এস.এম. সুলতান: সৃজনশীলতা ও প্রান্তিক মানসের দায়

 

এক

সুলতানের শিল্পকর্ম বিবেচনায় সামনে এসে দাঁড়ায় তাঁর জীবনচর্যার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য । বস্তুতপক্ষে তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার পেছনে তাঁর শিল্পকর্মের ভূমিকা যতখানি তার চেয়ে সম্ভবত অধিক জীবনাচারের ভিন্নতার আকর্ষণ।এটি অস্বাভাবিকও নয়। একই প্রকার বিড়ম্বনার দুর্বিপাক শিল্প ইতিহাসে আরো শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটেছে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ এবং পল গগ্যাঁ দু'টি খুব চটজলদি উদাহরণ । একে নিছক দুর্ভাগ্যও হয়তো বলা যাবেনা , কারণ এরকম পরিস্থিতি শিল্পীর জন্য এনে দেয় ব্যাপক পরিচিতি ও আবেগঘন লোকপ্রিয়তা হোকনা তা বেঠিক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে । সে যেমনই হোক , সভ্য সমাজের প্রচলিত নিয়ম কাঠামোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এ ধরনের সৃজনশীল মানুষের প্রতি আমাদের এ পক্ষপাত এক ধরনের কৌতুহলোদ্দীপক বৈপরীত্য বটে। সমাজ নির্ধারিত জীবনচর্যার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণকারী মানুষের প্রতি আমাদের সাধারণ মনোভাব হলো বিতৃষ্ণার , অবহেলার , নিন্দার ও করুণার । তাঁকে আমরা মনে করি জীবনে অসফল , ব্যর্থ , অধঃপতিত, এমন কি কখনো কখনো বিপদজনক ।তবে এমন ব্যক্তি যদি সৃজনশীল কোনো কর্মকাণ্ডের দ্বারা লাভ করেন সাফল্য ও পরিচিতি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন ব্যাপকভাবে বন্দিত ও নন্দিত । তাঁকে ঘিরে তৈরী হয় ' মিথ্ ' , ' কাল্ট ' , ' কারিসমা'। তাঁর জীবনের বৈপরীত্যসমূহ অতিরঞ্জিত ও বর্ণারোপিত হয়ে গড়ে ওঠে তাঁর বৈশিষ্ট্য ও জনপ্রিয়তা। শিল্পী এস.এম. সুলতানের ক্ষেত্রে কমবেশী এ ব্যাপারটা ঘটেছে। সমাজের মূলস্রোতের বাইরে বা বিপরীতে অবস্থান গ্রহণের প্রবণতাসম্পন্ন চিত্তবৃত্তিকে আমরা আখ্যায়িত করতে পারি ‘ প্রান্তিক ’ মানসিকতা হিসেবে । সুলতানের শিল্পভাবনা বিবেচনায় তাঁর এ প্রান্তিক মানসের ওপর আলোকপাত জরুরী হয়ে উঠতে পারে এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রান্তিকতা বিষয়ে যৎসামান্য উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না আশা করা যায় । 

প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ক্লোদ লেভি স্ট্রোস তাঁর সুবিখ্যাত দ্যা সেভেজ মাইন্ড গ্রন্থে সর্বতোভাবে সভ্যতার বাইরে অবস্থানকারী আদিম সমাজের পর্যালোচনা করে জোরের সঙ্গে দাবী করেন যে তথাকথিত সভ্য সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গে সব সময় সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও আদিম মানুষের মনন ও মূল্যবোধ কোনো অবস্থাতেই হীনতর নয় । বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা উন্নততর । রুচি ও বিচারের পার্থক্যের কারণে অনেক সময় তা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা । নৃতত্ত্ববিদ ভ্যান গেনেপ্ আফ্রিকায় উপজাতিদের মধ্যে এক ধরনের লোকাচার লক্ষ করেছেন যাকে তিনি নামকরণ করেছেন Rites of Passage । এর তিনটি স্তরের একটি হলো গতানুগতিক জীবন থেকে পৃথক হয়ে একটি প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ । ভ্যান গেনেপ একে বলেছেন Liminal stage বা Liminality । এই দ্বিতীয় স্তরে ব্যক্তির দৈনন্দিন সামাজিক নিয়ম ও রীতিনীতি সবই মুলতবী থাকে । এর সঙ্গে তুলনা করা হয় মৃত্যুর বা জন্মের পূর্বেকার অবস্থার । তৃতীয় স্তরে অংশগ্রহণকারীরা পুনঃপ্রবেশ করে সমাজে, তবে নতুনরূপে নতুন অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে । নৃতত্ত্ববিদ ভিক্টর টার্নার পরবর্তীতে ভ্যান গেনেপের প্রান্তিকতার ধারণাটিকে আরো প্রসারিত করেন এবং একে সমসাময়িক সমাজ ও শিল্প সমালোচনার বিভিন্ন বিস্তৃত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন । টার্নার দেখিয়েছেন যে শুধু উপজাতীয় বা আদিম সমাজেই নয় , সব সমাজেই সর্বকালে কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা স্বেচ্ছায় এ ধরনের প্রান্তিকতায় অবস্থান গ্রহণ করেন । এ প্রান্তিকতা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে । স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যবরণ, ভবঘুরে স্বভাব, স্বেচ্ছাচারী আচরণ, প্রচলিত মূল্যবোধের বিরোধিতা , এমনকি সমাজের সাথে সংঘর্ষেও এর প্রকাশ ঘটতে পারে । সমাজের চোখে এঁরা অসফল , অনৈতিক । কিছু এঁরা হয়তো পালন করেন ভিন্নতর, এমনকি হয়তো ঊর্ধ্বতর কোনো নৈতিকতা । সভ্যসমাজের প্রান্তিকতা প্রায়শ ব্যক্তিক , তবে কখনো কখনো তা গোষ্ঠিবদ্ধও হতে দেখা যায় । আমাদের দেশে বৈষ্ণব , সুফী বা বাউলের মধ্যে এ ধরনের গোষ্ঠিবদ্ধ প্রান্তিক প্রবণতা লক্ষ করা যেতে পারে ।

প্রান্তিক মানসসম্পন্ন ব্যক্তি সাধারণত সমাজের প্রচলিত ধর্ম, সংস্কার, মূল্যবোধ ও নিয়মনীতিতে আস্থা স্থাপন করেন না। তিনি এর অন্তর্নিহিত অনৈতিকতা ও স্ববিরোধিতার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নির্মম সমালোচনায় বা উপহাসে এর বিরুদ্ধাচরণ করেন । সমাজের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কখনো উন্নাসিকের, কখনো উদাসীনের , কখনো বিদ্রোহীর । সমাজ তাঁকে গ্রহণ বা সহ্য করতে চায় না । অথচ প্রায়শ দেখা যায় প্রান্তিক ব্যক্তি বিশ্বাস করেন এক শ্রেণী-বিভক্তিহীন সাম্যভিত্তিক সমাজে , বিসর্জন দেন সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের মোহ ও উপায় , বরণ করে নেন দারিদ্র্য ও বঞ্চনা, পার্থিব সহায় সম্পদের প্রতি থাকেন নির্লোভ । তার মধ্যে বিরাজ করে এক ধরনের সমতাভিত্তিক মানসিকতা ও মৈত্রীবোধ।বৈষয়িক ও সামাজিক উন্নতির সোপান বেয়ে ওঠার চাতুর্যময় কর্মকান্ডে অভ্যস্ত আমাদের মানসে এসব প্রান্তিক মানুষ অবহেলা ও করুণারই পাত্র । কিন্তু তেমন একজন যখন সৃজনশীল প্রতিভায় আমাদের মনোযোগ ও স্বীকৃতি দাবী করে বসেন তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া দ্রুত বিপরীতমুখী গতি লাভ করে। ইতিহাসে এর সাক্ষ্য রয়েছে ।

