অভিনব উদ্ভাসন

শেখ মুহম্মদ (এস . এম) সুলতানের আঁকা গুরুভার নিতম্ববিশিষ্ট পীনস্তনী এসকল চমৎকার স্বাস্থ্যবতী কর্মিষ্ঠা লীলাচঞ্চলা নারী, স্পর্ধিত অথচ নমনীয় সর্বক্ষণ সৃজনশীলতায় মত্ত অহল্যা পৃথিবীর প্রাণ জাগানিয়া এসকল সুঠামকান্তি কিষাণ, এসকল সুন্দর সূর্যোদয়, সুন্দর সূর্যাস্ত, রাজহাঁসের পাখনার মতো নরম তুলতুলে এসকল শুভ্র শান্ত ভোর, হিঙুল বরণ মেঘ-মেঘালীর অজস্র সম্ভার, প্রসারিত উদার আকাশ, অবারিত মাঠ গগন ললাট, তালতমাল বৃক্ষরাজির সারি, দীঘল বাঁকের নদীতীরের এসকল দৃষ্টিশোভন চর, মাঠের পর মাঠে থরে থরে ঢেউ খেলানো সোনার ধান, কলাপাতার ফাঁকে ফাঁকে জোনাকজ্বলা এমন মোহিনী অন্ধকার, আঁকাবাঁকা মেঠোপথের বাঁকে বাঁশ-কাঠে গড়া কিষাণের এসকল সরল আটচালা, এসকল আহলাদী বাছুর এবং পরিণত বয়ষ্ক গবাদিপশু, সর্বোপরি গোটা জনপদের জনজীবনের প্রসারিত উৎপাদন শৃঙ্খলে আবদ্ধ সভ্যতার অভিযাত্রী অজেয় মানুষ; তারা যেন দৈনন্দিন জীবনধারণের স্রোতে কেলিকলারসে যুগ থেকে যুগান্তর পেরিয়ে অনন্তের পথে ভেসে যাচ্ছে, ক্যানভাসে তাদের প্রত্যয়দীপ্ত বলিষ্ঠ উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ ঋজু গতিভঙ্গিমা এমনভাবে বাঁধা পড়েছে, মনে হবে সমস্ত নিসর্গ দৃশ্য ছাপিয়ে মেঘেতে ঠেকেছে তাদের মস্তক এবং পাতালে প্রবিষ্ট হয়েছে মূল, তাদের শ্রম-ঘামের ঝঙ্কার, চেষ্টার সঙ্গীত সমস্ত প্রাকৃতিক কোলাহল ভেদ করে আকাশ গঙ্গার কিনারে কিনারে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনিতে একসঙ্গে ফেটে পড়ছে।

শহরের চৌমোহনার ইট-সিমেন্টের পুরো কঠিন আবরণ ফাটিয়ে একটা আস্ত ঝর্ণা যদি বন্য আদিম ভঙ্গিমায় জেগে ওঠে রঙিন জলধারা হঠাৎ করে ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করতে থাকতো, পৃথিবীর অন্তরের এই নৃত্যপরায়ণ রসধারার প্রতি মানুষ যেমনি বিস্ময়াবিষ্ট নয়নে দৃষ্টিপাত করতো, তেমনি চোখে মানুষ সুলতানের আঁকা এসকল ছবি দেখেছে । এই ছবিগুলো অত্যন্ত আকস্মিকভাবে বাঙালার অস্পষ্ট,ঝাপসা,কুয়াশাচ্ছন্ন,অবগুণ্ঠিত অতীত ফুঁড়ে প্রবল প্রাণশক্তির তোড়ে ওপরের সমস্ত নির্মোক বিদীর্ণ করে শিল্পীর পারঙ্গম তুলির মাধ্যমে আমাদের যুগ এবং আমাদের কালের ঘাটে এসে আছড়ে পড়েছে। তারপর কোনোরকম ভনিতা না করেই বাংলাদেশের চিত্র - দর্শকদের উদ্দেশে অমোঘ নির্দেশবাণী উচ্চারণ করেছেঃ আমাদের দেখো । বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে এবং মজেছে । রঙের পরশ দৃষ্টিপট ভেদ করে মনের পটে অক্ষয় হয়ে স্থির ইদ্রধনুর মতো ফুটে গেছে। গ্রাম বাংলার এই চলমান ইতিহাস প্রবাহের সঙ্গে দর্শকদের তন্ময় সংযোগ স্থাপিত হয়েছে।তারা নিজেদের অস্তিত্বকেও এসকল কান্তিমান , আয়ুষ্মান চিত্রের অংশ হিসেবে মনে করতে বাধ্য হয়েছে ।

