শিল্পী সুলতান এশিয়ার কণ্ঠস্বর

আমাদের এখন জীবনকে ভালোবাসা দরকার। জীবনকে ভালোবাসতে গিয়ে যদি কৃষকের ছবি না আঁকতে চাই, কোনো অসুবিধা নেই। সিটি, এরাউন্ড ঢাকাকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু আঁকা যেতে পারে । তা না করে যদি আমি শুধু হরাইজন্টাল, ভার্টিকাল, সার্কল এগুলো দিয়ে স্পেসকে ব্যালান্স করতে থাকি, তাহলে তা ডিজাইন ছাড়া বেশী কিছু হবে না। অনেকের আবার টেকনিক্যাল মাস্টারি নাই বলে এসব করে। এসব কম্পোজিশন এমন কোনো বড় ব্যাপার নয়। এসব পেইটিং - এর সাথে জীবনের মহৎ কোনো আদর্শের সম্পর্ক নেই । আমি বোধহয় এরকম ছবি প্রতিদিনই অনেকগুলো আঁকতে পারি। আমাদের সাধারণ মানুষের সাথেও এ ধরনের ছবির কোনো সম্পর্ক নাই । তারা এসব ছবির কিছুই বুঝতে পারে না । তাদের মধ্যে কোন ফিলিং সৃষ্টি করে না । শিল্পীদের যদি জিজ্ঞাসা করেন, এটা কী এঁকেছেন, একটু বুঝিয়ে দেন তো ভাই । তো তারা বলবে, না ভাই এ তো বোঝানো সম্ভব না। ওটা আমার স্বপ্নের মধ্যে আসে, একটা ভাব হয়, ঐ ভাবের মধ্যে আমি আঁকি । বোঝাতে পারে না, পারবে না তো । কারণ, ওটার সাথে তার মনের কোনো সম্পর্ক নেই, বানানো।'

কথাগুলো শিল্পী এস.এম. সুলতানের। জীবনমন্থন করে বিচিত্র ও বহুমুখী অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছিল তাঁর শিল্পীমানস। প্রকৃতি ও মানুষ ছিল শিল্পের বিষয় । জীবনাচরণেও তিনি ছিলেন মৃত্তিকা ও মানবের সঙ্গে লগ্ন, অচ্ছেদ্য সেই বন্ধন। বড়ো মাপের শিল্পী সুলতান মানুষ হিসাবেও ছিলেন বড়ো মাপের । ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ মনের মানুষের দাপটে বর্তমানের সমাজ সংসার ক্লান্ত, বিব্রত সেখানে সুলতানের মত মহৎ হৃদয় কমিটেড শিল্পীর কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে বার বার। সে যাওয়া উৎসের কাছেই ফিরে যাওয়া। ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন সুলতান, নিছক শিল্পচর্চা করেই জীবন কাটিয়ে দেননি। কঠিন এক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়, সে দায়িত্ব ভবিষ্যতের সুন্দর নাগরিক গড়ে তোলার। তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ‘শিশু স্বর্গ' শিশুদের শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । এরকম সাংগঠনিক গুরুভার বর্তমান বাংলাদেশের অন্য কোনো শিল্পীই কাঁধে তুলে নেননি ।

আশ্চর্য এক স্বাপ্নিক ছিলেন শিল্পী এস.এম. সুলতান দেশ বিদেশে বহু ভ্রমণ, নানা ধর্ম-বর্ণ ও ভাষার মানুষের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা তার শিল্পচৈতন্যে ছিল সর্বদা জাগরুক। অকৃতদার সুলতান উপলব্ধি করেছিলেন আপন মৃত্তিকা ও মানুষই মূল ঠিকানা, মূল উদ্দিষ্ট।নাগরিক খ্যাতি, যশ , প্রাপ্তি - প্রতিষ্ঠা অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনি থিতু হয়েছিলেন নড়াইলের গন্ডগ্রামে। কঠিন সংকল্প না থাকলে এমনটি করা সম্ভব নয় । সারল্য ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য । এর বিশ্বস্ত প্রতিফলন ও উদ্ভাস তার শিল্পকর্মেও আমরা দেখতে পাই ।

