জীবন , প্রকৃতি ও শিল্পের এক অভিনব মালাকার

শিল্প ও প্রকৃতিরাজ্যে তিনি ছিলেন এক সুলতান । স্বদেশে এমনই এক মহিমান্বিত কমলাসন শেষ জীবনে পেয়েছিলেন শিল্পী এস. এম . সুলতান । জীবনকালে এক কিংবদন্তী , এক রূপকথার নায়ক তিনি । উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের উপাদান এবং শত শত প্রবন্ধ - নিবন্ধ শিরোনাম হয়ে ঘরে ঘরে তিনি আজ এক পরিচিত মানুষ । যতো লেখাই হোক তবুও তার সম্পর্কে সাধারণ কৌতূহল অন্তহীন ।

রূপকথায় যে রাজার হাতি পথের অচেনা ছেলেকে হঠাৎ শুঁড়ে তুলে পিঠে নিয়ে প্রাসাদে শূন্য সিংহাসনে বসিয়ে দেয়, শিল্পী সুলতানের জীবনেও এ ধরনের এক ব্যাপার আছে। প্রফেসর শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বালক সুলতানের যোগাযোগ প্রায় এমনই এক ঘটনা বলে আমরা ভাবতে পারি । কেননা সেখানে দুয়ে-দুয়ে চার মেলাবারই মতো কিছু ছিল না । তবুও সেখানে দুয়ে দুয়ে পাঁচ হয়ে যাবার মতোই অসম্ভব কিছু আমরা পাই । প্রফেসর সোহরাওয়ার্দী এক বিস্ময়কর শিল্প জহুরী বটে । নইলে যে পরিবেশ ও পটভূমিতে সুলতানের জন্ম, তা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর নাগাল তাঁকে সহজে পাইয়ে দেবে, এমন ছিল না। কবি গ্রে যেমন বলেছেন, ' কত ফুল সলাজ ফুটে যায় চোখের আড়ালে, ' শিল্পী সনুতানও হয়ত তেমন অখ্যাত অবজ্ঞাত অনাদৃত এক বিরল পুষ্পোদগম হয়েই ঝরে যেতেন । শেষ পর্যন্ত তা হয়নি । এই যে হয়নি, তার কারণ যে তিনি কোমর বেঁধে আদাজল খেয়ে না খেয়ে লেগেছিলেন, তা মনে হয় না। মানুষের জীবনে কোনো কোনো প্লাবনে ভাসতে পারলে সৌভাগ্যতীর্থে পৌঁছে যাওয়া যায় বলে শেকসপীয়র যে কথা লিখেছেন, তেমন জোয়ারে ভাসার সুযোগ পেয়েও শিল্পী সুলতান তা গ্রহণ করেননি। প্রতিষ্ঠান তাঁকে বাঁধতে পারেনি। প্রচারবিমুখ তিনি আজন্ম । যে সময়ে এই শিল্পীর ছবি দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রশংসিত তারপর কতকাল তিনি স্বদেশে প্রায় নেপথ্যচারী। প্রতিভা তাঁর কত বিশাল এবং সেই মনীষার স্বীকৃতি কতটুকু হলো না হলো, এ নিয়ে তাঁর আদৌ ভাবনা ছিল না। কালো আলখেল্লা গায়ে ওঠার আগেই তাঁর নাম বিশ্বের বড় বড় প্রদর্শনীতে উঠে গেছে । তখনও তিনি পোশাকে আশাকে চলাফেরায় অনুল্লেখ্য । ওই সময়ে “ যশোর তসবীর মহলে ” কোনো এক নাট্য মহড়ার ফাঁকে নাট্য পরিচালক ( অধ্যাপক নূরুল হালিম ) একজন আপাত অতি সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, 'উনি বিরাট শিল্পী, ইউরোপ আমেরিকায় ওঁর ছবির