 সকলে চিত্রকলার মর্ম বোঝে না, সূক্ষ্মতর বোধ এবং উপলব্ধি অনেকের না থাকুতে পারে , কিন্তু ইতিহাসকে তো কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বিশেষত সেই ইতিহাস গাজন উৎসবের নটরাজের মতো অট্টরোলে যখন নেচে ওঠে।সুলতান বছর কয়েক আগে শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত তাঁর সর্বশেষ প্রদর্শনীটিতে বাংলার আবহমানকালের ইতিহাসটিকে নাচিয়ে দিয়েছেন । যারাই এ চিত্রগুলো দেখেছেন , তাদের উপলব্ধিতে একটি কথা ভ্রমরের মতো গুঞ্জরন করেছে । আমাদের সভ্যতার প্রাণ কৃষি আর কিষাণ হলো সভ্যতার নাটমঞ্চের একক কুশীলব । যখন মানুষের কানে মহাকাশ আর মহাপৃথিবীর শ্যামের বেণু অপূর্ব সুরলহরী বিস্তার করে দিয়ে যাচ্ছে, তখনও এই প্রাচীন ভূখণ্ডটিতে আদলে এবং অবয়বে মানুষ সেই সনাতন মানুষই রয়ে গেছে । তাই সুলতানের আঁকা এই মানুষেরা বাংলাদেশের হয়েও সমস্ত পৃথিবীর মানুষ । যেখানেই সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে সেখানেই আদিপিতা হলধর আদমের চেহারায় তারা উপস্থিত ছিলো । তারা মিশরে ছিলো , চিনে ছিলো , ভারতে , ব্যাবিলনে , গ্রীসে, রোমে সবখানে বন কেটে বসত গড়ার দিনে , মাটির মর্মমধু টেনে তোলার বেলায় , বনের অগ্নিকুণ্ড পরিত্যাগ করে ঘরের দাওয়ায় সাক্ষ্য - প্রদীপ জ্বালাবার নম্র - মধুর ক্ষণে তারা হাজির ছিলো। যেখানেই মাটি শ্রমশীল কর্মিষ্ঠ মানুষের শ্রমে - যত্নে প্রসন্ন হয়ে ফুল - ফসলের বর দিয়েছে, উপহার দিয়েছে শান্ত স্নিগ্ধ গৃহকোণ সেখানেই ইতিহাস গতিচঞ্চল পথ পরিক্রমার সূচনা করেছে । মাটি এবং মানুষের এই দ্বৈত সম্পর্ক , বিশদ করে বলতে গেলে , নিসর্গ এবং মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সুলতানের আঁকা চিত্রমালায় এমন আকার পেয়েছে , এমন বরণ ধরেছে যে একান্ত নির্জীব এবং পাষণ্ড না হলে তার আবেদন অস্বীকার করা প্রায় একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় ।

বাংলার বদলে সুলতান যদি আরব দেশে জন্ম নিতেন, মরুচারী বেদুইনদের ছবি আঁকতেন। যদি জন্মাতেন নরওয়ে, সুইডেনে তাহলে সমুদ্রচারী জেলেদের সভ্যতার পথিকৃৎ হিসেবে আঁকতেন । নেহায়েত বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন বলেই এই কৃষকদের সভ্যতার জনপ্রিয়তা ধরে নিয়ে ছবি এঁকেছেন । সুন্দর প্রকৃতিতে নয়-- মানুষের মনই সৌন্দর্যের নিবাসভূমি।চারদিকে দৃষ্টিরেখা যতদূর ধাবিত হয় এবং সামনে পেছনে চিন্তা - কল্পনা অনেক দূর বিহার করার পর যে অনড় বিন্দুটিতে এসে স্থির হয়, সংহত হয়,সেইখানে,কেবল সেইখানেই সৌন্দর্যের নিভৃত নিকুঞ্জ।সেজন্য একজন আরবের চোখে লু হাওয়া তাড়িত ধু ধু মরুভূমি সুন্দর, একজন এস্কিমোর চোখে তুষার - আচ্ছাদিত ধবল তুদ্রা সুন্দর।

সুলতানকে বাংলার প্রকৃতিতে, বাংলার ইতিহাসে এবং বাংলার মানুষের শ্রম , ঘাম , সংঘাতের ভেতরে সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে দুস্তর পথ , পেরিয়ে আসতে হয়েছে সাধনা এবং নিরীক্ষার অনেকগুলো পর্যায়।তাঁর ব্যক্তি-জীবন এবং শিল্পী - জীবনের সমান্তরাল যে অগ্রগতি তা কম বিস্ময়কর নয় । পরে সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাবে। আপন অন্তরস্থিত সৌন্দর্যবোধ, নিসর্গ, ইতিহাস এবং জীবন্ত শ্রমশীল মানুষের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে ক্যানভাসে সবকিছু মূর্ত করে তোলা এর সবটুকু তাঁর একক শৈল্পিক-প্রয়াসের ফলশ্রুতি নয়। তার জন্য এই সুপ্রাচীন দেশটিকে সাম্প্রতিককালে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ঘোষণা করতে হয়েছে। একটি উদ্ভিদ-সমতুল ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে,প্রতিটি সামাজিক স্তরের মানব সাধারণের ভেতর বন্দুকের আওয়াজে, কামানের হুঙ্কারে যে জাগরণ এসেছে, যা তাদের সম্মিলিত সৃষ্টিশক্তির তেজ উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছে, তার প্রয়োজন অপরিহার্য ছিলো।ইনকিউবেটর যন্ত্রের তাপে ডিমের খোলস ফেটে যেমন করে মুরগীর বাচ্চা প্রাণ পেয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের উত্তাপে শিল্পীর অন্তর চিরে এসকল ছবি বেরিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু আবেগ,সবটুকু জীবনোল্লাস,সবটুকু স্পর্ধা এবং দুঃসাহস এই ছবিগুলো ধরে রেখেছে।এরকম একটি প্রলয়ঙ্করী ঘটনা না ঘটলে সুলতানের তুলি কস্মিনকালেও এরকম আশ্চর্য ছবি প্রসব করতে সক্ষম হতো না, যতো প্রতিভাই তাঁর থাকুক,কিষাণ জীবনের প্রতি তাঁর অনুরাগ - মমতা যতোই নিবিড় গভীর হোক না কেন।বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক সংগ্রামের একেবারে অন্তঃস্থল থেকেই এসকল চিত্রের উদ্ভভ।এ কারণে এ ছবিগুলো দর্শকের মনেও প্রত্যক্ষভাবে ইতিহাসবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। হয়তো দর্শক সচেতনভাবে অনুভব করতে পারেন না, কিন্তু অন্তরালে  এই বোধ ক্রিয়াশীল থাকে ঠিকই। ইতিহাসের এই জাগ্রত দেবতার প্রতি অজানিত শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে দলে দলে মানুষ এ সকল ছবি দর্শন করতে এসেছে।যুদ্ধে পরাজিত, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ ভেনিসের মরমে মরে যাওয়া জনসাধারণও আজ থেকে বহুকাল আগে একদা তরুণ শিল্পী মিকেলেঞ্জেলোর অপূর্ব মূর্তি ডেভিডের দিকে ভেনিসের অপরাজেয় ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক হিসেবে মমতা - মেদুর নয়নে দৃষ্টিপাত করেছিলো।আমাদের দেশের চিত্রশিল্পী এবং চিত্রসমালোচক এ দু'জাতের দৃষ্টিসীমার অনেক দূরে এই পরিপ্রেক্ষিতের অবস্থিতির দরুন তাঁরা এ অমর চিত্রসমূহের প্রতি শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে প্রণতি জানাতে পারেননি । 