বলা যেতে পারে সৃজনশীলতার সাথে প্রান্তিকতার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। শিল্প - সাহিত্য - সঙ্গীত - চলচ্চিত্র ইত্যাদির ইতিহাসের পাতা ওল্টালে অনেক নজীরই পাওয়া যাবে ।পুরোপুরি প্রান্তিক না হলেও প্রান্তিকতার ছিটেফোঁটা অনেক সৃজনশীল ব্যক্তির মধ্যেই লক্ষ করা যেতে পারে। বস্তুতপক্ষে সৃজনশীলতাও কিছুটা পরিমাণে প্রান্তিকতার জন্ম দেয়।সমাজে প্রচলিত আচার-সংস্কার, আপোষকামিতা , পার্থিব উন্নতির প্রতি আসক্তি সাধারণভাবে সৃজনশীল মানুষ এসবের প্রতি উদাসীন ও বৈরী হয়ে থাকেন। বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে লিওনার্দো - মিকেলএঞ্জেলো থেকে পিকাসো পর্যন্ত অনেকেই কমবেশী প্রান্তিক মানসিকতা সম্পন্নই ছিলেন । ভ্যানগঘ-গগ্যাঁর কথা আগেই উল্লিখিত হয়েছে।শিল্পকলায় গোষ্ঠিবদ্ধ প্রান্তিক বিশ্বাস ও আচরণও চর্চিত হয়েছে ডাডা , ফিউচারিজম প্রভৃতি দলবদ্ধ প্রান্তিকতার উদাহরণ । বাংলা শিল্প সাহিত্যের পরিধির মধ্যে খুঁজলেও এমন উদাহরণ পেতে বেশী দূর যেতে হয় না । সাম্প্রতিক অতীতের মাইকেল মধুসূদন ও কাজী নজরুল - এর প্রোজ্জ্বল উদাহরণ । আমাদের অনতিদীর্ঘ আধুনিক শিল্পের ইতিহাসেও এমন নজীর দুর্লভ নয় --- নভেরা আহমদ এবং এস.এম. সুলতান প্রান্তিক শিল্প মানসের সাম্প্রতিক উদাহরণ।পার্শ্ববর্তী ভারতেও রামকিঙ্কর বেজ বা এম. এফ . হুসেনের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে ।

সাহিত্য , নাটক , চলচ্চিত্র যেখানে কাল্পনিক চরিত্র নির্মাণ সম্ভব, সেখানেও প্রান্তিক নায়কের অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে এবং তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতিরও মোটেই কমতি নেই। লোককথা ও ধর্মকথায়ও এ ধরনের চরিত্র প্রায়শঃই পাওয়া যায় । টার্নার নিজেই বাইবেলের ‘ গুড সামারিটান' ও ডস্টয়ভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের সোনিয়া চরিত্রের উদাহরণ দিয়েছেন। আলবেয়্যার কাম্যুর আউটসাইডার ও গদার - এর পিয়ের লা ফু - এর নায়কদের কথা চট করে মনে পড়তে পারে । বাংলা সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই তবে দুটি কালজয়ী প্রান্তিক চরিত্রের কথা স্মরণ না করে পারা যাবে না শ্রীকান্ত ও অপু ।চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় প্রায়শই সভ্যতার অনৈতিক নিয়মনীতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন তাঁর প্রান্তিক নায়কদের , তাঁদের মুখ দিয়েই উচ্চারণ করিয়েছেন তাঁর নিজের ধিক্কারধ্বনি , ' শাখা প্রশাখা'র প্রশান্ত ও 'আগন্তুক ' - এর মনোমোহন মিত্র এ ধরনের দু'টি চরিত্র।

দুই 


তবে সাহিত্যে - নাটকে চলচ্চিত্রে যত অবলীলায় প্রান্তিক মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বাস্তবে পুরোপুরি প্রান্তিক মানুষ কিন্তু তত সহজলভ্য নয় । এর কারণও স্পষ্ট । কিছুটা খ্যাপামী , কিছু উদাসীনতা , জীবনের কিছু পর্যায়ে বাউন্ডুলেপনা এসব , অর্থাৎ প্রান্তিকতার কিছু কিছু আলামত , ভিন্ন স্বভাবের অনেক মানুষের মধ্যেই দেখা যায় । তবে সমাজ - সংসার - সভ্যতাকে অস্বীকার করে বা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জীবনব্যাপি প্রান্তিক অবস্থানে অনড় থাকতে বুকের পাটা দরকার । শুধু তাই নয় , আরো দরকার বিশ্বাস ও আদর্শের আসুরিক শক্তি , অমিত সাহস ও মনোবল , প্রাত্যহিক স্পৃহা ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে এক উন্নততর বোধের জগতে স্থিতি । বলাবাহুল্য , অসাধারণের পক্ষেই কেবল এ পর্যায়ে উত্তরণ সম্ভব ।

পুরোপুরি প্রান্তিক মানুষকে সমাজ সহানুভূতির চোখে দেখে না । তাকে মনে করা হয় দায়িত্বজ্ঞানহীন, অযোগ্য, অসফল ও ধিক্কারযোগ্য বোঝা হিসেবে । প্রাত্যহিক সাংসারিক ও সামাজিক দায়দায়িত্বে সাধারণতঃ সে ব্যক্তি ব্যর্থতারই পরিচয় প্রদান করেন । কিন্তু অনেক সময়ই তার মধ্যে শিল্প- সাহিত্য দর্শনের সৃজনশীল স্ফূরণ দেখা যায় । এগুলো প্রায়শই কোন পরিণতি অর্জন করে না, প্রতিভার ক্ষণিক দ্যূতি হয়ে মিলিয়ে যায় । তবে ক্ষেত্রবিশেষে পূর্ণ প্রান্তিক মানসের কোনো ব্যক্তি অসাধারণ সৃজনীশক্তির পরিচয় দিয়ে থাকেন এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার অভাব থাকলেও এক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল উত্তরণের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।তাঁর পরিচিতি স্থানিক গন্ডি ছেড়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যপ্ত হয়ে যেতে পারে।একটি বিশেষ মাত্রা অর্জনের পর সমাজ তাঁকে স্বীকৃতি না দিয়ে পারে না, যদিও অধিক ক্ষেত্রে এটি মৃত্যু - পরবর্তীকালেই ঘটে থাকে। সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রকদের স্বীকৃতি অর্জনের পর তাঁর সম্পর্কে সৃষ্টি হয় ব্যাপক আগ্রহ, এবং এক্ষেত্রে তাঁর প্রান্তিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁর একটি জাঁকালো ভাবমূর্তি তৈরী করতে সাহায্য করে । 


ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ প্রান্তিক মানসের সুসংবদ্ধ সৃজনশীলতার একটি মোক্ষম উদাহরণ । ভ্যান গঘের জীবন চরম স্বেচ্ছাচারিতা, নিদারুণ উচ্ছৃঙ্খলতা , খ্যাপামী , উদ্ভট আচরণ এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মনীতির সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষময় এক করুণ পরিণতির চিত্র উপস্থাপিত করে । তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই এত অবিন্যস্ত ও দিকনির্দেশনাহীন ছিল যে চিন্তায় ও মননে তাঁর পক্ষে কোনো শৃঙ্খলা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা শক্ত।তাঁর সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্যের উন্মোচন ও আবেগের প্রশমনের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সৃজনশীলতাকে এক বিক্ষিপ্ত ও বিচূর্ণিত মানসের খন্ড খন্ড স্বতস্ফূর্ত বিচ্ছুরণ বলেই মনে করা হতো । ভ্যান গঘের মৃত্যুর অনেক পরে ১৯২৭ এবং ১৯২৯ সালে অনুজ থিওকে লেখা তাঁর পত্রগুচ্ছের দু'টি সংকলন প্রকাশিত হয়। এগুলি ১৮২৭ থেকে তাঁর মৃত্যুর বছর ১৮৯০ সালের মধ্যে লেখা যখন দারিদ্র্য, শারীরিক পীড়া, মনোবিকলন তথা উন্মাদগস্ততার এক চরম সঙ্কটের মধ্যে চলেছে তাঁর জীবন । অথচ এক পরিশীলিত ও সুশৃঙ্খল শিল্পী- মানসের এক অপূর্ব উদঘাটন এ পত্রগুলি, বিশ্বের পত্রসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।পত্রগুচ্ছ প্রকাশিত হওয়ার পরই জানা গেল ভ্যান গঘ মোটেই ছিলেন না অশিক্ষিত ও অসম্পূর্ণ মানসিকতাসম্পন্ন কিংবা চিন্তা ও পরিকল্পনাবিহীন স্বতস্ফূর্ত প্রতিভামাত্র।বরং তাঁর জীবন ও কর্মধারা সম্পর্কে তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, এমন কি নিজের অসুস্থতাকেও তিনি অনুধাবন ও অতিক্রম করার প্রয়াস চালিয়েছেন।তাঁর সাহিত্যপাঠ ছিল যথেষ্ট গভীর। শিল্পকলা জগতের প্রাচীন ইতিহাস ও সমসাময়িক শিল্পজগত সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল পরিপূর্ণ।হেন বিষয় নেই যার অবতারণা এ পত্রগুচ্ছে ভ্যান গঘ করেননি। তাঁর দৈনন্দিন দিনযাপন, অসুস্থতা , অর্থাভাব , ক্ষোভ , গ্লানি , অভিমান ইত্যাদি বার বার ব্যক্ত হয়েছে । কিন্তু তারই সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে জীবন ও জগতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ, তীব্র মানবপ্রীতি ও অন্ত্যজ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা। সেই সঙ্গে প্রচুর আলোচনা রয়েছে শিল্পকলার প্রতি তাঁর অনুরাগ ও ভাবনা বিষয়ে-- শিল্পের নানা সমসাময়িক সমস্যা এবং ভবিষ্যতের শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর ভাবনা ও মতামত ।

