এস এম সুলতান

লাল মিয়ার গোটা জীবনটাই বড় অদ্ভুত যেন ধরা ছোয়ার বাইরে কোনো গল্পের জীবন। সত্য - মিথ্যায় মাখামাখি হয়ে সন্ধ্যার আলো - আঁধারীর মতো বহু কাহিনী কিংবদন্তী হয়ে ছড়িয়ে গেছে মানুষের মুখে মুখে তাকে নিয়ে । অনেকের বিশ্বাস, লম্বা একহারা গেরুয়াপরা সেই মানুষটি গলায় জ্যান্ত শঙ্খচুড় সাপ পেচিয়ে রুক্ষ বাবরি চুল হাওয়ায় উড়িয়ে পাড়াগাঁর জঙ্গলে জঙ্গলে রাত - বিরেতে ঘুরে বেড়ান একাকী । শ্যাওলা পড়া, জঙ্গলে ঢাকা পোড়ো বাড়িতে হিংস্র সব বুনো জন্তুদের সঙ্গে রাত কাটান তিনি।অমল-ধবল জ্যোৎস্না নিঃশ্বব্দে যখন তার সমস্ত কিরণ ঢেলে দেয় ঘুমন্ত গ্রামে, জঙ্গলের মধ্যে জেগে ওঠে ঝিঁঝিঁ পোকার দল, গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে দু'একটি শেয়াল, লক্ষ্মী পেঁচা হিজলের ডাল থেকে ' পাখায় জ্যোৎস্না মেখে উড়ে যায় শিকার করতে, গাছের গাঢ় কালচে সবুজ পাতা আর শান্ত নদীর বুক ঝিকমিক করে ওঠে স্বপ্ন দৃশ্যের মতো, অদ্ভুত সব ছায়া পড়ে সবুজ মাটির বুকে, কি যেন বলতে চেয়ে ভাষাহীন শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাকুল - আকুল হয়ে ওঠে দিগন্ত চরাচর।' ঠিক তখন চঁাদের আলোয় হিম হিম বাতাসে কোন সুদূর থেকে যেন ভেসে আসে বাঁশির সুর। প্রকৃতির সেই না বলা বাণী, সুখ-দুঃখের অতীত কোনো এক অনির্বচনীয় বোধ, গাছের পাতার মতো দুলে দুলে কখনও সূর্য কিরণের মতো নির্ভীক সাবলীলতায়, কখনও দুষ্টু মেয়ের চটুল - চলনের মতো এঁকেবেঁকে, কখনও মনউচাটন করা উদাস অভিমানে হুহু বাতাসের সঙ্গী হয়ে বয়ে যায় । মাঝ রাতে যাদের ঘুম ভেঙ্গে যায় আচমকা— কান পেতে তারা হৃদয়ের মধ্যে সেই শুশ্রূষার মতো সুর পুরে নিতে নিতে বিড় বিড় করে ওঠে' পাগলা লাল মিয়ায় বাঁশি বাজায় । মুখে না বললেও তাদের অনেকের গোপন ধারণা , লাল মিয়ার সঙ্গে জান - পরীর আছর আছে- না হলে রাত দুপুরে গহীন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় , ভাঙ্গা মন্দিরে ঘুমায় কেমন করে ? গ্রামের নিরক্ষর দেহাতী মানুষদের এই বিস্ময় জাগানিয়া প্রশ্নের মতো শহুরে শিক্ষিত আলোক প্রাপ্তদেরও বিস্ময় একইভাবে প্রকাশিত হয় , কেমন করে লাল মিয়া তার জীবন কাটাচ্ছেন । কিসের শক্তিতে । আধ্যাত্মিকতায় , পরম মোক্ষ লাভে বিশ্বাস নেই লাল মিয়ার- তাহলে কিসের শক্তিতে তিনি জীবিতকালেই নিজের জীবনকে কিংবদন্তীর অমরাবতীতে পৌঁছে দিলেন ? খোদ লাল মিয়াকেই যদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয় তবে তিনি স্মিত হাসবেন তার চোখে ঝিকিয়ে উঠবে নিঃশব্দ বিদ্যুৎ , তোবড়ানো গালে পড়বে পরিচিত মায়া মমতার স্নিগ্ধ ভাজ । তারপর বলবেন , কই আমি তো কোনো বিস্ময়কর জীবন কাটাই না । এখানেই আমার জন্ম এখানেই আছি । ঐ যে লোকজন বলে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর গল্প , সে অনেক দিন আগের কথা সব তার সত্যিও নয় । এখানে পুরনো এক ভাঙ্গা জমিদার বাড়ি ছিল । মন্দিরও ছিল । সাপখোপ এসব পুরনো ইটের পাজায় হরহামেশাই দেখা যায় । আমি চেষ্টা করেছিলাম বাড়িটাকে মেরামত করে একটা স্কুল করার । সে সব পঞ্চাশ দশকের কথা । এখন তো আর ইচ্ছা হলেও বন - বাদাড়ে ঘুরতে পারি না । বাশিও ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন হয় । আগে লোকজন আসত রাতভর তাদের বাশি বাজিয়ে শোনাতাম । এখন ছোটছোট ছেলে মেয়েরা আসে আঁকা শিখতে বেশ ভালইতো আছি । কোনো অসুবিধে হয় না । এখানকার মানুষরা আমাকে খুব ভালবাসে । বাইরে থেকে এসে দেখেন বলে আপনাদের অদ্ভুত মনে হয় । গ্রামের জীবনই তো আসলে আমাদের দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবন । আমার জীবনও তাই । ' অদ্ভুত ' ' অস্বাভাবিক ' বলে কিছু নেই এতে । 

লাল মিয়া কিন্তু এই কথাগুলো এক সঙ্গে একটানা বলেননি । থেমে থেমে দম নিয়ে ভাঙ্গা ক্ষীণ খসখসে শব্দে কথা বলেন এখন তিনি । সত্তরটি ' ষড়ঋতু ' পার হয়ে গেছে তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে । এককালের পিঠের মাঝ অবধি নেমে আসা রেশমী কালো ঢেউ এখন চৈত্র মাসের ক্ষীণ মরা স্তব্ধ নদীর মতোই । সেখানে সাদা - কালোর জটিল দ্বন্দ্ব । নাকে চেপে বসা কালো ফ্রেমে বাধা মোটা ঘোলাটে লেন্সের ভিতর দিয়ে তাকালে স্পষ্টই তার চোখে দেখা যাবে বেলা শেষের কমলা রোদের আভা । সামনের দুপাটির দাতগুলো তাদের জন্মস্থান ফেলে মহাকালের জিন্নায় চলে গেছে অনেক দিন হয় । মাড়িতেও নেই তারা অনেকেই । লম্বাটে ধাচের মুখটি তাই দুখালের পাশে বেশ তুবড়ে গেছে । দুই ভ্রু'র মাঝখানে , কপালে আর ঐ তোবড়ানো গালে জবরদস্ত করছে সব ব্যাকরণহীন রেখার দাগ । কাঁচা ফলের মতো নেই আর ত্বক খসখসে যেন ধুলো মাটির দাগ লেগে গেছে তাতে । বাংলার এক অজপাড়াগার হতদরিদ্র কৃষকের ঘরে তার জন্ম । কৃষকের ঘরে তো আর রাজপুত্র জন্মে না , রাজার চেহারাটি পাননি তিনি । কিন্তু রাজার আসন পেয়েছেন । সে আসন পাতা আছে বাঙালীর বুকের মণিকোঠায় । লাল মিয়া সুলতান হয়ে সেই আসনে বসে আছেন যার মতো আর কেউ নেই আমাদের । 

লাল মিয়া কেমন করে সুলতান হয়ে গেলেন আমাদের হৃদয়ের এবং জাতিরও সেটা জানতে হলে একটা গল্পের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আমাদের । সুলতানের জীবনটা আমাদের কাছে এ জন্য গল্পের মতো মনে হবে যে , আমরা নিজেদের জন্য বাস্তবে এ রকম জীবন আশা করব না কখনও । অনেকটা দেবদাসের জীবনের মতো তাঁকে ভালবাসব , কাদবও তার জন্য কিন্তু কিছুতেই চাইব না দেবদাসের মতো হোক নিজের জীবনটি । সুলতানের নিজের জন্য বাস্তব এবং আমাদের জন্য গল্পের মতো , তার জীবনটি শুরু হয়েছিল ১৯২৩ সালের আগস্ট তৎকালীন নড়াইল মহকুমার মাছিমদিয়া গ্রামে । পিতা শেখ মেছের আলী ছিলেন প্রান্তিক কৃষক । টুকটাক রাজমিস্ত্রিীর কাজও করতেন । সব পিতার মতো তারও স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে ছেলে ‘ মানুষ ’ হোক । তাই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন ছেলেকে । লাল মিয়া কিন্তু স্কুল পালালেন , ' মানুষ ' হওয়ার প্রথাবদ্ধ পথ ফেলে চলে গেলেন সুলতান হয়ে ওঠার পথে।