সে যাই হোক, শেখ মুহম্মদ সুলতানের চিত্রকর্ম আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই তাঁর জীবন আলোচনা করতে হবে।অবনীন্দ্রনাথ থেকে জয়নুল আবেদিন পর্যন্ত সমস্ত শিল্পীর যে জীবন বৃত্তান্ত আমরা জানি তার সঙ্গে শেখ সুলতানের জীবন-বৃত্তের সামান্যতম মিল কোথাও নেই।অন্য সকল শিল্পীর জীবন এবং তাঁদের কৃত শিল্পকর্ম একটা ছকে ফেলে বিচার করা যায় । শেখ সুলতানের জীবনকে যেমন তেমনই তাঁর ছবিকেও বিচার করতে হবে অনেকগুলো ছকে ফেলে এবং তাঁর সবগুলো আমাদের মানস - দৃষ্টির সামনে উপস্থিতও নেই। সুলতানের জীবন বলতে বড়জোর যা বলতে পারি তা হলো লাল মিয়া নামে একটি শিশু যশোর জেলার একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে আজ থেকে পঞ্চান্ন কি ষাট বছর আগে জন্ম নিয়েছিলো । সেই শিশুটিই এখন শেখ সুলতান নাম ধারণ করে যশোরের সেই কৃষক সমাজে ঝাঁকড়া কেশ দুলিয়ে নমঃশুদ্র নর - নারীর আদরের গোসাঁই সেজে অর্ধেক ছন্নছাড়া-লক্ষ্মীছাড়া, অর্ধেক সন্তের বেশে সাপ - শেয়াল-ইঁদুর-বেড়াল নিয়ে রঙের সংসার পেতে বসে আছেন।

আজকের দিনে সুলতান বলতে যশোরের যে ঝাঁকড়া কেশের আউলা -ঝাউলা মানুষটিকে বোঝায়, যিনি প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে বেশ কিছুদিন আগে পা রেখেছেন ; পুত্র - কন্যা - স্ত্রী -সংসারহীন একেবারে একাকী একজন-প্রাকৃতিক মানুষ; তিনি যখন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন , উনিশশ' ছিয়াত্তর সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীর প্রদর্শনী উপলক্ষে আঁকা এসকল চিত্র-সন্তান ছাড়া তাঁর নামের অমরতা ঘোষণা করার আর কেউ থাকবে না।

কস্তুরী হরিণের মতো আপনার গন্ধের পেছনে আপনি কক্ষচ্যুত ধূমকেতুর বেগে প্রাণ-প্রবাহের তাপে, ‘হেথা নয় হেথা নয়' নিরন্তর তিরিশটি বছরের ছুটে চলা জীবনের সমস্ত বেগ, সমস্ত আবেগ যশোরের ভাঙা মন্দিরের দ্বারে দ্বারে, জীর্ণ অট্টালিকার খিলানে- অলিন্দে, তরুলতার সংসারে পশু- পাখির সমাজে অসহায় শিশুর মতো গৃহ সন্ধান করে চলেছে । জীবন যাকে হেঁকচা টানে গৃহ - সমাজ - সংসারের বন্ধন খসিয়ে শিল্পতীর্থের যাত্রী করেছে, শিল্পের মানস-সায়রের উপকূলেই তো তাঁকে গৃহ সন্ধান করে নিতে হয়।এই গৃহের সন্ধান তিনি একবার পেয়ে গিয়েছিলেন।তখন ঊনিশশ' একাত্তুর সাল। হাজার বছরের পরাধীন বাংলা প্রাণ- পাতালের অভ্যন্তরে অপরাজেয় সত্তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করে, দর্পিত শক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে, ভেতর থেকে শিউরে আগুন বরণ ফণা মেলে জেগে উঠেছিলো।বাংলার ইতিহাসের সেই অভাবিত, সেই অচিন্তিত-পূর্ব জাগরণের অরুণ আভায় তার একখানি আশ্রয় নিকুঞ্জের ছায়া দর্শন করেছিলেন শেখ সুলতান, কামান- বন্দুকের হুংকারের মধ্যে গৃহের কল- কাকলী কান পেতে শুনেছিলেন। ইতিহাসের এই থরোথরো কম্পিত জাগরণের মধ্যে তিনি ধ্যান দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন সমাজের ওপরতলার শ্রেণীগুলো, বিভিন্ন ঐতিহাসিক সময়ে যারা ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তা দিতে দিতে উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কহীন পরগাছার মতো ফাঁপানো ফোলানো জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, এই সামাজিক ভূমিকম্পে তাদের অস্তিত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সময়ের প্রখর তাপে তারা মোমের পুতুলের মতো গলে একাকার হয়ে যাচ্ছে । এই কম্পনের বেগ ধারণ করা তাদের সাধ্যের বাইরেএই জাগরণের আগ্নেয় সংবাদ বহন করতে গিয়ে তারা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে ।পাশাপাশি আরেকটি শ্রেণীকে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, প্রকৃতি এবং ইতিহাসের গভীরতম অঙ্গীকার যারা নিরবধিকাল ধরে বহন করে চলেছে, নতুন ফুটন্ত ইতিহাসের আবেগ-উত্তাপ সবটুকু পান করে ফুটে উঠবার বীর্য এবং বিকাশমান সৃষ্টিশীলতা যাদের আছে।সেই শ্রমজীবী কিষাণ জনগণকে তিনি বাংলার ইতিহাসের নবীন কুশীলব হিসেবে দেখতে পেরেছিলেন। এ দেখা সমাজ-বিজ্ঞানীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সামাজিক সম্পর্কের জটা জাল বিচার নয়, অর্থশাস্ত্রীর চুলচেরা শ্রেণী- বিশ্লেষণ নয় ।এ দেখা শিল্পীর দেখা: বিন্দুতে সিন্ধু ঝিলমিলিয়ে ওঠে, ক্ষুদ্র তিল পরিমাণ বীজকণার অন্তরে সম্ভাবনার স্বপ্ন নিয়ে শায়িত থাকে বিশাল মহীরূহ। তাই সুলতানের কৃষক জয়নুল আবেদিনের কৃষক নয়। জয়নুল আবেদিনের কৃষকেরা জীবনের সংগ্রাম করে।সুলতানের কৃষকেরা জীবনের সাধনায় নিমগ্ন। তারা মাটিকে চাষ করে ফসল ফলায় না । পেশীর শক্তি দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সংগম করে প্রকৃতিকে ফুলে-ফসলে সুন্দরী সন্তানবতী হতে বাধ্য করে।

এইখানে জীবনের সংগ্রাম এবং সাধনা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন, আজ এবং আগামীকাল একটি বিন্দুতে এসে মিশে গিয়েছে । সুলতানের কৃষকেরা নেহায়েত মাটির করুণা কাঙাল নয় । রামচন্দ্র যেমন অহল্যা পাষাণীকে স্পর্শ করে মানবী রূপ দান করেছিলেন , তেমনি তাঁর মেহনতি মানুষদের পরশ লাগা মাত্রই ভেতর থেকে মাটির প্রাণ সুন্দর মধুর স্বপ্নে ভাপিয়ে উঠতে থাকে । এ মানুষগুলো পাখা থাকলে দেবদূতের মতো আকাশের অভিমুখে উড়াল দিতে পারতো । কিন্তু একটি বিশেষ ব্রতে , একটি বিশেষ অঙ্গীকারে আবদ্ধ বলেই তারা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে । সে অঙ্গীকারটি সে ব্রতটি মাটিকে গর্ভবর্তী ও ফসলশালিনী করা। মাথার ওপরে স্বর্গলোকের যা কিছু প্রতিশ্রুতি, যা কিছু প্রেরণা তার সবটুকু আকাশের নীল থেকে, রামধনুর বর্ণের সুষমা থেকে ছেঁকে এনে মাটির ভেতরে চারিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই মানুষ - মানুষীর দল । ম্যাক্সিম গোর্কীর সেই বাক্যটি 'কি দর্পিত, কি ব্যঞ্জনাময় এই মানুষ শব্দটি' -উচ্চারণ মাত্রই নিসর্গের অন্তরে কি ব্যাকুল সাড়া এবং কানাকানি পড়ে যায় । সুলতানের আঁকা এই কৃষকদের যিনি দেখেছেন , অবশ্যই একমত হবেন , ম্যাক্সিম গোর্কীর মানুষ সম্পর্কিত মন্তব্য কতো সার্থক এবং যথার্থ হয়েছে ।

শেখ সুলতানের মধ্যে দ্য ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল প্রমুখ শিল্পীর প্রকাণ্ড কল্পনা এবং কল্পনার বলিষ্ঠতার ছাপ এতো গভীর এবং অনপনেয় যে মনে হবে এ চিত্রসমূহ, কোনো রকমের মধ্যবর্তিতার বালাই ছাড়া, সরাসরি রেনেসাঁস যুগের চেতনার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে এই ঊনিশশ' ছিয়াত্তর সালে বাংলাদেশের কৃষক সমাজে এসে নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেছে। এই ছবিগুলো আঁকার মতো মানসিক স্থিতাবস্থা অর্জন করার জন্য শেখ সুলতানকে সব দিতে হয়েছে।পরিবারের মায়া, বংশধারার মধ্যদিয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রবাহিত করার স্বাভাবিক জৈবিক আকাঙ্ক্ষা ভেতর থেকে ছেঁটে দিয়ে, এই চিত্রসন্তান জন্ম দেয়ার একাগ্র প্রায় কাপালিক সাধনায় নিযুক্ত থাকতে হয়েছে সারাজীবন। শেষপর্যন্ত অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। বাংলার শিল্পীর হাত দিয়ে বাংলার প্রকৃতি এবং বাংলার ইতিহাসের একেবারে ভেতর থেকে রেনেসাঁস যুগের ফুল ফুটেছে। সুলতানের সাধনা মিথ্যা হয়ে যেতো, যদি না বাংলার শিল্পীর সঙ্গে সহযোগিতা করে একটি যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে ইতিহাসের জাগ্রত দেবতা স্বরূপে শিল্পীর সামনে এসে না দাঁড়াতেন।

এইখানেই সুলতানের অনন্যতা।এইখানেই বাংলার কোনো শিল্পীর সঙ্গে, ভারতবর্ষের কোনো শিল্পীর সঙ্গে সুলতানের তুলনা চলে না। অবনীন্দ্রনাথ, যামিনী রায় , নন্দলাল , জয়নুল আবেদিন , আবদার রহমান চুঘতাই,নাগী এসকল দিকপাল শিল্পীর মধ্যে যতোই পার্থক্য থাকুক, তবু সকলের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র অবশ্যই রয়ে গেছে । হ্যাভেল ভারতীয় শিল্পাদর্শের যে ব্যাপক সংজ্ঞাটি দিয়েছেন, কেউ তার আওতা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি একমাত্র সুলতান ছাড়া। বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন যে কাজটি করেছেন চিত্রকলার সুলতান সেই একই কাজ করেছেন।মধুসূদন যখন মহাকাব্য লিখেছেন , তার বহু আগেই ইউরোপে মহাকাব্য লেখার কাজ চুকেবুকে গেছে।কিন্তু মধুসূদন মহাকাব্য লিখলেন বাংলা ভাষায়। মধুসূধন দত্তের মহাকাব্য বাংলার সাহিত্য গগনে সূর্য শশঙ্ক দীপ্তি নিয়ে অনন্যতার নিদর্শন হয়ে মানব কল্পনার কুতুবমিনারের মতো দাড়িয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই ।কিন্তু এই অতিকায় কল্পনার বোঝা আরো অধিক বহন করবার জন্য তাঁর স্বগোত্রীয় কবিকুলের মধ্যে দু'চারজনের আকাঙ্ক্ষা জন্মালেও ক্ষমতা কারো যে ছিলো না, তা তো প্রমাণিত হয়ে গেছে । সুলতানের এই চিত্রগুলোও অনেকটা সে গৌরবে গরীয়ান ।

কোনো কোনো মানুষ জন্মায় , জন্মের সীমানা যাদের ধরে রাখতে পারে না । অথচ যাদের সবাইকে ক্ষণজন্মাও বলা যাবে না। এরকম অদ্ভুত প্রকৃতির শিশু অনেক জন্মগ্রহণ করে জগতে, জন্মের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য যাদের রয়েছে এক স্বাভাবিক আকুতি। তাদের সকলের জন্মে জন্মান্তর ঘটে না । কোটিতে গুটি হয়তো মেলে যারা জন্মেই জন্মান্তরের নির্বাণ লাভ করে। জীবনের দেবতা আপনি এগিয়ে এসে তাদের প্রাণের দেহলীতে সে আশ্চর্য পিদিম জ্বালিয়ে দিয়ে যান। সৌভাগ্য হোক, দুভার্গ্য হোক এ সকলের হয় না।শেখ মুহম্মদ সুলতান সে সৌভাগ্যের বরে ভাগ্যবান, আবার সে দুর্ভাগ্যের অভিশাপে অভিশপ্ত।

সুলতান ওরফে লাল মিয়ার জন্ম যশোর জেলার নড়াইল মহকুমার একটি কৃষক পরিবারে । কৃষি ছাড়াও তাঁর বাবা বছরের অকর্মা মাসগুলোতে কিছু বাড়তি আয়ের জন্য করতেন ঘরামীর কাজ। গ্রামীণ সমাজের পেশা বিচারে ঘরামী একটি বিশিষ্ট শ্রেণী।জন্মসূত্রে সবাই ঘরামী হয় না।কেউ কেউ যেমন গ্রামীণ সমাজে গায়ক বা বয়াতি হয়ে যায় তেমনি কেউ বেত-বাঁশ নাড়াচাড়া করতে করতেই একদিন ঘরামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই কিছুদিন আগে করোগেটেড টিন আসার পূর্বমুহূর্তটিতেও গ্রামীণ সমাজে একজন ভালো ঘরামী একজন শিল্পীর মতো খাতির যত্ন পেতো । রাখারির বেড়াযুক্ত আটচালা ,চৌচালা,শায়িত হাতীর মতো, আকৃতিবিশিষ্ট দোচালা বাংলার সে বিচিত্র গৃহনির্মাণ পদ্ধতির অপমৃত্যু হয়েছে সে কবে।এখনো হয়তো দোচালা হয়, হয়তো কেউ কেউ আটচালা ঘর উঠায়। কিন্তু তাতে প্রাণের সে ললিত প্রকাশ কোথায় ? কোথায় সে বেত বাঁশের রকমারী কারুকর্ম ? এখন যে আটচালা দোচালা হয় সেগুলো তো দারিদ্র ও হতশ্রীর প্রকাশমাত্র এবং দরিদ্র মানুষদের মাথা গুঁজবার স্থূল প্রয়োজনের উৎকট নির্মাণ।শিল্পিত চাহিদার প্রতিফলন নয়। বাংলার সে ঐতিহ্যিক বাঁশ-বেত-কাঠের নির্মিত গৃহশোভা চিরতরে বিলীন হওয়ার পথে। সে যাক, উত্তরাধিকারসূত্রে বিচার করলে বড়োজোর এটুকু বলা যেতে পারে, গৃহনির্মাণ শিল্পী পিতার কাছ থেকেই লাল মিয়ার মনে অপূর্ব বস্তুনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। কিন্তু সেটাও সবার কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে, তেমন বলার উপায় নেই। সে যাহোক, শিশু লাল মিয়া সুযোগ পেলেই কাঠ-কয়লা দিয়ে ছবি আঁকতো রঙ পেলে তো কথাই নেই। কিন্তু রঙ পাবে কই ? তাই সে কাঁচা হলুদ আর পুঁই গাছের ফলের রস টিপে টিপে ছবি আঁকতো।একদিন লালমিয়ার আঁকা এসকল ছবি স্থানীয় জমিদারের দৃষ্টিতে পড়ে।জমিদার মহাশয় খুবই অবাক হয়ে যান। সেখানে তাঁর পড়াশোনা কতদূর হয়েছিলো, বিশদ জানা যায়নি।তবে এটুকু সত্য যে স্কুলের শেষ পরীক্ষা পাস করার আগেই লালমিয়া পালিয়ে কলকাতা চলে যায়। কলকাতাতেই কিভাবে জানা যায়নি কলা- সমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর চোখে পড়ে কিশোর লাল মিয়ার ছবি। তিনি তাকে বাসায় নিয়ে খাওয়া- থাকার ব্যবস্থা করে দেন, জামা- কাপড় কিনে দেন এবং নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সুপারিশ করে আর্ট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তার নামান্তর ঘটে যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাল মিয়ার নতুন নামকরণ করলেন শেখ মুহম্মদ সুলতান ।এই নামান্তর ঘটিয়েই জন্মান্তরের একটি ধাপ পার করে দিলেন। আর্ট স্কুলেও তার আঁকাবুকির পালা সাঙ্গ হবার আগে লাল মিয়া ওরফে সুলতান আরো একবার নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ালেন, রবীন্দ্রনাথের 'অতিথি' গল্পের সেই সুকুমার স্নিগ্ধকান্তি কিশোরটির মতো, অযাচিতভাবে পাওয়া আদর - যত্ন বিত্ত - বৈভব এবং ভাবী স্ত্রীর মায়া পরিত্যাগ করে বিয়ের আগের দিন যে কাউকে কিছু না বলে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। প্রথমবার গ্রামের লালমিয়া পালিয়ে শহর কলকাতায় এসেছিলো। দ্বিতীয়বার শহর কলকাতা ছেড়ে কন্যাকুমারিকা থেকে হিমালয় পর্যন্ত প্রসারিত গোটা ভারতবর্ষ অভিমুখে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর মতো একজন স্নেহশীল অভিভাবকের আশ্রয়, সোহরাওয়ার্দী পরিবারের গরিমা কিছুই সুলতানকে আটকে রাখতে পারেনি। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল। সুলতান পাঁচ-দশ টাকার বিনিময়ে গোরা সৈন্যের ছবি আঁকছে , আর ভারতের শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ভয়-ভাবনা নেই,দায় - দায়িত্ব নেই, আছে শুধু সুন্দরের প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ আর ছুটে চলার গতি।এ সময়ে আঁকা ছবিগুলোর কি হয়েছে, কোথা থেকে কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না।ভারতবর্ষের নানা শহরে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীগুলোর বিলম্বিত সংবাদ আজ বুকে শুধু দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেবে।অনুমান করারও উপায় নেই, সে সময়ে তাঁর অঙ্কনশৈলী কিরকম ছিলো।সময়ের এবং বয়সের ব্যবধানে কতোদূর বিবর্তিত এবং রূপান্তরিত হয়েছে অঙ্কনরীতি , বোধ এবং উপলব্ধি ।

তারপরে ভারত ভাগ হলো।সুলতান এলেন পাকিস্তানে । তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর-করাচীতে অবস্থান করার সময় কখনো ঘর বাঁধার স্বপ্ন এ ঘরছাড়া মানুষটির মনে ঘনিয়ে এসেছিলো কিনা, সে অন্তর্গত সমাচার দেয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য। সূর্মা-আঁকা কাজলটানা কোনো রমণীর ব্রীড়াভঙ্গী তাঁকে চঞ্চল এবং উতলা করেছিলো কিনা, বলতে পারবো না। তেমনি করতে পারবো না ছবি সম্পর্কে কোনো মন্তব্য।এ সময়ে তিনি বিমূর্ত রীতিতে নাকি দেদার ছবি এঁকেছেন।পরী-কন্যার স্তরের গল্পের মতো কেবল গল্প শুনবো । কোনোদিন চোখে দেখতে পাবো না।তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর অনেক প্রদর্শনী হয়েছে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি সে সকল প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছেন, সংবাদপত্রের প্রশংসা প্রশস্তির সবটুকু হারিয়ে যায়নি।নানা সাময়িকীর কল্যাণে দুয়েকটার মুদ্রিত ব্লকও হয়তো সন্ধান করলে পাওয়া যাবে । সেগুলো তো আর ছবি নয় ।ছবির ছবি। সুতরাং কোনো সুচিন্তিত মন্তব্য করা অসম্ভব।বিলেতে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীর ছবিগুলো সম্পর্কেও আমরা একই রকম অন্ধকারে থেকে গেছি। যদিও ‘নিউ স্টেটসম্যান' পত্রিকায় উষ্ণ আলোচনা থেকে অনুভব করতে পারি ছবিগুলো ভালো হয়েছিলো এবং দর্শকরা প্রাণভরে উপভোগ করেছিলেন।কিন্তু আসল ছবি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে কি কোনো কথা চলে ? মন্তব্যগুলো শুনে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।বিলেতের পর আমেরিকা । সেখানেও সুলতান ছবি এঁকেছেন, সে ছবিগুলো কে কিনেছে , কোথায় কিভাবে আছে, অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে না হারিয়ে গেছে, কার কাছে জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর পাওয়া যাবে জানি না । এখানেই নিরুদ্দেশ যাত্রার ইতি । অন্যূন চল্লিশ বছরের জীবনের একটানা ছুটে চলা ঘর বিরাগী জীবনের সম্পর্কে কোনো গহন কথা আমরা যেমন উচ্চারণ করতে পারবো না, তেমনি তাঁর এ সুদীর্ঘকালের আঁকা ছবির ওপর কোনো বক্তব্য রাখতেও পারবো না। তাবৎ কলা-সমালোচকের মনে সুলতানের এ পর্যায়ে আঁকা ছবিগুলো একটা অতৃপ্ত কৌতূহল এবং একটা আফসোসের বিষয় হয়ে থাকবে। সুতরাং সুলতান বলতে যশোরের গণ্ডগ্রাম নিবাসী , মুসলমান চাষী এবং নমঃশুদ্র জীবনের একান্ত শরীক এই মানুষটিকেই চরম ও পরমভাবে মেনে নিতে হবে। তাঁর জীবনের যেন কোনো সূচনা নেই , শৈশব নেই , কৈশোর নেই, হঠাৎ করে বাংলাদেশের ইতিহাসের ভেতর থেকে একরাশ কাঁচাপাকা বাবরি চুল দুলিয়ে জেগে উঠেছেন। তাঁর ছবির সম্পর্কেও একই কথা । এ ছবিগুলোও অতীতের একেবারে কোলঘেষাঁ অন্ধকার ভেদ করে দলে দলে জগৎ-সংসারের কাছে এই মানুষ এই সভ্যতা, এই সমাজ, এই ইতিহাস এবং এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের বার্তা প্রেরণ করবার জন্য যেন আচমকা কারো মন্ত্রমুগ্ধ আহবানে ছুটে এসেছে।

এই যুদ্ধ এই জাগরণের একটা উল্লসিত বার্তা তো ছবিগুলোর মধ্যে আছে । হাজার হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে একটা জাতি প্রাকৃতিক সত্যের মতো জেগে উঠছে, শিল্পীর তুলিতে যখন এ জাগরণ - বৃত্তান্ত মূর্তিমান হয়, সে প্রবল প্রাণস্পন্দন ঝংকারিত না হয়ে কি পারে ? কিন্তু পাশাপাশি একটা বেদনার দিক আছে ( সুলতানের আঁকা একটা ছবি আছে যা তিনি প্রদর্শনীতে হাজির করেননি । ছবিটির নাম ‘ বিপ্লব ’ । একজন শক্ত সমর্থ মানুষ আপন হাতে তাঁর মস্তক ছিঁড়ে ফেলে ছুঁড়ে দিচ্ছে । নিজেই নিজের হাত ভেঙে ফেলছে , পা মচকে দিচ্ছে । প্রচণ্ড সামাজিক আলোড়নের ফলে যে বিপ্লবী শক্তি মুক্তি পেয়েছে , তা যে কি রকম আত্মঘাতী রূপ নিতে পারে এই ছবিটিতে তার সবটুকু বিধৃত রয়েছে । আজকের বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির আত্মঘাতী ক্রিয়াকলাপ হৃদয়ঙ্গম করার জন্য সুলতানের এ ছবিটিই যথেষ্ট । অর্থনীতি , সমাজতত্ব , রাজনীতি কোনো বিষয়ের অবতারণার প্রয়োজন নেই । 

সুলতান নিরুদ্দেশ যাত্রা অন্তে যখন দেশে ফিরলেন , তখন বোধকরি ঊনিশশ 'চুয়ান্ন কি পঞ্চান্ন সাল । ঢাকাতে জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে একটি চিত্রপীঠ স্থাপিত হয়েছে । সেখানে সুলতানের কোনো ঠাঁই হলো না । কারণ অতিশয় স্পষ্ট, যে নতুন মধ্যবিত্তটি সবেমাত্র জেগে উঠছে এবং শিল্প - সাহিত্যের নানাদিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পথযাত্রা শুরু করেছে, তার মানস অতিশয় সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্য অস্পষ্ট কুয়াশাচ্ছন্ন শিল্প - সংস্কৃতির কোনো গভীর উপলব্ধিতে রঞ্জিত হয়নি তার মানস পরিমণ্ডল । স্নিগ্ধতার বদলে উগ্রতা , উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, স্থূল আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্মর মোহ তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে কোনো বিকশিত চেতনার প্রতি প্রণত হওয়া তার ধাতের মধ্যেই স্থান পেতে পারেনি । সুলতানের কলেজের সার্টিফিকেট নেই এটা উপলক্ষ মাত্র । এমনিভাবে এ শ্রেণী সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো সাহিত্যের একজন দিকপালকেও দেশের বাইরে ছুঁড়ে দিতে সামান্যরকম দ্বিধান্বিত হয়নি । মুজতবা আলীর ক্ষেত্রেও উপলক্ষের অভাব ঘটেনি । আসলে সে সময়টাই ছিলো এমন : বাংলাদেশের মধ্যবিত্তটি তার ফিলিস্টিন মানসিকতার কারণে যা কিছু তার জাগতিক অধিকারবোধের বিপক্ষে যায় তার বিরোধিতা করেছে এবং প্রদর্শন করেছে অসহিষ্ণুতা। সৈয়দ মুজতবা আলীর জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রী ছিলো ,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ ছিলো , আর বাংলা সাহিতোর অনুরাগী পাঠক সমাজ ছিলো , সর্বোপরি সমাজের ওপরতলায় একটা স্থায়ী আশ্রয় ছিলো । তাই তিনি নির্বিবাদে ফিরে যেতে পারলেন বিশ্বভারতীতে এবং সেখানে সম্মানের সঙ্গে গৃহীত হলেন । কিন্তু সুলতান ? তিনিতো আপন পরিচয়ের সূত্র আপন হাতে কেটে দিয়ে সমাজ এবং সময়ের স্রোতের ভেতর দিয়ে কেবল বয়েই গেছেন । মধ্যবিত্ত , উচ্চবিত্ত , নিম্নবিত্ত কোনো সমাজেই গৃহীত হওয়ার মতো কোনো কিছুই তিনি অর্জন করেননি , না স্ত্রী, না পুত্র , না স্বভাব - চরিত্র , আদব - কায়দা। বিত্ত - বেসাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী কিছুই নেই , বুকের তলায় উজ্জ্বল আলোকিত চেতনা ছাড়া। তিনি যাবেন কোথায় ? বিশ্বভুবনে এমন কে আছে তাকে গ্রহণ করে ?

অগত্যা তাঁকে যেতে হলো সেই বহুকাল আগের ছেড়ে আসা পিতৃ - পুরুষের নিবাসে, সেই কিশোর লালমিয়ার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে হলো। সে কি সোজা কথা-- গ্রাম বাংলার লাজুক কিশোরটির সঙ্গে বিশ্ব-পরিব্রাজকের ঋদ্ধ-সমৃদ্ধ দৃষ্টির, বোধের অনুভবের সম্মিলন। শেষ পর্যন্ত তাও সম্ভব হলো।তবে তার পেছনে সুলতানের সক্রিয় চেষ্টার চাইতে সময়ের ধারার ভূমিকাই অনেক বেশি। যে মধ্যশ্রেণীটি ঊনিশশ' সাতচল্লিশ সাল থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছিলো, উনিশশো একাত্তর সালে এসে তাকে চূড়ান্ত অনিচ্ছায় একটা যুদ্ধকে কাঁধে নিতে হলো।কিন্তু শ্রেণীটির দোদুল্যমান জাতীয়তার বোধ দিয়ে না পারলো জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিকাশ ঘটাতে, না পারলো অর্জন করতে যুদ্ধের ভার বইবার মতো ঋজু মেরুদণ্ড।এই শ্রেণীরই শৈল্পিক প্রতিনিধি জয়নুল আবেদিন তাঁর 'মনপুরা' শীর্ষক চিত্রমালায় জানাতে বাধ্য হলেন যে বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীর সৃষ্টি ক্ষমতার সবটুকু অবসিত। সত্যি সত্যি তার নতুন কিছু সৃজন করার ক্ষমতার আর অবশিষ্ট নেই ।

ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে নতুন আরেকটি শ্রেণীর ডাক পড়েছে। কিন্তু বিশিষ্ট হয়ে সে শ্রেণীটি কোনো আকার লাভ করেনি । মধ্যশ্রেণীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে তার আকাঙ্ক্ষা পরস্পর বিজড়িত হয়ে রয়েছে, তার লক্ষ্য কোথায় স্থির করা হয়নি। প্রথম শিল্প-সাহিত্যেই তার প্রভাবটা বড় বেশি তীক্ষ্মভাবে অনুভূত হতে থাকলো। বাংলাদেশের পাতিবুর্জোয়া লিখতে গিয়ে বোধ করতে থাকলো,এই সময়ের উপযোগী গল্প-কবিতা তার লেখনি দিয়ে আর আসছে না।অথচ অতীতের মতো লিখতেও সে পারছে না।ঘটনার অভিঘাত অচঞ্চল চেতনাপ্রবাহে ভিন্ন একটা ঢেউ জাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ করার ভাষা তার নেই । গায়ক অনুভব করলো তার কণ্ঠের গানে সময়ের সংবেদনা বেজে উঠছে না । ছবি আঁকিয়েরা অনুভব করলো সময়ের খরতরঙ্গের দোলা জাগছে না তাদের চিত্রলেখায়।সর্বত্র একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা, সকলে বুঝতে পারছে , তাদের অন্যকিছু করা উচিত কিন্তু সেটা কি স্পষ্টভাবে বলতে পারছে না।এই লজ্জার কলঙ্ক ঢাকবার জন্য তারা কোলাহল দিয়ে সুরের অভাব, কথার পাশে কথা গেঁথে সাহিত্যের শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টায় অষ্টপ্রহর ব্যস্ত। কিন্তু সময় বড়ো নিষ্ঠুর।প্রতারকদের সুযোগ দেবে কেন ? দোদুল্যমান জাতীয়তায় বোধটি আরো দুলিয়ে দিয়ে তাদের নায়ক শেখ মুজিবকে সপরিবারে নিরস্তিত্ব করে দিলো সময় । কিন্তু জাতি অর্ধেক ভূমিষ্ঠ হলো,অর্ধেক রয়ে গেলো ইতিহাসের জরায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে।


সুলতান শিল্পের জরায়ুর বন্ধন ছিন্ন করে জাতির ইতিহাসকে মুক্ত করে দিলেন ।আগামীতে যাঁদের সাধনায় সংগ্রামে বাংলার ইতিহাস পাবে গতি, পাবে প্রাণ,সেই অনাহারক্লিষ্ট, রোগগ্রস্ত,ন্যুব্জদেহ কিষাণ- কিষাণীকে আঁকলেন বীর করে, রেনেসাঁস পেইন্টাররা যেমন তাঁদের আঁকা চিত্রে, গড়া ভাস্কর্যে মানুষ মানুষীকে সৌন্দর্য এবং অজেয়তার প্রতীক করে নির্মাণ করেছেন, সুলতান সেই সৌন্দর্য , সেই অজেয়তা চারিয়ে দিয়েছেন বাংলার কিষাণ কিষাণীর শরীরে।একটি সমাজের মানুষকে তার তুলি বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।বাঙালী মধ্যবিত্তের উত্থানযুগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত' বলে বুর্জোয়ার প্রতিভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়ার জন্য উল্লস্ফিত আবেগে শিহরিত চমকিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি কি বীররসে শেষ পর্যন্ত স্থিত থাকতে পেরেছেন ? তাঁকে কি করুণ রসের অগাধ সলিলে অবগাহন করতে হয়নি? সুলতানও কি সবটুকু বীরত্বের প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছেন ? তাই যদি হয় , তাহলে নায়কেরা নিজ হস্তে নিজের মস্তক কেন ছেদন করে ? কেন তারা নিজের হাত - পা নিজে ভেঙে বিজয়ের উল্লাস প্রকাশ করে ? তা হোক , তবু মধুসূদন একজন , তেমনি সুলতান আরেকজন । সময়, পরিবেশ , সমাজ , সামাজিক আদর্শ সব আলাদা। তবু তাঁদের কোনো পূর্বসূরী নেই।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles