এস . এম . সুলতান : একজন শিল্পী মানুষ

এস.এম. সুলতান।একজন শিল্পী। একজন মানুষ।সংবেদনশীল এক মানুষ। জন্মেছিলেন বিশ শতকের শুরুর দিকে, নড়াইলে।কৃষক পরিবারের এক সন্তান তিনি। রাজমিস্ত্রি বাবা ছিলেন একজন চাষীও। ফসল ফলানোর অবসরে কিংবা অবসর তৈরি করে নিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেছেন তিনি। এই ছুতোর বাবাকে কাজে সাহায্য করতে গিয়েই খেলার ছলে ছবি আঁকা শুরু করেন আমাদের সুলতান ।

বাংলার চাষী পরিবারে জন্ম। সুতরাং দরিদ্র তো বটেই।সুলতানের ছোটবেলা তাই কেটেছে দারিদ্রে। ছবি আঁকার প্রয়োজনীয় উপকরণ পান নি সব সময় । কিন্তু আঁকিয়ে সুলতান নজরে পড়েছেন স্থানীয় জমিদারের। পেয়েছেন পৃষ্ঠপোষকতা। তেরো বছর বয়সে কোলকাতা যান। সেখানে সে সময়কার বিখ্যাত চিত্র সমালোচক সাহেদ সোহরাওয়ার্দীর পরিবারে জায়গা পান ঘরের ছেলের মতো। ১৯৪১ সালে ভর্তি হন কোলকাতা আর্ট স্কুলে।তিন বছর পড়েন সেখানে। রেজাষ্ট হচ্ছিলো বেশ ভালো। কিন্তু হুট করেই ছেড়ে দেন পড়াশোনা।

বেরিয়ে পড়েন পথের টানে। সমাজসেবামূলক সংগঠন খাকসার আন্দোলন - এর একজন হয়ে ঘর করে তোলেন পথকেই । ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ভারতবর্ষব্যাপী । কাশ্মীর , লাহোর , করাচী , সিমলায় থেকেছেন , বেশ কিছুদিন ।তারপর ক্রমশ ইউরোপ - আমেরিকা । আজীবন ভবঘুরে, অবিবাহিত সুলতান বিশ্ব পরিভ্রমণ শেষে ৫৩ সালে দেশে ফিরে এলেন। বসতি গড়েন জন্মভূমি নড়াইলে । আমৃত্যু সেখানেই যাপন করেছেন অনন্য এক জীবন ।

এস. এস. সুলতান শিল্পী। জীবনাভিজ্ঞতাই তার শক্তির মূল ভিত্তি । কৃষক পরিবারে জন্ম এবং ভবঘুরে জীবনযাপন তার ছবির প্রাণ । ছোটবেলায় যখন নড়াইলে ছিলেন , ছবি এঁকেছেন কাঠ - কয়লা , হলুদ আর পুঁই ফলের রঙ দিয়ে । তারপর কোলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষা এবং ক্রমাগত ঘুরে বেড়ানোর যে জীবন সেই জীবনের কথাগুলো তাঁর ছবিতে । কাশ্মীরে যখন উপজাতিদের মধ্যে ছিলেন তখন চারপাশের মানুষ, সেখানকার নিসর্গ নিয়ে ছবি এঁকেছেন । এ ছবিগুলোর প্রায় সবই তেলরঙে আঁকা , তখন তার কাজে ভ্যানগগের সুস্পষ্ট প্রভাব। পরে তেলরঙের মাধ্যম থেকে সরে এসে অন্যান্য মাধ্যম নিয়ে নানা নিরীক্ষার পর ঝোঁকেন জলরঙে । মধ্য পঞ্চাশ পর্যন্ত একটানা তিনি জলরঙে শত শত ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন ।এস. আমজাদ আলীর মতে ‘ জল রং - এ সফট টোনে আঁকা বাংলার প্যানোরমাগুলোতে উঠে এসেছে শান্ত পরিবেশে জল আর আকাশের বিশাল বিস্তার, মিলিয়ে যাওয়া দিগন্ত, তালগাছ আর নৌকা , জেলে এবং কুঁড়েঘর।কাশ্মীরের প্যানোরমাগুলোর সবই বর্ণাঢ্য জমকালো- গাঢ় বর্ণের পাহাড়, বিচিত্র সব লতাগুল্ম, গাছপালা , হ্রদ আর নদী ।'

' সুলতানের সৃজনশীলতার শুরু থেকে ছবির মূল বিষয় ছিল প্রকৃতি । মধ্য পঞ্চাশের পর থেকে তার কাজে পরিবর্তন আসে।পল্লীবাংলার ল্যান্ডস্কেপ করতে থাকেন তিনি ল্যান্ডস্কেপে এলো ফসলের জমি, বাংলার কৃষিজীবন এবং ক্রমশ মানুষ । ষাটের শেষে তার পরীক্ষা - নিরীক্ষা এবং অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে মূর্ত হতে থাকে।তাঁর চিত্রকর্মের প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠলো মানুষের দেহাবয়ব।পরে ল্যান্ডস্কেপের পরিবর্তে মানুষই হয়ে উঠে তার ছবির অধিপতি। 

মানব সভ্যতার যাত্রা কিন্তু কৃষিকর্ম থেকে । কৃষি - জমি ফলিয়ে আবাদ করা মানুষেরাই ভারতবর্ষে, মেসোপটেমিয়ায়, চীনে, ব্যাবিলনে সভ্যতার জয়ডঙ্কা উড়িয়েছিল প্রথম । যেখানেই মাটি কর্মীমানুষের সাধনায় ফসল দিয়েছে, দিয়েছে স্থায়ী আবাসগৃহ সেখানেই ইতিহাস গতি পেয়েছে । ইতিহাস নির্মাতা এই কর্মী কৃষকেরাই শেষে সুলতানের ছবির নায়ক।সুলতানের আঁকা মানুষেরা তাই বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ । এ বিষয়ে আহমদ ছফার একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি : 'প্রকৃতি এবং ইতিহাসের গভীরতম অঙ্গীকার যারা নিরবধিকাল ধরে বহন করে চলেছে , নতুন ফুটন্ত ইতিহাসের আবেগ - উত্তাপ সবটুকু পান করে ফুটে উঠবার বীর্য এবং বিকাশমান সৃষ্টিশীলতা যাদের আছে।সেই শ্রমজীবী কিষাণ জনগণকে তিনি বাঙলার ইতিহাসের নবীন কুশীলব হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। সুলতানের কৃষক জয়নুল আবেদিনের কৃষক নয়।জয়নুল আবেদিনের কৃষকেরা জীবনের সংগ্রাম করে। সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন । তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না। পেশীর শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সাথে সঙ্গম করে প্রকৃতিতে ফুলে - ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে । এখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা , আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন , আজ এবং আগামীকালের একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে । সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয় । 

'সুলতান তাঁর ছবির প্রতিটি দেহকেই মহামানবের মতো এঁকেছেন।এ উপমহাদেশের অসহায় মানুষগুলোর অস্তিত্ব অনিঃশেষ যন্ত্রণার রূপকথা । এই মানুষেরা বৃটিশ শাসনে শোষিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে পাকিস্তানী শাসনামলে । এখনো স্বাধীন দেশের ভূমিতে তারা শোষিত বঞ্চিত হয়ে চলেছে । তবে অকুতোভয় তারা । টিকে থাকার জন্যে প্রতিমুহূর্তে অদম্য সংগ্রামে লিপ্ত। এই নির্ভীক মানুষগুলোর সাহসী অন্তরাত্মার জন্যে মানানসই দেহ তাই অনিবার্য । সুলতানের ফিগারগুলো মানুষের অন্তর্গত সেই শক্তি এবং উত্তাপেরই বাহ্যিক প্রকাশ। মানুষ ও জীবজগতকে অনুভব করার এই ধারা শিল্পী পেয়েছেন ইউরোপীয় রেনেসাঁসের শিল্পীদের কাছ থেকে , এ সম্পর্কে আহমদ ছফার পূর্বোক্ত লেখা থেকে আরো একটি উদ্ধৃতি :শেখ সুলতানের ছবির মধ্যে দ্য ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকান্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠতার ছাপ এতো গভীর এবং অনপনেয় যে মনে হবে এ চিত্রসমূহ কোনো রকমের মধ্যবর্তীতার বালাই ছাড়া, সরাসরি রেনেসাস যুগের চেতনার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে এই ঊনিশশো ছিয়াত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষক সমাজে এসে নতুনভাবে জন্ম গ্রহণ করেছে ।

'তার আঁকা পুরুষ ফিগারগুলোর মুখাবয়বে রয়েছে এক ধরনের আদিম রুক্ষ্মতা । জীবজন্তুর বিশেষ করে ষাড়গুলোর প্রতিকৃতিতে দেখি বলিষ্ঠতা । আদিম শক্তিতে মানুষ আর পশুর শ্রমের ঐকতান সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু নারী দেহগুলো এর বিপরীত । প্রাচ্য রীতি অনুযায়ী তারা আবৃত , উন্মুক্ত কেবল তাদের হাত - পা - মুখ । সোনা রঙে মাতৃময়ী মুখাবয়ব তাদের । সুলতান বিমূর্ত চিত্ররীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না । তিনি বিশ্বাস করতেন , ' পেইন্টিং - এ এবস্ট্রাকশনটা , পুরো নন - অবজেকটিভ ছবির ব্যাপারটা ডেভেলপ করেছে ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে । ওখানেই তো করবে । ওদের লাইফটা দেখুন । ওদের লাইফ কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে ভীষণ । ওদের চোখের সামনে শুধু ভারটিক্যাল লাইন তাছাড়া ওদের মনের ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে গেছে ।অত্যন্ত দ্রুত লাইফ , অহেতুক ফাস্ট , সবচেয়ে বড়ো কথাওদের কোনো ইনার ফুড নেই ।মানুষ মাত্রেরই কতোগুলো ইনার কনস্যলেশনের দরকার; লাভ , এফেকশন পরস্পরের মানবিক সম্পর্ক । ওগুলো ওরা লস্ করেছে । যতই আপনি ডেভেলপড মডার্ন হন না কেন , এসব না হলে লাইফ অর্থহীন । এসব কারণে কোনো এনভায়রনমেন্টই তাকে সুখী করতে পারবে না । ফলে একটা ডিপ ব্লুটেড ফ্রাসটেশন দেখা দিয়েছে । এ থেকে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ফিলিংস তৈরি হতেই পারে , যার রিফ্লেকশন ঐ ছবিগুলো। আমাদের এখানে এখন অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং করবার কোনো জাস্টিফিকেশন নেই।আমাদের লাইফ মোটেও ওয়েস্ট-এর মতো কর্মপ্লিকেটেড নয় । আমাদের এখন জীবনকে ভালবাসা দরকার । আমাদের জীবনের অনেক ডাইমেনশন এখনও আছে , ফাইট আছে । জীবনকে ভালবাসতে গিয়ে যদি কৃষকের ছবি না আঁকতে চাই , কোনো অসুবিধা নেই , সিটি , এরাউড ঢাকাকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু আঁকা যেতে পারে । তা না করে যদি আমি শুধু হরাইজন্টাল , ভার্টিকাল , সার্কল এগুলো দিয়ে স্পেসকে ব্যালান্স করতে থাকি , তাহলে তা ডিজাইন ছাড়া বেশি কিছু হবে না ।

সুলতান নিজস্ব এক রীতিকে পরিচিত করেছেন আমাদের শিল্প অঙ্গনে। নিজস্বতা নির্মাণে তার কোনো ফাঁক কি রয়ে গিয়েছিলো ? এ বিষয়ে শিশির ভট্টাচার্যের লেখাী লেখার অংশ বিশেষঃ বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির যে বৈচিত্র্য যা মানুষের চরিত্রের সাথে ওতপ্রোত জড়িত ।সুলতান সেই দৃষ্টিকোণ দিয়ে প্রকৃতি দেখেন নি । যেহেতু সুলতান গ্রামকে এবং প্রকৃতিকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন সেহেতু তার কাছ থেকে প্রকৃতির সাধারণ উপস্থাপন , অনেক ক্ষেত্রেই সাজানো একঘেয়ে বা মুখস্থভাব থেকে আঁকা , এমনটি কাম্য নয় । মানুষকে উপস্থাপন করার একটা বিশেষ ধরন ( স্বাস্থ্যবান পেশীবহুল ) যত গভীরভাবে সুলতান বেছে নিয়েছেন ঠিক সেই গভীর ভাবনাটা মানুষ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই যে সমস্ত চিত্রে নিসর্গের উপস্থিতির চেয়ে মানুষই সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে সেগুলো অনেক বেশি সম্পূর্ণ তার মধ্যে The First Plantation এবং চরদখল - এর মতো চিত্রগুলি চলে আসে। যা তার সাধারণ বর্ণনামূলক চিত্রগুলিতে মেলে না ।

নিরন্তর শোষণের মধ্যে ক্লীশ দিনযাপনে অভ্যস্ত আমাদের কৃষক সমাজ । অথচ এরাই আজো পর্যন্ত আমাদের অর্থনীতির মূল উৎস । শীর্ণকায় এই কৃষককে সুলতান দেখেছেন স্বপ্নময় , শক্তিমান এক চোখ দিয়ে । তার শক্তিমান দৃষ্টির ছোঁয়ায় , তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে কৃষকরা মহাশক্তির তেজে বলীয়ান । তার ক্যানভাস  মানুষ- প্রকৃতি সবই গেরুয়া মেটে রঙ । এই মাটির রঙে আঁকা বাংলার কৃষক দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে হয়েছে অনন্তের দিশারী ।অতীত থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের যাত্রাপথের কুশলী তো এরাই । শিল্পী এস.এম. সুলতান আমাদেরকে এই বিশ্বাসে বলীয়ান হতে বলেছেন, বলেছেন দেখো তাকিয়ে দেখো ' কি দর্পিত, কি ব্যঞ্জনাময় এই মানুষ শব্দটি । ' এইখানেই সুলতানের অনন্যতা । কিন্তু অনন্য এই শিল্পীর নায়ককেও নিজ হাতে নিজের মাথা ছিঁড়তে হয়েছে , ভাঙতে হয়েছে নিজের হাত - পা । সমাজের অন্ধকার অশুভ ছায়াই তো সুলতানের নায়ককেও দুএক সময় আত্মবিনাশী করে তুলেছিলো ।

বোহেমিয়ান, প্রকৃতি সংলগ্ন, জীবপ্রেমী , অপ্রাতিষ্ঠানিক,  প্রথা ভেঙে নিজস্ব প্রথাতে স্থিত এই শিল্পীমানুষের প্রয়াণে আমরা শোকগ্রস্ত । শান্তি পাক তাঁর আত্মা ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles