ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না

এক

চিরস্বপ্নজীবী জীবন শিল্পী শেখ মুহাম্মদ সুলতান ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর বিকেলে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । বিশাল কর্মযজ্ঞের অধিকারী এই শিল্পীর মুখরিত ক্যানভাস, স্বপ্নের জনপদ আর 'শিশু স্বৰ্গ ’ তাঁর কাছ থেকে অনেক দূরে এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে । জাগতিক সব ক্রিয়াকাণ্ড থেকে অনেক নিরাপদ আশ্রয়ে বিশ্বলোকের টানে তিনি সত্তার বাইরে গেছেন । সুলতান একজন কিংবদন্তীর মানুষ। জীবনকে সাজিয়েছিলেন অপরিসীম বর্ণাঢ্যতায়, কর্মমুখরতায় সজীবতায় — ছেলেবেলা থেকে খেয়াল খুশির যে রাজ্যটি তিনি আপন মানসপটে নির্মাণ করেছিলেন জীবনের শেষ ধাপে এসে ৬২ ফুট দীর্ঘ ১৫ ফুট চওড়া নৌকা বানিয়ে প্রমাণ করলেন, জীবন উপভোগের । এক মুঠোয় হাজার হাজার টাকা ভিক্ষুককে দিয়েছেন, আবার পকেটে বাতাসকে অবাধে বিচরণ করতে দিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছেন। ভোগের সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি সুলতান গঞ্জিকা সেবন করে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন।আলোকচিত্রী শামসুল ইসলাম আল-মাজীর একটা আলোকচিত্র আছে সুলতানের: গাঁজায় দম দিচ্ছেন । ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে আছে সুলতান এর গাজা খাওয়ার নিয়ম কানুন । সেই এক হাতি কল্কে, আর মাঝখানে ড্রেন হয়ে যাওয়া এক টুকরো সেগুন কাঠ, পুরিয়ার পর পুরিয়া  'আবগারী'-এখন সুলতানের সতীর্থদের স্মৃতিচারণার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ।

দুই

একটা কথা সবারই জানা যে, সুলতান ছবি এঁকেছেন নিজস্ব দর্শনকে সামনে রেখে । ‘তাঁর মতো কেউ ছিলো না এবং তিনিও কারো মতো নন '— নোয়েল কাওয়ার্ড সম্পর্কে এই কথা বলেছিলেন জন ওসবর্ন বেশ ক'বছর আগে। সুলতান সম্পর্কেও ঠিক নির্দ্বিধায় কথাটি চালিয়ে দেয়া যায় । তাঁর সত্তরোর্ধ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিলো চরম নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ । দীর্ঘদেহী লম্বাচুলের শীর্ণকায় সুলতান বৃটিশের রাজত্বকালে আবির্ভূত হয়ে জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির সাথে নিরন্তর বোঝাপড়া করে যাপিত দিনগুলোকে ভোগ করেছেন ইচ্ছেমতো।

শেখ মুহাম্মদ সুলতানের আঁকা অসংখ্য ক্যানভাস এবং পেপারে তেলরং, ড্রয়িং এবং জলরং - এ স্থাপিত শক্তিশালী মানুষের অবয়ব দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, মানুষের বিশ্রাম, কৃষক - শ্রমিক – জেলে - মাঝির গলদঘর্ম পরিশ্রম, বলিষ্ঠ দেহবল্লরীর রমণীদের স্নান কিংবা জলকে চলা; অনাগরিক ইমেজের ভেতর বন্দী এইসব মানুষের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-আনন্দ, কষ্ট - যন্ত্রণা, প্রতিদিনের চিৎকার ক্রদন, দীর্ঘবিরতিহীন অভাবের বিরুদ্ধে চিরন্তন সংগ্রামে লিপ্ত মানুষের দৃপ্ত মনোবল, চরদখলের অভিযানে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষের আদিমতা, পশুদের সাথে মানুষের গভীর সখ্য— মোটামুটি এইসব বিষয় বারবার স্থান পেয়েছিলো তাঁর ক্যানভাসে।এক শ্রেণীর প্রকরণবাদীর ধারণা, উপস্থাপনার ধরন একই রকম হওয়ায় তাঁর শিল্পকর্মসমূহ টাইপড হয়ে পড়েছে। তাঁর বিশ্বাস এবং বোধ প্রাগ্রসর চিন্তার ধারক নয়, পরিবর্তনশীলও নয়, তাই তাঁর ক্রমোত্তরণ চোখে পড়েনি ; একই রকম বিন্যস্ত কতোগুলো ফিগারকে সামনে রেখে গল্প বলে যেতে চাইছেন, যার মধ্যে সরলতা আছে, জটিলতা মুক্ত গল্প বলে যেতে তিনি অভ্যস্ত বলেই তাঁর শিল্পকর্মসমূহে উচ্চকিত সহজিয়া সুর। আধুনিক চিত্রকলার উজ্জ্বল সৌকর্যভূমিতে তাঁকে নিষ্প্রভ মনে হতে পারে অনেকের কাছে।

নেকেই মনে করেন, সুলতানকে বিচার করতে হবে সামগ্রিক শিল্প আন্দোলনের কয়েকটি ঘটনা , সন - তারিখ ধরে ধরে উল্লেখযোগ্য, বৈপ্লবিক , যুগান্তকারী অধ্যায়সমূহের প্রতি নজর রাখতে হবে। তারপর ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসতে হবে আধুনিকতাবাদীদের দিকে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে 'আধুনিক' শিল্পী হিসেবে তার পরিচিতি কতোটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে গভীরভাবে । সমসাময়িক অন্যান্য শিল্পীর তুলনায় — যেখানে অহরহ নাম নিচ্ছি ব্র্যাক , পিকাসো , ক্লী , কান্দেনিস্কি , দালি প্রমুখের — যারা এখনও সমান চর্চিত এবং আলোচিত দেশে দেশে , সেই তুলনায় সুলতানের চিত্রকলার আন্তর্জাতিকতা, আধুনিকতা কতোটুকু , সেটা বিশ্লেষণ করা জরুরী বলেও তারা মনে করেন । প্রশ্নে প্রশ্নে তত্ত্বে তত্ত্বে ভারাক্রান্ত করে সুলতানকে বিশ্লেষণ না করে একজন সত্যিকারের বাংলাদেশের শিল্পী হিসেবে তাঁকে দেখতে হবে । নিরহংকার , জটিলতামুক্ত , সরল , অকপট প্রকাশভঙ্গির জন্য যিনি বিখ্যাত, তাঁর শিল্পকর্মের ভেতর অন্যকিছুর সন্ধান করা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয় ।

তিন 

১০ আগস্ট ১৯২৪ সালে যে জীবনের সূচনা হয়েছিলো কালের অমোঘ নিয়মে ১০ অক্টোবর ১৯৯৪-এ এসে সে যাত্রা থামলো। সত্তরোর্ধমহাজীবন আকাশ গঙ্গার ছলাৎ ছলাৎ শব্দের ভেতর তলিয়ে গেলো । আর কোনোদিন তিনি জাগবেন না । জাগতিক সকল প্রাত্যহিকতা , কর্মব্যস্ততা থেকে তিনি দূরে । রং , তুলি , ঈজেল , ক্যানভাস, চিত্রা নদীর পাড় , বন অরণ্যানী , পশু - পাখি, সাপ-খোপ , সৃজন-স্বজন-দুর্জন-প্রিয়জন -বন্ধুজন সবার থেকে দূরে।

সুলতানের জীবিতাবস্থায় সংস্কৃতির অঙ্গনে একটা সরব- নীরব গুঞ্জন ছিলো , তাঁর চিরকুমারত্ব নিয়ে । বিয়েথা কেন করেননি , সারাটি জীবন শুধু ছবি এঁকে কেনোইবা কাটিয়ে দিলেন, যে নারী জাতিকে তিনি এতো শ্রদ্ধা করতেন তাদের কোন একজনকে কেন জীবনের সাথে বন্ধনে জড়িয়ে ফেললেন না ইত্যাদি । এ সব গুঞ্জন সুলতানের কানেও গেছে । মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস তাঁরও যে বুকের জমিন অন্ধকার করে পড়েনি , তেমনি নয় , অতিক্রান্ত দিনগুলোর কথা ভেবে।তবে সুলতানের প্রেমপর্ব নিয়ে খুব বেশি কথা শোনা যায় না। বিয়ে না করা নিয়ে তাঁর সর্বশেষ জন্মদিনে যে কথাগুলো বলেছেন : 'এ জীবন কিছুই না- এরকম আধ্যাত্মিক চিন্তা থেকে কি বিয়ে করিনি ? নিজেকে এ প্রশ্ন করি । তাতো ঠিক নয় । আমার নিজের ফ্যামিলি না থাকলেও (আমার) দায়দায়িত্ব অনেক। মনে হত নিজের সস্তান , নিজের পরিবার নিয়ে যদি জীবন কাটিয়ে দিই সেটা একধরনের স্বার্থপরতা হবে । হয়তো এ ভাবনা থেকেই বিয়ে করিনি ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫


Share

Recent Comments

Recent Articles