ভ্যান গঘের শিল্পকলাকেও এক সময় মনে করা হতো এ কেবলই এক উন্মতাল ও আবেগআপ্লুত অসাধারণ প্রতিভাধর শিল্পীর তাৎক্ষণিক উদ্দীপনার বিস্ফোরণ। এর পেছনে চিন্তা ও পরিকল্পনাও কাজ করেছে এমন মনে করা হতোনা । পত্রগুচ্ছ এ ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। আধুনিক শিল্পবিচারে ভ্যান গঘের শিল্পকর্মে স্বতস্ফূর্ততা ছাড়াও নির্মাণ ও সংগঠনের অসাধারণ সুসামঞ্জস্য গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এসেছে। প্রায় অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় আঁকা হলেও তাঁর প্রতিটি চিত্র গঠনসৌকর্যে শুধু নিটোল নয়,অভিনবও বটে । ইমপ্রেশনিজমের আলোর উদ্ভাসকে ভ্যান গঘ পৌঁছে দিয়েছেন বর্ণের এক নবতর অর্থময়তার জগতে।বর্ণের স্বাধীন অন্তরানুভূতি প্রকাশের শক্তি প্রথম তাঁর ছবিতেই প্রখরভাবে প্রতিভাত । তাঁর শিল্প একটি উদ্বেলিত প্রান্তিক মানসের পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শিল্প যেমন, তেমনই তা সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী শৈল্পিক ধারণাসম্পন্ন এক অসাধারণ শিল্পমানসেরও স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর শিল্পের মধ্যেই তিনি ধারণ করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সকল শিল্পভাবনার নির্যাস, তাকে রূপান্তরিত করে রূপায়িত করেছেন বিংশ শতাব্দীর শিল্প সম্ভাবনার দিকনির্দেশনা । মৃত্যুর একশত বছর পরেও তিনি এখনও অনেক শিল্পীরই প্রণোদনার উৎস ।

তাহলে জীবনযাপনে শৃঙ্খলা ও পরিকল্পনাহীন হয়ে কিংবা সামাজিক আচরণকে প্রত্যাখান করেও সৃজনশীলতায় উত্তরণশীল সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে অভিযাত্রা সম্ভব । সম্ভব সৃজনশীলতার ক্ষেত্রটিতে আধুনিক , সমসাময়িক ও পরিজ্ঞাত থাকা এবং বর্তমানকে অতিক্রম করে আগামীর দিকনির্দেশনা অনুধাবনের দৃষ্টিশক্তি অর্জন । তেমন সৃজনশীল প্রান্তিক হয়তো থাকেন সমকাল থেকে অগ্রবর্তী , জীবৎকালে হয়তো থাকেন অপরিজ্ঞাত ও উপেক্ষিত। কিন্তু তাঁর বিশিষ্টতা উদ্‌ঘাটিত হওয়ার পর সৃজনশীলতার চেয়েও প্রান্তিকতার নানান চটকদার অনুষঙ্গই তাঁকে করে তোলে অধিক লোকপ্রিয়এমন প্রায়শই ঘটে থাকে। প্রান্তিক অথচ সৃজনশীলকে বিচারের ক্ষেত্রে এ টানাপোড়েন প্রশ্রয় দিতে পারে বিভ্রান্তির, জন্ম দিতে পারে ভ্রান্ত মূল্যায়নের।শিল্পস্রষ্টা হিসেবে এস.এম. সুলতানকে বিবেচনার ক্ষেত্রে তাঁর প্রান্তিক মানসের গুরুত্বের দিকটি যেমন বিস্মৃত হওয়া যাবেনা তেমনই তা যেন তাঁর শিল্পকর্ম বিচারের ওপর ছায়াপাত না করে সে সতর্কতাটুকুও অবলম্বন করা প্রয়োজন ।

তিন

এদেশে সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিত্রশিল্পী সুলতানের অবস্থানই বোধ হয় সবচেয়ে প্রান্তিকতায় । জীবনের একেবারে গঠনমূলক পর্যায়েই তিনি গতানুগতিকতার গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসেছেন এবং স্থিত হয়েছেন প্রান্তিকতায়।মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আপোষহীনভাবে রক্ষা করেছেন সে অবস্থান, কোনো পিছুটান, মনোবাঞ্ছা, প্রলোভন কিংবা সামাজিক প্রতিপত্তির প্রত্যাশা তাঁকে টলাতে পারেনি তাঁর অধিষ্ঠান থেকে। প্রান্তিকতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ জীবনের কোনো কোনো পর্যায়ে ধারণ করা এক ধরনের বিলাসিতা বা ফ্যাশন হিসেবেও চলে।সুলতানের ক্ষেত্রে এটি মোটেই তা নয়, এ ব্যাপারে তাঁর সততা ও একনিষ্ঠতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশের কোনো অবকাশই নেই।সুলতান প্রথমতঃ প্রত্যাখান করেছেন নগরজীবনের উপর পালিশ দেওয়া চাকচিক্যময় জীবন।সেই সঙ্গে এই জীবনের ভোগবাদিতা, সম্পদ- সম্পত্তি অর্জনের প্রতিযোগিতাকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।তথাকথিত সভ্য ও শিক্ষিত মানুষের প্রচলিত ভব্যতা ও মূল্যবোধের ভণ্ডামিকেও তিনি পরিত্যাগ করেন। বিনিময়ে তিনি আস্থা স্থাপন করেন বিজ্ঞান ও সভ্যতার কলঙ্কস্পর্শহীন গ্রামজীবনে। সে গ্রাম হয়তো বা শতবর্ষ আগের স্বাবলম্বী পল্লীসমাজ, বাইরের কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই যা আপন অন্তর্নিহিত শক্তিতে চলিষ্ণু ও স্বনির্ভর।এখানে তিনি প্রযুক্তি বা আধুনিকতার কোনো চিহ্নকেই বরদাস্ত করতে চাননা। সুলতানের অমিত আস্থা গ্রামীণ কৃষিজীবী মানব মানবীর প্রতি। এদের উৎপাদনশীল, শ্রমশীল, মৃত্তিকা- আবদ্ধ জীবনপ্রবাহে তিনি প্রত্যক্ষ করেন জীবনের সকল অর্থময়তা। এরা আদিম ভূমিপুত্র , মৃত্তিকা থেকে উৎসারিত, মৃত্তিকা কর্ষণে শস্য উৎপাদনের প্রাচীন পেশার প্রতিভূ। অতএব মৃত্তিকারও একমাত্র ন্যায্য অধিকারী। এদের মহিমাকে বিস্তৃত বিস্ফারিত করা তাঁর কর্তব্য, এদের সংগ্রামে সহায়ক উদ্দীপনামন্ত্র সংযোজন তাঁর দায়িত্ব--- এভাবেই সুলতান নির্ধারণ করেন তাঁর জীবন ও শিল্পের অঙ্গীকার ।

