও ঠিক থাকলো না । ইতিমধ্যে আবেদিন ভাইয়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে । তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। ভাবলাম আর বোধহয় আমার প্রদর্শনী হবে না । এরপর নতুন করে গেলাম কবি আবুল ফজল সাহেবের কাছে । কবি হিসাবে আমার পরিচিতি ছিল । তিনি যখন শুনলেন আমি ভাস্কর্যের কাজ করি এবং প্রদর্শনী করবো তখন খুব খুশী হলেন ও প্রধান অতিথি হবার সম্মতি দিলেন । বিশেষ অতিথি হিসাবে ঠিক করা হল শিল্পকলা একাডেমীর মহা পরিচালক ড . সিরাজুল ইসলামকে । সভাপতিত্ব করবেন আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল সৈয়দ সফিকুল হোসেন । স্বাধীন বাংলায় আমার প্রথম প্রদর্শনী শুরু হলো আর্ট কলেজ গ্যালারিতে । প্রদর্শনী সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত চলতো । একদিন বিকেলে আমি সুলতান ভাইকে সাথে নিয়ে প্রদর্শনীর অভ্যর্থনায় বসে আছি । এমন সময় একজন বিদেশী শিল্পী মাহমুদের সঙ্গে অভ্যর্থনার দিকে এগিয়ে আসলেন । মাহমুদ ভাই সুলতানকে দেখিয়ে বললেন ঐ শিল্পীর নাম এস. এম. সুলতান । তিনি ভাস্কর মতিউর রহমান সাহেবের বাসায় থাকেন , যার প্রদর্শনী এখানে হচ্ছে । এ বিদেশীর নাম সুলতানী । সুলতানীকে সুলতান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো । সুলতানী কিছুক্ষণ আলাপেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন । সুলতানী ছিলেন ঢাকার ইরানী দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী । তিনি বললেন আমি তার কিছু ছবি দেখতে চাই । বাসায় নিয়ে এলাম । সুলতানী তার কাজ দেখে এবং একজন ফ্রিল্যান্সার বাঙ্গালী শিল্পী কাজ করছে দেখে খুবই খুশী হন । তাকে বললাম সুলতানের একক প্রদর্শনী হবে শিল্পকলা একাডেমীতে তাই কাজ চলছে । সুলতানী আমাকে বললেন আপনি এগিয়ে যান । এই ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করবো । এর পর পর সুলতানী , আমার মগবাজার বাসায় এসে সুলতান ভাইয়ের সাথে সময় কাটাতেন । একদিন এমন হলো যে , সলতান ভাই যে জিনিসের তালিকা দিয়েছেন তাতে ৫/৬ হাজার টাকা লাগবে । আমি অর্ধেক টাকা যোগাড় করেছি , তা দিয়ে অর্ধেক ম্যাটেরিয়াল কিনবো ঠিক করেছি । এগারটা ৪-১০ ফুট চাইনিজ বোর্ড কিনেছি , এতেই আমার টাকা শেষ হয়ে যায় । এরমধ্যে বড় বোর্ড পেয়ে সুলতান ভাই স্প্যাচুলারে কাজ শুরু করবেন , প্রচুর হ্যাভক দরকার । সুলতানী আমাকে বললেন, চলেন বাজারে যাই । তাকে নিয়ে নবাবপুর রং বিতানে গেলাম মালিক হাজী সাহের আগের পাওনা টাকা চাইলেন। তখন সুলতানী বললেন ফর্দের অর্ধেক জিনিস আমি কিনে দেব । সেই মতে দুই হদর হ্যান্ডক সহ আড়াই হাজার টাকার মাল কেনা হলো । টাকাটা সুলতানী দিলেন । এই হলো আমার বাইরের দাতাদের কাছ থেকে প্রথম সাহায্য । ইতিমধ্যে ৪/৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে । কেউ একটি পয়সা সাহায্য করেনি । এই সেই সুলতানী যার আড়াই হাজার টাকা দানে