তাঁর ছবিতে সহজ সাচ্ছন্দে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুটে ওঠে মহিমান্বিত কৃষক, মুটে মজুর, জেলে, গ্রামীণ রমণী। রূপবতী লাবণ্যময় প্রকৃতি তার রঙ, রূপ, সুষমা ও দৃষ্টিননন্দন দীপ্তি নিয়ে উদ্ভাসিত। ছবির বিষয়ের জন্য সুলতানকে বাইরে হাত পাততে হয়নি। শাশ্বত বাংলাদেশের সনাতন জীবনপ্রবাহকে তিনি মূর্ত করে তুলেছেন রঙ রেখা বিন্যাস ও উপস্থাপনাশৈলীর আশ্চর্য দক্ষতায়। ছবিতে বিশালদেহী পেশল মানুষের সপ্রাণ উপস্থিতি প্রসঙ্গে শিল্পীর নিজস্ব বক্তব্য অত্যন্ত জোরালো। তাঁর নিজের ভাষায় 'মানুষকে আমি খুব বড় করে এঁকেছি, কর্মী হিসাবে, কাজের  মানুষ হিসাবে এঁকেছি। আমি সেসব মানুষ এঁকেছি যারা অনবরত busy after work. ১৯৭৬-এর ছবিগুলোতে হয়তো নতুন অনেক ব্যাপার এসেছে । তবে আমি সব সময় কৃষকদের এঁকেছি, কৃষকরা যুগ যুগ ধরে অমানবিক পরিশ্রম করে চলেছে। ওদের উপজীব্য করেই সমাজটা গড়ে উঠেছে। কিন্তু ওদের চিরকালই betray করা হয়েছে । বৃটিশরা করেছে, পাকিস্তানীরা করেছে। '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অনেক আশা দেয়া হয়েছিল কিন্তু they were betrayed. এই যে একটা exploitation process আমার ছবিগুলো তার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ । শোষণ কর,কোনো মশা এদের খেয়ে শেষ করতে পারবে না, বৃটিশরা করেছে, পাকিস্তানীরা লুটেপুটে খেয়েছে । এখনও চলছে । কিন্তু ওরা অমিতশক্তিধর।কৃষককে ওরা কখনো শেষ করতে পারবে না, আমার কৃষক এ রকম । 

শিল্পী সুলতানের ৭০ তম জন্মবার্ষিকীতে ( ১০ আগস্ট ১৯৯৪ ) ঢাকার নড়াইল যুব পরিষদ একটি স্মরণিকা বের করে।সেখানে প্রকাশিত শাহাদুজ্জামানের লেখা ‘ সুলতানের সাথে আলাপ- এ শিল্পীর অনেক ভাবনা বক্তব্য সম্পর্কে জানা যায় । ইউরোপ, আমেরিকা ঘুরেছেন শিল্পী সুলতান। সেসব জায়গায় তার প্রতিভা স্বীকৃত, সম্মানিত হয়েছে যথেষ্ট । তা সত্ত্বেও ভিনদেশের মাটি ও মানুষ সুলতানকে আকৃষ্ট করেনি। তিনি ফিরে এসেছেন নিজের মাটিতে, আপনজনদের পরিসরে। শাহাদুজ্জামানকে সুলতান বলেছেন, হ্যাঁ, আমি ভেবেচিন্তেই ফিরে এলাম। ফিরে যে আসব সে চিন্তা আমার সব সময়ই ছিল। ওখানে থাকবার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না। ওটা তো আমার কাজের জায়গা না। বাচ্চাদের স্কুল নিয়ে আমার নানা রকম চিন্তা ছিল । বাচ্চাদের এবং গ্রামের সাধারণ মানুষদের মধ্যে সৌন্দর্য চেতনা গড়ে উঠবে এ রকম একটা ভিন্ন ধরনের ইনস্টিটিউশন করার ইচ্ছা আমার ছিল। আমাদের সাধারণ মানুষকে বৃটিশ শোষণ করেছে, পাকিস্তান শোষণ করেছে এখন বাংলাদেশের লোকেরা করছে, কিন্তু ঐ মানুষগুলোর দিকে কেউ কখনোই নজর দেয়নি । ওরা হাই লিভিং করতে না পারুক ডিসেন্ট লিভিং করতে শিখুক। থাইল্যান্ডে দেখেছি, ইন্দোনেশিয়াতেও দেখা যায় যত গরীব ঘরই হোক, বাড়িতে আর কিছু না থাকুক, ফুল বাগান আছে। এসব ব্যাপার আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি, তাদের এ্যাসথেটিক সেন্স যেমন দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তেমনি নষ্ট করে দেয়াও হচ্ছে। এসব নানা রকম ভাবনা থেকে দেশে চলে এলাম। দেখুন এদেশের চারণ কবিরা কোনো ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেনি, স্কুল কলেজে যায়নি, অথচ এরাই কত চমৎকার সাহিত্যের জন্ম দিয়েছে। পরবর্তীকালে মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, সেসব সাহিত্যের ধারাবাহিকতাতেই আরো উন্নত, শিল্পসম্মত সাহিত্য সৃষ্টি করেছে ।

বাঙালী জাতি তার অভিব্যক্তির জন্য উন্নত ভাষা খুঁজে পেয়েছে । তাই যদি হয় বাঙালী তবে তার রেখা খুঁজে পাবে না কেন ? বাঙালীর মনে স্বতঃস্ফূর্ত যে রেখা রয়েছে, তাকে উদ্ধার করতে হবে। সেটাকে ধারাবাহিকভাবে ডেভেলপ করতে হবে। তাছাড়া পেইন্টিং ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে, ড্রয়িং রুম ডেকোরেট করছে, এ থেকে পেইন্টিংকে মুক্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষ তাদের প্রয়োজনে তাদের মতো করে ছবি আঁকবে ।

এইসব ভাবনা নিয়ে আমি নড়াইল চলে আসি। আমার নিজের গ্রাম থেকে কাজ শুরু করার চিন্তা করি। এখানে এসে প্রথমে একটা প্রাইমারী স্কুল করি, পাশে নন্দনকানন নামে ফাইন আর্টসের স্কুল খুলি । সেখানে সাধারণ গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসত, পরবর্তীতে সেটাকে হাইস্কুলে পরিণত করেছিলাম। এরপর যশোরে “একাডেমী অব ফাইন আর্টস " করলাম, আরো পরে সোনারগাঁওতে করেছিলাম।'

"জন্মবার্ষিকী সংকলনে পুনর্মুদ্রিত আহমদ ছফার লেখাটির নাম' সুলতানের সাধনা'। আহমদ ছফা লিখেছেন ' ... সুলতানকে বাংলার প্রকৃতিতে বাংলার ইতিহাসে এবং বাংলার মানুষের শ্রম, ঘাম, সংঘাতের ভেতরে সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে দুস্তর পথ। পেরিয়ে আসতে হয়েছে সাধনার অনেকগুলো স্তর এবং শিল্পী জীবনের সমান্তরাল যে অগ্রগতি তাও কম বিস্ময়কর নয়। আপন অন্তরস্তিত সৌন্দর্যবোধ, নিসর্গ, ইতিহাস এবং জীবন শ্রমশীল মানুষের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে ক্যানভাসে সবকিছু মূর্ত করে তোলাএর সবটুকু তাঁর একক শৈল্পিক প্রয়াসের ফলশ্রুতি নয়। তার জন্য এই সুপ্রাচীন দেশটিকে সাম্প্রতিককালে একটি রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে ঘোষণা করতে হয়েছে। একটি উদ্ভিদ । সমতুল ঘুমস্ত জাতির প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে, প্রতিটি সামাজিক স্তরের মানব সাধারণের ভেতর বন্দুকের আওয়াজে, কামানের হুঙ্কারে যে জাগরণ এসেছে, যা তাদের সম্মিলিত সৃষ্টিশক্তির তেজ উপলব্ধি করিয়ে ছেড়েছে, তার প্রয়োজন অপরিহার্য ছিল। ইনকুবেটর যন্ত্রের তাপে ডিমের খোলস ফেটে যেমন করে মুরগীর বাচ্চা প্রাণ পেয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের উত্তাপে শিল্পীর অন্তর চিরে এ সকল ছবি বেরিয়ে এসেছ। মুক্তিযুদ্ধের সবটুকু আবেগ, সবটুকু জীবনোল্লাস, সবটুকু স্পর্ধা এবং দুঃসাহস এই ছবিগুলো ধরে রেখেছে। এ রকম একটি প্রলয়ংকরী ঘটনা না ঘটলে সুলতানের তুলি কস্মিনকালেও এ রকম আশ্চর্য ছবি প্রসব করতে সক্ষম হতো না। যতো প্রতিভাই তাঁর থাকুক, কিষাণ - জীবনের প্রতি তাঁর অনুরাগ মমতা যতই নিবিড় গভীর হোক না কেন, বাঙালী জাতির ঐতিহাসিক সংগ্রামের একেবারে অস্তস্থল থেকেই এ সকল চিত্রের উদ্ভব। এ কারণে এ ছবিগুলো দর্শকের মনেও প্রত্যক্ষভাবে ইতিহাসবোধ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম। হয়তো দর্শক সচেতনভাবে অনুভব করতে পারেন না, কিন্তু অন্তরালে এই বোধ ক্রিয়াশীল থাকে ঠিকই ... '।

নিজের দেশ বাংলাদেশে যশস্বী শিল্পী এস.এম. সুলতানের চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে অল্পই। ১৯৮৭ সালে তাঁর একটি প্রদর্শনীর প্রধান উদ্যোক্তা ছিল ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউট (জার্মান সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান) । ইনস্টিটিউটের তৎকালীন কর্মাধ্যক্ষ পিটার সেভিৎজ লিখেছেন, 'এই উপমহাদেশের গুটিকয়েক অসামান্য শিল্পীর মধ্যে সবচেয়ে জাঁকালো শিল্পী সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর। সুলতানের শক্তির উৎস তাঁর টিকে থাকার ক্ষমতায়। যেসব মানবমূর্তি তিনি রচনা করছেন, সেসব জীবনযুদ্ধে মানুষের টিকে থাকার বার্তাবহ। বাংলাদেশ আর বাংলাদেশীদের টিকে থাকার ক্ষমতা ছাড়া তেমন কিছু নেই। তাই সেসব ছবিতে এ জাতির স্বকীয়তার প্রতীক শনাক্ত করা যায়।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫

Share

Recent Comments

Recent Articles