এখানে আবারও স্মরণ করে নেওয়া ভালো নাগরিক ভোগবিলাস, সহায়সম্পত্তি ও খ্যাতি-প্রতিপত্তি অর্জন সুলতানের জন্য দুরূহ ছিলনা। এই মোহটুকু ত্যাগ করতে পারার মনোবৃত্তিটাই অসামান্য একটি ঘটনা । এই ত্যাগটুকুর মূল্যই অপরিসীম। যাঁরা সুলতানের প্রান্তিকতাকে সন্দেহের চোখে দেখেন এবং সেই সুবাদে তাঁর শিল্পকর্মের প্রতিও প্রদর্শন করেন উন্নাসিক বৈরিতা তাঁদের সাথে একমত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সুলতান শুধু বৈষয়িক প্রাপ্তিকেই প্রত্যাখান করেননি সেই সঙ্গে অস্বীকার করেছেন নাগরিক সমাজের ভণ্ডামিকে, তার ঘুনে ধরা মূল্যবোধকে। নিজের মধ্যে তিনি সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছেন এক ধরনের নিজস্ব বিশ্বজনীনতা, মানবিকতাবোধ, ধর্মীয় সমন্বয়চেতনা ও অধ্যাত্মবোধ।অন্ত্যজ ও অবহেলিত মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ও মমত্ববোধেও কোনো খাদ নেই । তাঁর শিল্পবিশ্বাসেও ধ্বনিত হয় মানবের অজেয় সত্তার জয়ধ্বনি। যে কোনো হীন উপায়ে আপন স্বার্থসিদ্ধির প্রতিযোগিতামূলক এই সমকালে বাস করেও এসবের ঊর্ধ্বে নিজকে স্থাপন করতে পারাটাই একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত ।

সুলতানের প্রান্তিক অবস্থানে প্রত্যাখানটিই মুখ্য।বিপরীতে এর বিকল্প হিসেবে তাঁর জীবনাদর্শ খুব পরিষ্কার নয়।তাঁর জীবন-ভাবনায় আধ্যাত্মিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে হয়।এই ভাবনার মূল সম্ভবত প্রেমঈশ্বরপ্রেম, মানবপ্রেম।এর ফলেই সম্ভবত তিনি তাড়িত হয়েছেন সুফী , বৈষ্ণব , বাউল, সহজিয়া ইত্যাকার প্রেমমুখী প্রান্তিক জীবনাদর্শে।প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সম্প্রদায়বোধকে অতিক্রম করে পেরেছেন একটি বিশ্বজনীন মানবিক চেতনা অর্জন করতে । তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্বে এসবের প্রকাশ দেখা যায় ।তবে তাঁর মানবিকতার সঙ্গে আধুনিক ইহজাগতিক মানবিক চেতনার কিছু পার্থক্য থাকে। কারণ সুলতান নিজেকে সমকালীন করে তোলার ব্যাপারে খুব চেষ্টিত নন। ফলে বর্তমান যুগের মানবিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে তাঁর তেমন আগ্রহ জাগ্রত হয় না অথবা এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যও থাকে ধোঁয়াটে ।গ্রামজীবনের স্বয়ম্ভর ও পরিপূর্ণ যে চিত্রটি তাঁর আদর্শ বাস্তবের সঙ্গে তাকে তিনি বিতর্কে টানেন না, এক দূরাচারী স্বপ্নের মত তাকে বহন করেন মাত্র।

তার মানে এ নয় যে সুলতানের প্রান্তিকতার কোনো ইতিবাচক গুরুত্ব নেই। তাঁর প্রত্যাখ্যানের বিকল্প কোনো সমাধান উদ্ভাবন তাঁকে করতে হবে এমনও কোনো কথা নেই । দৈনন্দিন জীবনযাপনে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে এর কিছু উদাহরণ হয়তো তিনি সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু একটি সৃজনশীল মানস তার বিকল্প চিন্তাকে প্রধানতঃপ্রকাশ করবে তার সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে।সুলতানের ক্ষেত্রে এটি চিত্রকলা।পল গগ্যাঁ সুলতানের মতই নাগরিক সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করে আশ্রয় নিয়েছিলেন পলিনেশীয় দ্বীপের আদিবাসীদের মধ্যে।সেখানে অনুপ্রবেশকারী ইউরোপীয়দের দ্বারা আদিবাসীদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে গগ্যাঁ উদ্ধতভাবে সরব ছিলেন, কিন্তু সেটি তাঁর প্রান্তিক অবস্থানের ইতিবাচকতার অতি সামান্য অংশ মাত্র। যে সহমর্মিতা ও উপলব্ধি মিশ্রিত করে ঐ দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের জীবন, বিশ্বাস ও ভাবনাকে তিনি রূপায়িত করেছেন তাঁর চিত্রকলায়, তাদের আদিম শিল্পশৈলীকে যেভাবে তিনি সংমিশ্রিত করেছেন আধুনিক শিল্পধারার সঙ্গে, এবং এভাবে আধুনিক শিল্পের যাত্রাপথে তিনি যেভাবে সংযোজন করেছেন নবতর বোধসেটিই গগ্যাঁর প্রান্তিকতা থেকে বড় প্রাপ্তি । সুলতানের ক্ষেত্রেও এটিই বিবেচ্য হওয়া উচিত, তাঁর প্রান্তিকতা সৃজনশীল উদ্ভাবনে আমাদের তেমন কোনো নবতর বোধের জগতে উন্নীত করতে সমর্থ কিনা ।

সৃজনশীলতার বাইরে সুলতানের প্রান্তিক মানসের অন্যান্য দিকগুলি খতিয়ে দেখা যেতে পারে । সামাজিক শৃঙ্খলতার সকল বন্ধনকে তিনি অস্বীকার করেছেন-- প্রত্যাখান করেছেন ভূ-সম্পত্তি ও জাগতিক প্রতিপত্তি অর্জনের মোহ, সংসারের বন্ধন ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে আপন অধিকারের সীমানা নির্ধারণ কিংবা পদক-পুরস্কারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা অর্জনের কুট-কৌশল অবলম্বনের আকর্ষণ। এক বিশ্বজনীন মানবিক বোধ এবং স্বদেশপ্রেম তাঁকে তাড়িত করেছে বরাবর যার ফলে ভবঘুরে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষের পথেপ্রান্তরে ।মাটি এবং মানুষের মধ্যে স্বদেশের আত্মাকে আবিষ্কারের প্রণোদনাও তাঁকে করেছে ঘরছাড়া ।সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আধ্যাত্মিক আকুতি পরমাত্মা বা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার বৈরাগ্যবোধ। পরমকে প্রাপ্তির এষণা শেষ পর্যন্ত প্রেম নামক অনুভূতিতে স্থিত হয়েছেমানবের প্রতি প্রেম, জীবজগতের প্রতি প্রেম, অকলঙ্ক প্রকৃতির প্রতি প্রেম।তাঁর মানব অবশ্য নয় আধুনিক সভ্যতা সৃষ্ট চতুর পরজীবী ভোগবিলাসী মানব, তাঁর প্রেম শুধুমাত্র সে মানবের প্রতি যে মানব আদিম প্রাচীন ভূমি উৎসারিত উৎপাদনশীল পল্লীবাসী কৃষিজীবী। তাঁর চিত্রকলায় তিনি বিধৃত করেছেন ভূমিপুত্র মানবের প্রতি তাঁর আস্থা ও স্বপ্নের বয়ান। নাগরিক সমস্ত সুযোগ প্রত্যাখান করে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে স্থায়ীভাবে স্থিত করেছেন পল্লীজীবনে।এখানে তাঁর অন্য দু'টি আকর্ষণ শিশু ও প্রাণীজগৎ ।এটি খুব স্বাভাবিক যে শিশুকালকেই তিনি মানবিক উৎকর্ষ রোপণের প্রকৃষ্ট সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং প্রকৃতি, প্রাণী ও শিল্পকলার স্পর্শের মধ্যে তাদের বিকাশকে তিনি আদর্শতম বলে মনে করেছেন। সামাজিক কর্মকাণ্ড বলতে সুলতান যা করেছেন সেটুকু শিশুদেরকে ঘিরেই। শিশুর শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন নান্দনিক অনুশীলন, 'শিশুস্বর্গ' নামক স্বপ্নে ছিল যার সম্পূর্ণতা প্রাপ্তির পরিকল্পনা। জীবজগতের প্রতি প্রেমকেও তিনি দিতে চেয়েছেন গভীরতর সংবেদনশীলতা, যাতে শিশু এবং বয়স্ক সকলের মধ্যেই সঞ্চারিত হবে কিছু মৌল মানবিক গুণ । চিত্রকলার বাইরে এসব তার প্রান্তিক ইতিবাচকতা ।