‘ বই পুস্তকের ছাপা অক্ষরের চেয়ে ছবিগুলো আমার ভাল লাগত বেশি এরকম করে বলেছিলেন তিনি । ছবি দেখতে দেখতে ইচ্ছা হয় আঁকার । রং পেন্সিল কিনে দেয়ার টাকা ছিল না পিতার । লাল মিয়া কাঠকয়লা দিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন , পাকা পুঁই বিচির রস , কাঁচা হলুদের রস দিয়ে রাঙাতেন সেই সব ছবি । প্রকৃতি একেবারে নির্গুণ করে কোন মানুষকেই পাঠায় না পৃথিবীতে । নিজের সেই প্রকৃতিদত্ত উপহারটি খুঁজে বের করে সেই গুণকে কাজে লাগানোই মানুষের সত্যিকারের কাজ । সুলতান খুব শৈশবেই খুঁজে পেয়েছিলেন প্রকৃতি কোন গুণটি দিয়ে দিয়েছে তার মধ্যে । জেনেছিলেন কোন কাজটি করার জন্য পৃথিবীতে জন্ম তার । সে কাজ রং - তুলি পেন্সিলের কাজ । ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে তাই একজন শ্রমিক বলেই ভাবেন সুলতান । এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই মানুষের মধ্যে সাম্যকে লক্ষ্য ও উপলব্ধি করেন তিনি । প্রত্যেক মানুষকে তার নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ , স্বাধীনতা , নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দেয়ার মতো সামাজিক অঙ্গীকারের প্রয়োজন অনুভব করেন তীব্রভাবে। আমাদের সমাজ - রাষ্ট্রে এর অনুপস্থিতি নিদারুণ উদ্বিগ্ন অসুখী করে তোলে তাকে এই বুড়ো বয়সেও । 

নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় জীবনের মোড় পালটে যায় লাল মিয়ার । জমিদার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপধ্যায় ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল পরিদর্শনে এলে লাল মিয়া তার একটি পোর্ট্রেট এঁকে তাকে উপহার দেন । সেই থেকে শুরু আজ পর্যন্ত তার ছবি আঁকা , যে কোনো মানুষের ‘ বিস্ময় আর ভাল লাগার ' প্রসঙ্গ হয়ে আছে । মানুষের এই ভাল লাগা ভালবাসাকে সঙ্গে নিয়েই পঞ্চম শ্রেণীর লাল মিয়া বেড়াতে চলে এলেন কলকাতা । নড়াইলের জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় থাকতেন কলকাতায় । শিল্পরসিক মানুষ ছিলেন তিনি । কলকাতায় লাল মিয়ার থাকা - খাওয়ার ব্যবস্থা হলো তার চেষ্টাতেই । ' কলকাতা দেখে অবাক হওয়ার জন্য সেখানে যাননি সুলতান । সুলতানের অবিচল লক্ষ্য আর অদম্য ইচ্ছা ছিল কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য । কিন্তু কাজটি মোটেই সহজ ছিল না তার জন্য । তখন ন্যূনতম এন্ট্রান্স পাস করে আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার নিয়ম ছিল । আর্ট কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মুকুল দে ছিলেন কড়া প্রিন্সিপল এর মানুষ । নিয়ম বরখেলাপ করে কিছুতেই তিনি ভর্তি করিয়ে নেবেন না সুলতানকে । ' আমারও জেদ চেপে গেল ভর্তি হবই বললেন সুলতান। শুধু প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক হিসাবেই নয় , সামাজিকভাবেও অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দী তাকে গিয়ে আবদার জানালেন লাল মিয়া । দুটো কাজ হলো এতে । নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন তাকে এবং আর্ট কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে বহু কথাবার্তা বলে রাজি করালেন লাল মিয়াকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অনুমতি দিতে । লাল মিয়ার ছবি দেখেই শাহেদ সোহরাওয়ার্দী অনুভব করেছিলেন ' পারবে এই ছেলে । অনেক বড় কিছু পারবে তার জীবনে । ' মিথ্যা হলো না তার বিশ্বাস । ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হলেন সুলতান । গুঁড়িয়ে গেল আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার বাধা । রাত থেকে দিন হওয়ার মতো আমুল পাল্টে গেল তার জীবন । সেটা ১৯৪১ সালের ঘটনা , এর পর থেকে দীর্ঘ একটি সময় শুধুই সুলতানের সাম্রাজ্য বিজয় সেখানে লাল মিয়াকে আর খুঁজে পাবনা আমরা ।

আর্ট কলেজে টানা চার বছর আঁকা শিখলেন সুলতান । নিজের ক্ষেত্র পেয়েছেন ভা করে । নিজের সবটুকু ঢেলে দিলেন নিষ্ঠায়- মমতায় । প্রথম বছরের পরীক্ষায় দ্বিতীয় হলেন । তার পরের দু'বছর প্রথম হলেন পরপর । ছেলের মতোন ভালবাসতেন শাহেদ সোহরাওয়ার্দী কোন অভাব বোধ হয়নি সুলতানের কখনও । সে বাড়ির দোতলায় ছিল প্রকাণ্ড লাইব্রেরি । দুনিয়ার বিখ্যাত সব চিত্রকরদের শিল্পকর্মের প্রচুর ছবি আর সেরা সেরা সমালোচকদের বই পুস্তকে ভর্তি ছিল সে লাইব্রেরি । সুলতান হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলেন যেন ' সাতরাজার ঐশ্বর্য ' । মনে ও মগজে গেঁথে নিলেন সেইসব অমূল্য বৈভব । সে সময় আর্ট কলেজের পুরো কোর্সের মেয়াদ ছিল ছ'বছর । সুলতান হাঁফিয়ে উঠলেন চার বছরেই । স্নেহ - যত্ন , আদর - আপ্যায়ন সবই পেয়েছিলেন ভরা নদীর মতো অবারিত ধারায় । তবু সেই যে কথা বলেছেন জীবনানন্দ ‘ স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয় । আমি তারে পারি না এড়াতে ........।' সুলতানও পারেননি এড়িয়ে যেতে সেই বোধের আহ্বান । তাঁর মনে হয়েছিল ' সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর স্বাদ কই ! ’ এক বছরের সিনিয়র জয়নুল আবেদিন , সহপাঠী কামরুল হাসান , প্রিয় শিক্ষক সতীশ সিনহার ভালবাসা , সোহরাওয়ার্দী পরিবারের অপত্য স্নেহ অদূরে দাঁড়ানো সোনালী সাফল্য কিছুই বেঁধে রাখতে পারেনি সুলতানকে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে । সংসারের সঙ্গে । সকলের মধ্যে থেকেও যেন 'নিজের মুদ্রাদোষে' একদিন আলাদা হয়ে গেলেন । বোধহয় সেই ১৯৪৪ সালে দুরন্ত লাল মিয়া হঠাৎ জেগে উঠেছিল সুলতানের মধ্যে । হঠাৎই একদিন আবার কলকাতা ছেড়ে ভারত দেখতে বেড়িয়ে পড়লেন সুলতান । যেমন আঁকার প্রতিভা তেমনি মানুষের প্রতি গভীর বিশ্বাস আর দায়বদ্ধতাও যেন জন্ম থেকেই সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সুলতান । রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ‘ মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ । আর সুলতানের বক্তব্য হচ্ছে ' পৃথিবীর সব বড় বড় ঘটনা , মহৎ ঘটনারই জন্ম দিয়েছে মানুষ । মানুষ অনেক পেরেছে অতীতে , তাই ভবিষ্যতেও আরও অনেক কিছু পারবে । মানুষকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই । ' তাঁর কণ্ঠস্বর শরীরের দুর্বলতা ছাপিয়ে সুরের আবাহনের মতো উঠে যাচ্ছিল উচ্চগ্রামে । যেন তাঁর বিশ্বাস দিয়ে তিনি ভরিয়ে দিতে চান সময়ের শূন্যতা যেন ব্যর্থতা; যেন ব্যর্থতা, অবিশ্বাস  ব্যক্তি কেন্দ্রিকতার মায়াবী জাল আর সকল নেতিবাচকতাকে আপন বিশ্বাসের আঘাতে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে মহামানবের মিছিল বাধাধীন দ্বিধাহীন এগিয়ে যাবার জন্য এক দিগস্ত জোড়া পথ তৈরি করে দেবেন । এই বিশ্বাসকেই সুলতান রূপে অবয়বে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ক্যানভাসে । তাঁর বিশ্বাসের প্রতিনিধি হয়ে তাই মানুষ বারবার এসেছে পট জুড়ে । হয়ে উঠেছে আঁকার প্রধান বিষয় । মানুষের সঙ্গে আর যা এসেছে তা প্রকৃতি । সে প্রকৃতিও অদম্য - আদিম নয় । বরং অদম্য মানুষেরাই । তারাই বশ মানিয়েছে প্রকৃতিকে । তৈরি করে নিয়েছে মানবিক পরিবেশ । সুলতানের নিসর্গ তাই প্রকৃতির আদিম রূপ ও শক্তির বিরুদ্ধে নিরস্তর সংগ্রামশীল মহামানবেরই জয়গান ।

 সুলতানের জীবনের এই অংশটিকে অনায়াসে আমরা ‘ প্রব্রজ্যা পর্ব ' বলতে পারি । কলকাতা ছেড়ে সোজা দিল্লী রওনা হয়ে গেলেন । কলকাতা ছাড়ার আগে আরও একটি কাজ করেছিলেন সুলতান । ' মানুষ ' যার বিশ্বাস আর ভালবাসার বিষয়-মানুষের কাছ থেকে তার দূরে সরে থাকা এক কথায় অসম্ভব । কলকাতাতেও তিনি আভিজাত্যের গজদন্ত মিনার থেকে ধূলোমাটিতে লেগে থাকা সংসার যাদের সেই সব মানুষের কাছে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন । ' খাকসার ' নামে এক বিখ্যাত আন্দোলন হয়েছিল সে সময় ভারতে। মুসলমানদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনের রাজনৈতিক চেতনা তেমন তীক্ষ্ণ ছিল না । সামাজিক আন্দোলনের মতো ব্যাপারটি, ধর্মীয় জাতীয়তার কথা ছিল প্রছন্নভাবে । মৃতদেহ সৎকার , পথঘাট সংস্কার এ সবই করে বেড়াতেন খাকসারের সভ্যরা । ভারতের বহু অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষের বহু বিপন্ন সময়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন উষ্ণ করতল । ভারত তাই একেবারেই অচেনা ছিল না তার কাছে । কোথায় যাবেন তা এক রকম ঠিক করাই ছিল মনে মনে । দিল্লী থেকে লখনৌ । সেখান থেকে হিমালয়ের দুর্গম পাহাড়ী পাদদেশ । কোথায় দেরাদুন , কোথায় কন্যাকুমারীকা , কোথায় মুসৌরী — একা পায়ে হেঁটে হেঁটে সুলতান নামের এক ঝকমকে যুবক যাচ্ছে এগিয়ে- কেমন ছিল সে সময় তাঁর অবয়ব, চুল কি নেমে এসেছিল কাঁধ ছাপিয়ে তুলিধরা হাত কেমন বিদ্যুত রেখার মতো খেলে যেত ক্যানভাসের ওপর দিয়ে- সে সব জানবার কোন উপায় নেই আমাদের । পাখিরা উড়ে উড়ে কোথায় না কোথায় চলে যায় তবু তাদের একটি লক্ষ্য থাকে - সুলতান পাখিদের চেয়েও চঞ্চল । হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়ী প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য তার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল ঐ প্রজাপতির চাঞ্চল্য । কোথাও থামতে চাননি । যেন এক বিশাল পুরুষ প্রজাপতির মতো পুরো এলাকাটিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব- উপভোগ করে যাবার এক অদম্য বাসনা ঝর্ণার মতো ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল তাঁর মধ্যে সে সময়। উঁচু - নিচু - দুর্গম উপত্যকা টপকে তিনি এসে থমকে গেলেন কাশ্মীরে। সেখানে তখন নর্থ - ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তুমুল ডামাডোল । সুলতান সে সব গায়ে মাখলেন না । গোঁড়া সৈন্যদের পোর্ট্রেট এঁকে পয়সা কামিয়েছেন আর দু'হাতে তা উড়িয়ে দিয়েছেন কাশ্মীরী হাওয়ায় । লেপ্টে থেকেছেন কাশ্মীরী নিসর্গ শোভায় । বলা যায় , প্রায় বুঁদ হয়ে পড়েছিলেন । এই একটি সময়ে সুলতানের মতো একজন সংবেদনশীল অন্তরের, তীক্ষ্ণ মেধার ও অত্যন্ত বড় মাপের স্রষ্টা মানুষটির মধ্যে সামান্য বিরোধাভাস লক্ষ্য করব । ' লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ' শ্লোগান বাতাসে উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়েছে , তার ওপরে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামাজিক ধাক্কা অথচ সুলতানের মধ্যে এসবের স্পষ্ট কোন প্রতিধ্বনি নেই। এ না থাকা যে পাপ-তা নয়।কিন্তু কেন তা নেই, তা অামাদের অনেকেরই জানতে ইচ্ছা করে । 

 সুলতান জানালেন , ' আমার কাজ ছবি আঁকা , এটা আমি অল্প বয়সেই বুঝেছিলাম । আর সব বাদ দিলেও রাজনীতি করতে গেলে অনেক প্রথাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে থাকতে হয় , অবাধে যাবার - আসবার ইচ্ছার স্বাধীনতাটুকু হারানোর ক্ষতিকে মেনে নিতে হয় । এই ক্ষতিটুকু মেনে নিতে ইচ্ছা হয়নি । রাজনীতি আমার কাজ না , আমি জানতাম । আমার কাজ ছবি আঁকা আর ঘুরে বেড়ানোর নেশা । আমি রাজনীতি করিনি যাকে রাজনীতি করা বলে সে রকম করে ।

' সুলতান বললেন , সে রকম রাজনীতি করেননি , তিনি তবে কি রকম রাজনীতি করেছেন ? এত সব টুকটাক প্রশ্নের জবাব দেয়ার শারীরিক সামর্থ্যই রাখেন না তিনি আর । অপারেশন হয়েছে তাঁর । কাটতে হয়েছে চোখ। হাঁপানি দীর্ঘদিন আগে বুকের মধ্যে এসে যেন হাঁটু ভেঙ্গে অচল হয়ে পড়ে আছে । একটানা তিনটে বাক্য বলতেও শ্বাসকষ্ট এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে প্রচণ্ড পরিশ্রান্তের মতো খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয় তাঁকে । তাই কিছু কিছু কৌতূহলের জবাব আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে তার জীবন ও কর্মের মধ্যে দিয়ে । আমরা তো সবাই জানি যে ' বৃক্ষের পরিচয় তার ফলেই ' । রাজনীতির অর্থ ও উদ্দেশ্য হয়ে থাকে মানুষের মধ্যে মহত্বকে জাগিয়ে তুলে সহমর্মিতাকে উৎসাহ দিয়ে একটি নিরিবিলি শাস্তিময় মানবসমাজ নির্মাণ এবং সেখানে জীবনের অর্থ আবিষ্কারের উদ্যোগ গ্রহণ , তবে সে কাজ সমস্ত অন্তর ঢেলে দিয়েই করেছেন তিনি । মানুষের শক্তি, সৃষ্টি , আর সম্ভাবনাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর রেখায় - বর্ণে । এবং তাঁর সামনে কোনো প্রহেলিকার অস্পষ্ট মায়াবী জাল বিছিয়ে দেননি তিনি । ' কুশলী ’ নন তিনি । খুব সহজেই এই অভিযোগ তোলা যায় তাঁ বিরুদ্ধে।বলা যায় - বড় বেশি স্বতঃস্ফূর্ত তাঁর আঁকা , যাতে সৃজনশীলতার অমিয়  লাবণ্যের চেয়ে স্বভাবগুণের গুণপনাই বেশি লক্ষণীয়। আরও বলা যায় , নিজেকে অতিক্রম করতে পারেননি তিনি । নিঃসন্দেহে তার আঁকা ভাল কিন্তু আরও কোনো ‘ ভালতর ভালতম'র দিকে দৃষ্টি দেননি তিনি । তাই তাঁর রচনায় এখন এসেছে অভ্যস্ততার অনাকর্ষণীয় স্বাদ । 

সুলতান নিজেও জানেন তাঁর সম্পর্কে এই সব অভিযোগ । কিন্তু নিজের পথটি তাঁর চেনা আছে । পরিবর্তন তিনিও চান কিন্তু চাপিয়ে দেয়া উপঢৌকনও গ্রহণ করতে সম্মত নন তিনি । ছবি নিয়ে, রং-তুলি নিয়ে বাংলার মানুষের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতায় চলে যেতে চেয়েছেন তিনি।ছবির দৃশ্যের সঙ্গে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের ভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যকার অমোঘ শক্তি আর অনস্ত সম্ভাবনাকে মানুষেরই সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি অকপটে । ' না কোন কৌশলের অনিন্দ্য সুন্দর সুষমা তাতে ছড়াননি তিনি । আমাদের এই জনপদের প্রাণস্পন্দন জাগানিয়া মানুষেরা ভুলে গিয়েছিল তাদের নিজেদের মুখচ্ছবি, দেহাবয়ব- সুলতান যেন এক একটি আয়না মেলে ধরেছেন সেই বিস্তৃত প্রাকৃতজনদের সামনে ।'

অঢেল ফল আর সুপ্রচুর ফুলেভরা দেশ কাশ্মীর । সেখানকার মানুষগুলোও পরিশ্রম করতে পারে প্রচণ্ড। পরিশ্রমী মানুষই মানুষের মধ্যে সব থেকে প্রিয় সুলতানের । দু'বছরেরও বেশি সময় থেকে গেলেন কাশ্মীরে। মার্কিন সৈন্যদের পোর্ট্রেট আঁকার পাশাপাশি কাশ্মীরের প্রচুর ' ল্যান্ডস্কেপও ' এঁকেছিলেন জলরং ' এ ' । জলরং নিয়েই কাজ করতেন তিনি এ সময় । এ সময়ই জীবনের প্রথম একক প্রদর্শনীটি তার অনুষ্ঠিত হয় সিমলায় ১৯৪৬ সালে এক কানাডিয়ান মহিলার সাহায্য ও উদ্যোগে — এ তথ্য সবারই জানা আছে । মহিলার নাম মিসেস হাডসন । ' ল্যান্ডস্কেপ ' আর কর্মজীবী মানুষদের নিয়ে সেই প্রদর্শনীতে সেকালের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছিলেন এস. এম. সুলতান নামের এক অচেনা অখ্যাত যুবকের আঁকা দেখতে। সেই থেকে বলা যায় সুলতান ছড়িয়ে যেতে শুরু করলেন লোকের মুখে মুখে । এখন যে ঢং - এ আঁকেন তিনি তাঁর প্রিয় মানুষের অবয়ব তার সূচনা হয়েছিল কাশ্মীরের শ্রমরত মানুষের ছবি আঁকার সময়েই। কাশ্মীর থেকে যুদ্ধের ডামাডোলে পড়ে করাচী এসে থামলেন আবার । করাচীতে তাঁর প্রথম প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন ফাতেমা জিন্নাহ্ । পরে আরও কয়েকটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় তাঁর । করাচীতে এসে কাশ্মীরের ল্যাগুস্কেপ ও বাঙালী নারী আর ক্ষেতের কৃষকদের ছবি এঁকেছেন প্রচুর । ছবির মধ্যে এ সকল মানুষের ঐতিহাসিক ধারা বিবর্তনকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি সে সময়। কারণ শুধু আঁকার বিষয়টি নয়, কি আঁকবেন সেটাও স্পষ্ট হয়ে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে । আঁকার পাশাপাশি সে সময়কার খ্যাতিমান পাকিস্তানী শিল্পীদের সঙ্গে একত্রে গঠন করেন আর্ট কাউন্সিল যা পরে পরিণত হয় শিল্পকলা একাডেমীতে এবং করাচীতে আর্ট কলেজ গড়ে তোলেন। সুলতান ততদিনে নিজেকে হিসাবে গোনার মতো খ্যাতিমান করে তুলেছেন। একাডেমিক ডিগ্রী না থাকুক কারাচী আর্ট কলেজে পড়ানোর কাজটি ঠিকই পেয়ে গেলেন । করাচীতে ছিলেন ১৯৫০ সাল পর্যন্ত । এক শিক্ষা বিষয়ক সংগঠনের আমন্ত্রণে ১৯৫০ সালে চলে যান আমেরিকায় । সেখানে অবশ্য তার কোনো শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়নি । আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের শিশুদের স্কুলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছেন তিনি । জেনেছেন কিভাবে তাদের পড়ানো হয় , পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয় এই সব খুঁটিনাটি বিষয়াদি।সেমিনারে বক্তৃতা দিয়েছেন, সাক্ষাতকার দিয়েছেন ভারতীয় সভ্যতা আর সংস্কৃতি বিষয়ে । এরপর আমেরিকা থেকে সফর শেষে লণ্ডন চলে আসেন সুলতান।লণ্ডনে বেশ অনেক দিন কাটিয়েছেন তিনি । সেখান থেকে প্রায় গোটা ইউরোপ চষে বেড়িয়েছেন । কলকাতায় কৈশরে - যৌবনে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর দোতলার লাইব্রেরির স্তব্ধতায় বসে বসে বইয়ের পাতা মেলে যেসব উজ্জ্বল মানুষের নাম দেখেছেন , দেখেছেন তাদের কালজয়ী সৃষ্টির অনুকৃতি – সেই সব অনন্য শৈলীর সামনে দাঁড়িয়েছেন দৃষ্টি ও হৃদয়ের দরজা মেলে দিয়ে। শুধু দেখাইতো নয়, শিল্পের বিষয় নিয়ে, দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে, কলাকৌশল নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেন সমকালীন শিল্পীদের সঙ্গে । ছবি আঁকাও চলছিল এর মধ্যে । লণ্ডনে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীও করে ফেলেছেন এর মধ্যেই । তাতেই শিল্প রসিকেরা ঠিকই চিনে নিয়েছেন তার ভিতরের মহৎ প্রতিভাকে । অনন্য এক ঘটনা ঘটে গেল এ সময় তার জীবনে । লণ্ডনের লিষ্টার গ্যালারিতে সমকালীন মাষ্টার আর্টিষ্টদের এক শিল্পকর্মের প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার জন্য প্রদর্শনী কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রণ জানালেন সুলতানকে।আমেরিকাতে আঁকা কয়েকটি ল্যাগুস্কেপ জমা দিলেন তিনি প্রদর্শনীর জন্য এবং এভারেই সুলতান এশিয়ার প্রথম শিল্পী হিসাবে পাবলো পিকাসো , সালভাদর দালি , পল ক্লী , প্রমুখ জগৎ বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে এক শ্রেণীতে এসে দাঁড়ালেন।এ বিরল সাফল্য ও সম্মান আমাদের আর কারও নেই । 

এ রকম একটা অবস্থায় ইউরোপে শেকড় ছড়িয়ে বসা মোটেই অসুবিধার বিষয় ছিল না সুলতানের পক্ষে।কিন্তু সুলতানের জীবনে তখন পাতা মেলতে শুরু করেছে নতুন এক অধ্যায় । 'প্রবজ্যা পর্ব'র ইতিটানা হয়ে গেছে । সুলতান স্থির করে নিলেন তাঁর পরবর্তী জীবন । অকপটে নিজেকে মেলে ধরলেন নিজের কাছেই । সেখানে দেখতে পেলেন চিত্রার পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে বহুদিনের না দেখা এক লাল মিয়া । খেজুরের তাল - শুপারির ধনুকের মতো বাঁকা শাখাগুলো যেন জননীর মতো হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে ইশারায় । নির্জীব কৃষকের পাঁজরভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস কানে ভেসে এলো যেন তাঁর । ইউরোপে তিন বছর কাটিয়ে ৫৩ - তে পিঠ অবধি ঢেউ খেলানো চুল আর সাদা আলখাল্লায় দীর্ঘ কৃশ শরীর ঢেকে সুলতান এক 'অন্য রকম মানুষ' হয়ে নামলেন ঢাকা বিমানবন্দরে । অল্প দিনের মধ্যেই শুধু 'অন্য রকম' নয় খ্যাপাটে মানুষ বলে পরিচিতি জুটে গেল তাঁর স্বদেশে ।তার লম্বা চুল, সাদাকালো গেরুয়া আলখাল্লা , বড় তামাকের কঙ্কে , কুকুর - বিড়াল - জীব জানোয়ারের সঙ্গে সাবলীল আন্তরিকতা - এ সবই আলোচনার ও লক্ষ্য করার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াল সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই কলারসিক বোদ্ধাদের কাছেও।সুলতানের কাজের চেয়ে সুলতান নিজেই দর্শনীয় বস্তু হয়ে পড়লেন স্বদেশীদের কাছে । যার ঘোর কাটেনি আজও পুরোপুরি । এই অবস্থাকে আরও তুঙ্গে পৌঁছে দিল যখন সুলতান গেরুয়া শাড়ি ( থান ) পরে , পায়ে নূপুর বেঁধে ঢাকার রাজপথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন । মুখে না বললেও অনেকেরই মনে মিশ্রীর মতো দানা বাঁধতে শুরু করেছিল এই বিশ্বাস যে , সুলতান সত্যি সত্যি এবার পাগল হয়ে গেছেন । হাসনাত আবদুল হাই তার ' সুলতান ' উপন্যাসে লিখেছেন, ' শাড়ি পরে বেরুলেই পাড়ার ছেলেরা পিছনে তাড়া করতো । ক্ষ্যাপাতো হিজড়ে , হিজড়ে করে ।

” ইউরোপ যার মধ্যে আবিষ্কার করেছিল অত্যন্ত বড় মাপের সৃজনশীলতা স্বদেশীরা তার মধ্যে পাগলামি আর নষ্টামির বেশি কিছু খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে এক সময় উৎসাহ হারিয়ে ফেললো তাঁর প্রতি। তিনি নিজে কোন অভিযোগ করেননি যদিও, তবু শোনা যায় ঘনিষ্ঠদের মধ্যে থেকেই অনেকে সেদিন চেয়েছিলেন । গোপনে চেষ্টাও করেছিলেন যাতে সুলতান তার বিশালতাকে মেলে দিয়ে ঢাকায় মহীরুহ হয়ে দাড়াতে না পারেন। কার ওপর অভিমান করবেন সুলতান ? কাকে দেখাবেন রাগ ? যেমন একদিন আকস্মাৎ কাউকে না জানিয়ে নড়াইল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন লাল মিয়া তেমনি আবার অকস্মাৎ ফিরে এলেন একাকী নিজস্ব - নির্জনে । 

ঢাকায় থাকতে প্রচুর ছবি এঁকেছিলেন । কিছু বিক্রি হয়েছিল , সেসবের কিছু চলে গেছে চতুর সন্ধানীদের সঞ্চয়ে। গ্রামে ফিরে সহসাই আর হাত দেননি আঁকায় । নড়াইল থেকে আরও নিবিড় গ্রামে গাছ - গাছালী ঢাকা প্রকৃতির মধ্যে এসে দাঁড়ালেন তিনি । এই যে তাঁর প্রত্যাবর্তন অদ্ভুত বেশভূষায় , কেন , কিসের জন্য ? 

– ' প্রকৃতি আমার ভালবাসার বিষয় । ভালবাসতে হলে কাছে যেতে হয় । যেতে হয় সে যেমনি তেমনি করে। তাকে উভয়েরই চিনে নেয়ার, বুঝে নেয়ার বাধাগুলো পেরিয়ে যাওয়া যায় সহজে। আমেরিকা-ইউরোপের ছাপমারা সুলতানের সঙ্গে কুড়িগ্রাম - মাছিমদিয়ার ক্ষেতের কৃষকরা অন্তরঙ্গ আলাপে সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি করে নিতে আসবে না । আসতে পারবে না । একটা জড়তা - ভয় মনের দরজা বন্ধ করিয়ে রাখবে তাদের। আমি লাল মিয়া হয়েই তাদের সঙ্গে একই গাছের ছায়ায় বসে ভাল মন্দের খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করেছি । বিখ্যাত হওয়ার চেয়ে বাঙালি হওয়াটাই সব সময় বড় মনে হয় আমার । এখানে এখনও লাল মিয়া বলেই বেশি লোকে চেনে আমাকে ।– এইরূপ বললেন সুলতান। সুলতান আর লাল মিয়া এবার এতদিন পরে এসে শীর্ণ চিত্রার পাড়ে দাঁড়িয়ে মিলে গিয়েছিল পরস্পরে ।দু'য়ে মিলে তখন এক অন্য মানুষ তিনি । রং তুলি ছেড়ে স্কুল গড়তে শুরু করলেন স্কুল পালানো লাল মিয়ার বয়সী ছেলে - মেয়েদের জন্য । এই স্কুলের ধারণার মধ্যেও ছিল তার আপন চিন্তার মৌলিকতা । প্রচলিত ধারার পাঠশালা খোলার কোন আগ্রহ ছিল না তার । শিশুদের মনে সৌন্দর্যের নিষ্কলুষ বোধ ও চেতনা জাগিয়ে দেয়ার জন্য সচেষ্ট হলেন তিনি ।' চারুপিঠ ' ' নন্দন কানন ' নামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চালুও করেছিলেন ‘ অফিসের বাধা ’ ‘ সমাজের অনিচ্ছাকে ' হটিয়ে দিয়ে । আশৈশব এই একগুঁয়ে ভাবটি কেমন করে যেন রয়েই গেছে তাঁর মধ্যে। যা করতে সিদ্ধান্ত নেন তা না করা পর্যন্ত নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তিনি । জঙ্গল কাটলেন । পোড়ো জমিদার বাড়ি উপযোগী হলো বসবাসের, চালু হলো সুলতানের স্কুল একদিন । চাষী শ্রমিকের হাওরের ছেলে - মেয়েরা দল বেঁধে এলো সৌন্দর্যের পাঠ নিতে। ছবি আঁকতে । ' আর্ট কালচার ' চাষা - ভূষার ছেলে - মেয়েদের কাছে এক নিষিদ্ধ জগৎ হয়েই ছিল এতদিন । আজও তা প্রায় তাই আছে। সুলতানই প্রথম ভেঙ্গেছিলেন সেই দেয়াল আমাদের জনপদে । সুলতান সাধারণ মানুষের অন্তরের সুলতান হওয়ার পথে এগিয়ে গেলেন এভাবেই । 

নিজের ছবি সম্পর্কে তেমন কিছু আর বলতে চান না সুলতান। যেন এক শিশুতোষ অভিমান সেতারের তারের মতো কাঁপিয়ে দেয় তাঁর স্বর ।' আর কত , অনেকতো হয়েছে । এই সব ছোট ছোট ছেলে - মেয়েদের মধ্যে সৌন্দর্যের চেতনা জাগিয়ে দিতে হবে।সেটাই আসল কাজ । সংসারে মানুষ এখন হানাহানি নিয়ে মেতে আছে । মানুষ অনেকদিন বাঁচে । মানুষের মতো আরও অনেক প্রাণী অনেকদিন বাঁচে।কিন্তু মানুষের বাঁচাটা তাদের চেয়ে আলাদা । আমরা জন্ম নিয়ে কয়েক বছরের মধ্যেই মানুষ হওয়ার তাড়না পাই । তার পরেই পথ হারিয়ে ফেলি । যদি এই সময়টিতে ঠিকভাবে লালন না করা যায় শিশুদের তবে তারা অন্ধকারের পথে চলে যায় । আমেরিকায় আমি দেখেছি সেখানকার শিক্ষায় শিশুদের জন্য ফাইন আর্ট বাধ্যতামূলক । এটা কেন তারা করেছে ? কি এর উপকারিতা ?  প্রতিটি শিশুর মধ্যেই প্রতিভা থাকে । বলা যায় এই প্রতিভা বিকাশের জন্য জন্ম নেয় তারা । এই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিতে হবে আমাদের । আমার স্কুলে আমি ড্রয়িং বাধ্যতামূলক করব । এতে প্রথমে তারা প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুকে সঠিকভাবে দেখতে শিখবে। তারপর ভাবতে শিখবে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক । যার যে বিষয়ে প্রতিভা আছে সে সে বিষয়ে চলে যাবে । এই চিত্রশিক্ষা যে শুধু শিল্পী সৃষ্টি করবে তা নয় । এই সুন্দর বিশ্বকে সুন্দর করে দেখার জন্য শিশুদের মানস গড়ে তুলতে হবে । তাদের এই প্রতিভাকে যদি কাজে লাগান না যায় তাহলে তা নষ্ট হয়ে যায়। শিশুদের মধ্যে সৌন্দর্যের বোধ জাগিয়ে দিতে পারলেই সন্ত্রাস, হানাহানি থেকে বিরত থাকবে তারা । 

আজকের দিনের ছেলে - মেয়েরা বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে জন্মেছে । তাদের সঠিক শিক্ষায় তৈরি করে নিতে হবে। দেখিয়ে দিতে হবে সঠিক পথ । এরাই তাহলে পারবে বাঙালী জাতির মুক্তি ঘটাতে । স্বপ্ন সফল করতে । এই ছেলে - মেয়েদের ছাড়া অন্যদের দিয়ে আর এই কাজ করানো যাবে না ।

'সুলতান তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন অমিত সম্ভাবনাময় কচিপ্রাণদের নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা। বলতে বলতে হঠাৎ করেই কিছুটা প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে আপাত সাযুজ্যহীন গভীর ইঙ্গিতময় আলাপচারিতা সুলতানের অভ্যস্ত কখনরীতি । অনেক সময়ই তাঁর আলাপের বিষয় শ্রোতাদের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে কিন্তু তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটাই এমন স্বচ্ছ ও আন্তরিক যে, তাঁর অন্তরের উপলব্ধি শ্রোতার উপলব্ধিকে অনায়াসে গভীরে স্পর্শ করে যায়। যেমন শিশুদের প্রসঙ্গেই বলছিলেন তিনিঃ আমাদের এই বিশাল পৃথিবী । আর আছে গভীর সমুদ্র ।......তাদের নিয়ে এমন করে ভাববার আর কে আছে এই জনপদে।' সুলতানের এখন একমাত্র ধ্যানজ্ঞানের বিষয় এই দেহাতী মানুষদের সন্তানেরা ।বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে তাদের জন্য একটি স্কুল খুলেছেন তিনি। বোধহয় কারও জানতে বাকি নেই সেই স্কুলের নাম রেখেছেন তিনি 'শিশু স্বৰ্গ '। শ'দুয়েক ছেলেপুলে ভোর হতেই খাতা - পেন্সিল বগলে নিয়ে, যার নেই সে খালি হাতেই চিত্রা নদীর পাড়ে সাদা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় । দরজা খুললেই একে একে সারি করে ভিতরে এসে ঢোকে তারা বাড়িটির মধ্যে গেটের সঙ্গেই ফাঁকা একটা ঘর । তারমধ্যে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ছোট - বড় বিভিন্ন সাইজের ক্যানভাস। কোনটির বুক ধবধবে সাধা । কারও বুকে পড়েছে সুলতানের দু'একটি সৃজনী চিহ্ন । কারও বুকে ফুটে আছে প্রকাণ্ড কৃষকের লাঙল চালানেরা দৃশ্য । এটাই সুলতানের স্টুডিও । তারই একপাশে টেবিল পাতা । টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বাচ্চাদের আঁকার সরঞ্জাম । সেসব নিয়ে তারা বাইরে চলে আসে ।স্টুডিওর সামনে দিয়ে ইংরেজি ' এল ' অক্ষরের মতো খানিকটা জায়গায় টিনের ছাউনির নিচে দুসারি করে বেঞ্চ। আঁকা শুরু করার আগেই অদূরে রান্নাঘর থেকে ' পায়েস চলে আসে তাদের জন্য । সকালের খাবার খেয়ে আবার কাজে মগ্ন হয়ে পড়ে তারা । আঁকা ছাড়াও নাচ , আবৃতি , অভিনয় , পরিবেশ , কৃষি আর সাধারণ পাঠ বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয় তাদের । সুলতান ইঞ্জিন লাগানো প্রকাণ্ড এক কাঠের দ্বিতল নৌকা তৈরি করেছেন তাদের জন্য ( বর্তমানে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এটি বিকল হয়ে আছে । মেরামতের অর্থ নেই সুলতানের কাছে ) । নৌকায় শিশুদের সঙ্গে নিয়ে চিত্রার বুকে ভাসতে ভাসতে বহুদূর ভাটির দিকে চলে যেতেন তিনি । আঙ্গুল তুলে তাদের চিনিয়ে দিতেন বাংলার সবুজ গাছ - পালা । বুঝিয়ে দিতেন রঙের বিন্যাস। দেখিয়ে  দিতেন কাগজে জলেমেশা রং কিভাবে ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিয়ে বাংলার শ্যামল মুখ তাতে ফুটিয়ে তুলতে হয়। শরীরে সামর্থ আর নেই আগের মতো সুলতানের । শিশু স্বর্গ পরিচালনায় মাস মাস যে মোটা অংকের টাকা দরকার সেটা যোগাড়ের দুশ্চিন্তা, যে বাড়িটি সরকার বরাদ্দ দিয়েছে সেটা নিয়ে  চলছে মামলা মোকদ্দমা । কোর্টে পর্যন্ত হাজিরা দিতে হচ্ছে তার জন্য ( তার নিজের যে পৈত্রিক সমান্য ভিটা ছিল তার সবটাই বেদখল হয়ে গেছে ) । তার ওপর আছে রোগব্যাধি । আয় বলতে শিল্পকলা একাডেমীর দেয়া রেসিডেন্স আর্টিস্ট এর মাসিক ন'হাজার টাকা ভাতা । তার জন্য আবার বছরে ছয়টি করে ছবি জমা দিতে হয় । প্রদর্শনী করার জন্য অনেকেই ছবি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে টাকা দিতে ভুলে গেছেন। সুলতানতো তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাবেন না।সারাজীবনই আপন সৃষ্টি দু'হাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এসেছেন এই বয়স্ক শিশুটি । আজ কেমন করে আর পাল্টে নিবেন নিজেকে । তিনি সংবাদ সম্মেলন করে জাতির কাছে আবেদন করেছেন বহুবার ‘ শিশু স্বর্গকে সঙ্গতিসম্পন্নরা একটু সাহায্য করুন। অথবা সরকার ট্রাস্ট গঠন করে ভার নিয়ে নিক তাঁর সম্পত্তির।মামলা- মোকদ্দমায় আর যেতে পারছেন না তিনি । 

স্বর্গের সৌন্দর্য দিয়েই শিশু স্বৰ্গকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সুলতান । বেশ বড় আয়তাকার পরিধির চারপাশ প্রাচীরঘেরা বাড়িটি ফুলের গাছে গাছে ভরিয়ে দিয়েছেন সুলতান । এক সময় নিজ হাতে পরিচর্যা করতেন গাছগুলোর । এখন আর পারেন না । জানালা দিয়ে নির্ণিমেশ চোখ মেলে দেখেন সকালে- বিকালে গাছের পাতা, পাতায় রোদের স্বচ্ছ আদর । কান পেতে শোনেন পূর্ব দিক থেক ভেসে আসা গাভীর হাম্বা ডাক । সেখানে বাতাবীলেবুর গাছের নিচে গোয়াল ঘর । তার পাশ দিয়ে বড় বড় খাঁচা । তার মধ্যে সুলতানের পোষা জন্তুরা হুটোপুটি করে । দুটি মুখপোড়া হনুমান আর কয়েকটি বাদর অযথাই সারাদিন হুটোপুটি করে । আদুরে ঢঙে পাশের খাঁচায় নরম ঘাসের ডগা চিবোয় খরগোশের দল । গিনিপিগ আর তুলতুলে বিলাতি ইদুরের দল খাঁচায় অর্থহীন খড় খড় শব্দ করে চলে সারা দিন । আর লম্বা ঠোঁটের ময়ূরের গায়ের রং - এর মতো পালকঢাকা প্রকাণ্ড মদনটাকটি একাকী আনমনা হয়ে সময়ের চলে যাওয়া দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । পায়ে পায়ে সুলতান ভোরের দিকে একবার তাদের সামনে এসে দাঁড়ান । দেব দর্শনের মতো আনন্দ হয় তখন তাদের । খাঁচায় লোহার শিকগুলোর ফাঁক গলিয়ে হাত বাড়িয়ে দেন তিনি তাদের দিকে । এক অভূতপূর্ব দৃশ্য তখন ঘটে যায় এই ব্যতিব্যস্ত জনপদের আড়ালে ; বহুদূর ছায়াময় এক গৃহকোণে । ভাষা , শব্দ যার প্রকাশ ঘটাতে অক্ষম । সুলতানের হাত স্পর্শ করে অবোধ সেই সব পশুপাখিকে । ভাষাহীন বোধে জানাজানি হয়ে যায় মানুষের ও মানবেতর প্রাণীতে। সুলতান নিজে প্রচলিত পন্থায় ঈশ্বরের সেবাতো করেননি কোনদিন , কাউকে বাধাও দেননি করতে । বাড়ির দক্ষিণ অংশে দু'টি টিনের ছাপড়ার নিচে তুলসীতলা । সেখানে ছোট শীতলা প্রতিমা । প্রসন্নকাস্তি নিয়ে দেবী তার উপস্য । সুলতান এইসব দেখেন আর ঘরে ফিরে বার বার নির্বোধ পশুদের সামনে, মাটি খুঁড়ে অনিবার্য বেরিয়ে আসা বৃক্ষরাজির সামনে , প্রবহমান চিত্রার বাঁকে , তার বাঁকে বাঁকে খেটে খাওয়া , রোদে পোড়া , বৃষ্টিতে ভেজা জীর্ণ মলিন মানুষ - মানুষীর শিশুর সামনে এসে দাঁড়ান । এদেরই মধ্যে খুঁজে নেন জীবনের গভীরতম অর্থ, খুঁজে নেন স্রষ্টা বলে , ঈশ্বর বলে কোনো এক পরমের অস্তিত্ব।

সংসারের কথা কোনদিন ভাবেননি এই এলোমেলো প্রাকৃতিক মানুষটি । কিন্তু শেষ বয়সে এসে সেই সংসারের ফাঁকেই জড়িয়ে গেলেন ঘোরতরভাবে ।ব্যাপারটা ঘটলো শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েই । কোমলপ্রাণ কুঁড়িদের নিয়ে তো আর রোজ বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন না তিনি । তাই এবার সুলতানের শেকড় ছড়িয়ে বসবার প্রয়োজন । সে ঠাইতো কোন ভূখণ্ড নয় । অস্তিত্বহীনতার প্রবল অস্তিত্ব ‘ সংসার ’ বলে থাকে লোকে । সংসারে ফিরলেন ' মুক্ত দেদার ' সুলতান । ঘটনাটি ঘটলো খানিকটা আকস্মিকভাবেই । সুলতানের জীবনের এই দিকটায় আমরা লক্ষ্য করলে দেখব সেখানে ' আকস্মিকতার ' যোগটি বেশ প্রবল । ' হরিপদ সা ' নামে এক অন্তজ হিন্দু দেহাতী মানুষের সঙ্গে নড়াইলে ফিরবার পর তাঁর আত্মার যোগসূত্র গড়ে ওঠে। লোকটির স্ত্রী নীহারবালা কাকু বলে শ্রদ্ধা জানান সুলতানকে । নীহারবালা নড়াইল হাসপাতালের স্টাফ নার্স। বাসনা ও পদ্ম দুটি মেয়ে তাদের । হরিপদ হুট করে একদিন মারা গেলেন আজ থেকে প্রায় ২৫-২৬ বছর আগে । সুলতানের যোগটি তাদের সঙ্গে প্রায় ছিন্নই হতে বসেছিল । কিন্তু নিয়তির অন্য রকম পরিকল্পনা ছিল সুলতানকে নিয়ে । বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুলতান একবার। চিকিৎসা করতে এলেন শেষমেশ নড়াইল হাসপাতালে । এখানে বলে রাখা যায় ডাক্তারী চিকিৎসাকে তেমন মান্য গণ্য করেন না সুলতান নিজের ক্ষেত্রে । ওষুধে তাঁর তেমন কাজ হয় না , ওষুধ না খেলেই বরং ভাল থাকেন বলে সুলতানের ধারণা । এই সুলতান যখন হাসপাতালে ভর্তি হতে আসেন তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না সুলতানের জীবনে বার্ধক্যের দাগ লেগে গেছে , শরীরে ঘোষিত হয়েছে অসুখের সাম্রাজ্য । নীহারবালার দাড়াবার আশ্রয় বলে কিছু ছিল না । স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিলেন সুলতানের পরিচর্যার ভার। চাকরি ছেড়ে দু'মেয়েকে নিয়ে দাদুর আশ্রয়ে উঠলেন । তিনি । সেটা আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা । বাসনা ও পদ্মকে ম্যাট্রিক পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন দাদু । তবে পদ্ম দাদুর কাছেই আছে মায়ের সঙ্গে । সেই চিঠিপত্র এলে দাদুকে পড়ে শোনায় । চিঠি পড়ার মতো চোখের শক্তি আর নেই দাদুর । ‘ লাল মিয়া ’ আর ‘ সুলতানের ' দিন ফুরিয়ে এখন শুরু হয়েছে ‘ দাদুর ’ সময় । সারাদেশের শিশুদেরই প্রিয় দাদু এখন তিনি । প্রতিবছর তাঁর জন্মদিনে দেশের আনাচে - কানাচে থেকে শিশুদের দল নড়াইলের অজ পাড়াগায় তাদের স্বর্গে চলে আসে । সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন পলিত কেশ , শীর্ণদেহ মমতায় মাথা মুখ এক দাদু । যেন সেই বড়দিনের রাতে ক্রিষ্টমাস গাছে গোপনে সব মিষ্টি কেক , আর তাজা ফল ঝুলিয়ে রেখে যাওয়া এক জীবন্ত ' সান্তাক্লস বুড়ো।”

সুলতানের কথা বলতে গেলে এই ' নীহারবালা মা ' নামের সেবাপরায়ণ মাতৃমূর্তির কথা মনে করতেই হবে যে কারও । আর সব বাদ দিলেও আজকের এই বিছানায় পড়ে যাওয়া সুলতানকে ভাত পানি ওষুধ তুলে খাইয়ে শারীরিকভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই নীহারবালা মা ছাড়া অন্য কেউ আর নেই সুলতানের পাশে । তার কাছ থেকেই শোনা গেল সাম্প্রতিক সময় কিভাবে কাটছে সুলতানের । খুব সকালে ঘুম ভাঙে সুলতানের । সামান্য ঘি আর আলু ভর্তা দিয়ে সামান্য নরম ভাত খেয়ে নেন । শরীর ভাল থাকলে হাঁটতে বের হন । কোনো কোনো দিন নদীর পাশ দিয়ে অনেক দূরেও চলে যান । ইচ্ছে হলে সামান্য হেঁটে এসে আঁকতে শুরু করেন । লোকজন এলে আঁকতে আঁকতেই তাদের সঙ্গে কথাবর্তা চালিয়ে যান । খুব বেশি সময় একটানা এখন আর আর্কেন না তিনি । দুপুরে সূর্য মাথার ওপর ওঠে এলেই তাজা মাছের ঝোল দিয়ে সামান্য ভাত খেয়ে নেন । কঁচু শাক তার খুব প্রিয় । রাতে কোনো কোনদিন ভাত খান অথবা এক বাটি স্যুপ খেয়ে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। বড় কষ্টে চলছে সংসার । মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হয় । শিল্পকলা একাডেমী থেকে পান ঐ ন ' হাজার আর কিছু আসে ছবি বিক্রি করে । তাও আবার অনেকেই ছবি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে কিন্তু টাকা দেয় না । চট্টগ্রাম থেকে একবার প্রদর্শনী করার কথা বলে ট্রাক বোঝাই করে ছবি নিয়ে গিয়ে সব বেঁচে দিয়েছে তারা একটি পয়সাও পাননি সুলতান । কাল মারা গেলেতো কিছুই রেখে যাবেন না । তখন কি হবে নীহারবালার – তা ভাবতে পারেন না তিনি । যা তাঁর বলা স্বাভাবিক তাই বললেন : ' কি জানি কি আছে আমার কপালে ? শিশু স্বর্গের ছেলেরা আছে । এরাই ভরসা । " শিশু স্বর্গের  নিজেরই ভবিষ্যত যেখানে সুলতানের জীবদ্দশাতেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সেই শিশু স্বর্গ নীহারবালা মাকে কতটুকু ভরসা দিয়েছে, দিতে পেরেছে – কেমন করে তা নিশ্চিত জানা যাবে ? 

সুলতান তেমনই মানুষ নিজের জন্য কিছু দাবি করার লজ্জা যাদের প্রকাশ্য রাজপথে নগ্ন হওয়ার লজ্জার চেয়েও প্রবল । নিজের পরিশ্রমের মূল্যও পাননি যিনি তিনি কেমন করেই বা আর কিছু চাইতে পারেন । দিল খোলা মানুষ তিনি বড় অকপটে তাই বলে গেলেন

‘ ইউরোপেও অনেকে চেনে আমাকে । এজন্য ধন্য মনে করি নিজেকে । তাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আমার কথা শুনেছে এটা আমার গৌরব বলতে পারেন । কিন্তু আমার নিজেরই মনে হয়- কোনো মহৎ কর্ম , কোনো ভাল কিছু হয়নি আমার দ্বারা । অসংখ্য মানুষের ভালবাসা পেয়েছি , স্নেহ পেয়েছি । আমার কাছে এটাই সব থেকে মূল্যবান । তবে ছোটদের জন্য যদি একটা গাইড লাইন দিয়ে যেতে পারতাম তাহলে ভাল কিছু হতো । তাতো হলো না ।”

না পারার এই অতৃপ্তিতে এখনও বিচলিত বোধ করেন সুলতান । বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যান : কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্প করিনি । আমার জন্মস্থানের প্রতি একটা ‘ সেন্টিমেন্টাল ' অনুভূতি আছে । সেখান থেকেই মনে হয়েছে গ্রামে কিছু কাজ করতে হবে । শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে শিল্পবোধকে আমাদের এখানে মেলানো হয়নি । এই কাজটি করতে হবে প্রথমে । আমি চাই গ্রামের মানুষদের মধ্যে থেকেই ' আর্ট ক্লাস ' হোক । যেমন কবিদের মধ্যে থেকে একদিন জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠেছে আমাদের সাহিত্য । আমাদের নিজস্ব সৌন্দর্য , রেখা রং খুঁজে নিতে হবে গ্রামের মধ্যে থেকেই । বড় একটা গ্রামইতো আমাদের দেশটা । এই গ্রামের মানুষের মধ্যে ' এ্যাসথেটিক সেন্স ' ছড়িয়ে দিতে হবে । তাহলেই সাজিয়ে গুছিয়ে বাঁচতে শিখবে তারা। এই সাজানো - গোছানোর বোধ না জন্মালে সাধারণ জনগন জাগবে না কখনও । এটা না হলে তার কোনো উন্নতি হবে না কোনোদিন । অভাবের মধ্যে গোছানো সাজানো জানলে সুন্দর করে থাকা যায় । হাজার বছরের এই শোষিত শাসিত কৃষকদের জীবন বদলাতে হলে সৌন্দর্যের বোধ জাগাতে হবে তাদের মধ্যে । ঘরে শুধু খড় বদলে টিন চাপিয়ে দিলেই হবে না । সৌন্দর্য চিনলেই সে বুঝবে কত অসুন্দরভাবে সে বেঁচে আছে । এটা বুঝলেই সুন্দর জীবনের জন্য সংগ্রাম শুরু হবে তার । তখন নিজেই সে বদলে নিতে পারবে তার জীবন সুন্দর করে । সেই শক্তিও তাদের শরীরের মধ্যেই আছে । আমি সেই শক্তিকেই আঁকিয়ে দেখিয়েছি তাদের । এজন্যেই তাদের কাছে আসবার দরকার ছিল আমার । জয়নুলও বুঝেছিলেন এই ব্যাপারটি । চেষ্টাও করেছিলেন । আমাকে ঢাকায় থাকতে বলেছিলেন জয়নুল - কামরুল ওরা । আমি থাকিনি । আমি তাদের বলেছিলাম আমার জীবনের লক্ষ্য আলাদা । আমি গ্রামে চলে এসেছি ।'

মানুষের প্রতি দুর্নিবার ভালবাসাই তাঁর মধ্যে জন্ম দিয়েছে এক অনন্য এক দায়িত্ববোধ ।'শিল্প শিল্পেরই জন্য শুধু' এই আপ্তবাক্যাটির মোহ থেকে সেই অনন্য দায়িত্ববোধই সুলতানকে দিয়ে  'শিল্পকে জীবনের সঙ্গে ’ মিলিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত করেছে। 'সমাজের ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য সবচেয়ে বড় কাজটি শিল্পীরই' – এসব বিশ্বাস করেন সুলতান । সমাজ থেকে দূরে নির্বাসনে যাওয়া চলে না শিল্পীদের । জয়নুলেরই কথাই ধরুন - পরের প্রজন্মের জন্য যে পথ তিনি করে দিয়ে গেলেন শিল্পচর্চার – তা না করে কেবল বসে বসে যদি ছবিই একে যেতেন তাহলে এত বড় জয়নুল হতেন না তিনি । জয়নুল যতবড় শিল্পী তার চেয়ে অনেক বড় সামাজিক । জয়নুলের আসল মহত্বই এই সামাজিক মধ্যে , ' বললেন তিনি ।

সরাসরি রাজনীতির কথা বলতে স্বস্তি বোধ করেন না সুলতান । তিনি সবচেয়ে বেশি মূল্য দেন  'দেশপ্রেম ' নামের সেই শাশ্বত সত্যের প্রতিই । এই বস্তুটি যে দুর্লভ হয়ে গেছে আমাদের জনপদে তা ভেবে ব্যথিত হন সুলতান । এরই প্রভাব পড়েছে আমাদের শিল্পে সাহিত্যে । নির্দিষ্ট করে নিজেদের চিনে নেয়ার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে আমাদের শিল্পীদের । এই বর্তমান নিয়ে কোন ভবিষ্যতের দিকে যাবে আমাদের শিল্প আমাদের চারুকলা সুলতানের কাছ থেকে তা জানতে ইচ্ছে হবে আমাদের ।  

'কিছুকাল এরকমই চলবে ।এখন 'ওয়েস্টার্ন কালচার ডোমিনেট' করছে । যখন দেশ প্রেম জেগে উঠবে তখন এই ধারা বদলে যাবে। এখনতো ঠিক দেশ প্রেম বলতে নির্দিষ্ট করে কিছু বোঝানো হচ্ছে না - নির্দিষ্ট করে দেখানো হচ্ছে না আমাদের 'কৃষি কালচার ' । ম্যাণ্ডেলাকেও যেভাবে যে দৃষ্টিতে দেখছি , আমাদের দেশের নেতাদেরও সেভাবেই দেখছি ।এককভাবে তো আমাদের ঐতিহ্যকে স্পষ্ট করে তুলে ধরছিনা আমরা । সব জায়গাতেই একটা ' হতাশা ' পাতায় পাতায় ঘষা লাগার শব্দের মতো কিসমিস করছে। সবার মনেই একই কথা কি হবে ! ' সেই যে ' ওভার ফ্লুয়েন্স ' মানসিকতাকে ইস্যু করে একবার সারা ভারতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হল তাইতো জ্বলছে এখনও । কিন্তু এটাই শেষ নয় । শুভ বুদ্ধি একদিন এসে যাবে মানুষের । এলে এসব আর থাকবে না । মানুষের সত্যিকার প্রতিজ্ঞাই হোল ' মানবোচিত গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধন ' । এই বোধ একদিন জাগবে মানুষের । এই প্রতিজ্ঞা একদিন করবে তারা ।

সুলতান যখন মানুষের জন্য এক সুন্দর ভবিষ্যতের কথা বলেন , মুহূর্তের জন্য যেন অসুস্থ মনে হয় না তাকে । লম্বা লোমওয়ালা টেরিয়ার কুকুরটি এসে তার ঠাণ্ডা - ভেজা নাক দিয়ে মৃদু ঢুঁস দেয় বিছানার কিনার থেকে ঝুলিয়ে দেয়া পায়ের পাতায় । বহু বিড়াল ছিল এক সময় সেগুলো আর নেই । উঠান জোড়া ফুলের বাগান থেকে নিরালা কোনো অলস সময়ে দু'একটি প্রজাপতি উড়তে উড়তে জানালা নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে আসে । প্রাত্যহিক গেরস্থালীর পরিচিত শব্দের টুকরো ভেসে আসে । নিভৃতে উঁচু আম গাছটির কোনো ডাল থেকে খসে পড়ে শুকনো পাতা । টুনটুনী পাখিগুলো গায়ে ফুলের রেণু মেখে সারাক্ষণ উড়ে উড়ে বেড়ায় । ছাদে এসে বসে পায়রার ঝাঁক । এরই মধ্যে দিয়ে মেঘে মেঘে বেলা কেটে যায় সুলতানের। বিয়ে করাটা আর হয়েই ওঠেনি এর মধ্যে । ভেবেছিলেন কি করবেন ? – না , না সে রকম গভীর চিন্তা হয়ইনি কখনও । এদিক থেকে আমি নিজেও ব্যতিক্রম মনে করি নিজেকে । এক সময় মনে হতো এ জীবন কিছু নয় । সংসার করব না । মুক্ত থাকবো । এক রকমের আধ্যাত্মিকতাও ছিল এক সময়। দায়িত্ববান মনে হয়নি নিজেকে আবার অন্য সময় দেখেছি তাও নয় ব্যাপারটা অনেক দায়িত্ব আছে আমার । অথচ মনে হয়েছিল সংসারে জড়িয়ে গেলেই কেবল দায়িত্ব আসবে । মুক্ত থাকতে পারবো না । বেশি করে মনে হয়েছে নিজের সংসারে থাকলে মানুষ স্বার্থপর হয়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যায় । আমি এটা পছন্দ করিনি । এসব ভাবতে ভাবতেই আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি ।

 'প্রেম ’ বলতেও সমূহ মানুষের প্রেম ছাড়া অন্য কোনরূপ প্রেমের আকাঙ্খা করেননি কখনও । গৃহহীন গৃহী হয়ে যে জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন সুলতান সে জীবন তার আঁকা মানুষগুলোর মতোই ‘ বিশিষ্ট ' , স্বতন্ত্র । তাঁর আঁকা ছবিগুলোর তুলনা যেমন তার ছবি ছাড়া আর কিছুতেই দেয়া যায় না তাঁর জীবনও এরকমই । তাঁর ছবির প্রকাণ্ড অবয়বের পাথরে গাঁথা চেহারার মানুষদের তাদের শ্রম ও সাধনা নিয়ে , সবে মাত্র আলোচনা শুরু হয়েছে আমাদের শিল্পবোদ্ধা মহলে । দেশে ফিরে ৭৬ সালে প্রথম প্রদর্শনীতেই মাঝখানের বিস্মৃতিকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে সমকালীন শিল্পকলার জগতে নিজের জন্য স্থায়ী আসনটি তৈরি করে নিয়েছেন তিনি । এরপরে আরো দু'টি প্রদর্শনী হয়ে গেছে তাঁর । কিছু দিন আগেই ঢাকার গ্যালারি টোন - এ হয়ে গেল তাঁর সাম্প্রতিক ড্রয়িং - আর জল রং - এর কাজের প্রদর্শনী । শিল্পকলা একাডেমীতেও দেশের শীর্ষ ন'জন সমকালীন চারুশিল্পীর সঙ্গে হয়ে গেল তার শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। 'সুলতান' কতখানি আন্তরিকভাবেই যে একজন 'শ্রমিক ' মনে করেন নিজেকে শ্রমের মধ্যে দিয়েই তার প্রমাণ দিয়েছেন আমাদের। শরীরে সামর্থ নেই । তবু আঁকছেন । প্রকান্ড  ' স্ক্রলে ' বাংলায় কৃষকদের জীবনের ধারাক্রম ফুটিয়ে তোলার দুঃসাহসিক কাজে হাত দিয়েছেন এর মধ্যেই । সর্বতোভাবেই চারুকলাকে শহুরে মানুষের দামী ড্রয়িং রুমের ‘ শো পিস ’ হওয়া থেকে মুক্তি দিতে সংগ্রাম করছেন তিনি । আরও কত সহজ , স্বল্প ব্যয়ে চিত্র রচনা করা যায় তারই চেষ্টা করছেন তিনি । সাদা চটকে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে নিচ্ছেন কাঠের ফ্রেমে। তাতে চড়িয়ে দিচ্ছেন সাদা ঘন রঙের প্রলেপ । তারপর তাতে কাল রেখার ড্রয়িং - এ ফুটিয়ে তুলছেন অবয়ব , নিসর্গ । তারপরে অধিকাংশই প্রকৃতির উপাদান থেকে তৈরি করা রং মাখিয়ে দিচ্ছেন যেখানে যতটুকু প্রয়োজন । পরে তাতে তেলের বার্নিশ দিয়ে দিচ্ছে তার ' পোক্ত সাগরেদ ' নাতী - নাতনীদের কেউ কেউ । এইভাবে হয়ে যাচ্ছে সুলতানের ছবি । তারপর সেটা কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে বড় একটা মাথা ব্যথা নেই তার । মানুষের ঘরে যাচ্ছে এটাই বড় কথা তাঁর কাছে । আরও একটু ভাল রং দিলে, ভাল ফল হত আরও এসব কথা তাঁর কাছে খুব বেশি মূল্যবান মনে হয় না । যে শক্তির প্রতীক হিসাবে মানুষদের এঁকেছেন তিনি তাতে কেবলই বাস্তবতার ধরা ছোঁয়ার বাইরের মনোহর জিনিস, তা নয় । চাষাদের ফসল ফলানোর মধ্যে , ক্ষরা বন্যায় সংগ্রাম করার মুহূর্তে , স্বাধীনতার যুদ্ধে , স্বাধিকারের যুদ্ধে আরও বহু অতীত সংগ্রামে সেই শক্তি প্রকাশিত রূপ অন্য সবার মতো দেখেছেন তিনিও । অনেকেই স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে পর মুহূর্তেই নিভে গিয়ে ভুলে গেছেন জ্বলে ওঠার কথা - সুলতান তা ভোলেননি । বরং চেষ্টা করেছেন সেই শক্তির স্ফুলিঙ্গকে দাবানলের মতো জ্বালিয়ে দিতে। তাই তার ছবির সামনে দাঁড়ালে ছবির সঙ্গে অন্তর মিলিয়ে নিতে দর্শকদের মোটেই চিত্র বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন হয় না । প্রচণ্ড দুঃসময়ে, পায়ের নিচে যখন থর থর কেঁপে ওঠে মাটি সে সময়েও এস এম সুলতানের যে কোন ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষের বুকে জ্বলে উঠবে সাহস আর সাবলীলতার নতুন সূর্য । প্রচণ্ড ইচ্ছে হবে বাঁচতে। ইচ্ছে হবে বদলে দিতে সবকিছু । ইচ্ছে হবে নতুন করে সাজাতে সংসার।  এই ‘ ইচ্ছে করে ’ , ‘ নতুন করে' সাজানো -একেই ' সৌন্দর্য ' বলেছেন , সুলতান । সৌন্দর্য কথাটি বড় ' এ্যাবস্ট্রাক্ট ' । ' কয়েকটি জিনিসকে সুন্দর করে প্লেসিং করলে সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় । যেমন লেখার টেবিলে বই-খাতা - পেন্সিলগুলো সাজিয়ে রাখলে একটা সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় । গোটা সংসারটাও এরকম। তাকে সাজাতে হবে ।”

এই ষড় ঋতুর বৈভব ভরা দেশে বড় মাপের ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার বেরুলোনা- এই দুঃখ, আগামীকালের প্রজন্মের জন্য সুন্দর এক দিকনির্দেশনা না দিতে পারার বেদনা নিয়ে সৌন্দর্য দিয়ে সংসার সাজাতে বসেছেন সত্তর বয়সের সুলতান । সুলতান নিজেকে অতিক্রম করতে পারেননি কথাটি যারা বলেন সুলতানের ক্যানভাস থেকে সুলতানের জীবনের দিকে চোখ মেলে তাকাবার প্রয়োজন তাদেরই বেশি । সেখানে দেখা যাবে সেই সুলতানকে, যিনি 'মিথ ' কে নয় সাধারণ প্রাকৃতিক মানুষদেরই মিথের অধিক মহিমা দিয়ে করে তুলেছেন লাবণ্যময়। সুগন্ধী রেশমী রুমালের মতো যে খ্যাতি আর প্রতিষ্ঠাকে আমরা আদরে যত্নে বুকে পকেটে রেখে দিয়েছি - ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো তাকে পথের পাশের আবর্জনার স্তুপে ফেলে দিয়ে যেতে দ্বিধায় কাঁপেনি যার বুক । দেখা যাবে সেই সুলতানকে যিনি পাশ্চাত্যের ফেলে দেয়া ছেঁড়া চটি জুতো আমাদের মতো পরম সম্পদ মনে করে টেনে নেননি বুকে । সেই সুলতানকে দেখা যাবে যিনি আপন চেতনায় আয়নায় দেখেছেন আপনার মুখ এবং সেই আয়না বাড়িয়ে দিয়েছেন অন্যদের দিকে। সেই সুলতান তিনি যিনি সত্তর বয়সে এসে আবার ফিরে পেয়েছেন শৈশব। লাল মিয়া হয়ে মিশে গেছেন চিত্রা তীরের শত শত শিশুদের মাঝে । প্রবীণ বৃক্ষের মতো সারাগায়ে সময়ের রেখে যাওয়া পুরাতন রোদ, কিছু উষ্ণ করুস্পর্শের স্মৃতি, না বলা অভিমান নিয়ে প্রবীণ সুলতান হারিয়ে গেছেন যেন এক নতুন লাল মিয়ার মধ্যে। যেন এক জনমেই জন্মান্তর ঘটে গেছে ” সুলতানের । এই জন্মের গায়ে কোনো দিন লাগবে না মৃত্যুর দাগ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles