লাল মিয়া আর চিত্রাসুন্দরী

মূল কাহিনীতে যাওয়ার আগে দু''একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। শিল্পী এস. এম. সুলতানকে আমার ছাত্রাবস্থা থেকেই চিনতাম। কিন্তু তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হয় ১৯৭৬ সালের গোড়ার দিকে। আমরা তিন সহপাঠী সুবীর, সাইমন এবং আমি তিন জনই তখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগে কাজ করি। সৌখিন ভাস্কর কাজী মতিউর রহমান (আমাদের মতিভাই) নড়াইল থেকে শিল্পী সুলতানকে ঢাকায় এনে শুরু করলেন তাঁকে নিয়ে শিল্পকলা একাডেমীতে নিয়মিত আসা যাওয়া। এ সময়েই শিল্পীর নিজের মুখে তাঁকে ঘিরে নানা অলৌকিক ঘটনা শোনার দুর্লভ সুযোগ মেলে আমাদের।এক সময় সিদ্ধান্ত হল শিল্পীর একক প্রদর্শনী আয়োজিত হবে শিল্পকলা একাডেমীর গ্যালারীতে। এর ফলে সাইমন এবং আমার শিল্পীর সাথে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হয় । অবশেষে সেপ্টেম্বর ৭৬-এ আয়োজিত হল শিল্পী এস. এম. সুলতানের সেই সাড়া জাগানো চিত্র প্রদর্শনীটি। এই প্রদর্শনীর পর শিল্পী সুলতান হলেন সমাজের প্রভাবশালীদের অহংকারের বস্তু। কাজী মতিউর রহমান এদের কাছে তখন অচেনা মানুষ, এমনকি শিল্পীর কাছেও ।

১৯৭৯ সালে আমি সরকারী বৃত্তি নিয়ে চলে যাই ভারতে।এর পরপরই সাইমন চলে যায় রাশিয়ায়। ১৯৮২ সাল, মিউজিয়লজিতে উচ্চ শিক্ষার পর আমি ফিরে এসেছি দেশে। এর মধ্যে শিল্পী এস এম সুলতানকে সরকার রেসিডেন্টশীপ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীকে এ বিষয়ে সকল ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে । আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো শিল্পীর জন্য বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করা । কেমন বাড়ি হবে সে সম্পর্কে শিল্পী কতগুলো শর্ত জুড়ে দিলেন। সেই শর্তাবলীর মধ্যে ছিল প্রথমতঃ বাড়িটি অবশ্যই একতলা হতে হবে, দ্বিতীয়তঃ ছাদের ওপর চিলে কোঠা ছাড়া আর একটি কামরা থাকতে হবে এবং তৃতীয়তঃ বাড়ির উত্তর ধারে লেক থাকতে হবে । 

বাড়ি ভাড়ার জন্য যে অর্থ বরাদ্দ ছিল সে অর্থে ধানমন্ডি বা গুলশান লেকের ধারে কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না বিধায় খোজ চললো অন্যত্র । একদিন হাজির হলাম মিরপুর ১২ নং সেকশনে । রাস্তায় দেখা হল এক বন্ধু ফিরোজ সাই - এর সঙ্গে । তিনি জানালেন তার এক আত্মীয়ের একটি বাড়ি আছে মিরপুর ঝিলের ধারে এবং নিয়ে গেলেন সেখানে । বাড়িটি দেখে আমি চমকেই উঠলাম । মনে হল শিল্পী সুলতান বোধ হয় এই বাড়িটি তার তৃতীয় নয়নে দেখেই শর্তগুলো জুড়ে দিয়েছিলেন ।

পরবর্তী সময়ে আমার কর্মস্থল বদল করায় ১৯৮৪-৯৩ প্রায় একদশক শিল্পকলা একাডেমীর সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগে কিছুটা ভাটা পড়ে ।ঠিক এমন এক পরিবেশে বন্ধুবর সুবীর চৌধুরী শিল্পকলা একাডেমীর পক্ষ থেকে আমায় দাওয়াত দিলেন দ্বিতীয় পেইন্টিং ওয়ার্কশপে যোগদানের জন্য। স্থান নির্ধারিত হয়েছে নড়াইল। পরিচালনা করবেন শিল্পী এস. এম. সুলতান । সময়কাল ৯-১৮ই ফেব্রুয়ারী ৯৪ ।বাড়তি কর্মসূচী হিসেবে সুন্দরবন ভ্রমণ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমি জলরঙে কাজ করে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তেলরঙে তেমনটি বোধ করি না । এ দু'য়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়লাম । পরে মনে হল এত ভাবনার আছে কি ? জলরঙ সাথে রাখি, আর কিছু না হোক সুন্দরবন ভ্রমণ তো আছেই বোনাস হিসেবে ।

ঢাকা , চট্টগ্রাম , খুলনা এবং রাজশাহী থেকে মোট ১৫ জন শিল্পীকে নির্বাচন করা হয়েছে এই ওয়ার্কশপের জন্য। আমি ছাড়া আর সকলকে নিয়ে একটি নৈশ কোচ ৮ ই ফেব্রুয়ারী ৯৪ রওনা হয়ে গেল নড়াইলের উদ্দেশে। পারিবারিক এক জরুরী কাজ থাকায় এই দলের সাথে আমার যাওয়া হল না ।

০ ই ফেব্রুয়ারী সকাল ন'টায় যশোর বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে একটা মাইক্রোবাস শেয়ার করে হাজির হলাম শহরের প্রধান বাস টার্মিনালে। চট করে মিলে গেল নড়াইল গামী একটি বাস। বাসে সামনের দরজা ঘেঁষে বসার জন্য একটা জায়গাও মিলে গেল। বাস কণ্ডাক্টর আর পাশের যাত্রীকে বললাম আমার গন্তব্যস্থলের কথা। অতএব যেখানে নামলে আমার সুবিধা হবে সেখানে আমাকে নামিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলাম। পাক্কা সোয়া ঘণ্টা চলার পর বাস এসে থামলো নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারে । আমার পাশের যাত্রী বললেন আপনি এখানে নেমে যে কোনো রিকশা বা ভ্যানওয়ালাকে বলুন আপনি লাল মিয়ার বাড়ি যাবেন । ভাড়া নেবে তিন টাকা । এ অঞ্চলে শিল্পী এস. এম. সুলতান লাল মিয়া নামেই পরিচিত । 

রিকশা এগিয়ে চলছে আমাকে নিয়ে সোজা উত্তর থেকে দক্ষিণে, ছোট্ট নড়াইল শহরের পুরোনো অংশের দিকে। হঠাৎ কতগুলা পুরোনো গাছ এবং পুরোনো দালানের ভাঙা ভিত দেখে একটু উৎসুক হয়ে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এলাকাটি নড়াইলের জমিদার বাড়ির। জমিদার বাড়িকে এখন কল্পনা করে নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। জমিদার বাড়ির লোকজনের নদীতে গোছল করার ঘাট ছাড়া আজ সব কিছুই বিলুপ্ত। কল্পনার পর্দায় একে একে ভেসে উঠলো জমিদার বাড়ির নানা ঘটনা যেগুলো শিল্পীর মুখ থেকে শুনেছিলাম ৭৬ - এর দিন গুলোতে । এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলোম । হঠাৎ করে রিকশার বাঁয়ে মোড় নেয়া আমার সম্বিত ফিরিয়ে আনে। দেখলাম পিচঢালা পথ ছেড়ে রিকশা এগিয়ে চলছে সোজা পূর্ব দিকে ইট বিছানো রাস্তা ধরে । কিছুটা এগুতেই চোখ পড়লো আধুনিক নকশার একটি বড় ফটক যেখানে রাস্তাটি আবার বাঁয়ে এবং পরে ডানে ঘুরে সোজা চলে গেছে নদীর ধারে। রিকশা থেকে ফটকের গ্রীলের ফাঁকে চোখ পড়তেই দেখি শিল্পী সুলতানকে ঘিরে ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারী ক'জন। রিকশা বিদায় করে ফটকের ভেতর কিছুটা এগুতেই শিল্পকলা একাডেমীর চারুকলা বিভাগের প্রদর্শনী অফিসার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, যিনি ওয়ার্কশপের সমন্বয়কারী, আমাকে স্বাগত জানাতেই ঘাড় ফিরিয়ে শিল্পী সুলতান বললেন ' আরে নাসিম যে ! এখনই এলেন নাকি। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো ! পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললেন --- ‘ এই খানটিতে বসুন । একটু জিরিয়ে নিন। অনেকটা পথ তো আসতে হয়েছে। অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না ভাই।'

'সরকারী খরচে নড়াইলের এই কুড়িগ্রামে শিল্পী এস এম সুলতানের বাসগৃহ এবং স্টুডিও যেমনটি করে সাজানো হয়েছে সেটি এ রূপ প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে শিল্পীর স্টুডিও । সেটিকে পাশে রেখে একটু এগুলেই বাঁয়ে শিল্পীর বাসগৃহ। এই দু'ভবনের মাঝখানে প্রায় ফুট বিশেক খালি জায়গা।এখান দিয়েই স্টুডিও ও ভেতর আঙিনায় আসার রাস্তা ফটক থেকে প্রথমে পূর্ব - পশ্চিম পরে ডানে ঘুরে উত্তর - দক্ষিণ এবং এরপর বায়ে ঘুরে ভেতর আঙিনায় চলে এসেছে শিল্পীর প্রাণপ্রিয় চিড়িয়াখানায় । যেটি তাঁর আবাসস্থলের দক্ষিণ এবং পূর্ব সীমানায় প্রাচীর ঘেঁষে অনেকটা ইংরেজী 'এল' এর মতন । আর একটি রাস্তা প্রধান ফটক থেকে শিল্পীর বাসভবনের উত্তর দিকে বাগানের মধ্য দিয়ে পূর্ব প্রাচীরের ছোট গেইট দিয়ে সোজা চলে গেছে নদীর ঘাটে, যেখানে বাঁধা থাকে ‘ শিশু স্বর্গের ' জন্য তৈরি করা যন্ত্রচালিত বজরা নৌকা। শিল্পীর সাধের গড়া 'শিশু স্বর্গের' ভবনটি নির্মিত হচ্ছে প্রাচীর ঘেরা জমির বাইরে। প্রধান ফটকে পৌঁছানোর ঠিক আগে ইট বিছানো রাস্তার বাঁ ধারে ( উত্তরে) যে রাস্তাটি বাড়ির ভেতর আঙিনার দিকে ঢুকেছে তারই সাথে সমান্তরাল ভাবে পাতা আছে লাল রঙের বেঞ্চ, এবং তার সাথে লাল রঙের বাগানবিলাস যা লাল মিয়ার বাড়ি চেনাতে ভুল করে না। এ ছাড়া তাঁর বাসভবনের উত্তর পাশে বাগানের রঙ-বেরঙের পাতাবাহারও খুব সহজেই নজর কাড়ে। এখানে ফুলের চেয়ে বাহারী পাতার গাছই বেশী। আশেপাশের বড় বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদের টুকরো টুকরো আলোগুলো যখন এই বিচিত্র রঙের পাতাগুলোর ওপর পড়ে তখন মনে হয় সমস্ত বাগানটাই যেন সুবৃহৎ একটি রঙের প্যালেট । 

শিল্পী সুলতান একজন এ্যাজমা রুগী ।শীতে তিনি একটু বেশি কাবু। বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখাবার জন্য যে বেঞ্চগুলো প্রথমে পূর্ব - পশ্চিম এবং পরে ডানে ঘুরে উত্তর পূর্ব কোণের সৃষ্টি করেছে ঠিক সেখানে বসেই রোদ পোহাচ্ছিলেন তিনি। আমাদের মধ্যে একজন, সম্ভবত ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সবেমাত্র স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নবীন শিল্পী আলগুগীন তুষার, তাঁর প্রতিকৃতি আঁকছিল। পরণে সাদা লুঙ্গি , পায়ে গরম মোজা, গায়ে ঘিয়ে রঙের শাল এবং মাথায় ঘিয়ে আর কালো রঙের ডোরা কাটা মাংকিক্যাপ। সকালের রোদের আলো পড়েছে তাঁর বাঁ কাঁধ থেকে। অনেকটা ব্যাক লাইটিং বলা যায়। পাশের লালরঙের বাগানবিলাস আর বেঞ্চের লাল সার্ফেস থেকে লাল রঙ প্রতিফলিত হয়ে বড্ড চমৎকার পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। তাঁর পাশে বসতে বসতেই শিল্পী কে. এম. এ. কাইয়ুম এবং মাহবুব আকন্দ এসে যোগ দিল আমাদের সাথে। বেলা তখন পৌনে বারটা। আকন্দ বললো ' নাসিম ভাই অল্পের জন্য বড় মজার খিচুড়ী মিস করলেন' ? ওকে থামিয়ে শিল্পী সুলতান বললেন ' আরে না মিস করবে কেন, ওর জন্য নিশ্চয়ই রাখা আছে । এই কে আছিস, এনে দে ওকে খিচুড়ী ' । শিল্পীর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁরই ব্যবস্থাপনায় আমাদের সকলের খাবারের ব্যবস্থা তাঁর ওখানেই করা হয়েছে। জোগাড়যন্ত্র করে পাক করতে একটু দেরী হওয়ায় সকালের নাস্তা খেতে বেলা প্রায় ১১ টা বেজেছিল। খিচুড়ী খাওয়া শেষে ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারী অন্যান্যদের সাথে আলাপের ফাকে ফাকে ভালমত ঘুরে দেখে নিলাম শিল্পী সুলতানের আপন ভুবন ।

ওয়ার্কশপ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য শিল্পী সুলতানের স্টুডিও আর বাসভবনের মাঝে বাচ্চাদের আঁকার জন্য যে বেঞ্চগুলো পাতা আছে তার ওপর সাময়িক ভিত্তিতে টিনের চালা তৈরি করা হয়েছে বাড়তি ব্যবস্থা হিসেবে। আবার ক'জন নদীর ঘাটে বাঁধা বজরার ছাদকে বেছে নিয়েছেন তাদের স্টুডিও হিসেবে। ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারী সকলকেই ৩'x৩' ফুট পরিমাপের দুটো করে তৈলচিত্র সম্পন্ন করতে হবে এই ক'দিনে । সে অনুযায়ী ঢাকা থেকে ক্যানভাস, রঙ, তুলি আর পনেরটি ইজেল আনা হয়েছে। শিল্পী সুলতানের শারীরিক অবস্থা দেখে বুঝলাম তাঁর পক্ষে সশরীরে ওয়ার্কশপ পরিচালনা করা সম্ভব নয় । তাই তাঁর মতামত নিয়ে কাজ শুরু করাটা সমীচীন ভেবে আলাপ শুরু করতেই বিনয়ের সঙ্গে তিনি বললেন 'আপনাদের কিছুই দেখাবার নেই আমার। তা ছাড়া আমার শরীরও কথা শুনছেনা। আপনারা আমার এই অজপাড়াগাঁয়ে এসেছেন এতেই আমি খুশি । এ হচ্ছে নকশী কাঁথার দেশ । নক্‌শী কাঁথার শিল্পীরা কখনও কাউকে গাইড করে না। আপন মনেই তৈরি করে অমন সুন্দর শিল্পকর্ম। আপনারাও যে যার স্টাইল অনুযায়ীই কাজ করুন। তবে আমি খুবই খুশি হব যদি আপনাদের ছবিতে এখানকার মানুষ আর প্রকৃতি ধরা পড়ে '।

নক্‌শী কাঁথার প্রসঙ্গ উঠতেই প্রায় বছর দশেক আগে শিল্পী সুলতানের কিছু কথা আমার মনে পড়লো। ১৯৮৬ সাল । আমি তখন বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে কাজ করি । একদিন সকালে শিল্পী সুলতান সেখানে এসে হাজির। বললেন তিনি যাদুঘরটি ঘুরে দেখবেন।আমি নিজের ইচ্ছায় এগিয়ে এলাম । এক এক করে যখন আমরা নকশী কাঁথার গ্যালারীতে হাজির হলাম তখন তিনি যা বলেছিলেন সেটি অনেকটা এরকম: ‘কি সুন্দর কারুকাজ। কালান্তরে এসব এখন আমাদের বড় গর্বের লোকজ শিল্পকলা।অতি সাধারণ মানুষগুলোর ঐসব শৈল্পিক গুণাবলী দেখে আমরা ক্ষান্ত হচ্ছি । আমরা সকলে কি জানি এসব রচনার আড়ালে কত দুঃখ বেদনা হাসি কান্না লুকিয়ে আছে। গৃহস্ত বাড়ির বউ । সকল দিক সামাল দেয়া তার কাজ। তবুও কােরো মন পাবার জো নেই। শাশুড়ি ননদী কথার ফোড়ন দিয়েই চলেছে। বউটির শৈল্পিক মন এরই ফাঁকে ফাঁকে বসছে কাঁথা নিয়ে। এখানেও শান্তি নেই, কোলের যে শিশুটি উঠোনে আপন মনে খেলছিলো সেও মাকে বসতে দেখে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে আবদার করছে দুধ খাবে বলে। এমনি পরিবেশে তাঁরা রচনা করেছেন এমন অসাধারণ লোকজ শিল্পকলা। বিশ্ববরেণ্য শিল্পী ভ্যান গগ সম্পর্কে বলা হয় তাঁর ছবিতে লাল রঙের প্রয়োজন হলে তিনি তুলি প্যালেটে না নিয়ে সেটি ডুবিয়ে দিতেন তাঁর হৃৎপিণ্ডে। গ্রাম বাংলার শিল্পীদের এসব কাঁথা দেখলে আমারও মনে হয় সামাজিক নানান প্রতিকূল পরিবেশে ওঁরা এসব শিল্পকলা রচনা করেছেন । সুঁইয়ের প্রতিটি ফোড়ন ওঁদের সেই ফোড় খাওয়া হৎপিন্ডের কথাই আমাকে বার বার মনে করিয়ে দেয় ।