কিন্তু তবু প্রশ্ন থাকে । ১৯৫৩ সালে নড়াইলের নিভৃত নির্বাসনে যাবার পর ১৯৭৬ এ ঢাকায় তাঁর প্রদর্শনীর মাঝখানে ২৩ বছর তিনি ঠিক কি করেছেন? তাঁর নিজের বয়ানেই জানা যায় যে, এসময় তিনি ছবি বলতে গেলে আঁকেনইনি । বলা যেতে পারে যে এ সময় তাঁর গর্ভযন্ত্রণাকাল, যথার্থ শিল্পভাষা অনুসন্ধানের ও আত্ম আবিষ্কারের রক্তাক্ত সাধনার কাল। কিন্তু তা মনে হয় না । দীর্ঘ তেইশ বছর তাঁর অনুশীলন বা অনুসন্ধানের কোনো রেখাচিত্রেরও সন্ধান পাওয়া যায় না। শিল্পের মাধ্যমেই যিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাঁর জীবনসত্য ও শিল্পসৃষ্টির মধ্যেই যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনযাপনের সার্থকতা তাঁর দীর্ঘ তেইশ বছরের নীরবতার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমরা জানতে পারিনা।পল্লীজীবন ও ভূমিআশ্রিত প্রাচীন উৎপাদন প্রথাসমূহের প্রতি তার অঙ্গীকার সত্ত্বেও তিনি নিজে সে জীবনের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত হন না। একটি রহস্যের আবরণে নিজেকে এক সন্ত , দরবেশ বা খ্যাপাটে বিবাগীর মত উপস্থাপিত করেন তিনি। ফলে গ্রামে বাস করেও তিনি থাকেন আউটসাইডার।পল্লীসমাজের মানুষ তাঁর প্রতি হয়তো জানায় রহস্যমিশ্রিত শ্রদ্ধা , বিরক্তিমিশ্রিত ঔদাসিন্য কিংবা বিস্ময়মিশ্রিত কৌতূহল।কিন্তু কখনোই সম্পূর্ণভাবে তাদেরই একজন মনে করেনা।এখানে তাঁর বিশ্বাস ও ভালোবাসার ক্ষেত্রটির সঙ্গে তিনি কিছুটা দূরত্বের সম্পর্ক আপনিই রচনা করেন। ফলে সুলতান কিছুটা হলেও অগ্রহণযোগ্য থাকেন তাঁর পরিপার্শ্বের গ্রামীণ পরিমণ্ডলের কাছে। নগর এবং গ্রাম উভয়ের সঙ্গেই তাঁর থেকে যায় একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ।

চার 

চিত্রশিল্পী হিসেবে এস.এম.সুলতান তাঁর জীবিতাবস্থাতেই ব্যাপক স্বীকৃতি ও সাধুবাদ লাভ করেছেন।তাঁর চিত্রকলা সম্পর্কে শিল্পরসিক মহলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা লিখেছেন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আলোচনা- সমালোচনা। তাঁর প্রদর্শনীসমূহ দর্শক মহলে যে পরিমাণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তেমন খুব কম শিল্পীর বেলায়ই দেখা গেছে। তাঁর জীবন নিয়ে রচিত হয়েছে উপন্যাস , নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র।সাম্প্রতিককালে তাঁর মৃত্যুর পর কাগজপত্রে সাময়িকীতে তাঁকে নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে প্রচুর উচ্ছ্বাস।বলাবাহুল্য সুলতান স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের দ্বারাই অর্জন করেছেন এমনতর সম্বর্ধনা।

তবু তাঁর সম্পর্কে লিখিত আলোচনাসমূহের অধিকাংশই মনে হয় সুলতানের শিল্পের নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ নয়।এগুলির সিংহভাগই গভীর কোনো পর্যালোচনাবিহীন আপ্লুত প্রশংসাবাক্যে আকীর্ণ অথবা শুধুমাত্র উপরতল স্পর্শকারী দায়সারা বয়ান।মাত্র দু'টি রচনাই উল্লেখযোগ্যরূপে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে এর একটি আহমদ ছফা রচিত সুদীর্ঘ নিবন্ধ ' বাংলার চিত্র ঐতিহ্য সুলতানের সাধনা, অপরটি শাহাদুজ্জামান এর সঙ্গে শিল্পীর বিস্তৃত আলাপচারিতা ।এ দু'টি রচনায় সুলতানের জীবনাদর্শ ও শিল্পসাধনার মর্মমূলটি উদঘাটনের পরিশ্রমী প্রয়াস লক্ষ করা যায় ।

এখানে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে সুলতান সম্পর্কে অধিকাংশ রচনায় তাঁকে লোকজ ধারার শিল্পী হিসেবে যে বয়ানটি উপস্থাপিত করা হয় সেটি সঠিক নয়। সুলতানের শিল্পকর্মের সঙ্গে আমাদের লোকশিল্প ঐতিহ্যের সম্পর্ক সামান্যই ।একমাত্র বর্ণচয়নে শুদ্ধতার প্রতি পক্ষপাত ও বিষয়ের পৌনঃপুনিকতার মধ্যে লোকশিল্পের সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ করা যেতে পারে । তাঁর শিল্পের অন্য সব কিছুই নাগরিক প্রশিক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাপ্ত । লোকজ বিষয় নিয়ে ছবি আঁকলেই কেউ লোকধারার শিল্পী হয়ে যান না । যে অর্থে জয়নুল আবেদিন লোকধারার শিল্পী নন, সে অর্থে সুলতানও তা নন - মোটেই ।সুলতানের সৃজনপ্রয়াসের কোনো বিবর্তনমূলক ধারাবাহিক চিত্র পাওয়া যায় না।১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত প্রথম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের পূর্বে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তাঁর আঁকা কোনো মূল ছবির হদিস পাওয়া যায় না । আমরা শুধু এটুকু জানতে পারি যে পঞ্চাশের দশকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানকালে তিনি শিল্পী হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। প্রধানত নিসর্গদৃশ্যের রূপকার হলেও তিনি ইমপ্রেশনিস্ট এবং এক্সপ্রেশানিস্ট ধরনের শৈলীর কাজ করেছেন, এমন কি নির্বস্তুক চিত্র রচনারও প্রয়াস চালিয়েছেন। তৎকালে অর্জিত খ্যাতির পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করা যায় যে এসব চিত্র শিল্পগুণে নেহাৎ ফেলনা ছিল না।তবুও দৃষ্টিসম্মুখে কোনো উদাহরণবিহীন চিত্রশিল্প সম্পর্কে আলোচনা সম্ভব নয় ।তাই ১৯৭৬ থেকে তাঁর সাম্প্রতিক সৃজনপর্ব সম্পর্কেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে হয় ।

সুলতানের চিত্রকলা দৃষ্টিসম্মুখে প্রথম যে অভিঘাতটি তৈরী করে তা হলো একটি বিস্ফোরণোন্মুখ শক্তির প্রকাশ ও মন্যুমেন্টালিটি বা সমুন্নতভাব। দর্শককে উদাসীনভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে দেয়না, আকৃষ্ট ও কৌতুহলী করে তোলে ; আবিষ্টও করে । বিস্তীর্ণ গ্রামীণ পটভূমি নিয়ে আঁকা হলেও তাঁর ছবির মূল থীম মানুষ , প্রকৃতি এসেছে নেহাত পটভূমি বা অনুষঙ্গ হিসেবে।শাহাদুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎকারে সুলতান আক্ষেপ করেছেন এদেশে একজনও ল্যাগুস্কেপ পেইন্টার হলো না বলে , সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেও কিন্তু তা হবার চেষ্টা করেননি।তাঁর ছবির পটভূমি জুড়ে গ্রামীণ নিসর্গের যে রূপায়ণ তা নেহায়েতই একটি সাজেশন মাত্র , কদাচিৎ তা হয়ে ওঠে ল্যান্ডস্কেপ, খুব কম সময়েই তা আকৃষ্ট করে তাঁর মনোযোগ।এটি বাঙালি গ্রামের একটি আর্কিটাইপ, বিশেষ স্থানিক নিসর্গের রূপায়ন নয় ।