খ্যাতি। মানুষটিকে দেখে সে কথা বিশ্বাস করাই যায় না। নানা মাপের মোটা সরু ডজনখানেক বাঁশী ঝোলার নিয়ে বসে আছেন তিনি, কথা বলছেন আশপাশের মানুষের সাথে। এমন সহজ সেই আলাপ, বোঝার কোনো উপায় নেই যে তিনি অনন্য । শুনেছি , জংলা ভাঙাচোরা ভূতড়ে বাড়িতে সাপকোপের সাথে তখন নাকি তিনি স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করছেন, বন্ধু অধ্যাপকদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, রঙ তৈরি করছেন, খুশি মতো ছবি এঁকে অকাতরে একে - ওকে বিলিয়ে দিচ্ছেন সেই সৃষ্টি। তখনকার সেই চিত্র প্রাপকগণ সবাই যে তাঁর ছবি সযত্নে রক্ষা করেছেন, তা নয় । কেন রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তখনকার ভাগ্যবান চিত্রপ্রাপক একজন কিছুদিন আগে আমাকে অকপটে বলেছেন 'তখন ওই ছবির মূল্য ও মর্ম ঠিক বুঝিনি। বিশ্রুত শিল্পবোদ্ধা প্রফেসর শাহেদ সোহরাওয়ার্দী একনজরে বালক এস. এম. সুলতানের মাঝে আগামী শিল্প জগতের এক সুলতানের বিপুল সম্ভাবনাময় আবির্ভাব দেখতে পেয়েছিলেন।এ দেশের মানুষ বহুকাল এই শিল্পীর খোঁজ পায়নি। তাঁর সম্পর্কে তেমন আগ্রহ কারো ছিল না। এজন্যে দায়ী কি শিল্পবোধে আমাদের সাধারণ দৈন্য ? হতে পারে । তবে প্রচারবিমুখ শিল্পীও যে কখনো তাঁর প্রকৃতির আড়াল ছেড়ে রাজধানীর বুকে খ্যাতির বরণমালা কুড়োতে আসেননি - সে কথাও একশ ' ভাগ সত্যি । এক সময় আমার এমন সংশয় ছিল যে এ দেশের গুণী শিল্পীরাও বুঝি এস এম সুলতানের নাম জানেন না। একেবারেই ভ্রান্ত ছিল আমার ধারণা। বাহাত্তর সালের কোনো এক সময়ে একদিন কথা প্রসঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম 'স্যার, আপনি কি শিল্পী সুলতানকে চেনেন ? " অবাক হয়ে আমার মুখে তাকিয়ে শিল্পাচার্য বললেন- ' আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় শিল্পীকে আমি চিনবো না ? ' নির্বোধ ও অর্বাচীনের মতো প্রশ্ন করায় আমি তখন লজ্জিত হলাম বটে, কিন্তু সেই মুহূর্তে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মনের বিশালতাও সাধারণ পরিমাপ ছাড়িয়ে গেল । একজন মহান শিল্পী বুঝি এমন করেই আর এক মহান শিল্পীর প্রতি তাঁর স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধাবোধ জানান। এই ঘটনার পর আমার আদৌ দুর্ভাবনা ছিল না , আমরা জেলার প্রচারবিমুখ এই শিল্পীকে কে চেনে - না - চেনে । তাছাড়া আমরাও আমরাও তো তাঁর প্রথম মূল্যায়ন করেছি পাশ্চাত্য শিল্পবেত্তাদের প্রশংসা শুনে। প্রায় ক্ষেত্রেই যা ঘটে আর কি।

