তার তো চাইবার আগেই পাওয়ার কথা ছিল

সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই মুনা চেঁচিয়ে বললো , মা এস. এম. সুলতান মারা গেছেন। তিনি আমার কাছে নন, পারিবারিকভাবে আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন।তাঁর মৃত্যুর খবরে  মুনা কষ্ট পেয়েছে।

আমার কাছে সুলতান ভাইয়ের মৃত্যুকষ্ট পাওয়া না পাওয়ার বাইরের বিষয় । তাঁর জন্য আমার মনে কষ্ট জমা ছিলো অনেক দিন ধরে । সেই মুহূর্তে ৮২ সালে লেখা তাঁর চিঠিটি আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে । সেদিন একজন শিল্পীর অর্থের আকুতি আমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে বেশি মনে হয়েছিলো। তাঁর তো কোনো কিছু চাইবার আগেই পাওয়ার কথা ছিলো , বেশি না সামান্য কিছু ।

দশটার দিকে বাংলা একাডেমীতে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছি। আমার ছেলে শমিক , এবার এস.এস.সি পাশ করেছে। দু'বছর বয়স থেকে সুলতান ভাইকে দেখছে। ও সরাসরি আমাকে বললো , তুমি কি আগে জানতে না যে সুলতান কতো বড়ো শিল্পী ? বললাম , জানতাম। বললো , তাহলে ওনাকে কেন আমাদের সেই দোতলার ঘরে থাকতে দিয়েছিলে ? ঘরটাতো ভালো ছিলো না। তুমি তখন তাকে ঠিকমতো যত্ন করোনি। যে স্মৃতি ওর মনে থাকার কথা নয়, সে স্মৃতি থেকে ও কথাগুলো বললো। আমি ওর কথার জবাব দিতে পারিনি।

 আপা সেলিনা !

আশা করি খোদার ফজলে শারীরিক কুশলেই আছেন । আনোয়ার ভাইয়ের হাতের ব্যাথা কেমন , তাঁহাকে আমার ছালাম বলিবেন। নড়াইল ফিরবার পথে সাক্ষাৎ করিয়া আসিতে পারি নাই, তাহার জন্যে দুঃখিত। আপা নিতান্ত অর্থাভাবে দিন যাপন করিতেছি, এই দুঃসময়ে কিছু অর্থ সাহায্য করিলে বিশেষ উপকৃত হইতাম। আশাকরি মনে কিছু করিবেন না। 

বাংলা একাডেমীতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া আসিতে পারি নাই, তাহার জন্য দুঃখিত , আপনার ছেলে - মেয়েদের প্রতি আমার আন্তরিক দোয়া ।

                     আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী

ভাই

এস. এম. সুলতান

আমার ঠিকানা :

এস. এম. সুলতান

গ্রামকুড়িগ্রাম (নড়াইল )

পোঃ- রতনগঞ্জ

জেলা- যশোর

আমি তো জানি এসব মানুষের যত্ন করতে আমি শিখিনি । আমার সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নেই । এ দেশের বড়ো মাপের মানুষেরা না খেয়ে মরে যায় । এ দেশে চোরেরা বিলাসী জীবন যাপন করে । দেশের এই সাংস্কৃতিক বলয় থেকে আমি নিজেকে আলাদা করবো কি করে ? 

সুলতান ভাইকে ঘিরে আমার সুন্দর স্মৃতি আছে । তাঁকে নিয়ে আমরা কমলগঞ্জের মাধবপুরে গিয়েছিলাম মণিপুরীদের রাস- উৎসব দেখার জন্য ।সারারাত ধরে সে উৎসব হয়। আমরা রাত জেগে উৎসব দেখেছি । তিনি চেয়েছিলেন চা বাগানে বসে ছবি আঁকবেন । তিনি ছবি এঁকেছিলেন । কতো কথা , কতো গল্প । তাঁর মুখে শোনা এক অন্য জগত । ভেবেছিলাম তাঁর এই গল্প দিয়ে উপন্যাস লিখবো । তাঁকে সে প্রস্তাব করাতে মধুর হেসে বললেন , কিইবা আমার জীবন । তাঁর বিনয়ের তুলনা হয় না । 

কিন্তু চমৎকার স্মৃতি ম্লান হয়ে যায় । সুলতান ভাইয়ের চিঠি আমাকে তাড়া করে ফেরে । কিইবা টাকা আমি তাঁকে দিতে পেরেছিলাম ।আমার ছেলের কাছে জবাবদিহি করে বলতে হয়, তাতেও তাঁর মতো মানুষের যত্ন করা হয় না। সুলতান ভাইয়ের ঐ চিঠি আমার সারা জীবনের এক বড়ো লজ্জা ।

তথ্যসূত্রঃএস এম সুলতান স্মারক গ্রন্থ

সম্পাদনাঃ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম 

সুবীর চৌধুরী 

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি 

প্রকাশকালঃজুন ১৯৯৫


Share

Recent Comments

Recent Articles