অবশ্য নিসর্গের রূপায়ণ সুলতানের উদ্দেশ্যও নয়।প্রকৃতির পটভূমিতে নেহাত ক্ষুদ্র মানুষকে প্রকৃতির চেয়েও বড় গগনচুম্বী শক্তিধর করে দেখানোই তাঁর কাজ । ফলে অনুপাতটি এখানে উল্টে যায় মানুষ হয়ে ওঠে বৃহৎ ও শক্তিধর, প্রকৃতি দূরে সরে যায় অকিঞ্চিতকর হয়ে।এখানে অনেকটাই তিনি জয়নুল আবেদিনের সগোত্র। তবে দু'জনের অমিলও লক্ষ্যযোগ্য । জয়নুলের ছবিতে প্রকৃতি জঙ্গম ও বিপুলা , মানুষ সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকার প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত ; সুলতানের চিত্রে প্রকৃতির ওপর মানুষের দাপট প্রতিষ্ঠত । তাঁর মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে না, প্রকৃতিকে শাসন করে ।

মানব শরীরের রূপায়ণেরই সুলতান হয়ে ওঠেন বৈশিষ্ট্যময় ও স্বকীয় । তাঁর ছবিগুলি থেকে মানবমানবীমূর্তিসমূহ তুলে নিলে যা অবশিষ্ট থাকে তা শিল্পের বিচারে নেহায়েতই সাধারণ মাপের বলে বিবেচিত হওয়ারই সম্ভাবনা । তাঁর স্ফীতদেহ পেশীবহুল পুরুষমূর্তিগুলিই বস্তুতপক্ষে তাঁর চিত্রে রচনা করেছে একটি ভিন্নতর দ্যোতনা , প্রাত্যহিকতার সামান্যতা ফুঁড়ে তারা তাঁর চিত্রকে উত্তীর্ণ করে দেয় নান্দনিক বোধের ঊর্ধ্বলোকে । তারাই এসকল চিত্রকে রক্ষা করে পল্লীদৃশ্যের সস্তা ভাবালুতা থেকে, এতে সঞ্চারিত করে চিরায়তের দোলা ।যে আদিম ভূমিপুত্র আদমসন্তান পৃথিবীর বুক চিরে প্রথম তুলে এনেছিল শস্যের মঞ্জরী তারই উত্তরাধিকারী গ্রামবাংলার কর্মিষ্ঠ কৃষককূলের দিনযাপনের এক পাঁচালী যেন রচনা করেন সুলতান। তাদের প্রাত্যহিক জীবনক্রিয়ার পরিচিত দৃশ্যই তিনি আঁকেন, কিন্তু পটভূমিজুড়ে মানবমূর্তির বিস্ফোরণোন্মুখ শারীরিক সামর্থের রূপায়ণে তা সাধারণের সীমাকে অতিক্রম করে যায়।এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপূর্ণতাকে সুলতান অতিক্রম করেন মানবশরীরের নিজস্ব অতিরঞ্জন দ্বারা স্বভাব শিল্পীর 'নাইভ' বা অপটু সৌন্দর্যের আকর্ষণ দ্বারা এবং বিষয়বস্তুর একরৈখিক পৌনঃপুনিকতায় তাঁর বিশ্বাসের অনড় রূপায়ণের মাধ্যমে । তাঁর বিরাটাকার ক্যানভাসগুলি কোনো বাস্তব দৃশ্যের হুবহু প্রতিরূপ নয়, এ যেন স্মৃতি ও স্বপ্নের ঘোর লাগা এক মানুষের অন্তর্গত বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব । এভাবেই প্রথম জীবনের জলরং ও তেলরঙে নিসর্গদৃশ্যের কুশলী রূপকার থেকে সুলতানের উত্তরণ ঘটে বিশ্ব-প্রকৃতির বুকে চিরায়ত অজেয় মানবসত্তার ভাষ্যকার হিসেবে।একই সঙ্গে তাঁর চিত্রমালা বর্তমানের বাঙালির সাথে যোগসূত্র রচনা করে তার পূর্বপুরুষ আদিপিতা কিষাণের, হাজার হাজার বছর ধরে এ মৃত্তিকার বুকে যার পদচারণা ।

সুলতানের মানবমূর্তিগুলি অস্থিসংস্থানের বাস্তব নিয়ম মেনে চলে না।পুরুষমূর্তিগুলির সমস্ত শরীরে আলোড়িত পেশীপুঞ্জ যেন কোন অন্তর্গত শক্তিতে বিস্ফোরিত হবে এখনি।সমস্ত পট জুড়ে তাদের তেজীয়ান উপস্থিতি এক আদিম, উদ্ধত, অসংস্কৃত শরীরী শক্তির প্রতিভূ যেন বা । কায়িক শ্রমের এমন গরীয়ান রূপায়ণ সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। তুলনামূলকভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর নারী যেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত শিল্পের আওতা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে কুণ্ঠিত।এমনকি কখনো কখনো তারা বেঙ্গল স্কুলের ভাবালুতায়ও আক্রান্ত নরম , বর্তুল , ফেনায়িত । মৃত্তিকা সম্পৃক্ত কর্মিষ্ঠ পুরুষমূর্তির পাশে তাদের কখনো কখনো গতানুগতিক ও অকিঞ্চিতকর মনে হয়।এটি লক্ষণীয় যে কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যত্যয় ছাড়া যখনই সুলতান শুধুমাত্র গ্রামীণ নারীচরিত্র রূপায়ণ করেছেন তার প্রাত্যহিক কর্তব্যে রত অবস্থায় তখন প্রায়শই সেগুলি মামুলীয়ানার ঊর্ধ্বে সেরকম কোন দ্যোতনা সৃষ্টিতে সমর্থ হয় না । মানুষ ছাড়া অন্য যে প্রাণীটির উপস্থিতি সুলতানের ছবিতে প্রবলভাবে দৃশ্যগোচর সেটি স্বাভাবিকভাবেই গরু কৃষিজীবনের সাথে যার ওতপ্রোত সম্পর্ক । কিন্তু এখানেও লক্ষ করি সুলতান একটি আর্কিটাইপ নির্মাণ করে নেন এবং ক্লান্তিহীনভাবে এঁকে যান গরুর প্রায় একই ভঙ্গীমার বৈচিত্র্যহীন রূপ। এখানে হয়তো লোকচিত্রের তুলনাটি হাজির করবেন কেউ।লোকচিত্রীও মানুষ ও প্রাণী আঁকবার একটি বিশেষ ভঙ্গি আয়ত্ত করেন এবং পরবর্তীতে ঐটিরই পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। সুলতানের ক্ষেত্রেও এটিকে লৌকিক বৈশিষ্ট্য বলা যাবে না কেন ? লোকচিত্রে মানুষ ও প্রাণীর যে আর্কিটাইপটি উদ্ভাবিত হয় দেখা যাবে বাস্তব থেকে সরে গেলেও তা ঐ বাস্তবতার একটি শক্তিশালী প্রতিরূপ নির্মাণ করে, যার নান্দনিক উৎকর্ষ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সুলতানের গরুর আর্কিটাইপটি বাংলাদেশেরই বটে তবে নান্দনিক বিবেচনায় তাকে খুব ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া বোধ হয় সম্ভব নয় । মনে হয় একটি যথার্থ প্রতিরূপ উদ্ভাবনের ব্যাপারে এ ক্ষেত্রে তিনি ততটা মনোযোগ স্থাপন করেননি, যতটা করেছেন মানবমূর্তিতে । একই কথা বলা চলে তাঁর দৃশ্যপট রূপায়ণের ক্ষেত্রেও।আধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শবিহীন তাঁর মানসলোকে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ একটি পটভূমি পুনরাবৃত্ত হয় তাঁর ছবিতে । এটিও তাঁর বিশ্বাস ও স্বপ্নকে একটি একরৈখিক যথার্থতা দান করে বটে, কিন্তু মানবমূর্তির মত বাস্তব-অতিক্রমী চিরকালীনতার দ্যোতনা তারাও জাগাতে সমর্থ হয় না।এখানেও প্রত্যাশার একটি অপূর্ণতা থেকে যায়, মনে হয় শিল্পী পটভূমির নিসর্গ ও অন্যান্য বস্তুসমূহের প্রতি সমান একাগ্রতায় তুলি স্পর্শ করেননি ।