পরের দিন ১১ ই ফেব্রুয়ারী ৯৪। এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে খুব ভোরে আমার ঘুম ভাগুলো। সূর্য ওঠা পর্যন্ত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটালাম। বেলা উঠতেই শহীদুল্লাহ আর আমি সোজা চলে এলাম চিত্রা নদীর সরকারী ঘাটে। নড়াইলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল হোটেল সম্রাট এ । এটি নদীর ঘাট থেকে খুবই কাছে। চিত্রা নদী সম্ভবতঃ পুরো নড়াইল শহরের পূর্ব দিক দিয়ে উত্তর - দক্ষিণে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে। জোয়ার ভাঁটা নদীকে প্রভাবিত করে । ফলে প্রচুর কচুরিপানা জোয়ার ভাঁটার টানাটানিতে সব সময়ই সচল। বর্ষাকালে বাড়তি পানিতে নদী খাল বিল ভরে গেলে যেমনটি হয় অনেকটা সেই রকম এর দু'কুল। জোয়ার ভাঁটার কারণে নদীর পানি একটু ঘোলাটে বটে তবে নোংরা নয়। গোসল সেরে হোটেলে ফিরে কাপড় বদলে কাছের একটা রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে একটি রিকশায় চড়ে রওনা দিলাম শিল্পী সুলতানের বাড়ির দিকে। আমাদের হোটেলটি রূপগঞ্জ বাজার সংলগ্ন এলাকায় । এখান থেকে শিল্পী সুলতানের বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার। সেখানে পৌঁছেই দেখি তিনি তাঁর দক্ষিণ বারান্দায় ক'জনের সাথে কি নিয়ে আলোচনা করছেন। আমাকে দেখেই বললেন 'চলুন ভাই নৌকোয় চড়ে একটু ঘুরে আসি দক্ষিণে পেরুলী আর গাজীর হাট থেকে ”। আমি প্রস্তুত ছিলাম না । বললাম আসুক সকলে তারপর যে সিদ্ধান্ত হয় সেভাবেই কাজ হবে। ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীদের দল নেতা শিল্পী কাইয়ুমের সাথে আলাপ করে নৌকা ভ্রমণ পাকা করা হল ।

আমরা প্রায় সকলেই যে যার প্রস্তুতি নিয়ে উঠে পড়লাম বজরায়। কিছু সময় পরে শিল্পী সুলতান এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। একজন তাকে নদীর ঢাল বাইতে সাহায্য করলো। বজরার সিঁড়িতে পা রাখতেই বললেন এবার আমি একাই পারবো । তাঁর পরনে হাল্কা ঘিয়ে রঙের সিল্কের পাঞ্জাবী। ঘাড়ে ঝোলানো পশমী শালটিও একই রঙের । সাদা ধবধবে ঢোলা ঢালা পায়জামা । পায়জামা আর পাঞ্জাবী দুটোই কড়া মাড়ে ইস্ত্রী করা, পায়ে বাদামী রঙের পাম্পশু পালিশে চক্‌চক্‌ করছে। হাতে দামী কালো রঙের ওয়াকিং স্টিক। লম্বা কোঁকড়া চুলে তেল দেয়ায় সেগুলো রোদের আলোয় রেশমের সূতোর মত দু'কান ঢেকে ঝুলে পড়েছে কাধের দু'পাশে । সব কিছু মিলে একটি ভিন্ন মানুষ । শিল্পী সুলতানকে এনে বসানো হল বজরার নিচের তলার ক্যাবিনের সামনে হাতলওয়ালা চেয়ারের ওপর । নিজের ঘর থেকে এ পর্যন্ত আসতেই তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। দুচোখ বন্ধ করে টেনে টেনে দম নিতে থাকলেন চেয়ারে বসে । এরই মধ্যে নদীর তীরে অনেক লোকের ভীড় জমেছে। একটিই ইচ্ছে তাদের দাদুকে ( শিল্পী সুলতানকে ) এক নজর দেখা । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে , শিল্পী সুলতান এ অঞ্চলের একজন কিংবদন্তী। তাঁকে এবং তাঁর গড়া ‘শিশু স্বৰ্গ' বা চিড়িয়াখানা দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসে ভীড় জমায় প্রতিদিন। শিল্পী সুলতানের প্রতি এদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা দেখে অবাক লাগে । আমাদের মধ্যে ২/১ জন তখনও বজরায় এসে পৌঁছায়নি। তাই বজরা ছাড়া যাচ্ছে না । এদিকে শিল্পী সুলতান তাঁর শ্বাসকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছেন দেখে আমি বজরার উপরতলায় এলাম । বজরাটি নির্মাণে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সে অনুপাতে নির্মাণের সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং যথার্থ তত্ত্বাবধানের অভাবে এর সৌন্দর্য এবং সম্পন্নতা দুটোই অনুপস্থিত। বজরাটি লম্বায় আনুমানিক প্রায় ৪০'/৫০' এবং পাশে ১০'/১২' ফুট । ছাদের ওপর ছোট একটা ক্যাবিন জনা কয়েক লোক ঠাসাঠাসি করে বসতে পারবে । এর সামনের দিকে একটি মিনি ক্যাবিন সম্ভবতঃ হাল চালনার জন্য । তবে এখন বজরার পেছন থেকেই এটির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয় । এই খানেই আমাদের চার জন চেপে বসেছি । ক্যাবিনের সামনে ছোট্ট একটা পাটাতন । কতগুলো ফোল্ডিং চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো এই পাটাতনের ওপর পেতে বসেছে অন্যেরা। সবাই নদীভ্রমণ শুরু করার জন্য দলনেতাকে অনুরোধ করছে। ঠিক এমনি এক মুহূর্তে আমাদের বাকী সদস্যরা বজরায় এসে উপস্থিত । ইঞ্জিন অপারেটরকে বলা হল ইঞ্জিন চালু করার জন্য। বজরার নোঙর তোলা হয়েছে। ভাঁটার টানে বজরা কিছুটা ভাসতে শুরু করেছে। এদিকে শিল্পী সুলতানকে এক নজর দেখার জন্য নদীর তীরে যে মানুষগুলো ভীড় জমিয়েছে তাদের মানসিক অবস্থা চিন্তা করে আমি নীচে নেমে এসে শিল্পীকে অনুরোধ করলাম বজরার জানালা দিয়ে ওদের একটু দেখা দিতে । তিনি মুচকি হেসে বললেন ' ওরা সবাই পাগল , কেন যে আমাকে এতো ভালবাসে জানিনে। তাঁকে জানালার ধারে নিয়ে আসতে সাহায্য করছি আর অন্য দিকে বজরার ইঞ্জিন চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা চলছে । বজরার যাত্রীরা যে যার মত ইঞ্জিন অপারেটরকে গালমন্দ করছে । শিল্পী সুলতান জানালার ফাঁকে মাথা বের করে হাত তুলে অভিবাদন জানাতেই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো আনন্দ আর উল্লাসে মাতিয়ে তুললো নদীর ধার। এরই মধ্যে ইঞ্জিন চালু হয়েছে । গিয়ার বদলের সাথে সাথে ইঞ্জিনের শব্দ আর বজরার গতি বৃদ্ধি পেতে থাকলো। নদীর ধারের মানুষগুলোর সেই সোরগোল ধীরে ধীরে আমাদের শ্রবণশক্তির বাইরে যেতে থাকলো। বজরার গতি এখন ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততর। এক সময় চিত্রার একটি বাঁক তাদেরকে আমাদের দৃষ্টির বাইরে নিয়ে গেল। 