সুলতান ভাইয়ের প্রদর্শনী হয়েছে বলে এক বরেণ্য কথা শিল্পীর বইয়ে স্থান পেয়েছে । সুলতানী খুব একটা স্বচ্ছল অফিসার ছিলেন না । তার একটি ভাই ও একটি বোন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত । যেহেতু তিনি চ্যান্সেরীর দায়িত্বে ছিলেন , তাই সাংস্কৃতিক তহবিলটি তার অধীনে ছিল । বরেণ্য শিল্পীদের ২ / ৩ টা রিসেপশান দেখিয়ে কিছু টাকা বের করে শিল্পীদের ছবি কিনে বাঙ্গালী শিল্পীদের সাহায্য করেন । যাহোক , আমার প্রদর্শনী শেষ হলে বেশ কিছু টাকা পাই । মায়ের নির্দেশ মূর্তি বেঁচা টাকা পয়সা যেন সন্তানদেরকে না খাওয়াই , তাই পুরো টাকাটা সুলতান ভাইয়ের খাতে লাগাতে পারবো ভাবলাম । পূর্ণোদ্যমে চলছে ছবি আঁকা । আমি ছুটি শেষে কাজে যোগদান করায় সারাদিন সুলতানকে সঙ্গ দিতে পারি না । তাই একটা কাজের ছেলে নিয়োগ করলাম । সুলতান আড্ডা না হলে ছবি আঁকেন না । তাই কয়েকজন শিল্পীকে অনুরোধ করলাম আমার বাসায় আসার জন্য ও সুলতান ভাইকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য । এরমধ্যে সবাই প্রায় তরুণ । ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে পাস করা । সার্বক্ষণিকভাবে ক্যানভাস ট্রিটম্যান্ট ও রং বানানোর কাজে সাহায্যের জন্য শিল্পী মেরাজ , সায়মন , নাদভি এগিয়ে এলো । মাঝে মাধ্যে খালেদ ভাই এবং সুবীর চৌধুরীও যোগ দিত । খুব জমজমাট অবস্থা প্রতিদিন প্রায় ৫০০/৭০০ টাকার ম্যাটেরিয়াল লাগত ।

এমনি অবস্থায় বেশিদিন টিকে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না । শিল্পকলা একাডেমীতে দরখাস্ত করে প্রদর্শনীর দিন ধার্য্য করি । গ্যালারির অনুমতি পাই ১৫ দিনের জন্য । ৫০ / ৬০ টা ছবি আঁকা হয় । এছাড়া অরো ৩০ / ৪০ টি ছবি কয়লা দিয়ে ড্রইং করা । সাধু দানা দিয়ে ট্রিটমেন্ট করা আরো প্রায় ৩০ / ৪০ টি ছবি । কাজের চাপে সুলতান ক্লান্ত হয়ে পড়েন । কাজে অনীহা প্রকাশ করতে শুরু করেন । একদিন রেগে চলে গেলেন নড়াইল , না বলে । আর আসেন না । চারিদিকে গুজব সুলতানের প্রদর্শনী হবে না , সে পালিয়েছে । বিপদ এবার অন্যরকম ভাগনে মেজর কুদ্দুসের স্মরণাপন্ন হলাম । সে ধরে এনে দিল সুলতানকে আমার বাসায় । আবার শুরু হলো ছবি আঁকা । ঢাকায় এবার এলে প্রতিদিন বিকেলে গাড়ী করে ঘুরতে ও আড্ডা দিতে যাই তার প্রাক্তন প্যাট্রিনদের কাছে । আড্ডা চলে আবেদিনের , কবি জসিম উদ্দিনের , বাউল মনসুর উদ্দিনের , এনাম চৌধুরী , সুলতানুজ্জামান ও মশুরুল হকের বাসায় । সবাই বাহবা দেয় প্রদর্শনী করার জন্য । আমার কথামতো কাজ করার জন্য তাঁকে উপদেশ দেন । যথেষ্ট চা নাস্তা খাওয়ান সবাই । আমার অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে । তবে কোনো রকমে কাজ বন্ধ করা যাবে না । তখন ডানে বামে ধারকর্য শুরু করলাম । তবুও সুলতানকে জানতে দিইনি যে আমি আর পারছি না । এ প্রদর্শনীর দিন যত কাছে আসছে আমি ততই আর্থিকভাবে দুর্বল হচ্ছি । সুলতানও শারীরিকভাবে কাজের চাপে