দেশজ আধুনিকতা ৷৷ সুলতানের কাজ

দেশজ আধুনিকতা ৷৷ সুলতানের কাজ 

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর 

সুলতান তিন অর্থে আদিম । তাঁর কাজ লোকজ এবং আধুনিক ঐতিহ্যের প্রান্তে ; তাঁর বিষয়াবলী , প্রায়শই, কৃষক জীবনের উপাখ্যান এবং কর্মতৎপরতা থেকে উত্থিত এবং সবশেষে তাঁর কাজে মানুষ এবং মানুষীর ফিগরসকল শ্রমজীবী শ্রেণী থেকে নেয়া । তিনি এক একক যাত্রী, মুসাফির কিংবা বৈরাগী, সে জন্য তিনি নির্দিষ্ট একটি ধারা কিংবা আচরণবিধির উত্তরাধিকারী নন। তিনি কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন ইংরেজ ভারতীয় ঐতিহ্যের চিত্রগত ব্যাকরণ ; সে জন্য তাঁর মধ্যে ব্যাকরণ নেই । আধুনিক প্রথাসমূহ থেকে বিবর্তিত আঙ্গিক দক্ষতার ওপর তিনি কর্তৃত্ব বিস্তার করেননি , সেজন্য তাঁকে চিত্রস্ত মনে হয়। চিত্রগত সমস্যার ক্ষেত্রে তাঁর সমাধান পুনরাবৃত্তিক, সে জন্য তাঁকে মনে হয় গ্রাম্য সরল । এসব হচ্ছে তাঁর ছেদ এবং এসব ছেদ তাঁকে ভিন্ন করেছে।

সুলতানের শক্তির ভিত্তি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা । তাঁর কৃষক উৎস এবং তাঁর বোহেমিয়ান জীবনস্টাইল পরস্পর প্রবিষ্ট এবং তাঁর চেতনাকে আকার দিয়েছে । তাঁর কাজের দিকে তাকালে মানতে বাধ্য হই এ সকল কাজ উৎসারিত হয়েছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এবং প্রায়শই উদ্দীপিত এবং উচ্চকিত হয়েছে অভিজ্ঞতার ঐ প্রগাঢ়তা থেকে । তিনি তাঁর কৃষক উৎস থেকে দূরে যেতে পেরেছেন এবং অন্যপক্ষে তাঁর বোহেমিয়ানিজম শ্রেণী বিভাজনের পরপারে তাঁকে নিয়ে গিয়েছে । এ সবই তাঁর কাজে তৈরি করেছে এক ধরনের টেনসন, সে জন্য তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র উন্মাতাল ।তাঁর ফিগরসকল সাধারণত মনুমেন্টাল মনুমেন্টালিটির কারণে তাদের এবং চতুর্পাশ্বের মধ্যে কোন সঙ্গতি নেই । সে জন্য তাদের মনে হয় নাটকীয়।এই নাটকীয়তা তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দুর ক্ষেত্রে বিপত্তি তৈরি করে। পটভূমির নিসর্গ রংয়ের বাজনায় নাচে, কিন্তু তাঁর নাটকীয় ফিগরসকল কৃষকের শ্রমের নিষ্ঠুর এবং স্কুল শারীরিকতার প্রতিভূ, এই শ্রমের নিষ্ঠুরতা এবং শারীরিকতা রংয়ের নরম নমিত স্কীমের সঙ্গে মেলে না । তাঁর পুরুষ এবং নারী ফিগরের মধ্যে তফাত আছে । যে ক্ষেত্রে তাঁর পুরুষ ফিগর দৈত্যাকার এবং পেশল এবং আদিম , সে ক্ষেত্রে তাঁর নারী ফিগর গোলাকৃতি , মদির এবং লাবণ্যময় । একই কাজে যেমন তেল রংয়ে আঁকা গ্রামের বিকেল, তৈরি করে বিষমতা, এক ধরনের দূরত্ব । তেল রংয়ে আঁকা ধান তোলা , নদী পার হওয়া , ধান মাড়াই , পুকুরে গ্রাম্য রমণীদের গোসল- এসব কাজে নারী ফিগর মদির এবং মায়াময়, যেন গ্রাম্য কিসসা কাহিনী , গীত থেকে উঠে এসেছে । বিপরীতে তাঁর পুরুষ ফিগরসকল- তেল রংয়ে আঁকা জমি দখলের লড়াই, ধান ক্ষেতে কৃষক , লাঙ্গল গরু কৃষক – এ সব জমিন থেকে উঠে এসেছে, যে জমিন তৈরী হয়েছে বাংলাদেশের ভূগোল এবং ইতিহাস থেকে, যে ভূগোল এবং ইতিহাসের মধ্যে আছে কৃষকের সঙ্গে জমির, কৃষকের সঙ্গে ধানক্ষেতের, কৃষকের সঙ্গে হালবলদের , কৃষকের সঙ্গে জমির দখলের সম্পর্ক । এই সম্পর্ক নিষ্ঠুর এবং কর্কশ , আবার ভালোবাসার এবং মমতার । কৃষক লড়াকু , কৃষক আবার তার ধানগাছ, তার হালবলদ, তার নারীর প্রেমিক।

সুলতান তাহলে কি ? একজন লুকানো পিকাসো ? একজন গোপন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ? সুলতান দুই - ই, খুব সম্ভব আরও । পিকাসোর সঙ্গে তাঁর কতক মিল আছে নাটকীয় ফিগরদের জন্য তাঁর প্যাশনের কারণে । তিনি ভ্যান ঘগের কাছের তাঁর ব্রাশ স্ট্রোকের ভঙ্গি এবং শক্তির জন্য । তিনি আরও অধিক বিষয়ের সঙ্গে তাঁর গভীর এবং নিবিড় মমত্ববোধের জন্য । ফল হচ্ছে: একটি ব্যক্তিক ভিশনের উৎপাদন: কিংবদন্তীর বাংলাদেশের ভিশন যার মধ্যে তিনি মিলিয়েছেন তাঁর কৃষক চতুর্পাশ্ব । এর ফলে গ্রাম্য মোহনতা কিংবা ভাবালুতা আক্রান্ত গ্রামীণ নিসর্গ আঁকা থেকে তিনি বেঁচে গেছেন । এ ভাবে তাঁর কৃষক সকল অর্জন করেছে একটি মিথনির্ভর বাস্তবতা , আদিমদের এক ধরনের শক্তি এবং ইচ্ছার জোর । তারা সবাই প্রস্তুত , ক্ষিপ্র এবং উদ্যত সংস্কৃতিবান শ্ৰেণীদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে । তাঁর দরকার আদিমদের ইচ্ছার জোর, তাঁর প্রয়োজন শ্রেণীচৈতন্যের উদ্দীপনা মধ্যশ্রেণীর ভদ্রতা ছিন্নভিন্ন এবং ইংরেজ - ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের দৃশ্যমান মদিরতা এবং নিরক্ত কাব্যিকতা বদলে দেয়ার জন্য । তিনি ভিন্ন এবং উন্মাতাল: শিল্প ভুবনের এক কৃষক, অভিজ্ঞতা এবং মনোভঙ্গির দিক থেকে বুর্জোয়াদের বিরোধী এবং বিপরীত।

মধ্য পঞ্চাশ দশক । আমিনুল আমাকে বললেন, সুলতান ঢাকায় এসেছে । আমেরিকা , ইংল্যাণ্ড , পাকিস্তান ঘুরে। সবার সঙ্গে দেখা করতে চায় । সুলতান তখনি একটি কিংবদন্তী । শিল্পী , ভবঘুরে , মুসাফির , বৈরাগী: হতচ্ছাড়া, ছন্নছাড়া , ছবি আঁকে ছবি ফেলে দেয় , ছবির মালিকানার চেয়ে ছবি নির্মাণেই তাঁর আনন্দ । আর বাঁশি বাজায়, গাজা খায় , রাধা খুঁজে বেড়ায় কিংবা নিজেকেই রাধা মনে করে । তখনকার আর্ট স্কুলে আমিনুলের একটি ঘর ছিল: তাঁর স্টুডিও । সুলতানকে দেখলাম, কালো পেড়ে শাড়ি পরা , বাঁশি বাজাচ্ছে । বকুলতালায় রোদ , রোদের মধ্যে পিঠ দিয়ে বসে আছে একটি কাক, আকাশে মেঘের শাদা: সুলতানের বাঁশির মধ্যে মোচড় দিচ্ছে শহর ঢাকা, ঢাকা ছাড়িয়ে গ্রাম নদী গাছপালা , এ সবটারই নাম নড়াইল , নড়াইলের ডাকাতিয়া বাঁশি । বাঁশি শেষ , গাঁজায় দম, সুলতান উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, রাধা এসেছে , রাধা বুড়িগঙ্গায় নৌকায় বসে , আমি যাই। সুলতানের পাশাপাশি কিংবা পিছু পিছু আমরা জনাতিনেক , সুলতানের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে বুড়িগঙ্গার পাড়ে । রাস্তায় মানুষজন অবাক , মধ্যে মধ্যে সুলতানের রাধা রাধা বোল এবং একটু নাচের ভঙ্গি, আমরা অদৃশ্য ঢোল এবং করতালের তালে তাল দিচ্ছি । বুড়িগঙ্গায় নৌকায় অনেকক্ষণ ঘোরা , মধ্যে মধ্যে সুলতানের বাঁশি , নদীর ঢেউগুলি গ্রীবা উচিয়ে শুনছে । ফের ফিরে আসা আর্ট স্কুলে , ক্ষিপ্র আঙ্গুলে ড্রইং - এর পর ড্রইং: গাছপালা নদী পশুপাখি, চেনা বিষয়ের মধ্যে অচেনার ইঙ্গিত , দৃশ্যের মধ্যে অদৃশ্যের হাতছানি । পরদিন খোঁজ নিতে এসে শুনি সুলতান উধাও, খুব সম্ভব নড়াইল চলে গেছে । রেখে গেছে তাঁর কয়েকটা ড্রইং শিট: তাঁর ঝোলা , তাঁর বাঁশি , তাঁর সুলতানকে নিয়ে সুলতান ফের বৈরাগী মুসাফির ভবঘুরে হতচ্ছাড়া ছন্নছাড়া । সুলতান সব পার্থিব সম্পদ ফেলে যায় , কিন্তু একটি সম্পদ তাঁর সঙ্গে থেকেই যায়। সে হচ্ছে সুলতানের সুলতান। সুলতান কখনোই তাঁর সুলতানকে কারো কাছে সঁপে দেয়নি , কিংবা জিন্মী করেনি : খ্যাতির কাছে নয়, পদের কাছে নয়, অর্থের কাছে নয়, প্রতিষ্ঠানের কাছে নয়, এমনকি কোন নারীর কাছে নয় । এই তাঁর স্থায়ী সম্পদ :  তাঁর বেঁচে থাকার রসদ , উৎস , ভিত্তি কেন্দ্র, মূল ।

সুলতানের এই মনোভঙ্গিটাই আমি থেকে থেকে তদন্ত করেছি । সুলতান প্রত্যাখ্যান করেছে পশ্চিমের আধুনিকতা, প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তানের কলোনীর আধুনিকতা, সুলতান বারবার ফিরে গিয়েছে তাঁর শিকড়ে । অধস্তন বিশ্বের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা কি প্রান্তিক ? ইংল্যান্ড , আমেরিকা , পাকিস্তান ফেরৎ সুলতানের বক্তব্য হচ্ছে : অধস্তন বিশ্বের শিল্পীরা কেবল এথনিক শিল্পী নয়, তাঁরা প্রান্তিক অভিজ্ঞতার প্রবক্তা কেবল নয় , যে অভিজ্ঞতা অতীতের মধ্যে আবদ্ধ, আধুনিকতা থেকে দূরে। অধস্তনদের অভিজ্ঞতা ঔপনিবেশিকতা, পরাধীনতা এবং দাসত্বের কারণে জটিল , স্বতন্ত্র এবং অনন্য ; এই অভিজ্ঞতা জনসমষ্টিকে একটি স্বতন্ত্র কন্ঠে এবং চোখে ' বলবার, দেখবার ভাববার ক্ষমতা প্রদান করেছে । এই কণ্ঠ এবং চোখ আধুনিকতার উৎপাদন থেকে বহির্ভূত নয় । এ হচ্ছে অন্য এক আধুনিকতা । এ হচ্ছে দেশজ আধুনিকতা , এ হচ্ছে কৃষকদের অভিজ্ঞতা , আউল - বাউল - ফকিরদের গীতের আধুনিকতা , এ হচ্ছে অধস্তন লাঞ্ছিত পরাজিত কৃষক আউল-বাউল- ফকীরদের প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা । প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা।এ অভিজ্ঞতা আধুনিকতা নামক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে ভিন্ন এক চয়ন এবং বুনন । এই চয়ন এবং বুনন থেকে তৈরি হয় দেশজ আধুনিকতা।

সুলতান যেসব কাজ করেছেন তাতে মনে হয় তিনি একপক্ষে প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈশ্বিক আধুনিকতা এবং অন্যপক্ষে প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈশ্বিক আধুনিকতার অন্তর্গত পাকিস্তানী কলোনীর ধর্মমনস্কতা । রাধা , কৃষক , পশুপাখি , হালবলদ সে জন্য প্রতীক , ফিরে যাওয়ার এবং প্রত্যাখ্যান করার এবং নির্মাণ করার । এ সব থেকে তৈরি হয়েছে দেশজ আধুনিকতার দুই পরিপ্রেক্ষিত এবং দুই পরিপ্রেক্ষিত উদ্ভুত স্থানিক বাঙালি সংস্কৃতি । এই স্থানিক বাঙালি সংস্কৃতি ( স্থানিকতা নড়াইল অঞ্চল অর্থে ) টিকে থাকে সকল পরিবর্তন এবং দুর্যোগের মধ্যে , টিকে থাকার মধ্যে দিয়ে এই সংস্কৃতি অস্তরিত হয়েছে এবং আকার দিয়েছে বাঙালিত্বকে, এই বাঙালিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত বিভিন্ন প্রান্তিক সংস্কৃতি : কৃষক - আউল - বাউল , লোকজ - ধর্মজ মনোভাব । অন্যপক্ষে এই স্থানিকতা হচ্ছে এক সার প্রক্রিয়া , যে প্রক্রিয়া নির্মাণ , পুনর্নির্মাণ এবং ভেঙ্গে ফেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান । এভাবে সুলতানের স্থানিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ফর্ম , যেসব প্রশ্ন করেছে বৈশ্বিক সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানী সংস্কৃতির পরিসর । বৈশ্বিক আধুনিকতার বিপরীত হচ্ছে স্থানিক আবহমানতা, এই আবহমানতা ফের রুখে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানী ধর্মমনস্ক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রাধা , কৃষক , পশুপাখি , হালবলদের ফর্ম নিয়ে । সে জন্য স্থানিকতা একই সঙ্গে আবহমানতা এবং প্রতিরোধ । এই আবহমানতা হচ্ছে মিথ এবং প্রতিরোধ হচ্ছে স্মৃতিনির্ভর । মিথ থেকে তৈরি হচ্ছে সকল দুর্যোগ এবং দুর্ভোগের মধ্যে টিকে থাকার শক্তি , অন্যপক্ষে প্রতিরোধ থেকে তৈরি হচ্ছে জীবনদর্পিতা : জমির জন্য, ধানের জন্য , সন্তানের জন্য, হালবলদের জন্য, প্রেয়সীর জন্য রুখে দাঁড়ানোর ভঙ্গি । আবহমানতার এই ভঙ্গিটি দেশজ আধুনিকতার শক্তি । সে জন্য সুলতানের দেশজ আধুনিকতা বাস্তব, স্পষ্ট এবং ফিগরটিভ । ফিগরের মধ্যে দিয়ে তিনি আবহমানতার শক্তি এবং প্রতিরোধের ডালপালা তৈরি করেছেন । এই ফিগর মধ্য - ডিকটোরীয় স্থাণু ফিগর নয়, এই ফিগর পিকাসোর সক্রিয়তার আমদানি নয় , এই ফিগর ভান ঘ'র সন্ত্রাস তাড়িত নয়: এই ফিগর নড়াইলের জমি থেকে উত্থিত , নড়াইলের আউল - বাউল - বৈরাগীর খঞ্জনীতে স্পন্দিত ।

দেশজ আধুনিকতা কতগুলো জিজ্ঞাসার সূত্র মেলে ধরে । বৈশ্বিক আধুনিকতার মধ্যে ক্রিয়াশীল কলোনিয়াল প্রভুত্ব কলোনীর মধ্যে কতগুলো জিজ্ঞাসা উত্থাপিত করে : ক. কলোনীর বাসিন্দাদের কেন কোন কন্ঠ/চোখ নেই, খ, তাদের ইতিহাস কেন বিকৃত এবং অধস্তন, গ. তাদের উৎসে ফেরার উপায় কেন সরল নয় এবং ঘ. বিভিন্ন ছেদের মধ্যে তাদের জীবনযাপন কেন যথার্থ নয় । এসব জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে তারা বৈশ্বিক আধুনিকতার অ-যথার্থতা এবং কলোনিয়াল নির্যাতনের প্রচণ্ডতা উপস্থাপিত করে । এই উপস্থাপন সে জন্য প্রতীক খোঁজার মধ্যে। এই প্রতীক তাই বাস্তবের বর্ণনা : এই বর্ণনাটাই সুলতান করেছেন দক্ষতা এবং যত্নের সঙ্গে । তাঁর বর্ণিত নড়াইল কিংবা বাংলাদেশ ইতিহাসের কোন পর্বে এটি শনাক্ত করা সহজ নয় । এই নড়াইল কি স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিব আমলের ? এই নড়াইল কি পাকিস্তানী কলোনিয়াল আইয়ুব আমলের ? এই নড়াইল কি কলোনিয়াল বৃটিশ আমলের ? কিংবা তারও আগের ? আসলে সুলতানের এটি হচ্ছে প্রয়াস ফিরে পাওয়ার এবং প্রতিষ্ঠিত করার একটি জনসমষ্টিকে প্রতীকের মধ্যে দিয়ে একটি অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুনর্বার যুক্ত করার, যে যুক্ততা এই জনসমষ্টিকে ভাষা খুঁজতে সাহায্য করবে যাতে করে তারা ফের নিজেদের নিজস্ব ইতিহাসসমূহ আত্মসাত করতে পারে। বৈশ্বিক আধুনিকতা এই নিজস্ব ইতিহাসসমূহ উদ্ধার কিংবা পুনরুদ্ধারের সহায় শক্তি নয় এবং কলোনীর আধুনিকতা এই নিজস্ব ইতিহাসসমূহ অধস্তন করে রাখে । সুলতান এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয় কৃষকের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাস্তবতা ফিরিয়ে এনেছেন । কৃষকের জীবনযাপনের অংশ সমাজের বিভিন্ন অধস্তন স্তর এবং কৃষকের মনোজীবনের অংশ সমাজের বিভিন্ন অধস্তন মনোজ্ঞতা । সুলতান রাধার কাছে , কৃষকের কাছে , পশুপাখির কাছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইতিহাসের মধ্য দিয়ে এবং বিভিন্ন ইতিহাসের কিংবদন্তী উপাখ্যান গীতির মধ্য দিয়ে ফিরে যেতে চেয়েছেন । সে জন্য তার বাঁশি দরকার , পশুপাখি দরকার , হালবলদ দরকার ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে এবং জীবনযাপনের সরঞ্জাম হিসাবে।

বাংলাদেশের তিন বিখ্যাত শিল্পী : জয়নুল আবেদিন , কামরুল হাসান এবং সুলতানের চোখে কৃষক বার বার হানা দিয়েছে । এই হানা দেয়া তিন জনের চোখে তিন ধরনের । বাংলাদেশের সমাজ গঠনে কৃষক অবদমিত এবং অবদমিত কৃষকের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তিন পক্ষ দিয়ে । জয়নুল আবেদিনের ক্ষেত্রে কৃষকের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে  লাঞ্ছনা এবং দুর্গতির পথ দিয়ে। কামরুল হাসানের ক্ষেত্রে কৃষকের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে গ্রামবাংলার রাজনৈতিকতার পথ দিয়ে । সুলতানের ক্ষেত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটেছে কৃষকের উপস্থিতির মধ্য দিয়ে । তিনজনের ক্ষেত্রে কৃষকের হানা দেয়ার অর্থ চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত করা: তারা তিন জনই দৃশ্যমান বাস্তবের মধ্যে লুকানো অদৃশ্যমান বাস্তবতাকে চোখে মেলে ধরেছেন । ভণ্ড রাজনীতি ছিঁড়ে খুঁড়ে , উন্নয়নের চকচকে কথাবার্তা নেংটো করে কৃষক হানা দেয় বারবার, ফিরে আসে বারবার অন্তরাল থেকে , প্রচণ্ড লাঞ্ছনা নিয়ে, প্রচণ্ড বিদ্রোহ নিয়ে, প্রচণ্ড উপস্থিতি নিয়ে।

সুলতান এই উপস্থিতিটাকে বাস্তবতা দিয়েছেন । কৃষকরা মৃত নয় , অতীতের একটা অংশ নয় , তারা বিদ্যমানতা এবং বর্তমানতার মধ্যে জীবন্ত । সুলতানের কৃষক আধুনিক ঐতিহ্যের অংশ, ঐতিহ্যের অবদমিত অংশ এবং অবদমিত অংশের উপস্থিতি। এই উপস্থিতি শ্রেণী বিক্ষুব্ধতার পরিচয় নয়, কিংবা নয় ধনদৌলত এবং ক্ষমতার বঞ্চিতকরণ । এই উপস্থিতি জীবনের উপস্থিতি । সুলতান তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে মনে করিয়ে দেন কৃষকদের জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে জীবনে, সেই জায়গায় উৎসারিত হবে কৃষক জীবন, উত্থিত তীব্রতা, গতিময়তা, জীবন্ততা : এই প্রক্রিয়ায় জীবন্ততার বাস্তবতা শৈল্পিক, সামাজিক এবং অস্তিত্বিক স্বীকৃতি আদায় করে নেবে আমাদের চোখ থেকে।

সুলতানের কৃষকের উপস্থিতির মধ্যে আছে প্রাথমিক বাস্তবতা, মৌলিক সরলতা এবং উপস্থিতির সমগ্রতা। এই সমগ্রতা স্ব - পর্যাপ্ত, বাইরের ঘটনা কিংবা উপাদান থেকে পরিশ্রুত, যেখান থেকে শুরু করা যায় এবং শুরু করা সম্ভব । কৃষক অধস্তন শ্রেণীর অন্তর্গত, অধস্তনতার মধ্যে কৃষকের অভ্যন্তরীণ উপস্থিতি, সুলতান এই অধস্তন এবং অভ্যন্তরীণ উপস্থিতি জনসমক্ষে এনেছেন এবং অভ্যন্তরীণ উপস্থিতি পাবলিক উপস্থিতিতে বদলে দিয়েছেন । কৃষক, সুলতানের চোখে প্রকাশ্য এক সমাজ অভিজ্ঞতা, এই অভিজ্ঞতা লুকানো যায় না কিংবা খাটো করা যায় না। কৃষক, এভাবে পরিবর্তন এক সমাজ বাস্তবতার এবং সমাজ কল্পনার এক সক্রিয় উপাদানে পরিণত । সমাজ বাস্তবতা এবং সমাজ কম্পনার অংশ হওয়ার দরুন কৃষক সুলতানের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ করেছে সমাজ অভিজ্ঞতায়।

বাঙালি সংস্কৃতির যে অংশ সাহিত্য সেখানে সোচ্চার ঔপনিবেশিক সভ্যতা সম্বন্ধে সাড়া এবং মনোভাব । মূাইকেলের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো , বঙ্কিমের কৃষক, দীনবন্ধুর নীল দর্পণ, মীর মশাররফের জমিদার দর্পণ এবং গাজি মিয়ার বস্তানী: সবখানেই এই সাড়া এবং মনোভাব কৃষকদের নিয়ে আবর্তিত। কৃষকরা সমাজ কাঠামোর মধ্যে অধস্তন সত্ত্বেও তাঁদের চিন্তার ক্ষেত্রে সক্রিয় । কৃষকদের মধ্য দিয়ে এবং মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সভ্যতার নিরক্ততা, ভদ্রতা, মেকিপনা মেলে ধরেছেন এবং এই সভ্যতা যে বর্বরতার আগ্নেয়গিরি তার উল্লেখে তাঁদের কোনো দ্বিধা নেই। গ্রাম কিংবা পল্লী শান্তি কিংবা স্বপ্নময়তা নয়, গ্রাম কিংবা পল্লী দুঃখ বঞ্চনা দারিদ্র্য এবং কদর্য : এসব নিয়েই গ্রাম কিংবা পল্লীর স্বাভাবিকতা, বাঙালির ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য কর্মীরা এই সত্য তুলে ধরেছেন । এই সত্য সম্বন্ধে বিচ্ছেদ কিংবা বিপত্তি তৈরি হয় বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে, ঔপনিবেশিক যান্ত্রিক সভ্যতার বিপরীত গ্রাম কিংবা গ্রামীন জীবন : এই বোধ রোমান্টিকতার পোশাকে বাঙালি সংস্কৃতিতে দেখা দেয় । বাঙালি সংস্কৃতির যে অংশ চিত্রকলা সেখানে এই রোমান্টিকতা শক্তিশালী হয়ে ওঠে । এর দরুন গ্রাম কিংবা কৃষক জীবন রোমান্টিক, ভাবালু, স্বপ্নমদির এবং মায়াবী হাতছানির মধ্যে হয়ে ওঠে ।

এই হাতছানির মদিরতা পরপর ভেঙে দেন জয়নুল আবেদিন , কামরুল হাসান এবং সুলতান । এই ঐতিহাসিকতার মধ্যে সুলতানকে যুক্ত করে দেখা দরকার। ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের কৃষক জীবনের স্বাভাবিকতা সুলতানের কাজে উপস্থিত হয়েছে। সেজন্যে এ সকল কাজ ঔপনিবেশিক সভ্যতার নিরক্ততার প্রতিবাদ, অধস্তনতার “ শিল্পে উত্থান : এই উত্থান স্বাভাবিক, সরল এবং স্বতঃস্ফূর্ত।

বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা আধুনিকতার যে সংজ্ঞা তৈরি করেছে যে সংজ্ঞায় স্বাভাবিকতা , সরলতা , স্বতঃস্ফূর্ততা প্রয়োজনীয় শর্ত নয় । সেজন্যে এসব গ্রাম্যতার সঙ্গে যুক্ত কিংবা গ্রাম্যতার সমান্তরাল হিসেবে বিবেচিত। এই প্রক্রিয়ায় বৈদগ্ধ নাগরিকতার সঙ্গে এবং স্বাভাবিকতা গ্রাম্যতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ( মনে কি পড়ে না গোবিন্দ দাস এবং জসিম উদ্দীনের কথা, যারা 'আধুনিক' সংস্কৃতির মধ্যে অচ্ছুত রয়ে গেলেন ) আবার নাগরিকতা হয়েছে বিশ্বপৃথিবী জানবার একটি মনোভঙ্গি এবং পল্লীতা পশ্চাদপদতার একটি মাপকাঠি। ঔপনিবেশিক আধুনিকতা উন্মূল করে দিয়েছে নাগরিক মনোভঙ্গি এবং গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতি অনবরত ছিন্নমূল হতে চলেছে ঔপনিবেশিক শোষণের মধ্য দিয়ে, এই বোধ ধরা পড়েনি ঔপনিবেশিক আধুনিকতায়। এই আধুনিকতা বৈশ্বিক শোষণের ভিন্নরূপ, গ্রামীণ সংস্কৃতি অধস্তন করার একটি প্রক্রিয়া এবং লোকজ মনোভঙ্গি উদ্ভূত : স্বাভাবিকতা , সরলতা , স্বতঃস্ফূর্ততা প্রত্যাখান করবার বুদ্ধিবাদী পদ্ধতি । ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্র কৃষক সমাজ অধস্তন করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টি দেশের যে অংশের বাসিন্দা সেই গ্রামাঞ্চল অধস্তন হওয়ার মধ্যে দিয়ে অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ জনসমষ্টির সংস্কৃতি ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্র থেকে উদ্ভূত হয়ে প্রবল হয়েছে । বৃটিশ বুর্জোয়ারা এবং দেশজ বুর্জোয়ারা একই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যে অংশগ্রহণ করেছে , যদিও এই অংশগ্রহণ অসম এবং স্তর বিন্যস্ত । দেশজ বুর্জোয়ারা বৃটিশ বুর্জোয়াদের নির্মিত নান্দনিক ভুবনে প্রবেশ করেছে, নির্মাণ করেছে বোহেমিয়া বোহেমিয়ান গ্রামীণ কল্পরাজ্য । এই কল্পরাজ্যের মধ্যে বাস্তবতা নেই ।এই প্রক্রিয়ায় নির্বাসিত হয়েছে দেশজ বাস্তবতা, দেশজ বাস্তবতার মধ্যে দুই পা মেলে দাঁড়ানোর কৃষক, তৈরি হয়েছে কল্পনার গ্রাম, বাস্তবের সঙ্গে দূরত্ব রেখে তৈরি হয়েছে কল্পনার স্বর্গরাজ্য: বোহেমিয়া।

বাংলাদেশের বোহেমিয়া বৃটিশ বোহেমিয়ার যতো কাছাকাছি, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতা থেকে ততো দূরে।

ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্রের নান্দনিক ভুবন হচ্ছে বোহেমিয়া। এই বোহেমিয়ার প্রধান উপাদান নিসর্গ ।এই নিসর্গ বানানো, কৃত্রিম এবং বৃটিশ বোহেমিয়ার অনুসরণে নির্মিত । সেজন্যে এর মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক প্যাস্টরালিজম নেই, বাস্তব গ্রামবাংলার প্রকৃতি নেই । এভাবে প্রকৃতি এবং নিসর্গের মধ্যে দূরত্ব তৈরি রয়েছে , নিসর্গ হয়ে উঠেছে শহরের আকুতি , ইচ্ছাপূরণ , বাস্তববর্জিত ' সুন্দর ' । এই সুন্দরই নিসর্গের মাধ্যমে শহরের জাতীয় সাংস্কৃতিক উৎপাদনে পর্যবসিত হয়েছে । নিসর্গের এই মতাদর্শিক নির্মিতির মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক আধুনিকতা গ্রামবাংলাকে নির্বাসিত করেছে । সুলতান এই মতাদর্শ চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং নিসর্গের বিপরীতে প্রকৃতির দিকে হাত বাড়িয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হচ্ছে লোভ । এই লোভকে সর্বগ্রাসী করে তোলা হয়েছে রাজনৈতিক দলকে সশস্ত্র এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার এবং প্রশাসনকে কদর্য করে । সেজন্য ন্যায় রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে স্খলিত হয়েছে  এবং ন্যায়বোধ আশ্রয় নিয়েছে প্রান্তিক জনসাধারণের মধ্যে । এই ন্যায়বোধ থেকে তৈরি হয়েছে ক্ষমতার বিকল্প বোধ, যে বোধকে ব্যবহার করেছেন সুলতান ( এবং জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান ) তাদের কাজে । সেজন্য তাঁদের কাজ একই সঙ্গে ক্ষমতার বোধ এবং সাহসের বোধ: তাদের কাজের দিকে তাকালে দর্শকের চোখে এবং বুকে ক্ষমতার বোধ এবং সাহসের বোধ সঞ্চারিত হয়।

রাষ্ট্রব্যবস্থার দুইদিকে ক্ষমতার দুই বিপরীত বোধ একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল । যেক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হচ্ছে সর্বগ্রাসী লোভ, সেক্ষেত্রে সুলতানদের , আবেদিনদের , কামরুল হাসানদের কাছে ক্ষমতা হচ্ছে জনসাধারণের ক্রোধের সাহসের ঘণীভূত অবস্থা / অবস্থান। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভিজ্ঞতার বিপরীত কিংবা বিরোধী হচ্ছে প্রান্তিক জনসমষ্টির অবস্থানের অভিজ্ঞতা । এই অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি সুলতানদের চোখে । এই চোখে সবকিছু থেকে যায় , এই চোখ থেকে কিছু লুকানো যায় না , সেজন্য সুলতানদের চোখে সতত উপস্থিত সবকিছু: রাজনৈতিক নেতৃত্বের লোভ, এই লোভকে স্থায়ী করার জন্য রাজনৈতিক দলের সশস্ত্রতা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহার, উগ্রতা এবং প্রশাসনিক কদর্যতা। 

সুলতান এবং জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান ক্ষমতার রাজনৈতিকতাকে অগ্রাহ্য করেছেন । ক্ষমতার রাজনৈতিকতা রাষ্ট্রব্যবস্থার শোষণ এবং নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত । এই যুক্ততার দরুন মানুষ, প্রান্তিক মানুষ, প্রান্তিক জনসমষ্টি নিজেদের মহিমা খুঁজে পায় না এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র করে তোলে। এই মহিমা নষ্ট হওয়া এবং ক্ষুদ্র হওয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আশরাফ, আতরাফ বোধ , মালিক - চাষী বোধ , জমিদার কৃষক বোধ সরকার প্রজা বোধ । আতরাফ , চাষী , কৃষক প্রজা সর্বত্রই ক্ষুদ্র এবং মহিমাহীন; সর্বত্রই নির্ভরশীল আশরাফ, মালিক, জমিদার, সরকারের ওপর । এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা । এই প্রক্রিয়ায় কৃষক আশরাফ , মালিক , জমিদার , সরকারের বিষয় নয় । তারা আছে, থাকে নির্যাতন এবং শোষণ বৈধ করার জন্য । তারা আছে, থাকে রাষ্ট্রগঠনের একটি উপাদান: জনসংখ্যার শর্ত পূরণের জন্য ।

সুলতান এবং আবেদিন এবং কামরুল হাসান শান্তভাবে এই বোধের সামাজিকতা বদলে দিয়েছেন । শান্তভাবে কিন্তু দুঃসাহসের সঙ্গে । ঔপনিবেশিক ধনতান্ত্রিক সমাজে সেই সংস্কৃতির প্রয়োজন যে সংস্কৃতি ইমেজের ওপর দাড়িয়ে আছে । এই সমাজ এবং সংস্কৃতির প্রয়োজন একটি বিনোদন ব্যবস্থার, যে ব্যবস্থায় প্রান্তিক মানুষ কিংবা প্রান্তিক জনসমষ্টি ভাঁড়, বোকা, সরল হয়ে যায়; এই ভাঁড় হওয়া , বোকা হওয়া , সরল হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রেণী, স্তর লিঙ্গজ লাঞ্ছনা ভুলিয়ে দেয়া যায়। এই মডেলে বঙ্গীয় সাহিত্যে প্রান্তিক মানুষ কিংবা জনসমষ্টির চরিত্র নির্মিত হয়েছে। অন্যপক্ষে এই সমাজ এবং সংস্কৃতি পরিচালনার জন্য দরকার অপরিমাণ তথ্য : প্রান্তিক মানুষ কিংবা জনসমষ্টি সম্বন্ধে, যাতে বাড়ানো যায় উৎপাদন, রক্ষা করা যায় শান্তি শৃঙ্খলা , হওয়া যায় সশস্ত্র, তৈরি করা যায় চাকরি খবরদারি করার জন্য । বঙ্কিমের বৈষ্ণবীরা , রবীন্দ্রনাথের বৈরাগীরা এই ইমেজে তৈরি , ভাঁড় , বোকা , সরল মানুষের মিছিল , প্রান্তিক মানুষ কিংবা প্রান্তিক জনসমষ্টির জীবন পদ্ধতি । বিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকে এই ইমেজের ফের বদল হয় । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পতিত ব্রাহ্মণ কাহার ডোম এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে চোর ছেঁচোর ভিখারীরা হচ্ছে প্রান্তিক মানুষ কিংবা প্রান্তিক জনসমষ্টি । এই ইমেজ এবং ইমেজের বদল ঔপনিবেশিক ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কেন্দ্র ভিত্তিমূল। কিন্তু এই ইমেজ এবং ইমেজের বদলের মধ্যে সংস্কৃতির পরিবর্তন কিংবা সংস্কৃতির বর্তমানতা কিংবা সংস্কৃতির অতীত নেই। বর্তমানহীনতা এবং অতীতহীনতার ইমেজ থেকে বিকল্প ভবিষ্যত তৈরি হয় না । এই ভবিষ্যত আশা: যা আমাদের দরকার যদি আমাদের টিকিয়ে রাখতে হয় লড়াই এবং প্রতিরোধ ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে । বৈষ্ণব , বৈরাগী , ডোম , চোর , ভিখিরীর ইমেজের প্রান্তিকতার মধ্যে আছে চূড়ান্ত এক আতঙ্ক , সমাজ এবং সংস্কৃতির নেতিবাদী উন্মোচন । সে হচ্ছে সমাজ এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাওয়া এবং কেন্দ্রে ফিরে আসবার চেষ্টা থেকে বিরত হওয়া । এ থেকে তৈরি হয় আত্মত্মমগ্নতা, আত্মত্মধিকার আত্মহত্যার প্রবণতা, এমনকি অপরাধ বোধ। বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত এই আত্মমগ্নতার বিভিন্ন ইমেজ বঙ্গীয় সংস্কৃতিকে আচ্ছন্ন করেছে । প্রান্তিকতার এই নির্মিতি কি একমাত্র কিংবা চরম ?

এই প্রশ্নটির ভিন্ন জবাব সুলতান এবং আবেদিন এবং কামরুল হাসান বিকল্পের মধ্যে খুঁজেছেন । শিল্পের মধ্যে অতীতের হাড়গোড় থাকে , যা কিছু ঘটছে তার রেশ থাকে , বর্তমানতা থাকে । যারা জীবন্ত, যেসব শিল্পী বেঁচে আছে তারা যদি অতীত এবং বর্তমানতা জনসাধারণের বেঁচে থাকার কেন্দ্র হয় , তাহলে শিল্পমাত্রের দরকার একটা জীবন্ত পরিসর , শিল্প থেকে যায় তখন সময়ের মধ্যে । এভাবে শিল্প সামাজিকতা এবং রাজনৈতিকতা খুঁজে পায় কিংবা সামাজিকতার এবং রাজনৈতিকতার ক্ষমতা অর্জন করে । শিল্পের ক্ষমতার মধ্যে ক্রিয়াশীল হয় অতীত এবং বর্তমানতার মানুষী স্মৃতি এবং আবেগ এবং অনুভব। এ হচ্ছে শিল্পের বিকল্প পরিসর : সুলতান ,আবেদিন, কামরুল হাসান এভাবে শিল্পকে অন্তরীণ করেছেন একটি জনসমষ্টির সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্মৃতির মধ্যে। সুলতান কিংবা আবেদিন কিংবা কামরুল হাসানের কৃষক কিংবা প্রান্তিক জনসমষ্টি সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্মৃতি অথবা সামাজিক এবং রাজনৈতিক বর্তমানতা। এসব কাজ কিংবা এদের কাজ বুর্জোয়া , জেনারেল , মন্ত্রী , আমলাদের খুশি করবার জন্য নির্মিত হয়নি । এসব কাজ কিংবা এসব ইমেজের লক্ষ্য সেসব যন্ত্রণা , উল্লাস যেসব বর্ণিত , বিশ্লেষিত , উদ্ভাবিত আমাদের চোখে এবং আমাদের বেঁচে থাকার মধ্যে । সেজন্য সুলতানের আবেদিনের কামরুল হাসানের বর্ণনা , বক্তব্য , বার্তা একই সঙ্গে ব্যক্তিক, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক, প্রাত্যহিক , ঐতিহাসিক এবং নাটকীয় । সুলতানের ‘ সৃজন ' আবেদিনের ' নবান্ন ' কামরুল হাসানের ' নবান্ন ' কাজ একই সঙ্গে বর্ণনা , বক্তব্য , বার্তা : এসবের পরতে পরতে আছে রাজনৈতিকতা, অর্থনৈতিকতা, ঐতিহাসিকতা , প্রাত্যহিকতা এবং নাটকীয়তা । কাজগুলি অনেক আয়তনের মধ্যে আমাদের নিয়ে যায়, তাদের অভিজ্ঞতার গতকাল এবং আগামীকাল এবং আমাদের অভিজ্ঞতার গতকাল এবং আগামীকাল মিশে যায় বিভিন্ন লক্ষ্যে । শিল্পীদের অভিজ্ঞতা থেকে শিল্পের অভিজ্ঞতা তৈরি হয় এবং দর্শকদের অভিজ্ঞতা থেকে শিল্পের অভিজ্ঞতা তৈরি হয় এবং দর্শকদের অভিজ্ঞতা শিল্পের অভিজ্ঞতার মধ্যে সংক্রমিত হয় । আবার দর্শকরা শিল্প ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় শিল্পীদের অভিজ্ঞতায় । এই ঘূর্ণায়মানতা থেকে তৈরি হয় বোঝার জানার দেখার ক্ষমতার বোধ। এই ক্ষমতার বোধ রাজনৈতিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করে । মার্ক্স সেজন্য লিখেছেন , ' প্রকৃতির মানবিক অন্তঃসার প্রথমত সামাজিক মানুষের জন্য বিদ্যমান; কারণ এ ক্ষেত্রেই কেবল প্রকৃতি বিদ্যমান তার নিজস্ব মানুষী অস্তিত্বের ভিত্তি হিসাবে । এ ক্ষেত্রেই কেবল তার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে মানুষী অস্তিত্ব, প্রকৃতি হয়ে ওঠে তার জন্য মানুষ। এভাবে সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ঐক্যসূত্র-প্রকৃতির যথার্থ পুনরুজ্জীবন-মানুষের স্বাভাবিকতা এবং প্রকৃতির মানবিকতা দুই-ই সম্পূর্ণতা পায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা যেভাবে বাংলাদেশে ব্যবহৃত এবং পরিচালিত তার মধ্যে এই সম্পূর্ণতার কোনো বোধ নেই । যা স্পষ্ট এবং উচ্চারিত তা লোভ , উদগ্র অন্ধলোভের গ্রাস।

সুলতান, আবেদিন, কামরুল হাসান এই লোভকে নেংটো করেছেন বিভিন্নভাবে। সুলতানের, আবেদিনের, কামরুল হাসানের কাজের পাশাপাশি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নয়নচারা এবং লালসালু, শওকত ওসমানের বনী আদম এবং জননী, শামসুদ্দীন আবুল কালামের পথ জানা নাই , আবু ইসহাকের সূর্য দীঘল বাড়ি , শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বউ এবং সংশপ্তক পড়ি তাহলে, গ্রাম, গ্রামবাংলা, কৃষক, কৃষকের ঘরগৃহস্থালী, অতীতময়তা এবং বর্তমানতার জীবন্ততা, ভয়াবহতা কদর্যতার মধ্যে মানুষ এবং কৃষকের বেঁচে থাকার ক্ষমতার রাজনৈতিকতা আমাদের চোখে ভর করে । আমরা বুঝি কেন এই ক্ষমতা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতার বোধের চেয়ে ভিন্ন , আমরা বুঝি কেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুর্ভিক্ষ , দেশ বিভাগ , দেশ শাসনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার লোভে আমগ্ন । আমাদের সমস্ত শরীর দিয়ে এই লোভকে অভিশাপ দেই। আমাদের সমস্ত শরীর ক্রোধে রি রি করে ওঠে , আমাদের ক্রোধে গেঁথে যায় তেভাগা , হাজং জিরাতিয়া , নানকার কৃষক বিদ্রোহ, আমাদের ক্রোধে পরিব্যাপ্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের ক্রোধে বেপরোয়া হয় এই সেদিনের সার বিদ্রোহ : আমরা অতীতের ক্রোধ দিয়ে বর্তমানে ক্রোধ দিয়ে বেঁচে থাকার ক্রোধ দিয়ে ঘেরাও করে রাখি রাজনৈতিক লোভের ঐতিহাসিকতাঃ এই হচ্ছে আমাদের কাছে, সাধারণ মানুষের কাছে জবাবদিহিতার শর্ত।

সুলতানের কাজ বহু ব্যাখ্যার দাবি করে না । বরং তাঁর কাজ শোনার জন্য অপেক্ষমান: আমরা, দর্শকরা কি বলছি, তা শোনার জন্য । আমরা তাঁর কাজ থেকে যে জবাব খুঁজি তার পরিসর তাঁর কাজের মধ্যেই আছে । তাঁর জীবন, তাঁর দারিদ্র, তাঁর লড়াই, তাঁর ভবঘুরেপনা সবই এখন জানা। কিন্তু তাঁর কাজ বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনকে কেন উদ্দীপ্ত করে তাঁর সঙ্গে তার জীবনচরিতের সম্পর্ক কম । সুলতানের কাজে দুরূহতা নেই , বাস্তব চেনা ; কাজটির মধ্যে কোথাও কোন চিহ্ন নেই  শিল্পীর লড়াইয়ের । ইমেজটি সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণতার মধ্য দিয়ে শিল্পী আস্তে আস্তে পটভূমি থেকে সরে যান এবং সম্পূর্ণ ইমেজটি চোখ দখল করে নেয় । বিষয়টি, বাস্তবটি কাছে এসে যায়।

সুলতানের বিশেষ আবেদন নিশ্চিতভাবেই শিল্পী হিসাবে তাঁর পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে তিনি দৃশ্যমানতাকে তাঁর ভিশনে বদলে দিতে থাকেন। এই প্রক্রিয়ায় বাস্তব হয়ে ওঠে অধিকতর বাস্তব, বাস্তবের চেয়েও বাস্তব। তাঁর ছবি আঁকার পদ্ধতির মধ্যে বাস্তবের এই রূপান্তরণ কিংবা বাস্তবের অধিকতর বাস্তব হওয়ার প্রক্রিয়াটি উদ্ভাসিত । বাস্তবের ইমেজটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং আমাদের ঘিরে ধরে । সেজন্য যখন আমরা তাঁর কাজটিকে দেখি তখন আমাদের চোখের সামনে কাজটি জ্বলজ্বল করতে থাকে, চেনা ইমেজ, যে ইমেজটিকে বহুবার আমরা দেখেছি । আমরা কাজটির মধ্যে অংশ নিই এবং ভাবতে থাকি সুলতানের ভিশন নিয়ে। আমরা ভাবি : কেন বাস্তব মাত্রই ভিশন হয় না।

সুলতানের কৃষকের ঘর-গৃহস্থালি, হালবলদ, জমির লড়াই বাস্তবের মধ্যকার বাস্তবের বোধ তুলে ধরেছে । সেজন্য এসব হচ্ছে বাস্তবের চেয়ে আরো প্রখর, আরো ক্ষিপ্র , আরো তীব্র । সুলতান একটি নির্দিষ্ট বাস্তবের মধ্যে একটি আবহমান বাস্তবের বোধ গেঁথে দিয়েছেন , আবার আবহমান বাস্তবের বোধ দিয়ে বিদ্যমান বাস্তবকে পরাভূত করেছেন । কখনো কখনো আবহমান বাস্তবকে ব্যবহার করা যায় আত্মরক্ষার জন্য এবং আক্রমণের জন্য। সুলতান সেই কাজটি করেছেন তাঁর পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ।

সুলতানের ফিগরসকল কার্ভ। একটি ফ্ল্যাট সারফেসে কার্ভ ফিগরসকল ভল্যুমের বোধ তৈরি করে এবং ফিগরসকলের মধ্যে আরও তৈরি করে তীব্রতা তাঁর ফিগরসকলের স্থান ইমেজের ক্ষেত্রে কার্ডের তীব্রতা আরও তৈরি করে দীপ্ততা। এভাবে তিনি তৈরি করেন চেনা ফিগরের মধ্যে যাদু :এ যেন সরলতার সঙ্গে জটিলতার এক দ্বান্দ্বিকতা । বিষয়ের সরলতা ফিগর নির্মাণের জটিলতার মধ্যে স্পন্দিত হতে থাকে : আমাদের চোখে দুই-ই পরপর কিংবা একসঙ্গে উদ্ভাসিত হতে থাকে। সরল বাস্তবের মধ্যে প্রোথিত থাকে জটিল বাস্তব, চেনা বাস্তবের মধ্যে গ্রথিত থাকে অধিকতর বাস্তব । সেজন্য অধিকতর বাস্তব বিদ্যমান বাস্তবের এক ধরনের সমালোচনা এবং অধিকতর বাস্তব আবহমান বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে বর্তমানতার সীমাবদ্ধতা করে স্পষ্ট।

সুলতানের ফিগরদের চোখে দৃষ্টি নেই। প্রায় পুরুষ ফিগর পেশল কিন্তু চোখে তাদের দৃষ্টি নেই এবং নারী ফিগরদের চোখ সম্মুখে নিবন্ধ নয় । এই সমস্যা আমাকে থেকে থেকে ভাবায় । এর কারণ কি তাঁর ফিগররা যা করে তাতেই আবদ্ধ, নিয়োজিত; প্রকৃতি / নিয়তি / ঈশ্বর কিংবা আল্লাহ কর্তৃক নিযুক্ত ? সে জন্য হয়তো তাদের মধ্যে একটা অন্ধ ঝোক আছে: তারা চাষে উন্মাতাল , লড়াইতে উষ্মাতাল , দৈনন্দিন কাজে উন্মাতাল । কাজের বাইরে পরপারে চোখ খুলে তাকাবার কোন অর্থ নেই কিংবা সময় নেই । তারা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ, নিজেদের পরপারে তাদের কোন আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই । তাদের ওপর ভর করেছে তাদের নিয়তি । তারা মগ্ন এবং তাড়িত । তাদের অভিজ্ঞতা গভীর । তাদের দাবি তাদের এভাবেই দেখতে হবে : বিকৃত, অতিরঞ্জিত, ' সুন্দর ' না করে । তারা যা তাই , এখানেই তাদের যথার্থতা ।

সুলতান এই যথার্থতাই খুঁজেছেন । তিনি বঙ্গীয় শিল্পের ইংরেজ-ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে জন্মাননি । ছবি আঁকার সমাজ পরিসর তাঁর ছিল না, এই সমাজ পরিসরের মধ্যে তিনি বেড়ে ওঠেননি এবং এই সমাজ পরিসর খুঁজতে হলে মিউজিয়ামে যেতে হয়।নড়াইলে কিংবা যশোরে কোন মিউজিয়াম নেই, মিউজিয়াম অনেক দূরে, কলকাতায় বৃটিশ বাংলার রাজধানীতে । সেখানে কৃষক সন্তান লাল মিয়ার স্বাভাবিকভাবে পৌঁছবার কথা নয় । তাঁর শক্তি তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এই অভিজ্ঞতার মধ্যে তিনি বেঁচে থেকেছেন এই অভিজ্ঞতাই তাকে শিল্পী হতে বাধ্য করেছে , কিন্তু বঙ্গীয় শিল্পের ঐতিহ্যে এই অভিজ্ঞতার কোন জায়গা নেই । তিনি এটা কি করে বুঝেছেন কোন মিউজিয়ামে কিশোর বয়সে না গিয়ে ? তিনি বুঝেছেন যে , তাঁর সমগ্র অভিজ্ঞতা তার সমাজস্থ ব্যবহারের বর্হিভূত এবং তিনি আস্তে আস্তে বুঝেছেন যে , শিল্প এক ধরনের ক্ষমতাই। যাদের আমরা আদিম বলি তাদের বিশ্বাস উৎসারিত হয় নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে এবং তাদের থাকে চারপাশের সমাজ সম্বন্ধে সন্দেহ । সুলতান এই প্রক্রিয়ায় নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাসী হন এবং সমাজ সম্বন্ধে সন্দিহান হন । শিল্পী শিল্পের বাধ্য হন এবং এই বাধ্যতা তৈরি হয় শিল্পীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে , যে অভিজ্ঞতা শিল্পের ঐতিহ্য থেকে বহির্ভূত। সংস্কৃতির শ্রেণী ব্যবস্থার বিরোধিতা করেই সুলতান শিল্পের শক্তি এবং গুণ অর্জন করেন । তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে তিনি বাদশা এবং এখানকার আশমানদারী তাঁর নিজস্ব নিয়মের অধীন । তাঁর শিল্পের নিয়ম তাঁর তৈরি করা।

শিল্পের ঐতিহ্য এবং শিল্পীর অভিজ্ঞতার মধ্যে ফারাক থাকতে পারে , যেমন থেকেছে সুলতানের ক্ষেত্রে। সুলতান এক পক্ষে বঙ্গীয় শিল্পের পেশাদারী ঐতিহ্য বিস্তৃত করেছেন এবং অন্যপক্ষে এই ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে শিল্পবহির্ভূর্ত অন্যান্য শ্রেণীর অভিজ্ঞতা প্রকাশের আয়তন তৈরি করেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত লড়াই, তাঁর ব্যর্থতা, বিরোধিতা সবই তাঁর প্রজেক্টের বিশালতর ইঙ্গিতবহ। শিল্প বহির্ভূত অন্যান্য শ্রেণীর অভিজ্ঞতা শিল্প ক্ষেত্রে বিস্তৃত করার প্রয়াস সঙ্কট মেলে ধরে । শিল্পের ঐতিহ্য তিনি ভেঙ্গে ফেলেছেন । ব্রিটিশ আমলের বঙ্গীয় শিল্পীরা অভিজ্ঞতার একটি সূত্র কিংবা উৎস ব্যবহার করেছেন । সেজন্য সে সময়কার শিল্প বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করেছে এবং চিত্রকলার সঙ্কীর্ণ অভিজ্ঞতার মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে । বিচ্ছিন্নতার অভিজ্ঞতার এক সূত্র হচ্ছে বৃটিশ শিল্প অনুসরণের প্রয়াস এবং অন্য সূত্র হচ্ছে মুসলমান সমাজ অভিজ্ঞতার পরপারে বিভিন্ন ধর্মজ পুরাণ অনুকরণ । এই দ্বিবিধ অভিজ্ঞতা পুনরাবৃত্তিত হয়েছে চিত্রকলার সঙ্কীর্ণ অভিজ্ঞতার মধ্যে । সেজন্য শিল্পক্ষেত্রে স্বাধীনতার পরিসর তৈরি হয়নি। জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান এবং সুলতান শিল্পক্ষেত্রে শিল্প বহির্ভূত অন্যান্য শ্রেণীর অভিজ্ঞতা এনেছেন এবং শিল্প ঐতিহ্য ভেঙ্গে ফেলার মধ্যে দিয়ে শিল্পক্ষেত্রে স্বাধীনতার সংজ্ঞা ও লুকানো আছে । অন্যের অভিজ্ঞতা শিল্পক্ষেত্রে স্বাধীনতার অপ্রত্যাশিত ভুবন উন্মোচিত করে, বাস্তবতার অন্য এক পৃথিবীর উন্মিলিত করে এবং বাস্তবের সেইসব বিষয় এবং ইমেজ যা স্বভাবত উল্লিখিত হয় না, সেইসব এবং একই সঙ্গে সেই সব বিষয় এবং ইমেজ যা স্বভাবত উল্লিখিত হয় না, সেইসব এবং একই সঙ্গে সেইসব বিষয় এবং ইমেজ যা হারিয়ে গেছে কিংবা লুষ্ঠিত হয়েছে কিংবা স্থানচ্যুত হয়েছে , সেইসব ফিরে ফিরে আসে । এ হচ্ছে দেশজ আধুনিকতার অন্য এক মুখ , দেশজ বাস্তবতার মুখোশহীন, নগ্ন মুখ, যে-মুখকে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বর্তমানতা ঢেকে রাখে এবং দেশজ আধুনিকতা মৌলিকতাকে আচ্ছন্ন করে রাখে ।

এই অন্যতার উদ্ভব এবং উদ্ভাবন এবং ব্যবহার বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান এবং সুলতান করেছেন মেসিয়ানিক আবেগে। সেজন্য তাঁরা তিনজনই শিল্পের মূলধারায় যেমন সংযোজন করেছেন, তেমনি মূলধারার মধ্যে অন্তর্ঘাতী ইমেজ এবং বিষয় লিপ্ত করেছেন । এই লিপ্ততার দরুন বাস্তবের উপস্থিতি এক পক্ষে বিরোধিতা করেছে শিল্পের প্রতিভাস, অন্যপক্ষে জীবন্ততার উদ্ভব এবং উদ্ভাসন ঘটেছে অন্য স্পেস থেকে। যেন এই উদ্ভব এবং উদ্ভাসনের মধ্য দিয়ে ন্যায়ের বোধ তৈরি করেছে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বিপরীতে।

ন্যায়ের বোধ শিল্পেক্ষেত্রে ? শিল্পের অর্থ যদি অভিজ্ঞতার উন্মোচন হয় তাহলে, সাধারণত একটি শ্রেণীর অভিজ্ঞতা এবং ঐ শ্রেণীর অপরাপর শ্রেণী সম্বন্ধে করুণাজাত অভিজ্ঞতা কেন শিল্পকে এবং শিল্পবোধকে দখল করে রাখবে? অভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক এবং অভিজ্ঞতার কোন একটি কেন্দ্র নেই । অভিজ্ঞতা বহু কেন্দ্রিক, বহু শ্রেণী এবং বহু স্তর উত্থিত, সেজন্য একটি অভিজ্ঞতা কিংবা একটি উদ্ভাবন শিল্পের পরিসর গ্রাস করে নিলে শিল্প থেকে স্খলিত হয় ন্যায়ের বোধ। এই বোধটির প্রতিষ্ঠার জন্য জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান এবং সুলতান লড়াই করেছেন। তাঁরা যে সময়ের বাসিন্দা সে সময়টা ঔপনিবেশিকতা এবং আধুনিকতার মধ্যবর্তী, কিংবা ঔপনিবেশিক গ্রামীণতা এবং আধুনিকতার ইউরোপীয় প্রবলতার মধ্যবর্তী, এই মধ্যবর্তী অবস্থান থেকে তাঁরা ফিরেছেন তাদের উৎসে । ফিরে তাকানোর মধ্য অতীতে প্রত্যাবর্তন নয়, অতীতকে বোঝার চেষ্টা । এই চেষ্টার জন্য ইউরোপীয় আধুনিকতার দিকে তাকানো দরকার ।

সুলতানের বিধি মোতাবেক আর্ট স্কুলে পড়াশোনা ছিল না বলে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছে স্থানচ্যুতির সত্য উত্থাপন করা । কৃষকরা নিজের দেশ এবং নিজের সময়ে স্থানচ্যুত, সেজন্য তারা নিজের দেশের সংখ্যালঘিষ্ঠ শিক্ষিত শ্রেণীর চোখের বিষয় নয়। এই স্থানচ্যুতি যেমন ঔপনিবেশকিতার কারণে, তেমনি আধুনিকতার কারণে।সেজন্য স্থানচ্যুতির মধ্য দিয়ে তাদের ঔপনিবেশিকতা অতিক্রমণ সম্ভব এবং আধুনিকতা দখল করা সম্ভব। এই অতিক্রমণ ঔপনিবেশিকতার সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে নয়, কিংবা নয় আধুনিকতার ধনতন্ত্রের মাধ্যমে। সুলতান এই বোধটাকে ধরতে চেয়েছেন, সেজন্য তাঁর ফিগরসকল আতঙ্ক ও উদ্বেগতাড়িত, একই সঙ্গে শান্তির মধ্যে স্বাভাবিক। তাঁর বিষয় একটা সম্ভাবনার দিকে উন্মীলিত, সেখানে তাঁর ফিগরসকল সব সময় উপস্থিত থাকার জন্য তাড়িত । সেজন্য তারা বিরাট বিষয় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে । তাঁর ফিগরসকল খাড়াখাড়া, তাদের শরীরের অভ্যন্তরের আয়তনে তারা প্রচণ্ড রকম জ্যামিতিক শরীরটাই তির্যক রেখা; তারা এতদিনকার অধিকারবোধ ধসিয়ে দিতে উদ্যত, তারা কাউকে গ্রাহ্য করে না এবং তাদের গ্রাহ্যে কিছু নেই ; তারা নিজেদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য দখল নিচ্ছে বিষয়,ক্যানভাস এবং দর্শকের চোখ । এতদিনকার বিষয়ের বদলে ভিন্ন বিষয় এবং দর্শকের চোখে এতদিনকার বিষয়ের বদলে ভিন্ন বিষয় । দর্শক জানতে বাধ্য হচ্ছে সুলতান এবং সুলতানের বিষয়কে। এও একধরনের ন্যায়ের বোধ প্রতিষ্ঠা শিল্পের মাঝে এবং দর্শকের চোখে।

সুলতানের কল্পনাকুশলতার ধরন ভাস্কর্যের মতো। ভাস্কর্যের প্রধান ক্ষেত্র মানুষের শরীর, সুলতানেরও তাই। তিনি যা বলতে চান মানুষের শরীরের পরিমাণেই তা বলা সম্ভব। তাঁর মনুমেন্টাল কাজের বিষয় হচ্ছে: মানুষের শরীর। সেজন্য শরীর হয়ে উঠেছে প্রতীক, শরীরের মধ্যে ভর করেছে প্রতীকময়তা, শরীর ফর্মে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন দিক। তিনি শরীরের সুন্দর নিয়ে ব্যস্ত কিংবা ব্যাপৃত নন, তিনি মগ্ন শরীরের ক্রিয়াশীলতা ,তার শক্তি , তার প্রতিরোধ , তার সীমাবদ্ধতা এবং তার রহস্যময়তা নিয়ে ।

শরীরের মধ্যে সুলতান কি খুঁজেছেন ? তিনি খুঁজেছেন আবেগ, আবেগের নাটক। তিনি ভেবেছেন শরীর হচ্ছে মন কিংবা হৃদয়ের অনুভবের প্রকাশ । তাঁর বিষয় : কৃষক । কৃষকের মন এবং হৃদয় কৃষকের শরীরে কোন ধরনের স্বপ্ন ,আকাঙ্ক্ষা , যন্ত্রণা , দ্রোহ তৈরি করে । সুলতান কৃষকের শরীরের মধ্যে এবং শরীরের মাধ্যমে এই প্রশ্নটা বুঝতে চেয়েছেন । সেজন্য তিনি একপক্ষে মানুষের শরীর এঁকেছেন, অন্যপক্ষে মানুষের শরীরটাকে কৃষকের অন্যদিকে আছে বেপরোয়াভাব । অভিজ্ঞতার এ দুটি দিক সুলতান ধরেছেন। এবং এ দুটি দিকের নির্যাস থেকে তৈরি করেছেন সহ্যশক্তি । এই সহ্যশক্তিটাই ছবিকে গ্রাস করে রাখে । সেজন্য তাঁর যে কোন ফিগরের দিকে তাকালে মনে হয় ফিগরটা বেড়ে উঠেছে ক্যানভাস ছাড়িয়ে ।

সেজন্য তাঁর ফিগরের সঙ্গে চারপাশের স্পেসের সম্পর্ক খাপ খাওয়ানোর। একটা সীমান্ত আছে, সীমান্তটা স্পষ্ট নয় । এভাবে তিনি তাঁর কাজের মধ্যে বহু ফিগর রেখে একটা স্পেসের বোধ তৈরি করে দেন । তাঁর কাজ সেজন্য ভিড়াক্রান্ত নয়, চারপাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাঁর বিশালতার এবং ওজনদার ফিগরসকল নিজেদের চলাফেরার জন্য একটা স্পেস পেয়ে যায় । সুলতানের এই কৃতিত্ব ঈর্যাযোগ্য । তাঁর ফিগরগুলির মধ্যে বেড়ে ওঠার বোধ আছে বলেই ফিগরসকল মনুমেন্টাল হয়ে ওঠে । এটা তাঁর কাজের একটা রহস্য।

জয়নুল আবেদিনের বিপরীত দিক থেকে সুলতান বাংলাদেশে চিত্রশিল্পে লাঞ্ছনা এবং ক্ষতকে আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন করেছেন । কৃষকরা দরিদ্র্য , তাদের দারিদ্র্য বাস্তবতার প্রকাশবহ । এই দারিদ্রের বাস্তবতা একই সঙ্গে আবহমান এবং শরীর করেছেন । এর মধ্যে একটা দূরত্ব আছে । শরীর এবং কৃষকের শরীরের মধ্যকার দূরত্ব তিনি সারা জীবন অতিক্রম করতে চেয়েছেন । তাঁর ট্র্যাজিডি তিনি এই দূরত্বের মধ্যে সারা জীবন হেঁটেছেন ।

এই দূরত্ব তাঁর চোখে স্বপ্ন এবং যন্ত্রণা তৈরি করেছে । তিনি কৃষকদের নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখতেন , আবার কৃষকদের বেঁচে থাকার নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় তিনি চিৎকার করতেন । স্বপ্ন দেখা এবং চিৎকার করার মধ্যে একটা বৈপরীত্য , একটা দ্বন্দ্ব আছে । তিনি স্বপ্ন দেখতেন মানুষের শরীর যেন মহান হয় । তিনি চিৎকার করতেন কৃষকের শরীর কেন লঙ্ঘিত হয় । প্রথমটির মধ্যে দ্বিতীয়টির অভিজ্ঞতা নেই । দ্বিতীয়টির অভিজ্ঞতা প্রথমটি থেকে দূরে । এই দ্বন্দ্ব এবং বৈপরীত্য থেকে তাঁর মনে একটা প্রশ্ন জাগ্রত হয় : কৃষকের দেশে কৃষকের অভিজ্ঞতা সর্বজনীন নয় কেন ?

এই প্রশ্নটা সুলতানের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে । আতঙ্ক তিনি অভ্যন্তরীণ করেছেন এবং অভ্যন্তরীণতার চাপে তার ফিগরসকল স্বাভাবিকতার পরিসরে বিশাল , ভারি , ওজনদার হয়েছে এবং ফিগরসকল কতকগুলো মৌল অভিজ্ঞতার সংকেত তৈরি করেছে । এই মৌল অভিজ্ঞতাগুলো কৃষক জীবন এবং অস্তিত্বের । এই জীবনটা কর্মাক্ত এবং ঘর্মাক্ত; এই অস্তিত্বটা নিষ্ঠুর । মোহনতা মদিরতা কোথাও নেই । কৃষকের মৌল অভিজ্ঞতার কেন্দ্র হচ্ছে : সহ্য শক্তি । জমির উত্তরাধিকার নষ্ট হলেও কৃথক সহ্য করে। জমিদার, ক্ষমতাবান, রাষ্ট্র অত্যাচার করলেও কৃষক সহ্য করে । প্রকৃতি বেপরোয়া হলেও কৃষক সহ্য করে । ঈশ্বর নিষ্ঠুর হলেও কৃষক সহ্য করে । এই সহ্য করার শক্তিটা তাকে আবহমান করেছে এবং এই কাজ করার শক্তিটার মধ্যে দিয়ে কৃষক সবাইকে পরাস্ত করেছে। এই শক্তিটা তাই কর্কশ, লাবণ্যহীন, রুক্ষ কোমল । সুলতান এই শক্তিটার বিভিন্ন দিক বার বার এঁকেছেন । সেজন্য তাঁর কাজে ভাস্কর্যের গুণ এসেছে বিশাল এবং ওজনদার ।

সুলতান তাঁর বিশাল এবং ওজনদার ফিগরসকল নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন প্রাত্যহিক বাস্তবতা । প্রাত্যহিক বাস্তবতায় তাঁর কৃষকরা অনুপস্থিত, বুর্জোয়া রাজনীতির বাস্তবতায় তাঁর কৃষকরা অধস্তন । তিনি তিন ধরনের বাস্তবতা চ্যালেঞ্জ করে এই কৃষকের গ্রামের রুক্ষ কদর্য নিষ্ঠুর জীবন ছবির মধ্যে নিয়ে এলেন, ছবির মধ্যে কৃষকরা একটা আবাসভূমি খুঁজে পেলেন এবং এই আবাসভূমিকে তিনি বাসযোগ্য করে তুললেন কল্পনার নান্দনিক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে । তাঁর ছবিতে কেউ একা নয়, সবাই যুক্ত , অনেক মানুষ গমগম করে । তাঁর কাজ তাই মূলত ভিড়, কিংবা অনেকের সঙ্গে এক সঙ্গে দেখার জন্য। এটা ভেবেই খুব সম্ভব তিনি তাঁর কাজ এমনভাবে নির্মাণ করেছেন । এক সঙ্গে দেখার কারণে সবাই অভিজ্ঞতার কোন না কোন অংশের মধ্যে মগ্ন হয় । এই মগ্নতার জন্য ব্যক্তিটি দর্শকের মধ্য থেকে একই সঙ্গে সুলতানের অভিজ্ঞতা এবং কৃষকের অভিজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যান। এই নিমজ্জনটাই সুলতান চেয়েছেন কিংবা সুলতানের কাজের বিশিষ্টতা । তিনি বার বার মনে করিয়ে দেন তিনি একা নন , তিনি কৃষকদের অভিজ্ঞতার মধ্যে মগ্ন এবং দর্শকরাও এই অভিজ্ঞতার মধ্যে মগ্ন হয়ে তার কাছে পৌঁছে যায় । তিনি নিজেকে পৌঁছে দেন কৃষকদের কাছে আর কৃষকদের মধ্যে । কৃষকদের অভিজ্ঞতা তাঁর এবং দর্শকদের মধ্যে ।

কৃষকদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আবহমান অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত রূপ। এই অভিজ্ঞতার একদিকে আছে লাঞ্ছনা, বর্তমান। সুলতান চোখের মাধ্যমে এই বাস্তবতাকে ছিড়ে দিয়েছেন, বাস্তবতার পরবর্তী আয়তন উন্মোচন করার জন্য , যাতে আমরা দর্শকরা এই উন্মোচনের পিছনকার সত্যের সম্মুখীন হতে পারি। সত্যের সম্মুখীন হওয়ার মর্ম আতঙ্কের সম্মুখীন হওয়া। সেজন্য তিনি বার বার দেখিয়েছেন যে, দৃশ্যমান হচ্ছে মায়া ,দৃশ্যমানতাই সবকিছু নয়, অদৃশ্যমানতার মধ্যে যে আতঙ্ক, তাকে মনে করিয়ে দেবার কৌশল মাত্র। সেজন্য কৃষক এবং তার কাজ দারিদ্রের যে চালচিত্র তৈরি করে তার পরপারে অন্য এক বাস্তব, অন্য এক সত্য আছে ।

সুলতান পরিণত বয়সেই দৃশ্যমান বাস্তব এবং অদৃশ্যমান বাস্তবের মধ্যকার আয়না ভেঙ্গে ফেলেছেন, দেখেছেন শরীর ভগ্ন, বিকৃত , লাঞ্ছিত। কৃষক জীবনের বাস্তবতা যেন এক দিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকার, সে অন্ধকার থেকে তিনি চোখ তুলে তাকিয়েছেন প্রতীয়মানতার ধ্বংসস্তূপের দিকে( তাঁর ব্রাশ স্ট্রোকের দিকে তাকালে তা বোঝা  যায় ), শরীরের টুকরো টুকরো অংশ তুলে এনেছেন, জোড়া লাগিয়েছেন । একটা তমিস্রা লক লক করে ওঠে তাঁর কাজে; সুলতান দৃশ্যমানতার বিচ্ছিন্ন, বিকৃত, বিখণ্ডিত টুকরোগুলো দিয়ে কাজে মগ্ন হয়েছেন । এসব ভাঙ্গা টুকরো , সেজন্য আমরা এর পিছনকার পটভূমি দেখি; আমরা দেখি দারিদ্রের আবহমান অন্ধকার।

এই প্রক্রিয়ায় এবং এই প্রকাশিতব্যের মধ্যে দিয়ে সুলতান বাস্তবতাকে অভিজ্ঞতার মধ্যে আয়ত্ত করেছেন । এনাটমি তাঁর জন্য একটা অনাবশ্যক কাজ, এই কাজের সঙ্গে শরীরের বর্বর যন্ত্রণার কোন সম্পর্ক নেই । সুলতানের কাজের সম্মুখে আমাদের চোথ শরীরের অংশ থেকে অংশে, হাত থেকে পায়ে, হাঁটু থেকে কাধে ঘুরে বেড়ায়, যেন আমরা একটা সিনেমা দেখছি। আমরা মগ্ন হই বিভিন্ন দিকে, একই সঙ্গে ; বিভিন্ন দিক একই সঙ্গে একটা সম্পূর্ণতা হয়ে আমাদের চোখ গ্রাস করে । নজির তাঁর শস্যক্ষেত্রে উৎসবের ছবি । সুলতান এঁকেছেন ক্ষেতের স্বর্গ থেকে উত্থিত তাড়িত সন্ত্রাস এবং ভয়ঙ্করতা । এক সার নারী তাদের শিশুদের নিয়ে সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে শয্যা পেতেছে, নারীদের শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আনন্দ এবং স্নেহ, তাদের হাতের পাশে শিশুরা কলরবে নিরাপদ। নারীদের, শিশুদের শস্যক্ষেত্রের এই আনন্দের মধ্যে তিনটি পুরুষ ফিগর তিন দিক থেকে উঠে এসেছে । তাদের পেশী ফোলা , তাদের শরীর ভয়ঙ্কর, তাদের চোখ নিষ্ঠুর, তারা রক্ষক কিংবা রক্ষা করছে একটা অসম্ভব । একটা ত্রাস তাদের শরীরে নারী শরীরের মোহনতার বিপরীতে, শিশু শরীরের মোহনতার বিপরীতে, শিশু শরীরের লাবণ্যের বিপরীতে। সুলতান এই তিনটি পুরুষ ফিগর এঁকেছেন ভয়ঙ্কর মগ্নতায় । তারা রক্ষক পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসেরঃ অসম্ভবের । তারা রক্ষক আবহমানকাল থেকে কৃষক, রমণী এবং শিশুদের ইজ্জতের, সেজন্য তারা অপেক্ষমাণ এবং হুঁশিয়ার সর্বনাশের বিরুদ্ধে, যে সর্বনাশ আবহমানকাল থেকেই দেখা দিয়েছে জমিদার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত, ক্ষমতাবানদের থেকে । সুলতান যেন বলছেনঃ ক্ষমতাবান যেন হাত না বাড়ায় রমণীর ইজ্জতের দিকে, শিশুদের কোলাহলের দিকে; গইয়ার মতো বলছেনঃ চিরকাল মানুষকে বলে যেও বর্বর না হওয়ার জন্য। ভালোবাসার এবং অন্ধকারের এক মহত্তম প্রকাশ সুলতানের এই কাজটি । এই তিনটি ফিগর যন্ত্রণায় উত্তোলিত, সুলতান তাদের রক্ষক করেছেন বাংলাদেশকে লুণ্ঠন থেকে বাঁচাবার জন্য; বাংলাদেশের লুণ্ঠিত নিসর্গের অভ্যন্তরে থেকেই এই তিনটি ফিগর আবহমান উঠে এসেছে সর্বনাশের বিরুদ্ধে । এক অসম্ভবের রক্ষক তারা, সুলতানের এই তিন পুরুষ ফিগর ।


তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫


Share

Recent Comments

Recent Articles