শিল্পীকে আবার চেয়ারে বসিয়ে আমি উঠে এলাম বজরার দোতলায়।এ মুহূর্তে বজরা চলেছে তার দ্রুততম গতিতে চিত্রার বুকে এঁকে বেঁকে । প্রতিটি বাঁকেই যেন সে নতুনরূপে ধরা দিচ্ছে আমাদের চোখে বিচিত্র হয়ে। প্রচুর শুশুক ( ডলফিন ) ডাইনে বাঁমে সামনে ক্ষণিক দেখা দিয়ে আবার চোখের আড়াল হচ্ছে । এ দৃশ্য এখন অনেকটা দুর্লভ। চিত্রার দু'ধারে আনুপাতিক হারে লম্বা সারি সারি নারকেল , তাল , খেজুরের গাছ , আর তারই সাথে লাল টকটকে শিমুল। নজর কাড়া সুন্দরের মেলা যেন। নদীর ধারে ঝুঁকে পড়া বাঁশ ঝাড়ের নিচে রমণীদের ধোয়া-মোছা, কৃষকের গো-গোছল, শিমুলের ফাঁকে শিশুদের নদীতে ঝাঁপ । সব মিলিয়ে শিল্পী এস. এম. সুলতানের আঁকা ছবিগুলোর জীবস্তরূপ। শিল্পীর আঁকা ছবি বিশেষ করে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে আয়োজিত তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনীটি যাদের দেখা আছে তারা কেউ এখানে এলে উপলব্ধি করতে পারবেন চিত্রার সাথে শিল্পী সুলতানের প্রেম কত নিগূঢ়, কত নিখাদ। ৭৬ - এর ঐ প্রদর্শনীর জন্য তিনি প্রথমে ঢাকার রামপুরাস্থ ভাড়া করা বাসভবনে এবং পরে ছবিগুলো চূড়ান্তভাবে শেষ করার জন্য শিল্পকলা একাডেমীর প্রধান গ্যালারীতে যখন কাজ করতেন তখন অবাক  নয়নে দেখতাম কেমন  করে ৪'×১০' মাপের চাইনীজ হার্ডবোর্ডের পেছন দিকে উপর থেকে ক্রমাগত নিচের দিকে তুলিতে ছোট ছোট স্ট্রোক দিয়ে ছবিতে রূপান্তরিত করতেন।তিনি এই ছবিগুলো একবারেই ফিনিশ করতেন। চিত্রা নদীর প্রাকৃতিক রূপ আর শিল্পী সুলতানের ছবি আঁকার উৎসের কথা ভাবছিলাম।আমার এই ভাবনায় ভাঙন দিয়ে শহীদুল্লাহ্ এসে বললেন , 'নাসিম ভাই, সুলতান সাহেব আপনাকে নিচে ডাকছেন ' ।

বজরার নিচের তলাকে তিন ভাগ করলে পেছনের এক অংশ জুড়ে পায়খানা, রান্না করার জায়গা এবং ইঞ্জিন । মাঝখানের অংশে এক দিকে ফুট দু'য়েক ছেড়ে একটি ক্যাবিন এবং সামনের এক অংশ খালি । ক্যাবিনের মেঝেতে মোটা গদিপাতা বিছানা, ধবধবে সাদা চাদরে মোড়া, একটি বালিশ এবং তার সাথে বড় মাপের একটি কোল বালিশ । ইঞ্জিনের শব্দ সংগত কারণেই বেশি হলেও বিশ্রামের জন্য ক্যাবিনটি সত্যিই জুতসই। ক্যাবিনের ঠিক সামনে খালি জায়গায় চেয়ারে বসে আছেন শিল্পী সুলতান। চিত্রার নির্মল পরিবেশে তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এক চিলতে আলো বজরার জানালা দিয়ে শরীরের বা অংশে গড়িয়ে পড়েছে ঠিক তার কোলের উপর ।অনেকটা বিখ্যাত শিল্পী রেমব্রান্টের লাইটিং - এর মত । আমি নিচে আসতেই হাসি মুখে বললেন, ‘নাসিম‘ কমন লাগছে নদী ভ্রমণ - কেমন লাল রঙের শিমুল ফুটে আছে চারি দিকে । কি সুন্দর দৃশ্য। রঙ তুলি তো সঙ্গে আছে নাকি? এঁকে ফেলুন দু ' একটা । আপনার তো ভাল দখল আছে জলরঙে' । আমি বললাম রঙ আনিনি তবে কালি আছে সাথে । আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ' আরে ওতেই চলবে। কালো রঙের ওপর আর কোনো রঙ হয় নাকি । এক রঙে ছবি আঁকতে বাহাদুরী বেশী। গত কাল যে ছবিগুলো কালি দিয়ে আঁকলেন তেমন করেই আঁকুন । বেশ মজা হবে । " এই আহ্বানে আমি তার আন্তরিকতাকে অনুভব করলাম। ভেতরে ভেতরে নিজের ওপর আমি আরো বিশ্বাসী হয়ে উঠলাম ।

কাগজ, কালি আর তুলি নিয়ে বসে পড়লাম তাঁরই পায়ের কাছে মেঝেতে। আমি এঁকে চলেছি শিল্পী সুলতান এরই ফাঁকে বললেন আমাদের যাত্রা শুরু করতে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল তাই ওদেরকে (বজরার মাঝিদের) বলেছি হাজী হাটা না গিয়ে যেন যাদবপুর যায়। আমি তাঁর কথায় যোগ না দিয়ে শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এর মধ্যে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় পার হয়েছে। বজরার ইঞ্জিন থামানোর সংকেত বেজে উঠলে শিল্পী সুলতান বলে উঠলেন' না এত তাড়াতাড়ি তো যাদবপুর পৌঁছানোর কথা নয় । এই কি হল রে !' এমন সময় বজরার ছাদের ওপর থেকে হট্টগোল শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখি আমাদের গৌতম পাল বজরার ছাদ থেকে নদীতে পড়ে গেছে। প্রাণপণ সাঁতার কেটে তীরে আসছে। বজরা পারে ভিড়িয়ে গৌতমকে তুলে আবার শুরু হল যাত্রা। আমি নিচে এসে শিল্পীকে সব বলতে বলতে আমার অসমাপ্ত ছবি শেষ করার জন্য বসে পড়লাম । সব শুনে তিনি বলেন ' দেখ দেখি কি কাণ্ড , ওর কোনো ক্ষতি হয় নি তো! ' আমি ' না ' বলে কাজে মনোনিবেশ করলাম।

আমার ছবিগুলো ছিল মূলতঃ চিত্রা নদী আর তার দু 'পারের নিসর্গ। ছবিগুলো ভালমত শুকোবার জন্য তারই চেয়ারের সামনে বিছিয়ে রাখছিলাম । তিনি কখনও বাহ ! কখনও চমৎকার। ' দেখ দিখি আমার চিত্রা কত সুন্দর হয়ে ধরা দিচ্ছে এই সাদা কালোতে এই সব বলে আমাকে উৎসাহিত করছিলেন। এক ফাঁকে শিল্পী সুলতানকে বললাম আপনি তো ফিগার ছাড়া কোনো ছবি আঁকেন না । আমার ছবিতে কোনো ফিগারই নেই । জবাবে তিনি বললেন 'ভাল ছবি দিয়ে কথা, তা ফিগার দিয়েই হোক আর ফিগার ছাড়াই হোক। প্রকৃতি নিজেই কথা বলে, এর গাছ-পালা,আলোছায়া পরিবেশ সবই। নির্জন প্রকৃতির রূপই আলাদা। কত গভীর।' এর মধ্যে অনেকটা সময় কেটে গেছে, আবার বজরা থামানোর সংকেত বেজে উঠলে শিল্পী সুলতান বললেন 'ভাই আমরা বোধহয় যাদবপুর এসে গেছি। গুছিয়ে নেন সবকিছু।আমি তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি নদীর ধার দিয়ে দলে দলে নানা বয়সের মানুষ দৌড়ে আসছে বজরার পিছু পিছু। ছাদের ওপর থেকে একজন বললো এরা নাকি দৌড়ে আসে অনেক দূর থেকে। একটু সামনে তাকাতেই দেখি যে ঘাটে বজরাটি ভিড়বে সেখানে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর লোকজন ।

এদের পোষাক - আশাক দেখে বুঝতে ভুল হয় না যে এটি হিন্দু প্রধান এলাকা এবং দরিদ্রতা এদের নিত্যদিনের সঙ্গী । বজরা পার ছুঁতেই জনাকয়েক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ এসে আমাকে এক পাশে রেখে অনেকটা কোলে তুলে নামিয়ে নিয়ে গেলেন শিল্পীকে বজরা থেকে। এদের মধ্যে একজন আগেই বজরায় যে চেয়ারটিতে তিনি বসেছিলেন সেটি নিয়ে গেছেন। সবার শেষে আমি নামলাম বজরা থেকে একটু এগিয়ে যেতেই আমার চোখে যে দৃশ্য ধরা পড়লো সেটি এক স্বপ্ন যেন ।

মাঝারি ধরনের একটি উঠোন । উত্তর সীমানায় একটি চৌচালা টিনের ঘর । একটা হাল্কা লালরঙের বাগানবিলাস বেয়ে উঠেছে তার ওপর। পূর্বদিকে ছোট মাপের একটি রান্না ঘর । খোলা আকাশের নিচে বসে রান্নার জন্য বড় মাপের দুটো চুলো, গ্রাম অঞ্চলে এটা একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।পশ্চিম ভিটায় একটি বেড়ার ঘর । এ ঘরের দক্ষিণ - পশ্চিম কোণে ছোট একটি গোয়াল । গোয়াল ঘরের বাইরে তিনটে গাভী বাধা। এ দিকেই কয়েকটি নারকেল গাছ।বাড়ির দক্ষিণে চিত্রা নদী । নদীর ধাঁর ঘেঁষে বেশ কয়েকটি  খেজুর গাছ। আগেই বলেছি চিত্রা শান্ত প্রকৃতির । তাই খেজুর আর নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে চিত্রাকে অনেকটা বড় দীঘির মত লাগছিল। চিত্রাকে পেছনে রেখে উত্তরমুখী হয়ে চেয়ারে ছড়ি হাতে আভিজাত্যের ছাপ নিয়ে বসে আছেন শিল্পী এস. এম. সুলতান। এখানে প্রায় সকলেই তাকে ঋষিকাকু বলে ডাকেন। তার দু' পাশে বেঞ্চ পেতে আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের পেছনে অর্ধগোলাকৃতি হয়ে ঘিরে দাড়িয়েছে অপেক্ষাকৃত তরুণের দল। উত্তরে বসেছেন সব প্রবীণ এবং মেয়ের দল। সবাই প্রাণ ভরে দেখছেন তাঁদের ভক্তির মানুষটিকে । এক পর্যায়ে শুরু হল প্রণামের পালা। বয়োজ্যেষ্ঠরাই আগে এলেন। হাঁটু গেড়ে মাথা মাটিতে ঠেকিয়ে এ শ্রদ্ধাঞ্জলি একেবারেই নির্মল, অকৃত্রিম। ছেলেদের পর মেয়েদের পালা । মাথায় পুরো ঘোমটা টেনে গলায় আঁচল জড়িয়ে সে প্রণাম এসব দেখে খুব সহজেই বোঝা যায় এই প্রাণঢালা শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়া - নেয়ায় উভয় পক্ষই অভ্যস্ত। একে অপরের খোজ খবর জেনে নিচ্ছেন এরই ফাঁকে ফাঁকে । এমন ভক্তদের মধ্যে এসে শিল্পী সুলতান গুরু শিষ্যের পরিবেশটিই তৈরি করলেন যেন। এখানে তাকে অনেক বেশি ধীর স্থির মনে হচ্ছিলো। এরই ফাঁকে বাড়ির মেয়েরা আমাদের সামনে গুড় মুড়ি হাজির করেছে। প্রবীণদের মধ্যে একজন আমাদের জন্য ডাব পেড়ে দেয়ার জন্য বলেছেন। এখানে ডাব পাড়ার কৌশলটি বেশ আকর্ষণীয়, অন্তত আমার কাছে। গাছ থেকে একটি ডাব নিচে ফেলা হয় । গাছের নিচে একজন চটের বড় খালি বস্তার অপেক্ষাকৃত ছোট দৈর্ঘ্যের দুই কোনো হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরেন। ফেলে দেয়া ড্যবটির মাটিতে আঘাত খাওয়ার আগ মুহূর্তে তার গতি এবং অবস্থান আন্দাজ করে উচিয়ে মেলে ধরেন । ডাবটি বস্তায় আছড়ে পড়ার সাথে সাথেই এর গতিবেগ ব্যাহত হয় এবং অতি অল্প গতি নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফলে ডাবটি ফেটে যায় না। আমাদের ক'জনের সঙ্গেই ক্যামেরা ছিল, উপরন্তু শিল্পকলা একাডেমীর ভিডিও ক্যামেরাও ছিল আমাদের সাথে। শিল্পী মাহবুব আকন্দ ওটা অপারেট করার দায়িত্বে ছিলেন। এই ডাবের পানি পান করতে করতে অনুভব করলাম আমরা সকলেই শিল্পী সুলতানকে ঘিরে এই স্বপ্ন রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম।আমরা কেউ আমাদের ক্যামেরা ব্যবহার করিনি এই স্বপ্নগুলোকে ধরে রাখার জন্যে ।

বজরা ভ্রমণে রওনা হওয়ার সময় দুপুরের খাওয়া বজরায় রান্নার জন্য সব কিছুই সাথে আনা হয়েছিল, বাবুর্চিও ছিল সাথে । বজরায় চুলোতে তেমন সুবিধে হয়নি তাই এই বাড়ির উঠোনে খোলা চুলোয় আমাদের রান্নার বাকি কাজটা করার ব্যবস্থা নেয়া হল ।

আমাদের সকলের উদ্দেশে শিল্পী সুলতান বললেন ' আপনারা গ্রামের নির্মল অক্সিজেন গ্রহণ করুন ঘুরে ঘুরে।' স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা গেল ষাটের পুরো দশক শিল্পী এই এলাকায় কাটিয়ে ছিলেন। আমরা যে বাড়ির আঙিনায় বসেছিলাম সে বাড়িতেই ছিলেন প্রাঁয় পাচ বছর। বাকী সময় গ্রামের অন্যান্য বাড়িতে। আমরা যে যার মত ছড়িয়ে পড়লাম গ্রামের এদিক ওদিক । একটু উত্তরে এগুতেই হাজির হলাম গাঁয়ের একটি প্রধান সড়কে। যেটি পূর্ব- পশ্চিমে চলে গেছে এঁকে বেঁকে। আর একটু এগিয়ে উত্তরে চোখ পড়তেই দেখি শিল্পী সুলতানের আঁকা সুবৃহৎ ক্যানভাস। সেই কুঁড়ে ঘর, ক্ষেতের আইলে খেজুর আর তাল গাছ , বিস্তীর্ণ প্রান্তর। নেই শুধু সবল গরু আর পেশাধারী সেই কৃষক কুল।একটি বিস্তীর্ণ আবাদী জমি।চারদিক থেকে ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নেই। শুধু ধু-ধু প্রান্তর।তারই মাঝখানে ছোট একটা বিলের ধারে কয়েকটি তালগাছ দেখিয়ে স্থানীয় একজন প্রবীণ বললেন ঋষিকাকু ঐ তাল গাছগুলোর নিচে গভীর রাতে বাঁশি বাজাতেন। তাঁর বাঁশি শুনে মাঝরাতে ঘুম ভাঙেনি এমন লোক এ এলাকাতে মেলা ভার। আর দিনের বেলায় লালরঙের শাড়ি পড়ে দু ' পায়ে ঘুঙুর হাতে ত্রিশূল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন একগ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। আমরা ঋষিকাকুর সাথে হেঁটে পারতাম না । দৌড়াতে হত । এমনি আরো অনেক বৈচিত্র্যময় ঘটনা বলতে বলতে প্রবীণ লোকটি আমাকে আবার বাড়ীতে ফিরিয়ে আনলেন । 

বেলা পড়ে এসেছে, এবার বিদায়ের পালা। আবার প্রণাম শেষে সকলে মিলে তাদের ঋষিকে তুলে দিয়ে আসলেন বজরায়।এক সময় বজরার ইঞ্জিন গর্জে উঠে যাদবপুরের মাটি ছাড়লো। আমাদের বজরা এগিয়ে চলেছে কুড়িগ্রামের দিকে। যাদবপুরের মানুষগুলো তাঁদের ঋষিকে যেন ছাড়তে চাইছে না । তাই অনেকটা পথ নদীর ধার ভেঙে আসলেন বজরার সাথে সাথে। পড়ন্ত বেলা আর চিত্রার বাঁক কখন তাদের আড়াল করেছে খেয়াল নেই ।

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে । আমরা আমাদের দুপুরের খাওয়া খেতে বসলাম বজরার ছাদে । আমার ছবি আঁকার কালির দোয়াত রেখেছিলাম বজরার জানালার চৌকাঠে। কখন সেটি সবার অজান্তে পড়ে গিয়েছিল সেই জানালার নিচে রাখা রান্না করা ডালের ভেতর । ফলে ঐ ডাল ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় থাকলো না । শুধু তরকারীই থাকল সবার জন্য । শিল্পী সুলতান আগেই বলেছিলেন তিনি বাসায় ফিরে একবারেই রাতের খাবার খাবেন। আমি খাওয়া শেষে নিচে এলাম । শিল্পী সুলতান আমাকে দেখে বললেন ' আর শরীরে কুলোচ্ছেনা, এবার একটু গড়িয়ে নেই'। আমি সাহায্য করলাম চেয়ার থেকে বিছানায় যেতে। বজরার গদিপাতা বিছানায় বসে তিনি গা থেকে পাঞ্জাবীটা খুলে ভাল মত শাল জড়িয়ে নিয়ে শুতে শুতে বললেন ‘ কেমন লাগলো যাদবপুর ? " আমি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম এত দিন পর এখানে এসে আপনার কেমন লাগলো ? একটু গম্ভীর গলায় একটা শ্বাস টেনে বললেন ' যা যায় তা কি আর ফেরে কখনও । সেই সময়ও নেই বয়সও নেই যে ওদের একটু সুর শুনাবো । ঐ বাঁশি বাজানো আর শাড়ি জড়িয়ে নূপুর পায়ে পাগল সেজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো, এ সবই করেছি জেনেশুনেই। কারণ আমি জানতাম ওরা আমাকে এসব কারণেই ভালবাসে ওদের অন্তর থেকে । যা কিছু করেছি তা শুধু ওদের ঐ আন্তরিক ভালবাসার জন্যই।' এর মাঝে নানান কথায় চিত্রার প্রসঙ্গ উঠতেই শিল্পী যেন কিছুটা আবেগময় হয়ে গেলেন ।

জড়ানো গলায় আপন মনে বলে চললেনঃ যৌবনে কল্পনার নানান আকর্ষণে আবেগে আপ্লুত হয়ে ঘুরে বেড়ালাম সারা ভারত বর্ষ। এতেও মন শান্ত হলনা, তাই পাড়ি জমালাম সাত সমুদ্র আর তের নদীর পাড়ে। সেখানেই ঘুরে বেড়ালাম আপন খেয়ালে। তারপর একদিন অনেকটা আচমকা মনের পর্দায় ভেসে উঠলো চিত্রাসুন্দরীর রূপপ্রকৃতি । রন্ধ্রে রন্ধে অনুভব করলাম তার প্রাণ উজাড় করা প্রেম আর ভালবাসাকে। আমি দিব্য চোখে দেখলাম চিত্রা আমায় হাতছানি দিয়ে বলছে তোমার আসন তো আমার অন্তরের মাঝখানে। কি লাভ ঐ মরীচিকার পেছনে ঘুরে। আমাদের বিরহকে দীর্ঘ করে! আমার মন উতলা হল আমি ফিরে এলাম ওঁর কাঁছে, না ঘরবাঁধা হল না আমাদের। সময় সবকিছু উল্টা করে দিয়েছে। চিত্রা হল চিরবহমান আর আমাকে করলো বহেমিয়ান। সংসারই হল না যাদের তাদের আবার সন্তান ! তাই তো জীবন সায়াহ্নে চিত্রার পাড়ে গড়ছি 'শিশু স্বর্গ' । কিছুটা থেমে আবার বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন আমার জীবদ্দশায় না হোক চিত্রার প্রাণপ্রদীপ নিভে যাবার আগে এই 'শিশু স্বর্গ' নিজ পায়ে দাড়াতে পারে সেই চেষ্টাই যেন করে সকলে মিলে।

ততক্ষণে বজরা ভিড়তে যাচ্ছে   'শিশু স্বর্গের' ঘাটে। সকলের হট্টগোলে লালমিয়ার শেষ কথাগুলো আর শোনা গেল না ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles