এই নষ্ট সময়ে আমার ঘুম আসে না

বেশ অনেক বছর আগে নড়াইলে এক পাগলা লোক ছিল, নাম শেখ মোহাম্মাদ সুলতান। শুকনা পাতলা লোক, চোখে চশমা আর মুখে হাসি। লম্বা চুল ছিল লোকটার। তবে কন্ডিশনার দেয়া সিল্কি চুল না, হাতের তালু ভর্তি করে নিয়ে নারকেল তেল দেয়া চুল। যারা গ্রামে বড় হয়েছেন তারা উঠোনে বসে মা চাচীদের চুলে তেল দেয়া কল্পনা করে নেন। এই লোকের ছিল অদ্ভুত এক শিল্প সত্তা। উনি বোধহয় উনার চশমায় বাচ্চাদের দেখার দৃষ্টি ফিট করে নিয়েছিলেন, কারণ তার দেখার চোখের সাথে আমি এখনো আর কারও দেখায় মিল পাই নাই। উনি উনার মত করে আপন দুনিয়া সাজিয়ে নিয়েছেন। সে এক মজার দুনিয়া। 

শুরুতেই বলে নিছি পাগলা কিছিমের মানুষ। কেন জানি আমেরিকান ড্রিম ফ্রিমের দৈন্য উনারে স্পর্শ করতে পারে নাই। শিল্প বেইচা মেলা ট্যাকা কামানোর ধান্দা বাদ দিয়া উনি ঠিক করলেন গ্রামে থাকবেন। উনার উঠানে সাপ আর বেজি একসাথে খেলবে, আর উনি মনের আনন্দে দেখবেন। সবাই যখন আখের গোছাতে ব্যস্ত তখন উনি ঠিক করলেন স্কুল করবেন। তো বানাইলেন স্কুল, সেই স্কুল আবার নৌকার মধ্যে (স্বাধীনতার পর প্রথমে নীলক্ষেতে আর পরে নড়াইলে নৌকা স্কুল)। ঐ আমলে ডেঙ্গু ছিল কিনা জানিনা তবে মাঝ নদীতে নৌকার মধ্যে না আছে গরম না আছে মশা। সুলতানের দেখা বাংলাদেশের সবচাইতে সেক্সি বিষয় ছিল বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ। জমিতে হাল চালানো বা কাঠ ফাড়াই করা ঘামে ভেজা হাতের ফুলে ওঠা পেশি বা এক প্যাঁচে শাড়ি পড়া স্ফীত স্তনের গৃহবধূর মধ্যে উনি যে আবেদন দেখেছেন, তা আর কেউ দেখেনি অমন করে। এই লোকটাকে সারা পৃথিবীর মানুষ এস, এম সুলতান নামে চেনে। 

পুরো দেশ এমন পাগলে দিয়ে ভরে গেলে কত সুন্দর একটা দেশ হতো আমাদের। হয়তো ক্ষমতার গরম থাকত না, আলগা পয়সার ফুটানি থাকত না, জিমের আয়নায় তোলা সেলফি থাকতো না কিন্তু শান্তি থাকত ঘরের কোনায় রাখা পানির ঘড়ায় বা এক ছিলিম হুঁকার তানে। এমনটা হলে হয়ত সিনপ্লেক্স এর পপকর্ণের বদলে কোচিং পালানো মেয়েটা হাটখোলার মেলায় ভুট্টার খই আর বাতাসা কিনে খেত, কিনত কয়েক গাছি রেশমি চুড়ি। স্কুল পালানো ছেলের দল হয়ত রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখে শিটি না বাজিয়ে দল বেধে কাঁদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলতো আর খেলা শেষে চলত মাঝ নদিতে দাপাদাপি। আপনি আমি হয়ত মা দিবসে ইমোশনাল  টিভিসি শেয়ার না দিয়ে রান্না ঘরে মায়ের গলা ধরে ঝুলে পরতাম আর মা কপট বিরক্তি দেখিয়ে মুচকি হেসে বলত, দূর হ সামনে থেকে। তখন হয়তো কোন প্রেমিক মেকআপ দিয়ে কন্ট্যুর করা ক্লিভেজ না খুঁজে প্রেমিকার বুকে কাঁঠাল চাপার গন্ধ খুঁজত। তবে ভয়ের কিছু নে। সুলতানরা হাজার বছরে একবার আসে, একটাই আসে। তাই আপনার এত সাধের ব্যাস্ত জীবন কেউ কেড়ে নেবেনা। 

আমার ছোটবেলা থেকে খুব শখ ছিল এই লোকটাকে দেখার, উনার মত করে দুনিয়া দেখার। যদিও আমি উনার শিল্পবোধ ধারণের যোগ্য নই তবুও কেন জানি একটা টান ছিল। সুলতান চলে গেছেন আমার শৈশবেই আর সে সুযোগে আমিও আমার চোখে অম্ল ঢেলে নিয়েছি। কিন্তু আমার সুলতানের কথা মনে পরে, লালনের কথা মনে পরে, শাহ আব্দুল করিমের কথা মনে পরে। যেন ওরা আমার ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু। আজো মাঝ রাতে তাদের প্রাণ খোলা হাঁসির শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এই নষ্ট সময়ে আমার ঘুম আসে না।

এস এম শার্দূল ইসলাম

৩৮ ব্যাচ ইংরেজি বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

Share

Recent Comments

Recent Articles