শিল্পী সুলতান দীর্ঘকাল এক রকম স্বেচ্ছা অন্তরীণ ছিলেন।পোশাকি ব্যাপার-স্যাপারে বড় একটা বের হননি । তবুও কিছু বিদগ্ধ শিল্প রসিক সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্কৃতিকর্মী গভীর ঔৎসুক্যে প্রকৃতির আড়াল থেকে তাঁকে ধীরে ধীরে টেনে এনে দেশের পাদপ্রদীপের পুরোভাগে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।এই কাজে যে ব্যক্তিরা অগ্রণী ছিলেন , তাঁদের কাছে আমাদের ঋণ কোনোদিন শোধ হবার নয়। কোনো কোনো নাছোড়বান্দা সংস্কৃতিকর্মী শিল্পী সুলতানকে এমন করে তাঁর গ্রামের বাইরে নিতেন বলেই তার হাতে খুলনার কবিতালাপের ভালোবাসা গ্রহণের সৌভাগ্য হলো আমার ।

সুলতানকে আবিষ্কার করা মানে শুধুমাত্র কোনো শিল্পীকে দেখাই ছিল না , এক মহৎ শিল্প সৃষ্টিরও মুখোমুখি হবার মতো অভিজ্ঞতা ছিল তা। রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধায় কবি নজরুল যেমন বলেছেন, 'রস পান করে আমি হয়ে গেছি রস'- শিল্পী সুলতানও ছিলেন শিল্প সাধনায় একাত্ম ও নিমগ্ন প্রকৃতির এক জীবন্ত শিল্প।অনেকবার এই মানুষটিকে দেখতে দলেবলে তার বাড়িতে গেছি। আকর্ষণ ছবি নয়, ছবির পিছনের এক দুর্লভ মানুষ, প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এক চমক । সম্রাট শাহজাহানের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ' তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ' । মানুষ সুলতানও তেমনি তার সষ্টিকে পিছনে ফেলে অনেক এগিয়ে ছিলেন । এই বিস্ময়কর মানুষকে তার আপন ভুবনে দেখায় এক ধরনের থ্রিল আছে বলেই সবাই বারবার রূপগঞ্জে ছুটে গেছে। অকৃতদার, তবে সংসারবিবাগী কিংবা গজদন্ত মিনারবাসী জীবনবিযুক্ত ভোলা মানুষ তিনি ছিলেন না । তার একান্নবর্তী পরিবার যেমন বৃহৎ, তেমনি বিচিত্র । নিঃসঙ্গ হবার কোনো উপায় ছিল না তার। সেখানে বন্যপোষ্য নানা জাতের পশুপাখি প্রাণী ও তাদের পরিচর্যারত মানুষজন এবং গ্রামের শিশুদের মধ্যে সুলতান ছিলেন প্রকৃতিরই এক অংশ ।এই পটভূমি থেকে পৃথক করে দেখলে তার সম্পূর্ণ দর্শন মেলে না । এখানেই তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ, এখানেই তার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের পূর্ণ প্রকাশ। জীবন ও প্রকৃতির সাথে তিনি ছিলেন অঙ্গাঙ্গী। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তার চেহারা খন্ডিত হয়ে যায়। আবার অন্যভাবে এ কথাও বলা যায় তার ছবি ও তিনি ছিলেন অভিন্ন । যে মাটি, প্রকৃতি ও কৃষিনির্ভর এ দেশের মানুষের চিরায়ত জীবন সাধনা, সংগ্রাম ও বিপুল শক্তি তার ছবিতে পাই, তারই প্রতীক ছিলেন তিনি। কেবলমাত্র মানুষকে নয়, তিনি ভালোবাসতেন সমস্ত সৃষ্টিকে। গাছগাছালি ও প্রাণী জগতের সাথে তার যে মিতালী, তা দেখেও এই সখ্যের সবটা বোঝা যায়নি। ভালোবাসার ভাষায় তাদের সাথে ছিল তার ভাব বিনিময় । তাদের সুখ - দুঃখ শিল্পী বুঝতেন, তাদের আনন্দবেদনা তাকে একইভাবে আলোড়িত করতো ।শিল্পীর কাছে এইসব বন্যপোষ্য প্রাণীর ভিন্ন ভিন্ন নাম ও পরিচয় ছিল এবং সেভাবেই ছিল তাদের ডাকাডাকি।একবার এক হিংস্র কোনো জন্তু বাঘের বাচ্চা হয়ত শিল্পী বাড়িতে স্বেচ্ছায় চলে এসে ধরা দেয় এবং সেখানে কিছুদিন আতিথ্য গ্রহণ করে। এ কথা শুনে একটু পরিহাস করে আমি বলেছিলাম 'শিল্পী, আপনাকে সে চিনিলো কেমনে ? " শিল্পী হেসে বললেন , ' ওরা টের পায় , ওরা সব বুঝতে পারে।'

শিশুরা প্রকৃতির এক অকৃত্রিম অংশ বলেই হয়ত শিশুদের প্রতি তার মনোযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। কোনো শিশু একবার রঙতুলি নিয়ে ছবি আঁকলে, বড় হয়ে অসুন্দর কিছু আর সে করতে পারে না এমন এক বিশ্বাসে তিনি ' শিশু স্বর্গ ' গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। শুধু স্বপ্নই নয় , শেষ জীবনে তার ছবির বিক্রয়লব্ধ অর্থ অকাতরে ব্যয় করতেন তার সেই শিশুদের কল্যাণে। যে প্রকৃতি পাঠের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, সেই রকম এক পাঠশালায় অধ্যয়নের জন্য নিজ তত্ত্বাবধানে শিল্পী তৈরি করালেন এক বড় নৌকা । উদ্দেশ্য শিশুদের নিয়ে তিনি চিত্রায় ভাসবেন, সুন্দরবন যাবেন । আমরা ভীতু , সাবধানী মানুষ। একবার তাকে বলা হলো, এই নৌকায় সুন্দরবন যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা সেখানে নদীর বুকে চলার মতো নৌকাটি নয়। শিল্পী একমত হননি।

শিল্পী সুলতানকে তাঁর চারপাশের প্রকৃতি ও জীবন থেকে আলাদা করে দেখায় তেমন মজা ছিল না । এই ' জীবন্ত শিল্প'র প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে সবাই তাঁকে দেখতে গেছে তার গ্রামের বাড়িতে । সেখানে বন্যপোষ্য পশুপাখি প্রাণীর বিচিত্র গন্ধের সম্মিলিত সৌরভ কখনো কখনো কারো কারো নাসিকা যন্ত্রকে একটু সুড়সুড়ি দিলেও ওই রাজ্যে এই ‘বিরাট শিশু'র জীবনচর্যা এক মুহূর্তে সবাইকে মুগ্ধ করে ফেলতো। চিরায়ত বাংলার অতিথিপরায়ণতার ঐতিহ্য থেকে একতিল ভ্রষ্ট হননি শিল্পী। একবার তো তার বাড়িতে পৌঁছতেই এলো ঝকঝকে কাপপিরিচে টাটকা বিস্কিট ও ধূমায়িত চা । গাছগাছালি পশুপাখি নিয়ে সংসার পাতলেও জীবনাচরণে পোশাকে- আশাকে আলাপে-সংলাপে একেবারেই তিনি জংলী ছিলেন না। মনে ও মননে যেমন, চলাফেরায় কথাবার্তায়ও তেমনি এক সংস্কৃত, পরিশীলিত মানুষ ছিলেন তিনি। গ্রামের মানুষ, গ্রামে বাস করতেন বটে ,কিন্তু এতটুকু 'গাইয়া' নন। বাংলাদেশের যেখানে তার আবাস, সে স্থানের আঞ্চলিকতাও তার জিভের ডগায় কখনো শুনতে পাইনি । বাংলা বর্ণমালা ও উচ্চারণের প্রমিত ধ্বনি ও রূপটি বরাবর তাঁর বাক্যবিন্যাসে পেয়েছি । কি বাংলা কি ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে তাঁর সচেতনতাও লক্ষ্য করেছি । এই ' সফিস্টিকেশন ' অবশ্য তাঁকে কখনো প্রকৃতি থেকে বিশিষ্ট করেনি । সম্পূর্ণ সংস্কৃত এক মানুষ ছিলেন তিনি । তাঁর শিশুস্বর্গও তাই প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক মিলন সাধনা ।শিশুদের গড়ে তোলায় তাঁর যে শিক্ষা ভাবনা, তার পূর্ণ রূপায়ণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। তাঁর তিরোধানের পর এখনো এক বছর পার হয়নি। অথচ ইতিমধ্যে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার সমগ্র পরিকল্পনা ।

শুধু শিশুদের কথাই বা বলি কেন কারো মনের সুপ্ত শিল্পবোধ জাগাতে তিনি যে কতটা সফল ছিলেন, তার একটি দৃষ্টান্ত আমার জানা আছে। ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী নামে যে শিকড় ভাস্কর্য শিল্পী এ দেশের শিল্পাঙ্গনে পরিচিত, শিল্পী সুলতান তাকে অনেক দিন আগে থেকেই চিনতেন । পঞ্চাশোর্ধ বয়সে ফেরদৌসি যখন নেহাৎ সখ ও খেয়ালে শত তুচ্ছের আড়ালে পড়ে থাকা মরা- পোড়া গাছের ডাল গুড়ি শিকড় বাকড় কুড়িয়ে নানা ফর্মে ঘর সাজাতে লাগলেন, একদিন শিল্পী সুলতান তা দেখে এক মুহূর্তে এই কাজের মধ্যে শিল্পের অমিত সম্ভাবনাকে বুঝতে পারলেন। ফেরদৌসিকে তিনি বললেন, এই প্রয়াস শিল্পের একটি নতুন ধারা, শিল্পের শিকড়, এক ধরনের আধ্যাত্মিক দৃষ্টি ব্যতিরেকে এই সংগ্রহ ও তার রূপদান সম্ভব ছিল না। শিল্পী সুলতানের বিপুল প্রেরণা না পেলে ফেরদৌসি তার খেয়ালী কর্মকে এক অভিনব শিল্পকর্মে রূপান্তর ঘটাতে এমন সিরিয়াস হতেন কিনা কে জানে। ফেরদৌসিকে হাত ধরে শিল্পের আলোময় স্বগতে টেনে এনেছেন তিনি। এখানে শিল্পী সুলতান যে নতুন একজন শিল্পী গড়লেন , তাই নয় । এই নতুন শিল্পীর মাধ্যমে তিনি উন্মোচন করলেন শিল্পের এক আপাত অদৃশ্য রূপ।বেঙ্গল ফাউণ্ডেশনের উদ্যোগে ফেরদৌসি প্রিয় ভাষিণীর ' শত তুচ্ছের আড়ালে ' শীর্ষক শিল্প প্রদর্শনীর দ্বার উদঘাটন করে শিল্পের এই নতুন ধারাকে বেগবান করে গেছেন তিনি। এই প্রদর্শনী উপলক্ষে তিনি ঢাকায় এলেন। বিমানবন্দরে অভ্যর্থনায় গিয়ে দেখি তার সফরসঙ্গীর হাতে একটি ক্যানভাস। আমরা জানতে পারলাম, শিল্পী ভেবেছেন- যদি তাঁর হোটেল বিল পরিশোধে প্রদর্শনী আয়োজকদের অসুবিধা হয়, তাহলে তিনি ছবি এঁকে ক্যানভাসটি হোটেলে দিলে বিল মেটানো যাবে ।

মৃত্যুর মাত্র ক'দিন আগে শেষবার শিল্পীর সাক্ষাতে গেলাম তার গ্রামের বাড়িতে।শরীর ভালো না হলেও ভালোই। চলাফেরা করছেন । পাশে পাশে ফিরছে মনে হলো, সাইবেরিয়ান এক স্পিৎজ। শিল্পীর বিছানা থেকে ছুটে নামলো, আগন্তুকবৃন্দের পা শুকলো । তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে শিল্পীর পায়ে পায়ে জড়িয়ে রইলো । পাশের ঘরে খাবার টেবিলে একটি বিড়াল তখন গভীর দিবানিদ্রামগ্ন।টেবিলের নিচে আরেকটি কুকুর ঘুমে অচেতন । এসব পশুপ্রাণীর প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই, কিন্তু আমার সঙ্গী পুত্রবধূ পলার সে কি কৌতুহল আর উৎসাহ । আমার কাছে শিল্পীই ছিলেন প্রধান । তিনি কথা বলতেন, শুনতাম । সবটাই প্রায় তার শিশু স্বর্গের ভাবনা । শিল্পীকে মনে হতো এক চিরশিশু, পঙ্কিল সমাজে এক পবিত্রতা ।

শিল্পী এস এম সুলতানের     জন্মদিন ( ১০ ই আগস্ট ) এসে গেল । কিন্তু তার সব আয়োজন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিছুদিন আগে শিল্পীর পরম স্নেহভাজন সংস্কৃতি কর্মী শেখ হানিফ ও চন্দনার মুখে শোনা গেল কেমন করে এই সহজ সরল বিরাট শিশুকে তার আশপাশের মানুষ এবং কিছু কিছু শিল্প ব্যবসায়ী আমৃত্যু ঠকিয়েছে ।আশপাশের মানুষ সরকারি অর্থ পেয়েও তার ওষুধ পথ্য কিনে দেয়নি তার মৃত্যুর আগে । এমন কি মৃত্যুর পরও তার স্বাক্ষর জাল করে তাদের বেনামা ছবি বাজারে চালাতে চেষ্টা করেছে । হানিফ জানালো , ইতিমধ্যেই পশুপ্রাণী স্থানান্তরিত হচ্ছে, কেউ কেউ অযত্ন ও অবহেলার শিকার। আর শিশু স্বর্গ ? কে দেখবে তাকে ?

অর্থাৎ এই হলো আমাদের জাতীয় অথবা রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা।শিল্পী সুলতানের ঐতিহ্যকে কে সমুন্নত রাখবে, কে তার উত্তরাধিকার কাঁধে তুলে নেবে। তার ভালোবাসার আলয়ে পরম নিশ্চিন্ত বন্যপোষ্য জীব ও প্রাণীরও অস্তিত্বের সংকট। শিল্পীর মৃত্যুর পর সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে শিল্পীর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। অথচ কত না জরুরী ছিল এই উদ্দ্যোগ। জীবন , প্রকৃতি ও শিল্পকে এক মালায় গাঁথার চেষ্টা করে গেছেন শিল্পী সুলতান।তাঁর এই প্রয়াসে যদি কোনো সত্য মূল্য থাকে, তাহলে সকলে, বিশেষ করে শিল্পী সমাজ, তার ঐতিহ্য রক্ষায় ব্রতী হবেন ,এই আমাদের আশা । শিল্পীর স্বপ্ন ও সাধনা যদি ফলবর্তী না হয়, তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে বর্তমান অভিযুক্ত হবে নিশ্চিয়ই।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles