হলদে পরীর দেশে

এবার চলিয়াছি যুগোশ্লাভিয়া। সেখানে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত মহাসভার অধিবেশন বসিবে। ভূগোলে আামি কোন দিনও ভালো ছিলাম না। যুগোশ্লাভিয়া কোন দেশ, কেমন তার লোকজন, কোন পথ দিয়া কিভাবে সেখানে যাইতে হইবে কিছুই জানিনা। আমার ছেলে জামাল আর কামালের মানচিত্রের বইগুলি সামনে লইয়া পথের নির্দেশ ঠিক করি। ভূগোলের বই পড়িয়া ওদেশের লোকজনের কথা জানিতে চেষ্টা করিকিন্তু আমাদের দেশের পাঠ্য বইগুলিতে কি ওসব জানার উপায় আছে? কোথায় যুগোশ্লাভিয়ার রাজধানী, কোথায় কোন্ বন্দর, কোথায় কোন্ নদী, শুধুমাত্র নতুন নতুন নামে ভূগোলের বই ভর্তি। এত সর্বনাম শব্দ মুখস্ত করিতে হইত বলিয়াই ছোটবেলায় ভূগোল বইখানা আমার কাছে মাষ্টার মহাশয়ের কঠিন বেতের চাইতেও ভয়ঙ্কর বলিয়া মনে হইত। দেশের লোকজনের কথা বলিয়া, তাহার আবহাওয়ার কাহিনী বর্ণনা করিয়া ভূগোলের বইকে শিশুদের হৃদয়গ্রাহী করিবার ইচ্ছা কোন পাঠ্যবই লেখকেরই দেখি না। কে আমাদের দেশের পাঠ্য বইগুলি নতুন করিয়া গড়িয়া তুলিবে?

যাক সে কথা। করাচী আসিয়া নানা দেশের দূতাবাসে যাইয়া সেই দেশে প্রবেশের অনমতি পত্র লইলাম। তুরস্কের দূতাবাস আমাকে অতি ভদ্র-ভাবেই গ্রহন করিলেন। অন্যান্য দূতাবাসের কেহ কেহ অমাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসাইয়া রাখিলেন। কেহ দুই তিনবার তাহাদের নিকট আমাকে দৌড়াদৌড়ি করাইলেন। কোন কোন দূতাবাসে পাহারাদার পাইকের বাধা অতিক্রম করিয়া যথাস্থানে প্রবেশ করিতে আমাকে গলদঘর্ম হইতে হইল। যুগোশ্লাভিয়ার দূতাবাসে আসিয়া আমি একেবারে অবাক হইয়া গেলাম। এখানে না আছে পাহারাদার পাইক, না আছে শাহীন সওকতের জাঁকজমক। দুইটি তরুণ কর্মচারী আমাকে বন্ধুর মত গ্রহন করিলেন। সিগারেট আনিয়া দিলেন। চা পান করিতে দিলেন। তাঁহারা ভালমত ইংরেজী বলিতে পারেন না। একজন কিছু বলিতে যাইয়া ঠেকিয়া গেলে অপরজন তাঁহাকে ইংরেজী কথা জুটাইয়া দিয়া সাহায্য করিলেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে তাঁহারা আমাকে বলিলেন, ”আমাদের দূতাবাসে আপনিই প্রথম পাকিস্থানী আমাদের দেশে যাচ্ছেন।এ-র অামরা অপর কাহাকেও অামাদের দেশে প্রবেশের ছাড়পত্র দেই নাই।আমরা নতুন লোক। আপনার প্রবেশপত্র লিখতে তাই আমাদের কিছুটা দেরী হবে। সেজন্য কিছু মনে করবেন না। এই বইগুলি দেই। আপনি ততক্ষন পড়ুন।

সুচিত্রিত দুইখানা ম্যাগাজিন যুগোশ্লাভিয়ার জনগণের নানা বিভাগে সাফল্যের চিত্রিত উপাখ্যান। আমি সেই বইগুলির মধ্যে চোখ বুলাইয়া যুগোশ্লাভিয়া দেশের বিষয়ে মনে মনে একটা ধারনা রচনা করিতেছিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁহারা আমাকে তাঁহাদের দেশের প্রবেশপত্র দিয়া দিলেন। খুঁটিয়া খুঁটিয়া আমি তাঁহাদের দেশের নানা তথ্য জানিয়া লইলাম। বিদায়ের সময় তাঁহারা আমাকে বলিলেন, ”আপনি আমাদের দেশে যাচ্ছেন, খবর আমরা ইতিপূর্বে সংবাদপত্রে পড়েছি। আপনি জনগনের কবি। আশা করি আমাদের জনগনের রাষ্ট্র যুগোশ্লাভিয়া আপনার ভালো লাগবে। আমি তাঁহাদের সঙ্গে বিদায় করমর্দন করিয়া বলিলাম, ”আমার যুগোশ্লাভিয়া যাত্রার প্রথম আতিথেয়তা আপনাদের নিকট হতে আরম্ভ হল। আমি মুগ্ধ হলাম আপনাদের সুন্দর সৌজন্যে। আশা করি আপনাদের সুন্দর দেশে যেয়ে আপনাদের মতই অনেক বন্ধু পাব।

করাচী যাইয়া এবার একটি সুন্দর দম্পতির সঙ্গে আমার পরিচয় হইল। মিঃ মহম্মদ হোসেন আর মিসেস রোজী হোসেন। ইহাদের মধ্যে কাহাকে রাখিয়া কাহার প্রশংসা বেশী করিব স্থির করিবার উপায় নাই। সুদূর করাচীতে থাকিয়া তাঁহারা পূর্ব বঙ্গের কৃষ্টির উপরে বক্তৃতা করিয়া সাময়িক কাগজে প্রবন্ধ লিখিয়া নানারূপ জলসার অনুষ্ঠান করিয়া আমদের এই প্রদেশকে তাঁহারা ওখানকার অবাঙ্গালী ভাইদের মধ্যে লোভনীয় করিয়া তুলিতেছেন। ওখানে বসিয়া পূর্ব বঙ্গের সাহিত্যের সকল খবর তাঁহারা ভালমত পান না। চায়ের নিমন্ত্রণে ডাকিয়া আনিয়া আমার নিকট হইতে তাঁহারা পূর্ব বঙ্গের সাহিত্যিক প্রচেষ্টার নানা খবর খুঁটিয়া খুঁটিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। মিসেস হোসেন উর্দু ভাষা জানেন। তাঁহার নিকট হইতে আমি বর্তমান উর্দু সাহিত্যের নামকরা লেখকদের বিষয়ে নানা রূপ খবর জানিয়া লইলাম।

তাঁহাদের চায়ের আসরে একজন পাগলা শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হইল। শিল্পীর নাম সুলতান। যশোর জেলায় বাড়ী। কলিকাতা আর্টস স্কুল হইতে পাশ করিয়া তিনি পশ্চিম পাকিস্থানে পশ্চিম ভারতে কপর্দকহীন অবস্থায় দশবারো বৎসর ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন সম্প্রতি করাচীতে তাঁহার ছবিগুলির প্রদর্শনী হইয়া গিয়াছে। সেই ছবিগুলির সমালোচনা করিয়া করাচীর সাময়িক কাগজগুলিতে বহু প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে। শিল্পী সুলতানকে পশ্চিম পাকিস্থানে পরিচিত করাইতে এই হোসেন দম্পতির দান কোন অংশে কম নয়। রাত প্রায় দশটা অবধি হোসেন সাহেবের চায়ের মজলিশ সরগরম করিয়া পাগলা শিল্পী সুলতানকে সঙ্গে লইয়া পথে বাহির হইলাম। আমি থাকি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের বাড়িতে। শিল্পী থাকেন স্যার আবদার রহিমের বাড়িতে। একবাড়ি হইতে অপর বাড়ির ব্যবধান পাঁচ মিনিটের পথ। এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করিতে আমাদের রাত একটা বাজিয়া গেল। শিল্পীর অঙ্কিত চিত্রের চাইতেও শিল্পীর বৈচিত্রময় জীবন আমার কাছে আরও লোভনীয় মনে হইল।

কত পথ সে ঘুরিয়াছেকত গৃহের ছায়া-সুশীতল স্নেহ তাহাকে আকর্ষন করিয়াছে। পথের সমস্ত লতাবন্ধন ছিন্ন করিয়া আপন সৃষ্টির দুরন্ত ক্ষুধায় সে হাহাকার করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কোথায় পশ্চিম দেশের এক মস্ত জমিদারের গৃহে সে কিছুদিন বাস করিয়াছিল। জমিদারের বারো বয়স্কা লাল টুকটুকে মেয়েটি হাসনা তার কাছে ছবি আঁকা শিখিত। কত বৎসর শিল্পী তাহাদের ছাড়িয়া আসিয়াছে। হাসনা কিন্তু তাকে ভুলিতে পারে নাই। সেদিন তার চিঠি আসিয়াছে, ”ওস্তাদ সাহেব। আমাদের আসমানের পশ্চিম কিনারায় সূর্য অস্ত যায়। লাল নীলে হলুদে জরদে মিশিয়ে কোন শিল্পী মেয়ে রেশমী পরদার উপর ছবির পর ছবি এঁকে যায়। সেই ছবিগুলির দিকে চেয়ে চেয়ে আমি আপনার হাতের তুলীর লেখা পড়তে পারি। রাতে আমার জানালা খোলা থাকে। শরতকালের আসমানের বুকে ভাঙা ভাঙা মেঘগুলো ঘুরে বেড়ায়। আমি জানালায় চোখ মেলে চেয়ে থাকি। অমার মনে  হয় আপনিই যেন চাঁদের তুলিতে করে সেই মেঘগুলোর গায়ে ছবি এঁকে চলেছেন। আমার ছবির খাতা মেলে ধরে আপনার আঁকা ছবিগুলো টুকে রাখি। ওস্তাদ সাহেব!আমরা আপনাকে ভুলিনি। ")

সুলতানের গল্পের অন্ত নাই। কোথায় এক গুণী সেতারাবাদক গভীর রাত্রিকালে আসিত তাহাকে বাজনা শুনাইতে। তারা দুজনে চলিয়া যাইত গহন জঙ্গলে। সেখানে গভীর রাতের নিরবতার সঙ্গে সুর মিলাইয়া সেতারী তার সেতারা বাজাইত আর কাঁদিত। সুলতানও তাঁর সঙ্গে অশ্রুজলের বিনিময় করিত।

এরূপ কত গল্প শুনিলাম সুলতানের কাছে। তাহার নিকট হইতে বিদায় লইয়া গভীর রাত্রিকালে বিছানায় আসিয়া শয়ন করিলাম। আমার জানালা দিয়া আকাশের চাঁদ দেখা যাইতেছিল। সুদূর পশ্চিম পাকিস্থানের সেই মেয়েটির মতই আমিও মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, কোন পাগলা শিল্পী যেন আকাশের আঙিনায় চাঁদের তুলিতে করিয়া মেঘে মেঘে ছবি আঁকিয়া চলিয়াছে।

পরদিন দুপুর বেলা সুলতানের ছবি দেখিতে গেলাম। মোহাম্মদ হোসেন তাঁর বন্ধু সামাদ শাহীনকে সঙ্গে লইয়া আসিলেন। কঁরাচি আসিয়া যাঁহারা সামাদ শাহীনের সঙ্গে পরিচিত না হইয়াছেন তাঁহারা পশ্চিম পাকিস্থানের সংস্কৃতি-জীবনের স্বাদ মোটেই পান নাই। তাঁর বিদুষী স্ত্রী মিসেস মমতাজ শিরীন উর্দু সাহিত্যে নামকরা গল্প লিখিয়ে। সামাদ শাহীনের  গ্রন্থশালা উর্দু সাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত লেখকবৃন্দের কলগুঞ্জনে মুখরিত। তিনিনয়া ডোর নামে একখানা বার্ষিক পত্রিকার সম্পাদক। পৃথিবীর যে দেশে যত ভাল সাহিত্য-পুস্তক ইংরেজীতে ছাপা হইয়াছে তাহার প্রায় অধিকাংশ শ্রেষ্ট পুস্তকই তিনি তাঁর লাইব্রেরীতে সংগ্রহ করিয়াছেন।

স্যার আবদার রহিমের কুঠীর নিকটস্থ একটি ছোট্ট ঘরে সুলতান থাকে। ওপাশের এপাশের ঘরে চাকরদের অবস্থান। কোথা হইতে একটি নোংড়া গন্ধ ভাসিয়া আসিতেছে। সমস্ত ঘরগুলি অপরিষ্কার। কম্বল বিছাইয়া সুলতান অামাদিগকে বসিতে দিল। তার সবগুলি ভাল ভাল ছবি প্রদর্শনীতে বিক্রী হইয়াছে। ল্যান্ডস্কেপের অনেকগুলি ছবি সুলতান আমাদিগকে দেখাইল। আমি ছবি ভাল বুঝিনা। সুতরাং বিষয়ে পাঠকেরা যেন বিশেষজ্ঞদের অভিমত সংগ্রহ করে। কিন্তু সুলতানের ছবিতে যে অপূর্ব বর্ণসমাবেশের পরিচয় পাইলাম তাহা ভুলিবার নয়। নানা দুঃখকষ্ট অভাবের মধ্য দিয়া সুলতানকে চলিতে হইয়াছে। কিন্তু তাহার ছবিতে সেই দুঃখকষ্টের এতটুকুও ছাপ নাই। নানা অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে থাকিয়াও এই বীর শিল্পী তাঁর স্বপ্নালু জগতটিকে অটুট রাখিয়াছেন। তাঁর ছবিগুলি দেখিয়া দুঃখ দুুর্দশা গ্রস্ত লোকগুলি যদি ক্ষণেকের জন্যও তাঁর স্বপ্ন জগতের এতটুকু স্বাদ পায় তাই কি শিল্পীর পক্ষে কম কৃতিত্ব।

আমি সুলতানকে বলিলাম, ”তোমার ছবিগুলিতে আমাদের স্বপ্ন-জগতের পরিচয় আছে। তার দাম কম নয়। কিন্তু আমরা শুধুই স্বপ্ন নিয়েই বাঁচিতে পারিনা। আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনে যে নানা অভাব অভিযোগ দৈন্য ক্ষুদ্রতা তার কথাও কিছু আঁকা থাক তোমার ছবিগুলোতে তোমার বৈচিত্রময় জীবনের সুদীর্ঘ পথে যারা এসে তোমার শিল্পী অন্তরকে নাড়া দিয়াছে তাহাদের কথাও তোমার ছবিগুলিতে দেখতে চাই। এই পৃথিবীতে সুন্দরকে উপভোগ করার ক্ষমতা আমাদের কোথায়? যারা দশ হাতে সুন্দরের অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধেও তোমার ছবিতে শানিত তরবারী অঙ্কিত দেখতে চাই।

আমার কথা শুনিয়া সুলতান কিছুক্ষন নীরব থাকিয়া বলিল, ”আপনি যখন ইউরোপ হতে ফিরে আসবেন, তখন আমার নতুন আঁকা ছবিগুলি দেখিয়ে আপনার কথার জবাব দিব।

বন্ধুবর শাহিন আর মোহাম্মদ হোসেনের অফিসে জরুরী কাজ ছিল। তাই ছবি দেখার মজলিশ বেশিক্ষন স্থায়ী হইল না। তাহারা উভয়েই সুলতানের ছবিগুলির প্রশংসা করিলেন।

বিকালে শিক্ষামন্ত্রী বন্ধুবর ফজলুর রহমান সাহেবের সঙ্গে বহুক্ষন আলাপ আলোচনা করিয়া আমার সুদূর ইউরোপ ভ্রমনের বিষয়ে নানা পরামর্শ করিলাম।

সন্ধার পরে রাত দশটায় আবার সুলতানের আস্তানায় গেলাম। সুলতানের এক বন্ধু সেতারাবাদক আসিয়াছেন তার বাজনা শুনাইবার জন্য। একখানা ছেঁড়া কম্বল গায়ে জড়াইয়া মলিন বেশে শিল্পী বসিয়া আছে। তার সমস্ত পোষাকে-পরিচ্ছদে, হাতে-পায়ে, মুখে পৃথিবীর সমস্ত মলিনতা যেন সে কুড়াইয়া কুড়াইয়া আনিয়া জীবন্ত করিয়া রাখিয়াছে। কিন্তু তার সেতারাটিকে সে অবহেলা করে নাই। এই যন্ত্রটিকে সে পিতল রূপদস্তার নানারূপ নক্সা পরাইয়া রূপসী রমণীর মত করিয়া সাজাইয়া রাখিয়াছে। শিল্পীর নিজের গায়ে ধুলা  হয়ত সে একদিনও  পরিষ্কার করে নাই কিন্তু এই যন্ত্রটির গায়ে কোথাও একবিন্দু ময়লা দেখিতে পাইলাম না।

সুলতানের এখনও নৈশভোজন হয় নাই। একটি যুবক বাহিরের দোকান হইতে ১০/১২ খানা চাপাটি সামান্য কিছু তরকারি শালপাতায় করিয়া আনিয়া দিল। চার পাঁচজন যুবক আর এই শিল্পীকে সঙ্গে লইয়া সুলতান তাহাই আহার করিল। পরিচয় লইয়া জানিলাম, এই যুবকেরা বেকার অবস্থায় সুদূর পশ্চিম পাকিস্থানের কোন কোন  গ্রাম হইতে করাচি আসিয়াছে চাকরীর অনুসন্ধানে। সুলতান তাহাদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, যাহার নিজেরই আশ্রয় নাই, সেই বোধ হয় এমন করিয়া অপরকে আশ্রয় দিতে পারে। এই করাচী শহরে কত ধনী  ব্যক্তি আছে তাহাদের কতজনের অন্তর সুলতানের মত এমন করিয়া পরের জন্য কাঁদে।

অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম কিছুদিন আগে সুলতাব প্রদর্শনী করিয়া কিছু টাকার ছবি বিক্রি করিতে পারিয়াছিল। সেই টাকায় সে তার সর্বহারা এই ক্ষুদ্র দলটিকে লইয়া কোন রকমে সংসার যাত্রা নির্বাহ করিতেছে।

আমি সুলতানকে বলিলাম, ”তুমি দেশের শিল্পী। তোমার জীবন কত মূল্যবান। এইভাবে বাজারের সাধারন দোকান হইতে নোংরা খাদ্য কিনে এনে তোমার জীবনকে বিপদাপন্ন করার তোমার কোন অধিকার নাই। যে দোকান হতে খাদ্য এনে এনে তুমি খাও, দিনের বেলা দেখেছি, সেখানে খাদ্যবস্তুর উপর মৌমাছির চাকের মত মাছি ভনভন করছে।

সুলতান হাসিয়া বলিল, ”ভাল দোকান হতে খাবার এনে খেলে তার দাম বেশী পড়ত। আমার এতগুলি বন্ধুকে নিয়ে আমি খরচে কুলিয়ে উঠতে পারতাম না।

কথার আর আমি কি উত্তর দিব। অল্পক্ষনের মধ্যেই  আহারাদি সমাধা হইল। এবার সেতারী তাহার যন্ত্রটি কোলের উপর লইয়া ধীরে ধীরে বাজান আরম্ভ করিল। সেকি মধুর বাজনা। ধীরে ধীরে যেন নৈশনিরবতা হইতেই অস্পষ্ট সুর বাহির হইয়া সুরের নৃত্যভঙ্গিতে উচ্চ হইতে উচ্চতর গ্রামে উঠিয়া আবার মৃদু হইতে মৃদুতর হইয়া অনন্ত নিরবতায় বিলীন হইতেছিল। তারই সঙ্গে সঙ্গে  শিল্পীর দেহে-মুখে-চোখে ভাবান্তর হইতেছিল। রাত প্রায় ২টা অবধি তাহার বাজনা শুনিয়া গৃহে ফিরিয়া আসিলাম।আমাকে আগাইয়া দিতে দিতে সুলতান বলিল,”প্রতিদিন সারারাত জাগিয়া সে এই শিল্পীর বাজনা শোনে। লোকটি অদ্ভুত ধরনের। সারাদিন এখানে ওখানে ভিক্ষা করিয়া কাটায়। কাউকে বাজনা শুনাইয়া পয়সা লয় না। সে বলে, বাজনা শুনান মানে নিজের অন্তরকে অপরের অন্তরে ভরিয়া দেওয়া। ইহা মূল্য দিয়া হয় না। রেডিও তাহাকে প্রোগ্রাম দেওয়ার জন্য কত চেষ্টা করিয়াছে। কত বড়লোক বাজনা শুনিবার জন্য তাহাকে আহ্বান করে। সে কাহারও ডাকে সাড়া দেয় না। শুধু মাত্র রাত্রে আসিয়া সে সুলতানকে বাজনা শুনাইয়া যায়। সে বলে, রসিক ব্যক্তির কাছেই শুধু রস বিতরণ করিতে হয়। অরসিকের কাছে রসের অবতরণা করিলে শিল্পকেই শুধু অপমান করা হয়।

বিছানায় শয়ন করিয়া করাচির এই সদ্য পরিচিত বন্ধুদের কথা চিন্তা করিতে লাগিলাম। মিষ্টার হোসেন, মিসেস রোজী হোসেন এরা তথাকথিত অভিজাত সমাজে বসত করিয়া সুদূর বাংলাদেশের গ্রাম্য গান, মাটির পুতুল, লোকনৃত্যের কথা চিন্তা করিতেছেন, আর শিল্পী সুলতান নোংড়া গৃহকোণে ছেঁড়া কম্বল বিছাইয়া, কাগজের উপর ইন্দ্রসভার সমস্ত ইন্দ্রজাল তার তুলির মোহস্পর্শে ভুলাইয়া আনিয়া, ছবির লীলায়িত রেখায় জীবন্ত করিয়া রাখে, আর পার্শ্বে বসিয়া তার সেতারী বন্ধু ছিন্ন মলিন বেশে বুভুক্ষা পীড়িতদেহে অতীত ভারতের রাজসভার  অভিজাত সঙ্গীতকে আহার হাতের তার-যন্ত্রের উপরে আনিয়া সুরের মহামাধুরী বিস্তার করে।

ইহারা সকলেই শিল্পী। কবে ইহারা একই আসনে আসিয়া উপবেশন করিতে পারিবে?

ইউরোপ হইতে ফিরিয়া আসিয়া সুলতানকে বহু অনুসন্ধানেও খুঁজিয়া পাই নাই। আজ একান্তে বসিয়া শিল্পীকে ভাবিতেছি, শিল্পীকে উপরোক্ত পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা আমার কতটুকু আছে? সুলতানের সঙ্গে দেখা হইলে বলিতাম, ”বন্ধু! তুমি কিছু মনে করিও না, তোমাকে পরামর্শ দেওয়ার আড়াল রচনা করিয়া আমি সেদিন আমার সাহিত্যিক মনকেই উপদেশ দিয়েছিলাম। ইহার পরে আরও বহু বিচিত্র অবস্থায় সুলতানকে দেখিয়াছি। সে সব কথা সামান্য কিছু লিখিয়া রাখি।

ইহার বছর দুই পরে একদিন টিমটিম করিয়া বৃষ্টি হইতেছে, দেখি সুলতান আমার দরজায় দাঁড়াইয়া। তাহাকে আদর করিয়া বৈঠকখানায় বসাইলাম। ইতিমধ্যে সুলতান ইউরোপ আমেরিকা ঘুরিয়া আসিয়াছে। বহু দেশের খবরের কাগজ ফটোসহ তাহার উপরে কিছু কিছু লিখিয়াছে। সুলতান বলিল, ”এবার বাংলায় এলাম আপনার উপদেশ মতো দেশের জনসাধারণের কথা চাক্ষুস জেনে তাদের ছবি আঁকতে সুলতানকে রংয়ের দোকানে লইয়া গেলাম। সে রঙ-তুলি-কাগজ মিলিয়া প্রায় দুইশত টাকার সওদা করিল। তারপর একদিন পরে তাঁর নিজের দেশ যশোরে চালিয়া গেল। সুলতানের অতীত কাহিনী আপাতঃত মূলতবী থাক।

 সূত্রঃহলদে পরীর দেশে-জসীম উদ্দীন

পলাস প্রকাশনী 

প্রথম মুদ্রন-১৯৬৫

Share

Recent Comments

Recent Articles