দুর্বল হয়ে আসছেন । আবার একদিন না বলে হঠাৎ পলাতক । প্রদর্শনীর মাত্র ২০/২৫ দিন বাকী। বনের পাখী আবার বনে , ঝাকের পাখী আবার ঝাঁকে , অর্থাৎ নড়াইলে পালিয়ে যান । বিপদ দেখে এবার স্মরণাপন্ন হলাম বিগ্রেডিয়ার মশুরুল হক সাহেবের । তিনি টেলিফোনে জিওসি যশোরকে সব ঘটনা বলেন এবং যেভাবে হোক সুলতানকে ধরে ঢাকায় আমার বাসায় পৌঁছে দিতে অনুরোধ জানালেন । আমি কায়দায় একদল অফিসার জীপ নিয়ে নড়াইলে সুলতানের পুরানো আস্তানায় গিয়ে তাকে না পেয়ে শহরের দিকে যেতেই পরিচিত গাইড সুলতানকে দেখে । সুলতান ভ্যান যোগে যাচ্ছেন । জীপ ভ্যানের গতিরোধ করে ও সুলতানকে জীপে উঠিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে পরে বিনা টিকেটে বিমানের ককপিটে উঠিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে মেসেজ দেওয়া হয় যেন তারা তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করে এবং বিগ্রেডিয়ার মশুরুল হক সাহেবের বাসায় নিয়ে যায় । তাই করা হলো । বিকেলে মশুরুল ভাই শিল্পীকে নিয়ে হাজির হয়ে বললেন এই যে মতি তোমার চিড়িয়া ধরে এনেছি। স্বভাবসুলভ কায়দায় সুলতান বললেন মাফ করবেন মতি ভাই । নড়াইলের বন্ধুদের কথা মনে পড়ায় ও একটু মুক্ত আলো বাতাস খেতে পালিয়ে গিয়েছিলাম । এই আর্মি সাহেব আমাকে সেখান থেকে ধরে নিয়ে এসেছেন । আবার নতুন করে কাজ শুরু হলো । এবার নতুন সমস্যা । উসিলা বের করলেন ভিস্যুয়াল ডিস্টান্স পাচ্ছিনা । এত ছোট স্পেসে এত বড় ছবি আঁকা সম্ভব নয় । এদিকে বাড়ী ওয়ালা বাড়ী ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছে । একই সময়ে সুলতান ভাইয়ের ব্রেকডাউন ঘটলো । বাড়ী ছাড়তে হলো । নতুন বাসা নিলাম খিলগাও মসজিদের পিছনে । ইমাম সাহেব এককালে আমার বাসায় থাকতেন । তিনি আশেপাশের লোকজনকে বললেন মসজিদের পাশে দুজন হিন্দু বাসা নিয়েছে । একজন লম্বা চুলওয়ালা সাধু গাজা খায় । আরেকজন হিন্দু মূর্তি বানায় । মাত্র কয়েক সপ্তাহ হয় নতুন বাসায় এসেছি । এক শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর ইমাম সাহেব কয়েকজন কিশোর ও যুবক নামাজিকে বলেন ঐ টিনের ঘরে সাধু সন্ন্যাসীরা আড্ডা জমিয়েছে । মূর্তি বানাচ্ছে । গাজা মদ চলছে । অতএব পাথর মেরে তাদের উড়িয়ে দিতে হবে । এই সময় সুলতান ভাই আমার ছোট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন বাইরে খোলা জায়গায় , যেখানে আমি একটা কাঠাল গাছ দিয়ে মূর্তি বানাচ্ছিলাম । হাতে আমার চাইনিজ কুড়াল । হঠাৎ ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে বৃষ্টির মতো ইট পাথর মারতে শুরু করলো যুবকরা । সুলতান ভাই আমার মেয়েটিকে নিয়ে দ্রুত ঘরের ভিতর চলে গেলেন । আমি চাইনিজ কুড়াল নিয়ে তাড়া করে দেখি পাগড়ী ওয়ালা ইমাম সাহেব হুকুম দিচ্ছেন আর ছেলেরা ইট পাথর মারছে । টিনের ঘর । বিকট আওয়াজে মানুষ চারদিকে ছুটে গেল । আমার বাসার সমস্ত লোক ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঘরের ভিতরেই অবস্থান করছিল । ইমাম সাহেব আমার হাতে কুড়াল এবং আমার রাগন্বিত অবস্থা দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , কাজী সাহেব আপনি কি এই বাসায় থাকেন ? আমাকে বলা হয়েছে এই বাসায় একজন ইণ্ডিয়ান গাজাখোর সাধু আরেকজন হিন্দু মূর্তি বানানোর কারখানা খুলেছে । আমি ইমাম সাহেবকে বললাম , না দেখে না শুনে এই একশান নেওয়ার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে ? ইমাম সাহেব ক্ষমা চাইলেন। প্রদর্শনীর দিন এসে গেল । প্রধান অতিথি কাজী আনোয়ারুল হক । সভাপতিত্ব করলেন শিক্ষা উপদেষ্টা কবি আবুল ফজল । সুলতান ভাইকে নতুন জামা কাপড়ে সাজানো হলো । উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে শিল্পকলার প্রশাসন বিল্ডিংয়ের হল ঘরে । সুলতান ভাই সকালেই অনুরোধ করলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাকে কিছু বলতে হলে আমার বিগ মেডিসিন লাগবে । বিকেল ৫ টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হবে । প্রধান অতিথি সভাপতি এসে গেছেন । কিন্তু বিগ মেডিসিন আসেনি । দর্শক সমাগম হয়েছে প্রচুর । হল ঘরটা ভরে গেছে । বাইরেও অনেক দর্শক অপেক্ষমান । সুলতান ভাইকে বার বার অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো , তিনি জানিয়ে দিলেন বিগ মেডিসিন না আসা পর্যন্ত আমি ওখানে যেতে পারব না । বসে আছেন চারুকলা বিভাগের রুমে । বিগ মেডিসিন আনার দায়িত্ব দেওয়া ছিল ভাগনে মেজর কুদ্দুসের উপরে । সে আধা ঘন্টা লেটে আসলো । জিজ্ঞাস করলাম এনেছ । উত্তর দেওয়ার আগেই সাফারীর দুই পকেট থেকে দুটি শিশি আমার হাতে ধরিয়ে দিল । প্রশান্ত হাসি মুখে সুলতান ভাই ডক ডক করে দুই শিশি খেয়ে ফেললেন । এরপর দাড়িয়ে বললেন চলেন এখন কোথায় যেতে হবে । হলে একটু সামান্য উঁচু একটি ডায়াসে সবাই বসে আছেন । সুলতান ভাইকে সভাপতির পাশের সিট দেওয়া হল । কিছুক্ষণের মধ্যে সভাপতি সাহেব বুঝতে পারলেন ঘটনাটা । তিনি একটু সরে বসতে চেষ্টা করছেন । ইতিমধ্যে ডিজি সাহেব উদ্বোধনী ঘোষণা করলেন ও শিল্পীকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলেন । সুলতান ভাই দাড়িয়ে সবাইকে দেখলেন । সামনের সারিতে বসে আছি আমরা , এনাম আহমেদ , সুলতানুজ্জামান ও মশুরুল হক । শুরু করলেন সুন্দরভাবে বাংলায় । মুহূর্তে সুইচ অন হ'ল ইংরেজীতে । প্রদর্শনী ১৫ দিন চলে। শিল্পকলায় এ রকম প্রদর্শনী কোন দিন হয়নি । সবকিছু ভালভাবে চললো । চারিদিকে লোক লাগিয়ে করপোরেশন ও কিছু সংস্থায় কিছু ছবি বিক্রির মটিভেশান চলছে । দুঃখজনক হলেও সত্য হার্ডবোর্ড ও লোকাল ম্যাটেরিয়ালের বলে বড় ছবিগুলোর কাছে কেউ ভিড়লো না । মাত্র ২৭ হাজার টাকার ছবি প্রদর্শনীতে বিক্রি হলো । যা খরচের কাছাকাছিও নয় । এভাবে প্রদর্শনী শেষ হলো ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫



Share

Recent Comments

Recent Articles