শিল্পী সুলতানের প্রয়াণ

তিনি চলে গেলেন, যা আশঙ্কা করেছিলাম মনে মনে, উচ্চারণ করতে পারিনি; তাঁর চলে যাবার ঠিক আগের দিনই লিখেছিলাম এ ক’টি ছত্র: ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করছি; চিত্রকর শেখ মুহাম্মদ সুলতান গুরুতর অসুস্থ হয়ে যশোহরে সামরিক হাসপাতালে রয়েছেন; কাগজে জেনেছি, সরকার নির্দেশ দিয়েছে তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে করণীয় সবকিছু করতে, এও নির্দেশ আছে জেলা প্রশাসক যেন সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন; কিন্তু ঢাকার বাইরে হচ্ছে ঢাকার বাইরেই এবং চিকিৎসার সেখানে সীমাবদ্ধতা আছে; ভ্রমণ করবার মতো সুলতান ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা এখন হয়তো নয়, কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় এখুনি কি তাঁকে ঢাকা পাঠানো যায় না?—এবং প্রয়োজনে বিদেশে?পাছে না দেরি করে ফেলি, পাছে না আমাদের মুখের কথা কেবল কথাতেই থেকে যায়—এই ভয় করি; বহুবার দেখেছি বড় মর্মান্তিক সে অভিজ্ঞতা,চিকিৎসার জন্যে সরকারের ঘর থেকে টাকা বের করা, বিদেশে চিকিৎসার জন্যে পাঠাবার কাগজপত্র তৈরি ও পাস করা হয় জটিল ও সময়-খাদক একটি প্রক্রিয়া; প্রয়োজনের তুলনায় টাকা বরাদ্দ হয় সবসময় কম, এবং সে টাকার আবেদন ও গ্রহণের ব্যাপারটিও সংশ্লিষ্ট বিভাগের আচরণে মোটেই সম্মানজনক হয়ে দাঁড়ায় না; টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও যে সরকার সবসময় রাখে, তা-ও নয়, যেমনটা আমরা রাশেদ খান মেননের বিলেতে চিকিৎসার বেলায় দেখেছি। এই প্রক্রিয়া ও আচরণসমূহের অবসান আমরা দেখতে পাব আর কবে? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি অবহেলা, লাঞ্ছনা ও আর কত মৃত্যুর পরে?মনে পড়ছে নড়াইলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীতে ভাসমান সুলতান ভাইয়ের স্বপ্নের নৌকাটি তখন তৈরি হচ্ছে; ছাদের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছি তাঁর সঙ্গে, তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিশুনিকেতনের কথা বলে চলেছেন; কিছুক্ষণআগেই দেখে এসেছি—দেয়ালঘেরা বাগান তো নয়, তপোবন যেন, সেখানে প্রায় গায়ে গায়ে সারিবদ্ধ গাছ, তারই ফাঁকে ফাঁকে শিশুরা বসে কেউ আঁকছে, কেউ অক্ষরপরিচয় নিচ্ছে।সুলতান ভাই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, 'আচ্ছা বলুন তো, আমাদের দেশে শিশুরা ঘুম থেকে উঠেই কাঁদে কেন? সঙ্গে সঙ্গে উত্তরটাও দিলেন তিনিই, বললেন,‘কাঁদে তারা খিদের জন্যে। তাই আমার ইস্কুলে আমি নিয়ম করেছি, বাচ্চারা এলেই তাদের মুড়ি, চিড়ে কি মোয়া যা যেদিন হয় পেট ভরে খেতে হবে আগে,তারপরে লেখাপড়া। জানেন, এই খাওয়ার ব্যবস্থা আছেই বলেই ছুটে আসে আমার ইস্কুলে ।'আজকাল প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে দেশে, বাচ্চাদের ইস্কুলে পাঠাবার তাগিদ নিয়ে কত রঙের বা ঢঙেরই না প্রচার দেখেছি বেতার ও টেলিভিশনে । বেসরকারি কত না স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শিশুদের ইশকুলে আনবার ও তাদের ধরে রাখবার জন্য কতরকমের নীতিকৌশল রচনা করছে, দেশ-বিদেশে নন্দিত বন্দিত হচ্ছে, কিন্তু সুলতান ভাইয়ের এই সরল ও চোখ খুলে দেবার মতো বিশ্লেষণটি কেউ করেছেন ও মূলে গিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।চিত্রকর সুলতানের কাছে আমাদের নেবার আছে অনেক—এ সকলেই বলবেন, কিন্তু শিশুদের বিদ্যালয়গামী করবার ক্ষেত্রেও যে তাঁর কাছে অনেক কিছু নেবার আছে, এ আমরা ভুলে না যাই।

দৈনিক সংবাদ, ১৩ অক্টোবর ১৯৯৪

Share

Recent Comments

Recent Articles