সুলতানের চিত্রকর্মের মূল প্রাণশক্তি তার রেখা। প্রধানতঃ মানব ও প্রাণীমূর্তিতেই তাঁর রেখার স্বকীয়তা পরিদৃশ্যমান । এ রেখা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ও বর্তুলাকার , কোমল ও প্রবহমান নয় । ঠিক বাস্তবধর্মী নয়, অথচ প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনের আভাস লেগে থাকে এর গায়ে ।জয়নুল আবেদিনের মত একাডেমিক রেখাঙ্কনের অতটা ধার ঘেঁষে নয় এ রেখা, নন্দলালের মত ঐতিহ্যিক দরবারী রেখার অনুযঙ্গও এতে নেই , আবার যামিনী রায়, কামরুল হাসানের লোকাশ্রয়ী রেখা এ নয় । বরং একে বলা চলে শহুরে ' নাইভ ' শিল্পের কাছাকাছি কিছু , আমাদের রিক্সা পেইন্টিং - এ যে ধরনটি দেখা যায়। সুলতানের অতিরঞ্জিত মানবশরীরগুলি তুলে নিলে বাকি যেটুকু থাকে তার সঙ্গে এই শহুরে নাইভ আর্টের তুলনা বোধ হয় চলতে পারে। তাঁর ঘরবাড়ী, গাছপালা, আকাশপ্রান্তর একটু খুঁটিয়ে লক্ষ করলে এ ধারণাটির সমর্থন মিলতেও পারে। সুলতান সচেতনভাবে এটি করেছেন বলে জানা নেই, তবে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অপূর্ণতা ও বিশ্বাসের একমুখীনতা যুক্ত হয়ে এমনটি ঘটতে পারে।এই আকাশপ্রান্তর বৃক্ষরাজি ও লোকালয়সমূহ চিরঅচঞ্চল' আবহমান' বাংলাদেশের একটি ধারণা বটে , তবে মানবমূর্তিগুলির পাশাপাশি পটজুড়ে তারা সমান গুরুত্ব নিয়ে দাঁড়ায় না, কেবল ভরাট করে পরিসর ।তার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রেখার ব্যবহার এখানে নেই বললেই চলে ।

তার পুরুষমূর্তিগুলি মাইকেলএঞ্জেলোকে মনে করিয়ে দেয় ।রেনেসাঁস যে মানবমাহাত্ম্যকে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিল তার একটি অন্যতম চেতনা ছিল বিজ্ঞানভিত্তি। মানব শরীরের সৌন্দর্যকে অস্থিসংস্থানবিদ্যার আলোকে গরীয়ানভাবে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন রেনেসাঁস শিল্পী, মাইকেলএঞ্জেলোতে যার পরম প্রকাশ ।এখানে বাস্তবতা শিল্পের অন্যতম উপাদান । মানবশরীরের স্পর্শযোগ্য ত্রিমাত্রিকতা শিল্পীর অন্যতম উদ্দেশ্য ।সুলতানের উদ্দেশ্য ভিন্ন । মানবাত্মার জয়ধ্বনি ঘোষণার প্রেরণাটি তিনি হয়তো অর্জন করেছেন রেনেসাঁস শিল্প থেকেই, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য বাস্তবতা নয় , বরং কর্মিষ্ঠ ভূমিসম্পৃক্ত আদি মানবের একটি প্রতীক অর্জন যা পরিপার্শ্বের ওপর ঘোষণা করবে তার সরব আবিষ্কার । তার এদেশীয় ভিত্তিটিও প্রকাশমান হবে জোরালোভাবে । তাঁর পুরুষ মূর্তিগুলি রেনেসাসেঁর মত পরিশীলিত আদর্শ মানবশরীর নয়, তারা উদ্যত অসংস্কৃত ভূমিপুত্রের স্বদেশী চিরায়ত রূপ। এমনকি তাঁর নারীরাও কখনো কখনো অর্জন করে সে মাহাত্ম্য। তাদের ভঙ্গিমা ও চলনে ফুটে ওঠে আদিম স্থূলভাব।এসব ক্ষেত্রে সুলতানের সাফল্য অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে ।

সুলতানের চিত্রকলার শক্তি ও ঘাটতিকে তবু তার প্রান্তিকতার আলোকে ভেবে দেখা যেতে পারে । শাহাদুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎকারে তাঁর প্রান্তিক মানসের আনাচ কানাচ মোটামুটিভাবে ফুটে উঠেছে।তাঁর মানবপ্রেম, অন্ত্যজ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, সেকুল্যার মানসিকতা বা আধ্যাত্মিক আকুতির পাশাপাশি শিল্পকলা, রাজনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য , রবীন্দ্র - নজরুল, হিন্দু - মুসলিম, পশুপাখি প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। জীবন সম্পর্কে তাঁর মত বৈচিত্র্যময় সরাসরি অভিজ্ঞতা কম মানুষেরই আছে, জীবনের উত্তাল স্রোতে আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে তিনি শিখেছেন এর সূত্র। স্বাভাবিকভাবেই সব কিছু সম্পর্কে তৈরী হয়েছে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা ও মতামত।এগুলো চমৎকৃত করে, কৌতূহল উসকে দেয়, ভাবায়ও বটে। রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্মচেতনা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর মতামত এক সংবেদনশীল শিল্পীর নিজস্ব অনুভব হিসেবে মূল্যবান মতপার্থক্য থাকলেও এখানে তাঁর সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু শিল্পকলা, যা তাঁর বিচরণক্ষেত্র, সেখানে তাঁর মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়। এক্ষেত্রে তাঁর মতামতের চমৎকারিত্ব বা নিজস্বতা সত্ত্বেও এটিও প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে এসব বিষয়ে তিনি ঠিক ‘ কন্টেম্পোরারী ' নন । তিনি অনেক সত্য কথা নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছেন যা সমাজাশ্রিত কেউ অমন অকুণ্ঠভাবে বলবে না, কিন্তু তাঁর অনেক বক্তব্যই অতি সরলীকরণ বা তথ্যের দীনতা থেকে উদ্ভূত। এক্ষেত্রে ভ্যান গঘের সাথে তাঁর একটি প্রতিতুলনা খাড়া করা যেতে পারে। সুলতানের মতই ভ্যান গঘ প্রধানত কাজ করেছেন গ্রামীণ অন্ত্যজ মানুষ ও পরিপার্শ্বকে নিয়ে, একই রকম সহানুভূতি ও সহমর্মিতা নিয়ে। জীবনাচারে চরম প্রান্তিক অবস্থান সত্ত্বেও ভ্যান গঘ সৃষ্টিশীলতার মাহেন্দ্র ক্ষণগুলিতে পরিচয় দিয়েছেন সর্বোচ্চ সংহতির । চরম মানসিক বৈকল্যের সময়ও তাঁর অঙ্কিত চিত্রগুলি উচ্চকিত আবেগের পাশাপাশি গঠন ও বিন্যাসেরও সর্বোচ্চ সংহতি বজায় রেখেছে । চিত্রের প্রতিটি অংশ সার্বিক কাঠামোর সমান অংশীদার, বর্ণচয়ন ও বর্ণলেপন নবতর বোধের ইঙ্গিতবহ এবং নির্মাণশৈলী সমকালীন চিত্ররীতিকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের দিকে চালিত। এটি সম্ভব হয়েছে  সমকালের শিল্পকলা ও তার সমস্যা সম্পর্কে ভ্যান গঘের' কন্টেম্পোরারী ' জ্ঞান ও স্বচ্ছ ভাবনা দ্বারা। তাঁর পত্রগুচ্ছই এর সাক্ষাৎ প্রমাণ।পল গগ্যাঁ বা এমনকি রামকিঙ্করও যখন সমসাময়িক শিল্পকলা বিষয়ে কথা বলেন তখন তাঁদের বিশৃঙ্খল জীবনের আড়ালেও বিষয় সম্পর্কে তাঁদের সমসাময়িকতা ও স্পষ্ট ধারণার ইঙ্গিত মেলে। এক্ষেত্রে সুলতান কিছুটা থেকে যান ধোঁয়াটে ও অস্পষ্ট । ভ্যান গঘ - গগ্যাঁ- রামকিঙ্করের শিল্পসাধনার যে নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা দেখা যায়, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও যেভাবে তাঁরা সৃজনকর্মে সক্রিয় থাকেন সুলতানের মধ্যে তার কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।জীবনের একটি পর্বে, প্রায় দু'যুগ সে পর্ব, তিনি কেন কোনো ছবি আঁকেননি বা আঁকার তাগিদ অনুভব করেননি তা পরিষ্কার নয় । আঁকতেই হবে এমন কথা নেই, তবে ঐ সময় তাঁর সৃজনবেদনার কোনো কষ্টকর অনুসন্ধানপর্বেরও প্রমাণ পাওয়া যায় না। জনৈক বিদেশীর প্রেরণা ও তাগাদায় তিনি আবার আঁকতে শুরু করেন , তাঁরই বয়ান এটি । এ দীর্ঘ বিচ্ছেদ হয়তো তাঁর ক্ষমতার মৃত্যু ঘটায়নি, কিন্তু সমসাময়িক শিল্পের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে ছিন্ন করেছে তাঁর যোগাযোগ। ফলে অসাধারণ ক্ষমতা ও স্বকীয়তা সত্ত্বেও তাঁর চিত্রকর্ম সাময়িক নির্মাণে কিছু অপূর্ণতার মধ্যে আটকে যায়।আরো একটি কারণ মনে হয় সমগ্র চিত্রপটকে সংহত করে সার্বিক ঐক্য নির্মাণে তাঁর মনোযোগের অভাব। মনুষ্যমূর্তিগুলিকে তিনি যে অভিনিবেশ ও অঙ্গীকার দিয়ে রূপায়িত করেন পটভূমির অন্যান্য কিছুর বেলায় তার প্রয়োজনীয়তার কথা স্মরণ করেননা।স্বতস্ফূর্ত আবেগ তাঁকে যতটুকু নিয়ে যায় ততটুকু অভিনিবেশই তিনি দেন, বাকিটুকু রূপায়িত করেন অভ্যাসের সাহায্যে। এর ফলে তারতম্যটুকু ঘটে যায়। আরো একটি কথা। মহৎ স্রষ্টা মাত্রই আপনাকে আপনি অতিক্রম করার একটি লড়াইয়ে প্রবৃত্ত থাকেন, সর্বদাই নিজের সৃষ্টিকর্মকে উত্তরিত করতে চান নবতর স্তরে। কেউ কেউ অবশ্য বাঁধা পড়ে যান আত্মতৃপ্তির কিংবা বাণিজ্যিক সাফল্যের মোহে। যেমনটি ঘটেছিল যামিনী রায়ের ক্ষেত্রে। এতে শিল্পীর গৌরবও বাঁধা পড়ে ক্ষুদ্র গন্ডির সীমানায়।১৯৭৬ সালে সুলতানের একক প্রদর্শনী দারুণভাবে সফল হয়েছিল। সেখানে তিনি যা এঁকেছিলেন পরবর্তী দু'যুগে তা থেকে উত্তরণের কোনো তীব্র প্রয়াস তাঁর মধ্যে দেখা গেছে বলে মনে হয় না । তাঁর পরবর্তী অনেক চিত্রই পুনরাবৃত্তিতে মলিন।এখানে তাঁর প্রান্তিকতা ও সৃজনশীলতার মধ্যে সংহতির ক্ষেত্রে কোথাও কোনো ফাটল বোধহয় রয়ে যায় ।

পাঁচ

চিত্রশিল্পী এস . এম . সুলতানের কাছ থেকে প্রাপ্তিকে তবু শেষ বিচারে কোনক্রমেই খাটো করে দেখা যাবে না ।ইতিহাসের তুলাদণ্ড তাঁকে শিল্পকলার ইতিহাস- অট্টালিকার কোন কুঠুরিতে স্থান দেবে তা এখনই নিঃসংশয়ে বলা সম্ভব নয় ।তবে এটুকু বোধ হয় নিশ্চিতভাবে উচ্চারণ করা সম্ভব যে বাংলাদেশের শিল্প-ইতিহাস সুলতানকে বাদ দিয়ে রচিত হবে না। বাঙালির ইতিহাস ও মৃত্তিকাগন্ধময় ঐতিহ্যের মর্মমূল চিত্রশিল্পে তাঁর মত দীপ্রভাষায় রূপায়িত করেছেন কম শিল্পীই।যুগযুগান্তরের ঘাম-শ্রমের গন্ধমাখা কমিষ্ঠ বাঙালি কিষাণের প্রাণভোমরাকে আবিষ্কার করেছেন তিনি, বহুকালপ্রবাহী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অস্তিত্বের নীরবতা ভেঙে তাদের প্রাণশক্তি ও অধিকারের সরব জয়ধ্বনি তিনি ঘোষণা করেছেন। এই সততা, এই সহমর্মিতা, এই মানবতাবোধ, এই প্রাণের টান, এই আপন মৃত্তিকায় প্রোথিত জীবন বিশ্বাস আমাদের সমীহ আদায় করবেই।আমাদের শিল্পকলা যখন জীবন ও মানবভূমি পরিত্যাগ করে কৃৎকৌশল ও হৃদগগণের অলীকলোকে উন্মার্গগামী হবার প্রলোভনে টলটলায়মান তখন সুলতানের শিল্পকর্ম তাকে টেনে রাখে শেকড়ের দিকে, উপড়ে ভেসে যেতে দেয় না। তাঁর এই গুরুত্ব হয়তো ভবিষ্যতে কখনো অনুভূত হবে।

আরো কিছু শেষ কথা তবু বাকি থাকে ।সুলতানের প্রান্তিকতাই তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত করেছে ব্যতিক্রমী প্রত্যয় ও শিল্পধারা , এ যেমন সত্য , তেমনি সত্য বোধ হয় এও যে এ প্রান্তিক বিছিন্নতার শৃঙ্খলাবিহীনতার মধ্যে বাস করেও ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ বা রামকিঙ্কর শিল্পের যে সংহতি , উত্তরণ ও সমকালচেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন সুলতানের শিল্পকলায় তাঁর কিছু ঊনতা থেকে যায়। মহত্তম শিল্পে যে পরিপূর্ণতা ও সমগ্রতার ঐকতান নির্মিত হয়, কালের নির্দিষ্টতা অতিক্রম করে চিরায়তের যে ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠে , তাঁর চিত্রমালা সাধারণের ঊর্ধ্বে বিপুল সম্ভাবনার প্রত্যয় সঞ্চারিত করেও সে সম্পূর্ণতায় সংহতি লাভ করে না । তাঁর প্রান্তিকতাই তাঁর শক্তি যেমন একদিকে, তাঁর অপূর্ণতারও কারণ বোধ হয় সেটিই ।

তবে কি এস. এম. সুলতান কক্ষচ্যুত নক্ষত্র এক ? তাঁর শিল্প কি কালোত্তীর্ণের প্রবেশদ্বারে কড়া নাড়তে গিয়ে থমকে গেল শেষে ? যে প্রান্তিকতা তাঁকে জীবনের প্রাত্যহিকতা থেকে উপড়ে ফেলে স্থাপন করেছে বিশ্বমানবের মর্মলোকে সে প্রান্তিকতাই কি তাঁকে বঞ্চিত করেছে শিল্পের অনুপুঙ্খ জ্যামিতি ও সমকাল - মানসের স্পর্শ থেকে? এসবের সরাসরি জবাব দেবার সময় এখনো আসেনি, মহাকালের কষ্টিপাথরে নির্ণিত হবে তার স্থায়ীত্বের পরিমাপ।যে নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব ও নিরাসক্তি এর জন্য প্রয়োজন তার নিমিত্তে হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরো।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles